অশ্বিনীর তারকের কৃপা লাভ
অশ্বিনীকে সঙ্গে করি সেই মহানন্দ।
চলেছেন মহাভাবে পরম আনন্দ।।
হরিচাঁদ গুণকথা বলিতে বলিতে।
ভাবে গদ গদ চিত্ত চলেছেন পথে।।
জলে ভরা আখি দু’টি প্রেমিক অশ্বিনী।
পিছনে পিছনে চলে জুড়ি দুই পাণি।।
এইভাবে চলেছেন বলে হরি হরি।
সন্ধ্যাবেলা উপনীত তারকের বাড়ী।।
তারকের পদে সবে প্রণাম করিল।
হরি বলে রসরাজ আর্শীবাদ দিল।।
ভক্তি ভাবে তারকের মহানন্দ কয়।
শুন শুন রসরাজ বলি যে তোমায়।।
অশ্বিনীকে নিয়ে আমি আসি তব ঠাই।
অশ্বিনীকে কর দয়া এই ভিক্ষা চাই।।
গুরুচাঁদ দিয়াছেন আদেশ করিয়া।
কবিগান শিক্ষা দাও ইহাকে রাখিয়া।।
তারক বলেছে আমি ভাবি মনে মনে।
অশ্বিনীকে কবিগান শিখাব যতনে।।
দয়াময় গুরুচাঁদ অন্তরে জানিল।
তোমা দ্বারা অশ্বিনীকে এখানে পাঠাল।।
গুরুচাঁদ আজ্ঞা আমি পালন করিব।
অশ্বিনীকে যত্ন করি কবি শিখাইব।।
সেই হতে অশ্বিনীকে তথায় রাখিয়া।
মহানন্দ আসিলেন দেশেতে চলিয়া।।
সেই হতে তারকের সঙ্গে সঙ্গে রয়।
তারকেরে গুরু মানি রহিল তথায়।।
চিন্তামণি দেবীকেই ডাকে মা বলিয়া।
তিনি তারে ভালবাসে পুত্র স্নেহ দিয়া।।
সকালে বিকালে রত্ন হরিগুণ গায়।
নয়ন জলেতে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
সেই ভাব দেখি সবে আনন্দ হৃদয়।
সবাকার মনে হয় প্রেমের উদয়।।
মাঝে মাঝে রসরাজ কবিগান করে।
অশ্বিনীকে নিয়ে যায় কবির আসরে।।
যখনেতে হয় তথা কাব্য আলোচনা।
সেদিনের কথা সব হয়ে যায় জানা।।
সেই ভাবে কবিগান শিখিতে লাগিল।
ভাবের আবেশ তার ক্রমেই বাড়িল।।
এইভাবে মাঝে মধ্যে কবিগান গায়।
সংসারের কর্ম করে সকল সময়।।
প্রশস্ত গার্হস্থ ধর্ম আদর্শ দেখাতে।
হালের বলদ ছিল আবাদ করিতে।।
শম্ভু নামে এড়ে ছিল আর ছিল গাভী।
বকনা গরু ছিল যে নামেতে সুরভী।।
সেই গরু মাঝে মাঝে অশ্বিনী চরাত।
মাঠি গিয়ে সে অশ্বিনী হরিনাম নিত।।
হরিনাম করিবারে ঝরে দু’টি আখি।
মনে হয় হরিচাঁদের পোষা শুকপাখী।।
হরি বলা পাখী সে যে জগতে আসিল।
শুকপাখী সবে তারা অনুগত হোলো।।
পতিত জমিতে গিয়ে গরু চরাইত।
প্রাণভরে গরু গুলি সে নাম শুনিত।।
হরিনাম শুনে তারা ছাড়ে আখিজল।
তাই দেখে সে অশ্বিনী বলে হরিবল।।
হরিনামে মাতোয়ারা ছাড়ে শুধু হাই।
চক্ষু জলে ভাসে বাহ্যজ্ঞান নাই।।
ভাষাহীন পশুজাতি হেন দৃশ্য দেখি।
একদৃষ্টে চেয়ে আছে না পালটে আখি।।
শুকপাখী উড়ে এসে গা পৃষ্টে পড়িত।
হরিনাম শুনে তারা আনন্দে নাচিত।।
অশ্বিনীর হরিনামে হেন জ্ঞান হয়।
আকাশে বাতাসে যেন হরিগুণ গায়।।
কোকিল আসিয়া সেথা ধরে কুহু তান।
মনে হয় তারা করে হরি গুণগান।।
হরিভক্ত ভালবাসে পশু পাখিগণ।
তাই তারা কাছে এসে নিয়াছে স্মরণ।।
ক্ষণেক চৈতন্য পেয়ে নয়ন মেলিল।
গরুগুলি চেয়ে আছে দেখিতে পাইল।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী উঠিয়া দাঁড়ায়।
গরুকে কহিছে ডেকে হস্ত দিয়া গায়।।
মাঝে গিয়ে ঘাস খাও মনের হরষে।
পেট ভরে গেলে আমি নিয়ে যাব শেষে।।
তাই শুনি গরুগুলি মাঠ মধ্যে যায়।
মনের আনন্দে তারা চরিয়া বেড়ায়।।
তারপর সে অশ্বিনী বৃক্ষতলে যেত।
বসিয়া বসিয়া শুধু হরিনাম নিত।।
মনমত গরুগুলি ভোজন করিয়া।
অশ্বিনীর কাছে এসে দাঁড়ায় আসিয়া।।
অশ্বিনী বলিত মোরা চল বাড়ী যাই।
পথ বেয়ে গরুগুলি চলিত সবাই।।
পিছনেতে চলে রত্ন বলে হরি হরি।
সন্ধ্যা অগ্রে উপনীত তারকের বাড়ী।।
যত্ন করি গরুগুলি গোয়ালে বাঁধিত।
হাত মুখ ধুয়ে সে যে গৃহেতে পশিত।।
তারকের কাছে গিয়া জুড়ি দুই হাত।
ছল ছল আখি দু’টি করে প্রণিপাত।।
দুই হাতে পদ ধুলি লইত মাথায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
তাই দেখি রসরাজ বলিত বচন।
তোমার মনের বাঞ্ছা হইবে পূরণ।।
মায়ের চরণে গিয়ে প্রণাম করিত।
স্নেহ ভরে মাতা মোর তাহাকে কহিত।।
তুই মোর প্রাণাধিক ওহে বাছাধন।
মনের বাসনা তোর হইবে পূরণ।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে যায়।
হাতে কাম মুখে নাম করিত সদায়।।
এইভাবে কতি দিন গত হয়ে গেল।
মাঝে মধ্যে কবিগান শিখিতে লাগিল।।
একদিনি অশ্বিনীকে বলে রসরাজ।
এবে তুমি মাঠে গিয়ে কর কৃষিকাজ।।
হালের বলদ লয়ে জমি চাষিবারে।
মাঝে মধ্যে চলে যাও বলি যে তোমারে।।
এইকথা বলা মাত্র তারক সুজন।
পশ্চিমপাড়ায় গেল করিতে ভ্রমন।।
গুরু বাক্য শুনি রত্ন ভাবে মনে মন।
কোন জমি চাষ করি নাহি নির্ধারণ।।
মনে মনে সে অশ্বিনী ভাবিতে লগিল।
বলদের কাছে গিয়ে কাতরে কহিল।।
শুন শুন গো দেবতা আমার বচন।
যেই জমি চাষ হবে কর হে গমন।।
তোমরাত জান ভাল মোর জানা নাই।
যেই জমি চাষিবারে বলেছে গোঁসাই।।
তাই শুনি গরু দু’টি গমন করিল।
পিছে পিছে সে অশ্বিনী চলিতে লাগিল।।
লাঙ্গল জোয়াল স্কন্ধে চলে পিছে পিছে।
যে জমিতে গিয়া গরু দাঁড়াইয়া আছে।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী লাঙ্গল জুড়িল।
হরি বলে সেই জমি চষিতে লাগিল।।
জমি চাষ করে আর হরিগুণ গায়।
হরি নাম শুনে গরু দ্রুতগতি ধায়।।
দেখিতে দেখিতে জমি চাষ হয়ে গেল।
অমনি হালের গরু ছাড়াইয়া দিল।।
তাহাদের বলিলেন মাঠ মধ্যে যাও।
পতিত জমিতে গিয়ে চরিয়া বেড়াও।।
গরুগুলি ছেড়ে দিয়ে ভক্ত শিরোমণি।
মাঠ পার্শ্বে বৃক্ষতলে চলিল অমনি।।
শ্রম করি বসে গিয়া বৃক্ষের ছায়ায়।
ঘার্মাক্ত দেহখানি সুশীতল হয়।।
গুণগান হরিনাম করিতে করিতে।
শয়ন করিল শেষে বৃক্ষের ছায়াতে।।
নিদ্রার আবেশ হয়ে হল অচেতন।
ঘুম ঘোরে হরিনাম করে উচ্চরণ।।
ভীষণ রৌদ্রের তাপ বৃক্ষ পাতা ফাঁকে।
সূর্যের কিরণ পড়ে হরিভক্ত মুখে।।
হরিভক্ত কষ্ট দেখে দয়াময় হরি।
অশ্বিনীকে ছাড়া দেয় সর্প মূর্তি ধরি।।
দয়াময় হরি আজি ভক্তের লাগিয়া।
সর্পরূপে ছায়া দেয় ফণা বিস্তারিয়া।।
দেখরে জগতবাসী দেখরে চাহিয়া।
কিভাবে কি করে হরি ভক্তের লাগিয়া।।
এইভাবে সে অশ্বিনী বৃক্ষ তলে রয়।
মধ্যাহ্ন হইল গত হল অসময়।।
অসময় হলো দেখি তারক গোঁসাই।
অশ্বিনী আসে না কেন মনে ভাবে তাই।।
মন বড় উচাটন কি করি উপায়।
অশ্বিনীকে খুঁজিবারে মাঠ মধ্যে যায়।।
মাঠে মধ্যে গিয়ে তিনি দেখিবারে পায়।
পতিত জমিতে গরু চরিয়া বেড়ায়।।
অশ্বিনীকে নাহি দেখি ভাবিতে লাগিল।
বৃক্ষতলে লক্ষ্য করে দেখিতে পাইল।।
কিছু দুর থেকে দেখে আশ্চর্য ঘটনা।
মস্তক উপরে আছে সর্পরাজ ফণা।।
এমন সাপের ফণা কভু দেখি নাই।
পরাণ ভরিয়া দেখে তারক গোঁসাই।।
ধীরে ধীরে শ্রীতারক নিকটেতে গেল।
অদৃশ্য হইয়া সর্প বাতাসে মিশিল।।
তাই দেখে তারকের ঝরে আখি জল।
আধ আধ ভাষা দিয়ে বলে হরেবল।।
ছুটে গিয়ে অশ্বিনীকে বুকেতে ধরিল।
মহাভাবে সে তারক কহিতে লাগিল।।
কত কষ্ট করি আছ হাল চাষ করি।
তাই তব মনে বাছা দুঃখ হল ভারী।।
কেন বাছা শুয়ে আছ গাছের ছায়ায়।
শ্রীঘ্র তুমি ঘরে চল বেলা বয়ে যায়।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া সে যে কান্দিতে লাগিল।।
হাল চাষ করি আসি গরু ছেড়ে দিয়ে।
বৃক্ষতলে এসে আমি রয়েছি ঘুমায়ে।।
বেলা বয়ে গেছে মোর হেলায় হেলায়।
অপরাধ ক্ষমা কর ধরি তব পায়।।
তারক বলেছে তোর অপরাধ কিরে।
তোর মত হরিভক্ত নাই এ সংসারে।।
ত্বরা করি চল বাছা গৃহে চলে যাই।
অন্য কথা দিয়ে তব আর কার্য্য নাই।।
তারকের বাক্য শুনি অশ্বিনী তখন।
গরু লয়ে করিলেন গৃহেতে গমন।।
সেই হতে ভাবিলেন কবি রসরাজ।
অশ্বিনীকে দিয়ে আর করা’ব না কাজ।।
কাঁদিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।