১৯১৪ খ্রষ্টাব্দ ও মহাসমর
ইউরোপ মহাদেশে আছে বহু জাতি।
জার্ম্মাণ তাহার মধ্যে দুর্দ্দান্ত যে অতি।।
পূর্ব্বেতে জার্ম্মাণ দেশে বহু রাজ্য ছিল।
প্রুশিয়া তাহার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লভিল।।
এই রাজ্যে বিসমার্ক নামে একজন।
শুভক্ষণে করিলেন জনম গ্রহণ।।
তাঁহার চেষ্টার বলে ক্ষুদ্র রাজ্য যত।
বৃহত্তর জার্ম্মাণীতে হ’ল পরিচয়।
‘জার্ম্মাণ সাম্রাজ্য’ বলি হ’ল পরিচয়।
প্রুশিয়া রাজ্যের রাজা “কাইজার” হয়।।
“কাইজার” কল্পনা করে পৃথিবী বিজয়।
তলে তলে যুদ্ধ-অস্ত্র গোপনে সাজায়।।
সলা পরামর্শ তেঁহ করে বিধিমতে।
কোন মতে নাহি পারে যুদ্ধকে বাধাতে।।
মনে মনে তার অঅর পূর্ব্ব দুঃখ ছিল।
ফরাসী জাতির হাতে জার্ম্মাণী হারিল।।
“আলসেস লোরেণ” নামে দুইটি প্রদেশ।
ফরাসীরা করে নিল তাহাদের দেশ।
অন্য বহু দুঃখ মনে জার্ম্মাণীর ছিল।
“পৃথিবীর রাজা” হবে বাসনা করিল।।
সেই লোভে ক্রমে ক্রমে যুদ্ধ সজ্জা করে।
কেমনে বাধাবে যুদ্ধ ভাবিছে অন্তরে।।
হেনকালে অষ্ট্রিয়ার যুবরাজ যিনি।
সারভিয়া রাজ্য মধ্যে চলিলেন তিনি।।
দৈবের নির্ব্বান্ধ যাহা তাহাই ঘটিল।
যুবরাজ সেই রাজ্যে নিহত হইল।।
রাজরকতে কলঙ্কিত হল সরাভিয়া।
যুদ্ধের দামামা ধ্বনি উঠিল বাজিয়া।।
জার্ম্মাণী বুঝিয়া দেখে এই ত সুযোগ।
অষ্ট্রিয়াকে ক্ষেপাইয়া যুদ্ধে দিল যোগ।।
বেলজিয়াম হল্যান্ড দুটি ক্ষুদ্র দেশ।
দুর্দ্দান্ত জার্ম্মানী দোহে করে দিল শেষ।।
দুর্ব্বলের বন্ধুরূপে আসিল ইংরাজ।
দুর্ব্বলে বাঁচাতে তাই পরে যুদ্ধ-সাজ।।
জার্ম্মাণী ইটালী আর প্রচন্ড রাশিয়া।
অষ্ট্রিয়া তুরস্ক সব গেল এক হইয়া।।
এদিকে ফরাসী আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য।
“মৃত্যু কিংবা যুদ্ধ জয়” করিলেন ধার্য্য।।
কানাডা ভারতবর্ষ আর অষ্ট্রেলিয়া।
আফ্রিকা উপনিবেশ মিশিল আসিয়া।।
আরব পারস্য দোঁহে ক্রমে যোগ দিল।
বুলগেরিয়া রুমানিয়া পূর্ব্বাহ্নে মরিল।।
সার্ভিয়া মুছে গেল কোন চিহ্ন নাই।
সমস্ত পৃথিবীব্যাপী বাধিল লড়াই।।
তিন বর্ষ যুদ্ধ চলে ভীষণ আকার।
জার্ম্মাণীর তবু নাহি ভাঙ্গে অহঙ্কার।।
শেষ বর্ষে যুক্তরাষ্ট্র আমেরিতা খন্ডে।
নামিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে অতীব প্রচন্ডে।।
একে ইংরাজ আর ফরাসী জুটিয়া।
জার্ম্মাণীর রক্ত সব নিয়াছে শুষিয়া।।
রক্তশূণ্য দেহে মারে মার্কিন আঘাত।
মৃতপ্রায় জার্ম্মাণেরা হ’ল ভূমিস্মাৎ।।
ভার্সাই নগরে পরে সন্ধিপত্র হ’ল।
অহঙ্কারী ‘কারজাই’ দেশ ছেড়ে গেল।।
এই যুদ্ধে ভারতের যত নরনারী।
রাজার সাহায্য করে প্রাণ তুচ্ছ করি।।
কেহ বা সৈনিক সাজে বীরত্বে নির্ভিক।
বাঙ্গালী পাঞ্জাবী গুর্খা আর কত শিখ।।
অর্থ দেয় স্বার্থ দেয় মজুর জোগায়।
দেশ ছেড়ে কতজন গেল বসরায়।।
মহাযুদ্ধে গুরুচাঁদ রাজার কল্যাণে।
বহু নমঃশূদ্রে দিল যুদ্ধের কারণে।।
বিভিন্ন বিভাগে তারা করিল চাকুরী।
কেহ কেহ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ গেল মরি।।
উৎসাহ দেখিয়া তাঁর মীড ডাকি কয়।
“উপর্যুক্ত কাজ এই হ’ল মহাশয়।।
রাজভক্ত নমঃশূদ্র জানিবেন রাজা।
দিনে দিনে নমঃশূদ্র হবে মহাতেজা।।
দলিত পীড়িত জাতি বঙ্গে যত আছে।
তারা সবে শিক্ষা পাবে নমঃশূদ্র কাছে।।
তোমার কার্যের ধারা আমি দেখিয়াছি।
তরাবে পতিত জনে ভাবে বুঝিয়াছি।।
যে বীজ রোপণ আজি করিলে ঠাকুর।
ইহার শিকড় যাবে দূর হতে দূর।।
এই বীজ যেই বৃক্ষ উঠিবে জাগিয়া।
পতিত বাঙ্গালী তাতে যাইবে তরিয়া।।”
যে বাণী বলিল মীড তাহা দেখি পরে।
সকলি হইল সত্য অক্ষরে অক্ষরে।।
যুদ্ধ শেষে বঙ্গবাসী নব শক্তি পায়।
পীড়িত জাতির হল নব অভ্যুদয়।।
দেশের ‘আইন-সভা’ বিস্তৃত হইল।
বঙ্গদেশে বহুজনে ভোটাধিকার পেল।।
অনুন্নত বলি যত জাতি বঙ্গে ছিল।
ভোট দিয়া কাউন্সিলে মেম্বর পাঠাল।।
ভীষ্মদেব দাস আর নীরোদ বিহারী।
কাউন্সিলে সভ্য হ’ল বহু চেষ্টা করি।।
প্রথম আইন গৃহে ইহারা দু’জন।
নমঃশূদ্র পক্ষ হতে করে আগমন।।
ভীষ্মদেব দাস হয় ওড়াকান্দী বাসী।
প্রথমে তাঁদের বিদ্যা শিখাইল শশী।।
কাউন্সিলে পশিবারে তেঁহ ইচ্ছা করে।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদে বলে ভক্তিভরে।।
“আপনার দয়া ভিক্ষা এই কার্যে চাই।
চিরদিন তব ঠাঁই আমি কৃপা পাই।।
আশীর্ব্বাদ চাই আমি জাতির কারণে।
ক্ষুদ্র হয়ে কিবা ফল জাতির কারণে।।
তাঁর বাক্য শুনি প্রভু বড়ই সন্তোষ।
বলে “ভীষ্ম করিও না বৃথা আপশোষ।।
অবশ্য সাহায্য আমি করিব তোমারে।
নিশ্চয় মেম্বর তুমি হবে এই বারে।।
প্রভুর অমোঘ বাণী হল পরিপূর্ণ।
মনোনীত-সভ্যরূপে ভীষ্ম হল ধন্য।।
বরিশাল জিলা পক্ষে নীরোদ বিহারী।
কাউন্সিলে সভ্য হন বহু চেষ্টা করি।।
বিখ্যাত মল্লিক বংশে জনম তাঁহার।
কুমুদের হন তিনি চতুর্থ সোদর।।
তথাকার ভক্তগণে প্রভু ডাকি বলে।
“নীরোদ বাবুকে ভোট দিও এক দলে।।”
যেই দেশে হতে যে ভক্ত কাছে আসে।
“কাউন্সিলে কে দাঁড়াল” তাঁহারে জিজ্ঞাসে।।
অনুন্নত জাতি হয়ে যাতে সভ্য যায়।
সেই মত উপদেশ সকলেরে কয়।
বিস্তৃত আকারে তাহা বলিব যে পরে।
এবে বলি সব কথা মূল-সূত্র ধরে।।
দলিত জাতির এই নব অভ্যুদয়।
রাজাকে সাহায্য-করা তার মূলে রয়।।
সেই কা্র্যে মূলে দেখি গুরুচাঁদ প্রভু।
তাঁরে ভিন্ন পতিতেরা উঠে নাই কভু।।
মহাযুদ্ধে বিশ্বে এল মহাজাগরণ।
সর্ব্বক্ষেত্রে আবিষ্কার হইল নূতন।।
আকাশে উড়িল নর জলেতে ডুবিল।
পৌরাণিক কথা সত্যে পরিণত হল।।
কিবা রাজ্যে কি বাণিজ্যে নবযুগ।
“সকলে স্বাধীন হ’ব” উঠিল হুজুগ।।
সেই আন্দোলন কথা পরে বলা হবে।
এবে শুন মহাপ্রভু কি করিলা তবে।।
“খৃষ্টান হইবে” বলি প্রভু দিল ভীর।
ঐশ্বর্য্যের ভক্তিধারী ছিল যাঁরা যাঁরা।
ভক্তিগুণে গুরুচাঁদে পাইলেন ধরা।।
যাহা ইচ্ছা হয় মনে প্রভু করে তাই।
এদিকে ছাড়িল দেহ তারক গোঁসাই।।
সে কাহিনী অতঃপরে বলিবার চাই।
কহি কহে গেল দিন আর বেলা নাই।।