ভবঘুরেকথা

গোস্বামী গোলোক ও অজগর বিবরণ
পয়ার

একদিন মহাপ্রভু বসিয়া নির্জনে।
পাগল গোলোকজীরে বলিল যতনে।।
কত ঠাই কতদিনে কর দৌড়াদৌড়ি।
অদ্য যাও গজারিয়া লক্ষ্মণের বাড়ী।।
শুনিয়া গোলোকচাঁদ করিল গমন।
বেগেতে চলিল হয় হরষিত মন।।
জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।
নামধ্বনি করি চলে তেজেতে অনল।।
ক্ষণে লম্ফে ক্ষণে দৌড়ে নামে করে দর্প।
বিল মধ্যে দেখে এক অজগর সর্প।।
বিল মধ্যে খাল এক আড়ে দুই নল।
নামিল পাগল তাতে উরু সম জল।।
সেই জল মধ্যে হ’তে উঠে অজগর।
ভেসে উঠে তাহার প্রকাণ্ড কলেবর।।
দুই চক্ষু জ্বলে যেন আকাশের তারা।
নাসারন্ধে কর মুষ্ঠি যায় যেন ধরা।।
চক্ষু মূল লাল নাসারন্ধ্রে টানে জল।
হইতেছে শব্দ বুড় বুড় কল কল।।
শ্বাস পরিত্যাগে স্বাহা স্বাহা শব্দ করে।
নর্দমার জল যেন বেগে পড়ে সরে।।
সর্ব অঙ্গ অজগর কালকূট বর্ণ।
মস্তক উপর মণি হরিপদ চিহ্ন।।
গোস্বামীর অঙ্গে যেই কান্থাখানি ছিল।
শ্বাস পরিত্যাক্ত জলে কান্থা ভিজে গেল।।
বদন ব্যাদান করি পড়িল অমনি।
দন্ত দুই পাঁতি যেন মুক্তার গাঁথনি।।
তাহা দেখি পাগলের লাগে চমৎকার।
বুঝিতে না পারে মর্ম কি হ’ল ব্যাপার।।
খাল পাড় হয়ে কূলে রহে দাঁড়াইয়া।
অজগর পানে প্রভু রহিল চাহিয়া।।
এ কখন সর্প নহে ভাবে মনে মনে।
ধাইয়া চলিল সর্প পাগলের স্থানে।।
হাঁ করিয়া পাগলকে চলিল গ্রাসিতে।
পাগল দৌড়িয়া যায় তাহার ত্রাসেতে।।
ক্ষণেক দৌড়িয়া শেষে দেখেন ফিরিয়া।
আসিতেছে অজগর মুখ বিস্তারিয়া।।
গোস্বামী ভেবেছে মনে ভয় করি কার।
মরণ জীবন সম হরিনাম সার।।
লইয়া বাবার নাম মারিতেছি ডঙ্কা।
চৌদ্দ ভুবনের মধ্যে কারে করি শঙ্কা।।
এসেছে আমাকে খেতে উহাকে ধরিব।
ধরিয়া লইয়া মহাপ্রভুকে দেখাব।।
হনুমান গিয়াছিল গন্ধমাদনেতে।
পর্বত মাথায় রাখে সূর্য শ্রবণেতে।।
ভরত বাটুলাঘাতে মুখে উঠে রক্ত।
রামনাম লইয়া বাঁচিল রাম ভক্ত।।
প্রথমতঃ কুম্ভিরিণী করিল উদ্ধার।
কালনেমী রাক্ষসের জীবন সংহার।।
কাহারে না করে ভয় রাম নাম জোরে।
নির্ভয় শরীরে হনু রামকার্য করে।।
কিছার মিছার প্রাণে কেন বেঁচে রই।
ভাবিতেছি মানব জনম হ’ল কই।।
বুঝি এই হেতু পাঠালেন কল্পতরু।
সর্প দর্প দেখে কেন হই এত ভীরু।।
বদন ব্যাদান করি যায় অজগর।
দর্প করিলেন প্রভু সর্প ধরিবার।।
জয় হরি বল রে গৌর হরি বলে।
লম্ফ দিয়া প’ড়ে অজগরে ধ’রে তুলে।।
অতি দর্পে কহে সর্পে তোরে ধ’রে নিব।
ওরে ফণী তোর মণি প্রভু পদে দিব।।
ফণীবর পেয়ে ডর তখনি দাঁড়ায়।
সুন্দর কুমার হ’য়ে দৌড়াইয়া যায়।।
ধেয়ে যায় ফণী, হ’য়ে সুন্দর বালক।
পিছে পিছে ধেয়ে যায় গোস্বামী গোলোক।।
কৃষকেরা হাল ধরা করিছে দর্শন।
যোগালে রাখালে তারা একাদশ জন।।
বালক সেখানে গিয়া বলে সবাকারে।
রক্ষা কর তোমরা এ বেটা মোরে মারে।।
তাহা শুনি কৃষকেরা রুষিয়া উঠিল।
দাঁড়াও এখানে দেখি কোন বেটা এল।।
আমাদের কাছে তুমি আসিয়াছ হেথা।
তোমাকে মারিবে হেন কাহার যোগ্যতা।।
তাহা শুনি গোস্বামী আইলেন বাহুড়ী।
উপনীত হ’ল গিয়া লক্ষ্মণের বাড়ী।।
আহারাদি করিলেন লক্ষ্মণের বাসে।
পাগলামী করে ক্ষণকাল বীর রসে।।
বীর রসে যান ভেসে গোলোক গোঁসাই।
ওঢ়াকাঁদি আসিলেন ঠাকুরের ঠাই।।
পুষ্করিণী তীরে হরি বসিলেন এসে।
কিছুদূর গোলোক নিভৃতে গিয়া বসে।।
প্রভু হরিচাঁদ জিজ্ঞাসিলেন গোলোকে।
লক্ষণ কেমন আছে কি এসেছ দেখে।।
খনার বচন আছে সাপ স্বপ্ন পোনা।
দেখিয়া যে না ফুকারে মুনি সেই জনা।।
অসম্ভব দেখিলে না কহে বিজ্ঞজনে।
মনের মনন কথা থাক মনে মনে।।
কি শুনিবা অধিক জানা’ব কিবা আর।
আজ কোন মহাভাগ হইল উদ্ধার।।
শুনিয়াছ ভারত পুরাণ রামায়ণ।
শাপ ভ্রষ্ট ভবে জন্মে কত মহাজন।।
কোন মহাপুরুষের শাপে কোন জন।
স্থানভ্রষ্ট হ’য়ে থাকে পর্বত কানন।।
যক্ষমুনি শাপে গন্ধকালী ভবে এসে।
কুম্ভিরিণী মুক্তি পেল হনুমান স্পর্শে।।
অদ্য কোন মহাভাগ হইল উদ্ধার।
বহিরাংগ লোক মাঝে না কর প্রচার।।
মহাপ্রভু কহিলেন গোলোকের স্থানে।
এ সময় যাহারা ছিলেন সন্নিধানে।।
গোস্বামীর পদ ধরি তাহারা জিজ্ঞাসে।
এড়াইতে না পারিয়া গোস্বামী প্রকাশে।।
ত্রেতাযুগে সূর্যবংশে রাজা অযোধ্যায়।
ব্রাহ্মণের পাদোদক ভক্তি করে খায়।।
একদিন ভগবান তারে ছলিবারে।
ব্রাহ্মণ বেশেতে যান ত্রিশঙ্কুর দ্বারে।।
কুষ্ঠাব্যাধিগ্রস্থ বিপ্র হ’লেন কানাই।
ভাগবতে দ্বাদশ প্রস্তাবে আছে তাই।।
ব্রাহ্মণের পাদোদক হাতে ধরি নিল।
তার মধ্যে ক্লেদ কীট দেখিতে পাইল।।
ঘৃণা করি না খাইল থুইল মাথায়।
সেই অপরাধে সর্প যোনী প্রাপ্ত হয়।।
সেই জন্য কৃষ্ণপদ পাইল মাথায়।
প্রভু কৃষ্ণ ব্রজে কালীনাগ কালীদয়।।
না চিনিয়া ভগবানে করিল দংশন।
মস্তকে চরণ দিল প্রভু জনার্দন।।
অদ্যাবধি মস্তকেতে প্রভু পদচিহ্ন।
যদ্যপি সে সর্প তবু ত্রিভুবন মান্য।।
কালীনাগ কৃষ্ণপদ করিয়া ধারণ।
বলে প্রভু তোমার যে রাতুল চরণ।।
ভাবিয়া না পায় পদ ব্রহ্মা পঞ্চানন।
পদ লাগি শিবা করে শ্মশানে ভ্রমণ।।
সেই পদে বিষদন্তে দংশিলাম আমি।
এ পাপেতে হ’তে হয় বিষ্ঠা কণ্ডু কৃমি।।
দিয়াছ অভয় পদ বাঞ্ছা নাহি আর।
কত সুখ পাইতাম হ’লে নরাকার।।
ওহে প্রভু নরবপু যদি পাইতাম।
মনো সাধ মিটাইয়া পদ সেবিতাম।।
কবে হ’বে হেন ভাগ্য তুমি সানুকুল।
শুনিয়াছি নরবপু ভজনের মূল।।
এই অপরাধ প্রভু আমার ঘুচাও।
দয়া করি ওহে হরি নরবপু দেও।।
তারে বর দিলে সেই নররূপ হরি।
এর পর শ্রেষ্ঠলীলা যে সময় করি।।
জাতিসর্প খল দংশী অদ্য তাতে পাপ।
পরজন্মে আবার হইতে হবে সাপ।।
গুপ্তভাবে থেক গিয়া বিলে পদ্মবনে।
পিতা যশোমন্ত গৃহে জন্মিবো যখনে।।
রুদ্র অংশে জনমিবে আমার সেবক।
পরম ভকত সেই নামেতে গোলোক।।
যেদিন হইবে দেখা তাহার সঙ্গেতে।
বিষ্ণুলোকে যা’বে সুখে চ’ড়ে পুষ্পরথে।।
বিষ্ণু পরিষদ হ’বে বলিলাম তাই।
পাইবা সালোক্য মুক্তি একলোক ঠাই।।
সেই কালীয়ার প্রাপ্তি হ’ল বিষ্ণুলোক।
কারু কাছে না কহিও বাপরে গোলোক।।
এই কথা যে সময় শুনিল গোলোক।
নিভৃতে বলিল প্রভু শুনিল তারক।।
দশরথ তাহা জানি লিখি পাঠাইল।
সে লেখা দেখিয়া তাহা তারক রচিল।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!