পাগলের তাল বৃক্ষ ছেদন
পয়ার
কতদিন পর্যন্ত সে রাই ভাবে মনে।
পাগলের কার্য কিছু বুঝিতে পারিনে।।
অমানুষী কার্য সব না বুঝে দেবতা।
আমি কোন ছার এর মর্ম পা’ব কোথা।।
পাগল চাঁদের দেখি মহিমা অপার।
শ্রীমন্ত লোকের ভক্তি হইল সবার।।
রাইচরণের ভক্তি একান্ত অন্তরে।
মন হ’ল পাগলকে আনিবার তরে।।
রাইচরণের নাই আশার অবধি।
নারিকেল বাড়ী গিয়া গেল ওঢ়াকাঁদি।।
পাগল বসিয়া আছে ঠাকুরের বামে।
রাই গিয়া ঠাকুরের শ্রীপদে প্রণামে।।
ঠাকুরে জিজ্ঞাসা করে আ’লি কোথা হ’তে।
মনের মানসা তোর পাগলকে নিতে।।
রাই বলে আজ্ঞা প্রভো! অই মনোনীত।
বুঝিয়া করুণ কার্য যে হয় উচিৎ।।
ঠাকুর ইঙ্গিত কৈল গোলোকের পানে।
গোলোক ইঙ্গিত বুঝি উঠিল তখনে।।
অমনি চলিল রাইচরণ সঙ্গেতে।
ঠাকুর নিকটে রাই নারিল বসিতে।।
নারিকেল বাড়ী গিয়ে পাগলামী করে।
মারপিট করে জোরে যারে তারে ধরে।।
পদাঘাত মুষ্ট্যাঘাত চপেট আঘাত।
দশ বার জনে করে ভূমিতে নিপাত।।
পরে গেল করপাড়া যুধিষ্ঠির বাড়ী।
এক লাউ কাটিয়া পুরিল এক হাঁড়ি।।
জ্বাল দিয়া হাঁড়ির উপরে রেখে হাঁড়ি।
উঠানে আনিয়া ভাঙ্গে লাউ পোড়া হাঁড়ি।।
গোস্বামী তখন রাগে দর্প করে অতি।
রাইচরণের পৃষ্ঠে মারে দুই লাথি।।
দর্প করি বলে রাই শীঘ্র যারে বাটী।
বাড়ী আছে তালগাছ শীঘ্র ফেলা কাটি।।
তাহা শুনি রাই তবে বাটীতে আসিল।
রাত্রি এল তালগাছ কাতিতে নারিল।।
পাগল যথা তথায় পাগলামী করে।
পাটগাতী খেয়াঘাটে রাত্রি দ্বিপ্রহরে।।
পাটনীর ঘর খেয়া ঘাটের উপর।
বলে ওরে পাটনী আমাকে পার কর।।
পাটনী কহিছে রাগে তুই কার বেটা।
এত রাত্রে বল তোরে পার করে কেটা।।
জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।
দর্প করি যখনেতে উঠিল পাগল।।
পাটনীর হৃদকম্প হৈল তাহা শুনে।
নিত্য পার করি মন্দ ব’লেছি না চিনে।।
রাবণ পাটনী নাম হয় যে আমার।
পার করি অন্তে যদি মোরে কর পার।।
প্রভু বলে যাহা দিবি পাবি সেই ধন।
হরি তরাইবে তোরে বলিনু বচন।।
এতবলি পাগল চলিল গঙ্গাচর্ণা।
রাইচরণের বাড়ী চলে উগ্র মনা।।
বলে রাই মোর বড় ভ্রম হইয়াছে।
আমাকে সুস্থির কর এসে মোর কাছে।।
রাই ডেকে বলে তার রমণীর স্থান।
পাগলকে সুস্থ করি তৈল জল আন।।
তাহা শুনি ক্রোধেতে পাগলচাঁদ কয়।
তেলে জলে সুস্থ হওয়া পাগল এ নয়।।
তালগাছ কাটিতে তোমাকে আমি কই।
তাহা যদি কেটে ফেল তবে সুস্থ হই।।
রাই কহে আসিতে যে রাত্রি হ’ল মোর।
অবশ্য কাটিব গাছ নিশি হ’লে ভোর।।
প্রভাত সময় তালগাছ কেটেছিল।
গাছের ডাগুয়া পাতা বাটীতে রাখিল।।
বাস্তু ঘর বেড়া সঙ্গে বেড়া হেলা দিয়া।
ডাগুয়া নীচায় পাতা উপরে রাখিয়া।।
পাগল তাহার পরদিন ফিরি ঘুরি।
গঙ্গাচর্ণা এল রাইচরণের বাড়ী।।
রাত্রিযোগে পাগল সে ডাগুয়া পাতায়।
আগুন লাগা’য়ে দিয়া নাচিয়া বেড়ায়।।
হু হু শব্দ করি অগ্নি জ্বলে অবিরাম।
রাই করে সোর শব্দ পুড়িয়া মলেম।।
গৃহ মধ্যে গিয়া বলে পাগল গোঁসাই।
শুয়ে থাক রাই তোর কোন চিন্তা নাই।।
বাহির হইয়া রাই দেখে অকস্মাৎ।
আগুন হ’য়েছে উর্দ্ধ আট দশ হাত।।
যে খানের আগুন নির্বাণ সেখানেতে।
ঘর বেড়া কিছু না পুড়িল আগুনেতে।।
পাগল কহিল রাইচরণের তরে।
যাও যদি ওঢ়াকাঁদি এস সমিভ্যরে।।
তাহা শুনি ভাসে রাই প্রেমের তরঙ্গে।
প্রভাতে চলিল রাই পাগলের সঙ্গে।।
পাগল আসিয়া বাসুড়িয়া গ্রামে রয়।
রাইচরণকে কহে যাও নিজালয়।।
কাছারী হইতে এক পেয়াদা আসিয়া।
রাইচরণকে নিল কাছারী ধরিয়া।।
নায়েব কহেন কেন গাছ কেটেছিস।
গ্রামীরা জুঠিয়া সবে করিছে নালিশ।।
আগুন জ্বালালি কেন ঘরের বেড়ায়।
তুই পুড়ে যা’স মোর গ্রাম পুড়ে যায়।।
রাই কহে আমি এর কিছুই না জানি।
ভাবের পাগল এক তার কথা শুনি।।
সেই কহে তালগাছ কাটিবার তরে।
গাছ কাটিয়াছি তার বাক্য অনুসারে।।
গাছের বাগুয়া পাতা ঘরের পিছনে।
রাখিয়া ছিলাম পোতা বেড়ার সংলগ্নে।।
রাত্রিযোগে ছিনু আমি ঘরেতে শুইয়া।
পাগল আসিয়া দেয় আগুন জ্বালিয়া।।
ডাগুয়া পুড়িয়া তার পাতা পুড়ে গেল।
আট দশ হাত অগ্নি উর্দ্ধেতে উঠিল।।
চালের উপর দিয়া অগ্নি বায়ুলায়।
আগুন দেখিয়া আমি করি হায় হায়।।
ভয় নাই কহে মোর পাগল গোঁসাই।
তাল পাতা পুড়ে গেল ঘর পুড়ে নাই।।
বাবু কহে পাগলের কার্যে দোষ নাই।
ঈশ্বরের তুল্য ব্যাক্তি পাগল গোঁসাই।।
তোমার নাহিক দোষ যাও নিজ ঘরে।
পাগলে কহিও যেন দয়া থাকে মোরে।।
কর্মকর্তা হরি পাগলের ঠাকুরালী।
এত দিনে শত্রু মুখে প’ল চুনকালি।।
পাগলে ভাবিয়া রাই উঠে কাঁদি কাঁদি।
চারিদিন পরে যাত্রা কৈল ওঢ়াকাঁদি।।
দেখিয়া ঠাকুর রাইচরণে জিজ্ঞাসে।
অদ্য বাছা ওঢ়াকাঁদি এসে কই মানসে।।
রাই কহে শ্রীচরণ দর্শন আশায়।
মহাপ্রভু বলে বৎস! তাহা বুঝি নয়।।
মোর প্রতি ভক্তি তোর আছে ত’ নিশ্চয়।
এবে আলি গোলোকেরে দেখিতে আশায়।।
যেই ভক্ত সেই আমি গ্রন্থে লেখে স্পষ্ট।
গোলোকে সেবিলে আমি আরো বেশী তুষ্ট।।
বাড়ী ছিল তালগাছ কেটেছিস নাকি।
আগুনে পুড়িস নাই শুনে হইনু সুখী।।
যাহা হোক তাহা হোক আমার সৌভাগ্য।
হ’য়েছে তোমার বাড়ী রাজসূয় যজ্ঞ।।
যা করে গোলোক আমি করি সেই কাজ।
পয়ার প্রবন্ধে কহে কবি রসরাজ।।