শ্রীশ্রীহরিচাঁদকে দর্শণ ও শক্তিলাভ
“আমারে আড়াল করিয়া দাড়াও
হৃদয়-পদ্মদলে”
–বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আর দিন সে তারক গেল সেই দেশে।
সাধনা করিছে যেথা মৃত্যুঞ্জয় বসে।।
প্রণাম করিল গিয়া গোস্বামীর পায়।
হাসি হাসি মৃত্যুঞ্জয় তারে ডেকে কয়।।
“তারক হে! তুমি নাহি জান সমাচার।
ওড়াকান্দী হরিচাঁদ হরি-অবতার।।
মোর যাহা কিছু দেখ সবি তাঁর দয়া।
আমাকে ঘিরিয়া আছে তাঁর কৃপা-ছায়া।।
জনম সফল যদি করিবারে চাও।
সময় থাকিতে তুমি ওড়াকান্দী যাও।।
যদি বল আমি তব সঙ্গে যেতে পারি।
নয়ন সার্থক হবে যদি দেখ হরি।।
কথা শুনি তারকের চিন্তা হয় মনে।
“হরি অবতার পুনঃ হ’ল বা কেমনে?”
শেষ অবতার হ’ল শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য।
পরে নাহি অবতার গোরা রায় ভিন্ন।।”
শাস্ত্র গ্রন্থে কোথা নাই প্রমাণ তাঁহার।
কিসে গুরু বলে হরিচাঁদ অবতার?”
অন্তর জানিয়া তবে কহে মৃত্যুঞ্জয়।
“তারক হে! সন্দ করা কভু ঠিক নয়।।
শাস্ত্র গ্রন্থে প্রমাণাদি নাহি বল কিসে?
সে কথা বলিয়া গেছে শ্রীজীব বিশেষে।।
“শ্রীচৈতন্য ভাগবতে সন্ন্যাস অধ্যায়।
মাতার নিকটে প্রভু অঙ্গীকারে কয়।।
তব গর্ভে জন্ম লব আর দুই বার।
এই নহে মাতা মোর শেষ অবতার।।
ভক্ত গণে সঙ্গোপনে পুনঃ ইহা বলে।
অবতার হ’ব পুনঃ সংকীর্ত্তন-ছলে।।
পড়িয়া দেখগে তাহা তারক গোঁসাই।
এই বাক্য আমি কভু ভুল বলি নাই।।
স্বচক্ষে দেখিবে যবে প্রভু হরিচান্দে।
এ কথা স্বীকার তুমি করিবে আনন্দে।।”
এই কথা বলিলেন সাধু মৃত্যুঞ্জয়।
শ্রীঘ্র গতি সে তারক নিজগৃহে যায়।।
শ্রীচৈতন্য ভাবগত সংগ্রহ করিল।
সন্ন্যাস অধ্যায় পরে পাঠ করি নিল।।
দেখ সব লেখা আছে সত্য পরিচয়।
বুঝিল গৌরাঙ্গ শেষ অবতার নয়।।
কিন্তু অবতারে আছে বহুত লক্ষণ।
পাপী বিনাশন আর সাধুর লক্ষণ।।
অঙ্গে থাকে শুভ চিহ্ন দ্বাত্রিংশ প্রকার।
অন্তর বুঝিয়া করে সেই ব্যবহার।।
হরিচাঁদ হৎতে পারে মহৎ পুরুষ।
শক্তিশালী হৎতে পারে সাধক মানুষ।।
আর এক কথা মোর উঠিয়াছে মনে।
আপন গুরুকে লোকে ভগবান মানে।।
আমার প্রভুর গুরু প্রভু হরিচাঁন।
সেই হেতু গুরু তাঁরে বলে ভগবান।।
মোর পক্ষে ভগবান গুরু মৃত্যুঞ্জয়।
তাঁর পদে মন মোর যেন সদা রয়।।
কাজ নাই ওড়াকান্দী হরিচাঁদে দেখে।
সদয় আমারে যদি প্রভু মোর থাকে।।
পুনরায় তবে যায় সে কালীনগরে।
মৃত্যুঞ্জয় হাসি তবে বলিল তাহারে।।
‘হে তারক! আর কোন মনেতে সন্দেহঃ
এক মনে এই বারে মোর বাক্য লহ।।
দূরে থেকে সে কল্পনা সে সব অলীক।
ওড়াকান্দী গেলে তুমি সব পাবে ঠিক।।
সন্দেহ-ভঞ্জন হরি আছে ওড়াকান্দী।
চল এক সঙ্গে মোরা সেই পদ বন্দি।।”
এ মত কহিল যদি প্রভু মৃত্যুঞ্জয়।
তারক স্বীকার করি পড়ে তাঁর পায়।।
দুই দিন পরে দোঁহে করে শুভযাত্রা।
অন্তর্য্যামী মহাপ্রভু জানিলেন বার্ত্তা।।
সন্দেহ-দোলায় দোলে তারকের মন।
কি জানি কি-ভাবে হরি দেয় দরশন।।
হেন-মতে ওড়াকান্দী হেইল উদয়।
চক্ষে জল মৃত্যুঞ্জয় হরি! হরি! কয়।।
স্পর্শ মাত্রে শ্রীধামের পবিত্র প্রাঙ্গন।
অকস্মাৎ উচাটন তারকের মন।।
প্রাঙ্গণের প্রান্তভাগে চটকা তলায়।
মহাপ্রভু বসিয়াছে ছিন্ন-কান্থা গায়।।
বলিষ্ঠ উন্নত দেহ এক মহাজন।
উম্মাদের প্রায় যেন করিছে ভ্রমণ।।
সম-কায় দেখা যায় অন্য একজনে।
প্রফুল্ল বদনে রহে প্রভুর পিছনে।।
যবে মৃত্যুঞ্জয় আসি উপনীত হ’ল।
হাসি হাসি মহাপ্রভু কহিতে লাগিল।।
“ওরে গোলক! হীরামন! তোরা দেখে যা।
মিত্যুনে এনেছে সাথে এক তোতার ছা।।
সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করি পড়ে মৃত্যুঞ্জয়।
প্রভু প্রতি এক দৃষ্টি সে তারক চায়।।
মৃত্যুঞ্জয় উঠে বসে চক্ষে ঝরে জল।
ভাব দেখি সে তারক হইল বিহ্ববল।।
প্রণাম করিতে যবে ভূমি স্পর্শ করে।
সন্দেহ-ভঞ্জন-প্রভু দেখা’ল তাঁহারে।।
দুই পদ প্রসারিয়া প্রভু দেখাইল।
ধ্বজ বজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন তারক দেখিল।।
ঊদ্ধ দৃষ্টি করি তবে চাহিল তারক।
ঊর্দ্ধ হস্ত করিলেন ভূবন-পালক।।
সবে ভাবে অলসতা নাশিবার তরে।
মহা প্রভু হস্ত পদ প্রসারিত করে।।
তারক দেখিল কিন্তু সর্ব্ব সুলক্ষণ।
শাস্ত্রে গ্রন্থে যেই সব করেছে কীর্ত্তন।।
“পঞ্চদীর্ঘো পঞ্চ সূহ্মঃ সপ্তরাক্তঃ ষড়োন্নতঃ।
ত্রিহ্রাস্ব প্রীতিগাম্ভীর্য্যং দ্বাত্রিংশো লক্ষণ মহান।।”
সন্দেহ-মেঘেতে-ঢাকা ছিল যে হৃদয়।
হরি কৃপা-বায়ু তাহা দূরে লয়ে যায়।।
জ্ঞানহারা সে তারক পড়িল ধরায়।
শির-স্পর্শ হ’ল তার ঠাকুরের পায়।।
কৃপাময় কৃপা করি শক্তি দিল তারে।
বলে “ধর মৃত্যুঞ্জয় ধর তুমি ওরে।।”
মৃত্যুঞ্জয় পরশিলে জ্ঞান ফিরে এল।
উচ্চঃস্বরে সে তারক কাঁদিতে লাগিল।।
লক্ষ কথা আসে মনে বুক ফেটে যায়।
এক মুখে কিবা কবে করে হায় হায়।।
প্রভু কয় মৃত্যুঞ্জয় এই তোতার ছা।
আর কারে দিবি তুই মোরে দিয়ে যা।।
কেন্দে বলে মৃত্যুঞ্জয় অনাথের নাথ।
এ তোমাকে নেয়া দেয়া সব নিজ হাত।।
তোতা তো সামান্য কথা ব্রহ্মান্ড তোমার।
নেয়া দেয়া কর্তা তুমি ব্রহ্ম পরাপর।।
দয়া করে এ তোতারে যদি তুমি নিলে।
জনমের মত বাঁধ কৃপার শৃঙ্খলে।।
মহাপ্রভু ডেকে বলে তবে তাই হোক।
যা বলি তোতারে আমি সেই বুলি কোক।।
এ সময়ে তারকের কিছু চিত্ত স্থির।
দর দর ধারে দুই চক্ষে বহে নীর।।
যেই মাত্র প্রভু বলে “সেই বুলি কোক।।
তারকের জিহ্বাগ্রে অম্নি ফুটিল শ্লোক।।
অপলকে শ্লোকে শ্লোকে করিল বন্দনা।
মৃত্যুঞ্জয় আনন্দিত শুনিয়া রচনা।।
দেব-ভাষা সহযোগে বন্দনা করিল।
মাতৃ-ভাষা সহযোগে ভাব লেখা হ’ল।।