ভবঘুরেকথা

তারকের সধনা
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
অপূর্ব ঘটনা এক করিব বর্ণন।।
নবগঙ্গা কুলে শোভে নামে কোলাগ্রাম।
সেই গ্রামে বাস করে নবকৃষ্ণ নাম।।
তার হয় চারি পুত্র কন্যা দুই জন।
সাধনা নামেতে কন্যা অতি সু-শোভন।।
সর্বগুণে গুণান্বিতা জেষ্ঠ্যা সেই হয়।
মাধুর্য রসেতে ভরা তাহার হৃদয়।।
তারকেরে ভালবাসে মনপ্রাণ দিয়ে।
দৈব যোগে হল তার অন্যপাত্রে বিয়ে।।
পরদিন গেল তার স্বামীর ঘরেতে।
বিধাতার বিধি যাহা কে পারে খন্ডাতে।।
সর্পাঘাতে তার স্বমী সে রাত্রি মরিল।
বিধাবা হইয়া শেষে পিতৃ গৃহে এল।।
তাই দেখে তার পিতা বিষাদিত মন।
সাধনার দুঃখ দেখে ঝরে দুনয়ন।।
পিতার চোখেতে জল দেখিল যখন।
করপুটে সে সাধনা কহিল তখন।।
শুন তুমি ওগো পিতা আমার বচন।
বিধাতার বিধি যাহা কে করে খণ্ডন।।
এই দেহ মন প্রাণ দিয়েছি যাহারে।
আমার মনের মানুষ আছে ধরাপরে।।
তারকেরে মনপ্রাণ দিয়াছি সপিয়া।
দিবা নিশি কান্দে প্রাণ তাহার লাগিয়া।।
সে যাহা কহিবে আমি তাহাই করিব।
তাহার আদেশে আমি মনে শান্তি পাব।।
তাই শুনে তার পিতা তাহাই করিল।
তারকের কাছে গিয়ে সকল জানাল।।
শুনিয়া সকল কথা তারক গোঁসাই।
কোলা গ্রামে আসিলেন সাধনার ঠাই।।
দেখিয়া সাধনা দেবী পড়িলেন পায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
শুন তুমি রসরাজ চরণে জানাই।
তোমা বিনে এ জীবনে কোন শান্তি নাই।।
এ জীবনে শুখ শান্তি যা কিছু আমার।
আজ হতে সপিলাম চরণে তোমার।।
তারক বলেছে তুমি শুন দিয়া মন।
আমি যাহা বলি তুমি কর হে পালন।।
সত্য পথে চল সদা সত্য কথা কও।
হাতে কাম মুখে সদা হরিনাম লও।।
নিস্কাম নিয়মে তুমি ভালবাস মোরে।
মাধুর্য্যের পাত্র তুমি হও ধরা পরে।।
মনে প্রাণে টানাটানি সতত রাখিবে।
অলক্ষেতে সব কিছু জানিতে পারিবে।।
মাধুর্য্য রসেতে ভরা তারকের মন।
সাধনার সঙ্গে তাহা করিত যাজন।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়।
মনে প্রাণে টানাটানি থাকিত সদয়।।
সাধনা সধনা করে অরোপে থাকিত।
তারক যেখানে আছে দেখিতে পাইত।।
তারক অরোপে তারে দেখিত নয়নে।
যার যার তার তার মনে প্রাণে টানে।।
এই ভাবে দুই জনে সাধনে তৎপর।
মনে প্রাণে মিলাইত প্রেমের বাজার।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
একদিন সাধনার পিতৃগুরু এল।।
ব্রাহ্মণ সে কুলগুরু আসিল বাড়ীতে।
সাধনা কে কহিলেন যতন করিতে।।
পিতার আদেশ শুনে সাধনা তখন।
গুরুদেবে সমাদরে করিল যতন।।
পাক পাত্র ধৌত করি আনিয়া তখন।
লেপিয়া পাকের ঘর করে আয়োজন।।
পাক করিবারে গুরু সে ঘরেতে গেল।
জল ছিটাইয়া গুরু পাক আরম্ভিল।।
পাক করে সেই গুরু ভোজন করিতে।
বারে বারে সাধনাকে লাগিল ডাকিতে।।
ডাক শুনে সাধনা সে আসিল নিকটে।
কি কারণে ডাকিতেছে কহে করপুটে।।
কামাতুর সেই গুরু লাগিল কহিতে।
প্রসাদ মাখিয়া তুমি দাও মোরে খেতে।।
এক গ্রাস তুমি মোর মুখে তুলে দাও।
তারপর যেথা ইচ্ছা সেথা চলে যাও।।
তাই শুনে সে সাধনা লাগিল ভাবিতে।
ঝর ঝর আখি দু’টি লাগিল ঝরিতে।।
তারকে স্মরণ করি পিতার বাক্যেতে।
একগ্রাস মুখে তুলি দিল ব্রাহ্মণ মুখেতে।।
এ সময় সে তারক কবির খেলায়।
কি করিলি ও সাধনা ডেকে ডেকে কয়।।
এত ভালবাসি তোরে হারে রে সাধনা।
কাম দেহ স্পর্শ করি দিলিরে যন্ত্রনা।।
সেই খানে দোঁহারেরা ছিল যত জন।
তার মধ্যে ডেকে বলে সূর্য্যনারায়ণ।।
হেন কথা কেন তুমি কহিলে গোঁসাই।
সাধনা সে কি করিল কহ মোরে তাই।।
তাই শুনে সে তারক কহিল তখন।
একে এসে কহিলেন সব বিবরণ।।
তাই শুনে সকলেতে আশ্চার্য্য হইল।
মনে মনে তারা সবে ভাবিতে লাগিল।।
গোবরা কাছারী বসে মোরা গান গাই।
সাধনা সে কি করিল দেখিল গোঁসাই।।
গান শেষে মোরা সবে কোলগ্রোমে যাব।
সত্য কিবা মিথ্যা হয় সকল জানিব।।
গান শেষে সকলেতে বিদায় হইল।
সবে মিলে কোলা গ্রামে উপনীত হল।।
সাধনার কাছে গিয়ে সকল শুনিল।
শুনিয়া সকলে তাই কান্দিতে লাগিল।।
কান্দিয়া সকলে এসে পড়িলেন পায়।
তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
সাধনা আসিয়া যেই প্রণাম করিল।
ক্রোধ ভরে সে তারক কহিতে লাগিল।।
আমাকে ছুয়োনা তুমি শুন হে সাধনা।
তব দেহ আর আমি স্পর্শ করিব না।।
হেন কথা বারে বারে তারক কহিল।
বজ্রসম সাধনার বুকেতে লাগিল।।
অমিন সাধনা দেবী ধুলাতে লুটায়।
বুক ভরা অভিমানে গড়াগড়ি যায়।।
সঙ্গে যারা কহে তারা তারকের ঠাই।
অবলারে ক্ষমা কর শুন হে গোঁসাই।।
তারক বলেছে আমি ক্ষমা করে দিব।
তার আগে সাধনাকে পরীক্ষা করিব।।
এক খন্ড অগ্নি পিণ্ড হস্তেতে করিয়ে।
একদন্ড থাকিবে সে এখানে দাড়ায়ে।।
তাই শুনে সে সাধনা দ্রুতগতি গিয়ে।
তেতুলের কাষ্ঠ অগ্নি আনিল ধরিয়ে।।
তারকের ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।
চক্ষু মুদি রহিলেন সেখানে বসিয়া।।
মহাভাব উথলিয়া ভাসে আখি জলে।
তারকের হস্তপরে অগ্নিতাপ জ্বলে।।
হাতে ঠোষা পড়ে তাই ফুলিয়া উঠিল।
অমনী তারক চন্দ্র কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে কেন্দে সে তারক সাধনারে কয়।
ফেলরে হাতের অগ্নি আর নাহি সয়।।
শুনিয়া হাতের অগ্নি ফেলাইয়া দিল।
অমনী তারক চন্দ্র বুকেতে ধরিল।।
সাধনাকে বুকে ধরে ছাড়িতেছে হাই।
তোমা হেন প্রাণ প্রিয়া কোথা গিয়ে পাই।।
তাই শুনে সে সাধনা কান্দিয়া ভাসায়।
তারকের পদধরী কেন্দে কেন্দে কয়।।
এ জীবন মন প্রাণ দিয়েছি তোমায়।
জনমে জনমে যেন পদে মতি রয়।।
হেন দশা হল সেথা কহন না যায়।
মাটিতে পড়িয়া সবে করে হায় হায়।।
সূর্য্যনারায়ণ আর কাঙ্গালী বেপারী।
তারকের পদে পড়ে যায় গড়াগড়ি।।
উঠিল প্রেমের বন্যা স্রোত বয়ে যায়।
প্রেমের তরঙ্গে সবে ভাসিয়া বেড়ায়।।
হরি হরি বলে সবে কান্দিতে লাগিল।
বহুক্ষণ পরে সবে সুস্থির হইল।।
তারপর সে সাধনা সান্তনা পাইয়া।
সবাইকে খেতে দিল আনন্দে মাতিয়া।।
সকলে আনন্দ ভরে করিয়া ভোজন।
যার যার দেশে সবে করিল গমন।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়।
মাঝে মধ্যে সে তারক আসিত তথায়।।
এই ভাবে কোলাগ্রামে আসিত গোঁসাই।
দুই এক দিন থাকে সাধনার ঠাই।।
তাই দেখে গ্রাম্য লোকে ভাবিত সবাই।
কেমন মানুষ এই তারক গোঁসাই।।
সধনা অসতী তাই সকলে ভাবিত।
এই ভাবে কানাকানি সবাই করিত।।
স্বজাতি ভোজন যদি কোন খানে হত।
পাক করিবারে সেথা সাধনা থাকিত।।
একদিন একবাড়ী স্বজাতি ভোজন।
সমাজের যত লোক হোল নিমন্ত্রণ।।
সামাজিক যত লোক আসিয়া তথায়।
এক ঠাই বসে তারা সবাকে জানায়।।
সাধনা করিলে পাক মোরা খাইব না।
চরিত্রহীনা নারী সে সকলের জানা।।
এই কথা যখনেতে সাধনা শুনিল।
সবার মধ্যোতে এসে কহিতে লাগিল।।
করো জোড়ে বিণয়েতে কহলি ভারতী।
এই গ্রামে যত নারী সব হয় সতী।।
আসিয়া করুক পাক বিনা ওড়োনেতে।
খালি হাতে পাক হবে দেখিব চক্ষেতে।।
তাই শুনে যত নারী আসিতে না চায়।
সাধনা কহিছে তবে কি হবে উপায়।।
আমি গিয়ে করি পাক বিনা ওড়োনেতে।
হরি বলে করি পাক সবার স্বাক্ষাতে।।
হেন কথা যখনেতে সাধনা কহিল।
তাই শুনে গ্রাম্য লোকে কহিতে লাগিল।।
উত্তপ্ত তেলের মধ্যে তব হস্ত দিয়া।
নাড়িয়া করিবে পাক দেখিব থাকিয়া।।
তাই যদি পার তুমি পাক কর গিয়া।
না পারিলে মোরা সব দিব দেখাইয়া।।
তাই শুনে সে সাধনা করিবারে পাক।
প্রাণভরে হরিচাঁদে দিল এক ডাক।।
তারকের ছবিখানি হৃদয়ে ধরিয়া।
নয়ন জলেতে ভেসে পাক করে গিয়া।।
চুলা জ্বালাইয়া দিয়া কেন্দে কেন্দে কয়।
কোথা মোর হরিচাঁদ রেখ রাঙ্গা পায়।।
তারক তারক বলে কান্দিতে কান্দিতে।
তপ্ত তেলে হাত দিয়া লাগিল নাড়িতে।।
ডাল তরকারি মধ্যে হাত দিয়া নাড়ে।
আগুনেতে সাধনার হাত নাহি পোড়ে।।
সাধনার অঙ্গ হতে জ্যোতি বাহিরায়।
তাই দেখে সব লোকে কান্দিয়া ভাসায়।।
মা বলিয়া সাধনারা চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে বলে ওগো মাতা বলি তব ঠাই।
তোমাসম সতী নারী এ জগতে নাই।।
না জানিয়া তোমা প্রতি দোষ করিয়াছি।
সমোচিত ফল মোরা প্রত্যক্ষে পেয়েছি।।
কত কি বলেছি মাগো আগে না বুঝিয়া।
ক্ষমা কর ওগো মাতা সন্তান বলিয়া।।
এই ভাবে সবে এসে পদে ক্ষমা চায়।
নয়নের জলে সবে কান্দিয়া ভাসায়।।
তাই দেখে সাধনার দয়া উপজিল।
হাসি মুখে সে সাধনা ক্ষমা করে দিল।।
তারপর সে সাধনা রন্ধন করিয়া।
সবাই কে খাওয়াইল আনন্দে মাতিয়া।।
ভোজন করিয়া সবে কহিল তখন।
এমন স্বাদের খাদ্য খাইনি কখন।।
সেই হতে সাধনাকে মা বলে ডাকিত।
ছোট বড় সকলেতে ভকতি করিত।।
কোলাগ্রাম ধন্য হল সাধনার গুণে।
আনন্দে মাতিল যত হরিভক্তগণে।।
হরিভক্ত ছিল সেই লোচন গোঁসাই।
সাধনাকে মা বলিয়া ডাকিত সদিই।।
সে বস বৃত্তান্ত কথা লীলামৃতে আছে।
নিজ হাতে শ্রী তারক তাহা লিখিয়াছে।।
সাধনার সাধনায় হরিভক্তগণ।
সাধনার গুণগান করেন কীর্তন।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
তারকের ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা বেশী নাই
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!