অপার্থিব প্রেমাবদ্ধ দম্পতীর একসঙ্গে দেহত্যাগ
কানাই ঠাকুর নামে তালেশ্বর গাঁয়।
বাগহাট থানা মধ্যে খুলনা জিলায়।।
হেমন্তকুমারী নামে সাধ্বী পত্নী তার।
অপার্থিব প্রেমে বদ্ধ এই নারী নর।।
শ্রীগুরুচাঁদের পদে দৃঢ় নিষ্ঠা রাখে।
পতি পত্নী সর্বদায় একসঙ্গে থাকে।।
পুত্র-কন্যা-হীন দেখি প্রভু বলে তাকে।
“সন্তান বলিয়া তোরা পোষ এক পাখী।।”
শালিকের বাচ্চা এক রাখিল পুষিয়া।
হরি বলে দিন কাটে নিরালে বসিয়া।।
নরদেহে গুরুচাঁদ করিলেন ত্যাগ।
দম্পতী সংসারে তা’তে হ’ল বীতরাগ।।
ভক্ত কি অভক্ত যার সকলের যাত্রী।
বিরহ বেদনা দিয়ে বেড়াইল ঘুরি।।
সর্বস্ব বেচিয়া কিছু অর্থ হাতে হ’ল।
আশ্রয়ে রাখিয়া এক দুষ্ট তাহা নিল।।
অর্থ নিয়া পরে দোঁহা তাড়াইয়া দেয়।
চৈত্র মাসে লক্ষ্মীখালী হইল উদয়।।
সরল সহজ দেখি দম্পতীর প্রাণ।
দয়া করি শ্রীগোপাল দিল দোঁহে স্থান।।
জ্যৈষ্ঠ মাসে এক সঙ্গে উভয়ের জ্বর।
একসঙ্গে আসে ছাড়ে নাহি ভাবান্তর।।
সপ্তম দিবসে দেখ জ্বর বৃদ্ধি হ’ল।
হরি বলে সে কানাই জীবন ত্যজিল।।
সংবাদ জানিয়া বলে হেমন্তকুমারী।
“চলে গেলে প্রাণনাথ কিসে প্রাণ ধরি?”
শয্যা ত্যাগ করি দেবী হাঁটিয়া চলিল।
পতির চরণ তলে শয়ন করিল।।
কেন্দে কেন্দে বলে দেবী “ওগো প্রাণেশ্বর।
আজ কেন ছেড়ে যাও দাসীকে তোমার?
চিরকাল দয়া করে রাখিয়াছ সাথে।
দাসীরে ছাড়িয়া একা হও কোন পথে?
অপরাধ হয়ে থাকে দয়া করে ক্ষম।
দাসীকে লহ গো সাথে ওগো প্রিয়তম।।”
তৃষ্ণার্ত হইয়া দেবী জল খেতে চায়।
একটি ডাবের জল তারে এনে দেয়।।
কেন্দে কেন্দে জলপান সে সতী করিল।
পতির বামেতে এসে আপনি শুইল।।
সতীর প্রার্থনা কভু ব্যর্থ নাহি হয়।
পতিশোকে সতী নারী দেহ ছেড়ে যায়।।
ধন্য সতী! ধন্য পতি! ধন্য ব্যবহার।
সতীর চরণে করি কোটি নমস্কার।।
“প্রেম প্লাবনে ভক্ত-তরঙ্গ”
অনন্ত-সায়ারে হরি অনন্ত-শয়নে।
কাঁপিল ক্ষীরোদ সিন্ধু ধরার ক্রন্দনে।।
আদরিনী কন্যা ধরা ডাকে বারে বার।
‘ত্রাহি’ ‘ত্রাহি’ বিশ্বনাথ! পারি না যে আর।।
পাপ-দাবানলে অঙ্গ যেতেছে পুড়িয়া।
শান্তি দাও শান্তিপতি! ধরাতে নামিয়া।।
বিন্দু মাত্র ক্ষীরসিন্ধু কাঁপিয়া উঠিল।
ডুবিল তাপিতা ধরা প্লাবন ছুটিল।।
অনন্ত ক্ষীরোদ সিন্ধু সৃজন মেখলা।
ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র বিন্দু ধরণী একেলা।।
সম-ভার কেন্দ্রে বিশ্ব রাখি তুলা দণ্ডে।
অচিন্ত অব্যয় শক্তি দেখে প্রতি দণ্ডে।।
প্রতি বিন্দু সমেস্থিতঃ সৃষ্টির মাহাত্ম।
অসমে শাসিয়া সম করিছে প্রভুত্ব।।
অসম ধরার বুকে আনে হাহাকার।
কাঁপিল ক্ষীরোদ সিন্ধু ছুটিল জোয়ার।।
বিশ্ব-শান্তি নরাকারে করে মহারণ।
অসম নাশিনী ছোটে প্রেমের প্লাবন।।
তরঙ্গ আকারে তাহে কোটি ভক্তগণ।
সংক্ষেপে করিব আমি সে সব বর্ণন।।
করুণা করিয়া গুরু! হৃদয় কন্দরে।
দেখা দাও দয়াময়! স্নিগ্ধ মূর্তি ধরে।।
প্রেমের প্লাবন ছোটে ওড়াকান্দি হ’তে।
দেশে দেশে চলে স্রোত নানাবিধ পথে।।
নরদেহ হরিচাঁদ দিলেন ছাড়িয়া।
শক্তিরূপে গুরুচাঁদ রহিল বেড়িয়া।।
অজ্ঞ যারা তারা ভাবে “বন্যা বুঝি নাই”।
জানিল প্রকৃত তত্ত্ব তারক গোঁসাই।।
“পিতা-পুত্র অভিন্নত্মা” করিল প্রচার।
দ্বিতীয় প্লাবনে ঢেউ প্রথমে তাঁহার।।
গোলকের শক্তি পেল স্বামী মহানন্দ।
গুরুচাঁদে পূজা করে জানি পূর্ণব্রহ্ম।।
দ্বিতীয় তরঙ্গে বেগ দিল মহানন্দ।
ধাইল কলির জীব দূরে গেল সন্দ।।
যশোহরে হরিপাল পালের প্রধান।
বাদাবনে গিয়ে পেল তত্ত্বের সন্ধান।।
ওড়াকান্দি এসে দেখে প্রেমের প্লাবন।
জাতিকুল মান ফেলে ডুবিল তখন।।
কত যে করুণা প্রভু তাহারে করিল।
ধন জন দিনে দিনে বাড়িয়া চলিল।।
‘জাতি’ ‘জাতি’ তুচ্ছ কথা হরিভক্তি সার।
দেশে দেশে হরিপাল করিল প্রচার।।
“এমন মানুষ আমি দেখিয়াছি চোখে।
তাঁহারে দেখিলে আর গর্ব নাহি থাকে।।”
তার দেশে যত ছিল ব্রাহ্মণ পণ্ডিত।
এই বাক্যে তারা সবে বুঝে বিপরীত।।
তারা বলে “সে মানুষে আন মোরা দেখি।
আমাদের গর্ব কিছু নাশ হয় নাকি।।”
তাই বুঝি হরিপাল হয়েছে পাগল।
তাই বুঝি তার ঘরে খাও অন্ন জল।।
ব্রাহ্মণের কূটচক্রে সেই হরিপালে।
বাদ দিল স্বজাতিরা মিশি এক দলে।।
কায়স্থ নবীন বসু খালাসিয়া বাস।
তারকেরে গুরু বলে করেন বিশ্বাস।।
ওড়াকান্দি এসে পরে মতুয়া হইল।
তার যত স্বজাতিরা তারে বাদ দিল।।
মনোদুঃখে দুইজনে গেল ওড়াকান্দি।
প্রভুর চরণে গিয়ে পড়িলেন কান্দি।।
তারা কয় “দয়াময়! যদি একবারে।
দয়া করে যাইতেন সে কেশবপুরে।।
আমাদের দুঃখ ভার নিশ্চয় কমিত।
আপনারে দেখে পাপী দমন হইত।।”
ভক্ত দুঃখে দুঃখী প্রভু বলে “বাধা নাই।
মহোৎসব আয়োজন করা কিন্তু চাই।।
আনন্দে ছুটিল তারা সে কেশবপুরে।
মহোৎসবের লাগি তারা আয়োজন করে।।
বিরোধী পণ্ডিতবর্গে দিল সমাচার।
দলে দলে পণ্ডিতের আসিল বহর।।
ভাবিছে পণ্ডিত সবে যার যার মনে।
‘হেস্ত-নেস্ত’ আজ কিছু করিব এখানে।।
এদিকে প্রভুজী তবে চলিল নৌকায়।
শ্রীবিধু চৌধুরী তার সঙ্গে সঙ্গে রয়।।
নৌকা নিয়ে ঘাটে যাওয়া বড়ই কঠিন।
বাহুড়িয়া যেতে হলে লাগে একদিন।।
প্রভু কয় বিধু তুমি হেথা হতে যাও।
আমার সকল কথা হরিপালে কও।।
আমি নাহি যাব সেথা নৌকা পথে ঘুরি।
পারে যদি হেথা হতে নিক তার বাড়ী।।
আজ্ঞা পেয়ে বিধু গিয়ে সেথা উপস্থিত।
দেখিল বিরাট সভা অসংখ্য পণ্ডিত।।
স্মৃতি তীর্থ স্মার্ত্তারত্ন তর্ক পঞ্চানন।
বসিয়াছে সভা করে সেথা জনে জন।।
তার মধ্যে খাট দিয়া খাটের উপরে।
করেছে আসন এক বিচিত্র আকারে।।
“প্রভুর আসন” তাহা হরিপাল কয়।
বিধুর অন্তরে তাতে লাগে মহা ভয়।।
মনে ভাবে আজ বুঝি হবে অপ্রস্তুত।
বিশেষতঃ চারিদিকে পণ্ডিতের যুথ।।
কি জানি কি আছে ভাগ্যে আজিকার দিনে।
আমি ত’ মনেতে মোটে সাহসী হইনে।।
যা’ হোক তা’ হোক বিধু বলে সমাচার।
হরিপাল বলে তা’তে চিন্তা কিবা আর।।
বিধুকে বলিল “অগ্রে চলুন আপনি।
লোকজন নিয়ে আমি আসিব এখনি।।”
ত্র্যস্তেব্যস্তে বিধু গিয়া প্রভুজীরে কয়।
“কর্তা! হেথা যাওয়া আজ মোটে ভাল নয়।।”
সকল বৃত্তান্ত বিধু বলিল খুলিয়া।
কথা শুনে প্রভু তবে বলিল রাগিয়া।।
“ভীরু পুরুষের মত কথা কেন কও?
সিংহ-শিশু হয়ে কেন ভেড়া বনে যাও?
মোদের সহায় আছে আপনি শ্রীহরি।
এ বিশ্ব জগতে মোরা কারে শঙ্কা করি।।”
হেনকালে হরিপাল বহু লোক সাথে।
উপস্থিত হইলেন প্রভুর সাক্ষাতে।।
প্রভু কয় “কোন ভাবে যাবে এই তরী?”
হরিপাল বলে “প্রভু কিসে শঙ্কা করি”।।
তখনি সকলে তরী ধরে হাতে হাতে।
সকলের স্কন্ধে তরী চলে শুষ্ক পথে।।
মুহূর্তে সংবাদ গেল সভার ভিতরে।
“শ্রীগুরুচাঁদের তরী আসে শূন্য ভরে।।”
আশ্চর্য মানিয়া তবে পণ্ডিতেরা কয়।
“এইরূপ কাণ্ড নাহি কভু শোনা যায়।।
যার তরী শূন্য ভরে উড়ে যেতে পারে।
সে জন সামান্য নহে পৃথিবী ভিতরে।।”
হেনকালে তরী নিয়ে উপস্থিত হ’ল।
কাণ্ড দেখি বিশ্ববাসী আশ্চর্য মানিল।।
সভা স্থলে প্রভু যবে করিল প্রবেশ।
সকলে চাহিয়া দেখে অপরূপ বেশ।।
আপন আসনে প্রভু আপনি বসিল।
আসনের রূপ যেন দ্বিগুণিত হ’ল।।
কোন কোন পণ্ডিতেরা ভাবিল অন্তরে।
আসনে বসিতে প্রভু ডাকিবে তাদেরে।।
আসনে বসিলে প্রভু তারা ভাবে মনে।
আসনে বসিতে যেন শঙ্কা হয় কেনে।।
এত যে পণ্ডিত ছিল তর্ক বান নিয়ে।
সব তর্ক থেমে গেল প্রভুকে দেখিয়ে।।
ধীরে ধীরে প্রভু তবে বলে বহু কথা।
পণ্ডিতেরা সায় দিয়ে ঘন নাড়ে মাথা।।
মহানন্দে মহোৎসব হ’ল সমাপন।
অবশেষে বলিলেন পণ্ডিতেরগণ।।
“যার তরী শূন্য ভরে উড়ে যেতে পারে।
শ্রেষ্ঠ গুরু বটে তিনি শাস্ত্রের বিচারে।।
তার অন্ন-অন্ন নহে সী মহাপ্রসাদ।
সে মহাপ্রসাদ খেলে নাহি হয় বাদ।।”
অনর্থক হরিপালে বাদ দেয়া হ’ল।
বুঝিলাম হরিপাল শতগুণে ভালো।।
এত বলি পণ্ডিতেরা হ’য়ে কুতূহলী।
প্রভুকে প্রণাম করে হ’য়ে কৃতাঞ্জলি।।
শ্রীতারক মহানন্দ আর হরিপাল।
তিন ঢেউ একসঙ্গে ডুবাল ময়াল।।
মহানন্দ পাগলের ভাই একজন।
দশরথ নাম তার অতি মহাজন।।
তার পৌত্র মাধবেন্দ্র রহে ওড়াকান্দি।
শ্রীগুরুচাঁদের কৃপা করে তারে বন্দী।।
হরিপাল মাতাইল পালের ময়াল।
শালনগর বাতাসী ছিল যত পাল।।
শশধর পাল তার ভগিনী কুসুম।
বারুণী মিলায় তারা চোখে নাহি ঘুম।।
শ্রীগুরুচাঁদের আজ্ঞায় মিলায় বারুণী।
শ্রীহরি মন্দিরে সেবে দিবস রজনী।।
অমূল্যরতন পাল বাড়ী নড়াগাতী।
বড় ঠাকুরাণী যারে করিলেন সাথী।।
শ্রীহরিপালের পত্নী বড় ঠাকুরাণী।
ওড়াকান্দি যাতায়াত সদা করে তিনি।।
পুত্ররূপে সে অমূল্য সাথে সাথে ধায়।
প্রতি উৎসবের কালে ওড়াকান্দি যায়।।
চিন্তারাম নামে সাধু কামারের গ্রাম।।
যার গৃহে গিয়াছেন প্রভু গুণধাম।।
শালনগর গ্রামে বাস নামে রসমতি।
শ্রীগুরুচাঁদের পদে যার নিষ্ঠা অতি।।
পতি তার চন্দ্রকান্ত বিশ্বাস সুজন।
বিদ্যাধর গ্রামে বাস করিত সে জন।।
দেহ অন্তে তার সতী রসমতি ধনি।
পিতৃগৃহে আসিলেন সেজে কাঙ্গালিনী।।
দুই পুত্র কোলে দেবী পিতৃ গৃহে রয়।
শশী নামে ভ্রাতা তার অতি মহাশয়।।
শ্রীগুরুচাঁদের নামে করে ঠাকুরালী।
দিবানিশি মুখে তার হরি হরি বুলি।।
ভ্রাতা ভগ্নি এক সঙ্গে ওড়াকান্দি যায়।
গুরুচাঁদ পদে নিষ্ঠা রাখে অতিশয়।।
প্রভুর আজ্ঞায় পরে দেবী রসমতি।
শ্রীহরি মন্দির গড়ে করিয়া ভকতি।।
গুরুচাঁদ কৃপাগুণে বহু রোগী সারে।
‘হাজৎ’ আনিয়া দেয় প্রভুর গোচরে।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীউপেন্দ্র অতি ভক্তিমান।
কনিষ্ঠ নগেন্দ্র ভক্ত দাদার সমান।।
তারক চাঁদের ঢেউ লাগিল কোথায়?
ক্রমে ক্রমে বলি শোন সেই পরিচয়।।
মহানন্দ শ্রীতারক একসঙ্গে মেলা।
এক সঙ্গে প্রায় দোঁহে করে সব লীলা।।
তা’তে দেখি শ্রীতারক যারে যারে ধরে।
মহানন্দ সর্বস্থলে তারে দয়া করে।।
পদুমা নিবাসী যিনি যাদব মল্লিক।
হরিচাঁদ পদে যার দৃষ্টি ছিল ঠিক।।
লোহারগাতীর গ্রামে শ্রীযাদব ঢালী।
পূর্বে লিখিয়াছি যার ধন্য কার্যাবলী।।
তারকচাঁদের পদে আত্মসমর্পণ।
মহানন্দ করে দয়া তাঁহার কারণ।।
হরিলীলামৃত গ্রন্থ করাঙ্কিত করে।
গোস্বামীজী মহানন্দ এল তার ধারে।।
শিরে পদ রাখি তারে আশীর্বাদ দিল।
কেন্দে কেন্দে সে যাদব আকুল হইল।।
মহানন্দ শ্রীতারক হ’লে অন্তর্ধান।
পূর্বাপর শ্রীযাদব ওড়াকান্দি যান।।
গুরুচাঁদ অন্তে এবে প্রমথরঞ্জন।
মতুয়ার মহাসংঘ করেছে গঠন।।
শ্রেষ্ঠ এক স্তম্ভ তার যাদব গোস্বামী।
নতশিরে গোস্বামীর চরণেতে নমি।।
শ্রীকার্ত্তিক, গণপতি দুই পুত্র তার।
গণপতি বিয়া কৈল ঘৃতকান্দি পর।।
শ্রীরাধাচরণ মৃধা কুমুদের পিতা।
গণপতি হয় বটে তাঁহার জামাতা।।
প্রমীলা নামেতে কন্যা সরলা সুমতি।
প্রভুর আজ্ঞায় বিয়া করে গণপতি।।
মহানন্দে দেখে মত্ত হল হরিবর।
কবিরত্ন, কবিশ্রেষ্ঠ উপাধি যাঁহার।।
‘কবিগানে’ তারে চেনে সারা বঙ্গবাসী।
শেখে সব তারকের পদতলে বসি।।
তার খুল্লতাত ভাই নামে মনোহর।
শ্রীতারকে ধরি আসে ওড়াকান্দি ‘পর।।
শ্রীহরিবরের মাত্র এক পুত্র জানি।
কন্যা মধ্যে কনিষ্ঠারে শ্রেষ্ঠ বলে মানি।।
গোপাল সাধুর পুত্র নাম কাশীনাথ।
গুরুচাঁদ বিয়া দিল সেই কন্যা সাথ।।
সাবিত্রী নামিনী নারী অতি বুদ্ধিমতী।
গোপালচাঁদের প্রতি ছিল নিষ্ঠারতী।।
পতির আগেতে সতী লভিল মরণ।
কিছু পরে কাশীনাথ ত্যজিল জীবন।।
কবিবর হরিবর অতি মহাজন।
মতুয়া সংঘের তিনি শ্রেষ্ঠ একজন।।
চন্দ্র দিঘলিয়াবাসী নামেতে অক্ষয়।
ব্রহ্মবংশে অবতংশ শ্রেষ্ঠ মহাশয়।।
প্রেমের প্লাবন তারে ফেলিল বেড়িয়া।
তারকের ঢেউ লেগে পড়ে গড়াইয়া।।
মহানন্দ দিল তাল হইল বেহুঁশ।
উদাসী হইয়া গেল সোনার মানুষ।।
‘কুল গেল’ ‘কুল গেল’ কহে তার জাতি।
অক্ষয় বলিল “কেহ হয়ো না রে সাথী।।”
দমন করিতে সভা করে আয়োজন।
অক্ষয় দমন কিসে পাষণ্ড দলন।।
খাশিয়ালী গ্রামে বাস সে নবীন বসু।
যুগ্ম গুম্ফ মুখে তার যেন সিংহ শিশু।।
তারকেরে গুরু করে থাকে পদাশ্রয়।
তারকের সঙ্গে সঙ্গে কবিগান গায়।।
কায়স্থ বংশেতে জন্ম বংশেতে কুলীন।
কুল ছেড়ে প্রেমে মেতে হ’ল দীনহীন।।
কাথলী গ্রামেতে ঘর খুলনা জিলায়।
নিবারণ নামে সাধু সরল হৃদয়।।
তারকেরে গুরু করি গেল ওড়াকান্দি।
গুরুচাঁদ পদে ক্রমে প্রেমে হ’ল বন্ধী।।
বহু লোক মাতাইল মতুয়ার ধর্মে।
কথাতে ছিল না ধন্য, ধন্য ছিল ক্রমে।।
গুরুচাঁদ অন্তে সাধু পড়িল ধাঁধায়।
অল্পকালে পূর্বে তেহ দেহ ছেড়ে যায়।।
মৃত্যুঞ্জয় নামে সাধু মাটিয়ারগাতী।
নিবারণে মান্য করে রহে তার সাথী।।
দক্ষিণে বাদার দেশে গ্রাম হুকুড়ায়।
রমণী গোঁসাই ধন্য খুলনা জিলায়।।
তারকচাঁদের পদে আত্ম সমর্পিয়া।
ওড়াকান্দি গেল সাধু ভকতি করিয়া।।
বহু কৃপা শ্রীতারক করিলেন তারে।
তার গুণে গুরুচাঁদ তারে দয়া করে।।
বহু দেশে নাম ধর্ম করিল প্রচার।
খুলনা যশোরে আছে বহু শিস্য তার।।
তেরশত আটত্রিশ সালে দেহ রাখে।
তার পত্নী ফুলমালা নিষ্ঠা নিয়ে থাকে।।
ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীযতীন্দ্র বিশ্বাস সুজন।
‘ঠাকুর’ উপাধি বলি জানে সর্বজন।।
মতুয়া ধর্মেতে তেহ মত্ত সর্বদায়।
ফুলমালা দেবী সঙ্গে শিস্য বাড়ী যায়।।
মতুয়ার মহাসংঘে তিনি একজন।
স্তম্ভ শ্রেষ্ঠ বলি কীর্তি করেছে অর্জন।।
রমণীর শিস্য মধ্যে শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ যারা।
মতুয়া সংঘের স্তম্ভ সকলের তারা।।
লবণ গোলায় বাড়ী খুলনা জিলায়।
“বিহারী ঠাকুর” বলি যার পরিচয়।
শ্রীরাস বিহারী সাধু ভক্ত মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
রমণীর প্রতি তার আছে ইষ্ট নিষ্ঠ।।
তার গৃহে গুরুচাঁদ করেন গমন।
আনন্দে বিহারী তারে করিল পূজন।।
বলরাম জোদ্দার গঙ্গারামপুর।
প্রধান মতুয়া ভক্ত উপাধি ঠাকুর।।
রামচন্দ্র নামে সাধু উপাধি ঠাকুর।
গুরুচাঁদ পদে নিষ্ঠা রয়েছে প্রচুর।।
বটবেড়া গ্রামে ঘর শ্রীহরিচরণ।
রূপচাঁদ গোস্বামীর শিস্য সেইজন।।
ওড়াকান্দি প্রতি নিষ্ঠা বহু আছে তার।
মহেন্দ্র নামেতে সাধু বৈটাঘাটা ঘর।।
মালমারা গ্রামে ভক্ত শ্রীসুরেন্দ্র রায়।
ভক্তিমান সুপণ্ডিত সেই মহাশয়।।
পূর্ণচন্দ্র মিস্ত্রী বুড়ীরডাঙ্গা গাঁয়।
গুরুচাঁদে মান্য করে ওড়াকান্দি যায়।।
রামপাল গ্রামে বাস পূর্ণচন্দ্র নাম।
হরিপ্রেমে মাতোয়ারা সেই গুণধাম।।
বালক বয়সে তেহ আছিল দুরন্ত।
রমণী গোঁসাই তারে করিলেন শান্ত।।
শ্রীকালীচরণ নামে রামপালে বাস।
গুরুবলে রমণীরে করিল বিশ্বাস।।
ভগবতীপুরে বাস সন্তোষ কুমার।
গুরুচাঁদে মান্য করে স্বয়ং অবতার।।
তেলীখালী গ্রামে ঘর কালীপদ নাম।
হাটবাড়ী হরিপদ দুই গুণধাম।।
এইরূপ শত শত ভক্ত বহু রয়।
লিখিতে অসাধ্য তাহা গ্রন্থ-বৃদ্ধি ভয়।।
ফুলমালা দেবী সতী অতি নিষ্ঠাবতী।
যেমন আছিল পতি তেমনি সে সতী।।
“গুরুচাঁদ-চরিতের” মুদ্রণ কারণে।
বহু টাকা সেই দেবী দিয়াছেন এনে।।
পরিচালক সংঘে সভ্য যতীন্দ্র সুজন।
তার বহু ব্যাখ্যা করে যত ভক্তগণ।।
অন্ধ সাধু দ্বিজবর হীরা মহাশয়।
যশোহর জিলাধীনে চাচই’র গাঁয়।।
তারকচাঁদের কৃপা তার ‘পরে ছিল।
ভক্তিগুণে দ্বিজবর শক্তি লাভ পেল।।
উৎকট ব্যধিতে তার চক্ষু অন্ধ হয়।
ঠাকুরের কৃপাগুণে ঘুরিয়া বেড়ায়।।
শক্তিশালী সাধু ইচ্ছা যদি মনে করে।
শূন্যভরে যেত সাধু নদী পারাপারে।।
শ্রীগুরুচাঁদের পদে গাঢ় নিষ্ঠা ছিল।
তেরশত আটত্রিশে জীবন ত্যজিল।।
তালতলা গ্রামে বাস মহেশ সুজন।
তার ভ্রাতুষ্পুত্র নাম জানি বিচরণ।।
মহেশের গুণকীর্তি হইয়াছে লেখা।
কি করিল প্রভু যবে শেষে দিল দেখা।।
লাট দরবার হ’ল সে গোপালগঞ্জে।
বহুবিধ সম্মানাদি প্রভু তথা ভুজে।।
ফিরিবার পথে প্রভু গেল তালতলা।
অচল মহেশ সাধু নাহি তার চলা।।
‘দাদা’ বলি ডাক দিল প্রভু দয়াময়।
মহেশের দুই চোখে ধারা বয়ে যায়।।
নিজ হস্তে দুধ আম প্রভুরে খাওয়ায়।
দুধ আম খেয়ে প্রভু মহেশেরে কয়।।
“সন্ধ্যা যেন আসে দাদা বেলা ডুবে যায়।
শীঘ্র শীঘ্র এখনে ত’ দেশে যেতে হয়।।”
প্রভুর কথার ভাব নরে বোঝা দায়।
এক কথা বলে প্রভু দুই দিকে যায়।।
ভাবুক মহেশ ভাব বুঝিয়া তখন।
গুরুচাঁদ প্রতি চাহি বলিল বচন।।
“দেশে ত’ যাবই বটে তা’তে চিন্তা নাই।
কিন্তু এক কথা আমি ভাবিতেছি ভাই।।
যতকাল হরিচাঁদ গেছে দেশ হ’তে।
একটু বলেছি কথা শুধু তব সাথে।।
অজানা কোথায় যেন যাব এর পরে।
সেই দেশে কথা ক’ব বল কা’র ধারে?”
প্রভু বলে “যাও দাদা! কোন ভয় নাই।
পরে পরে একখানে হ’ব সব ভাই।।”
এর কিছু কাল পরে মহেশ মরিল।
এমন ভাবুক সাধু সে মহেশ ছিল।।
শ্রীচণ্ডী বৈরাগী নামে সাধু বটে ধন্য।
যার পুত্র সে নরেন্দ্র সবে করে মান্য।।
মল্লকাঁদি গ্রামে ঘর উপাধিতে রায়।
শ্রীগোপাল নামে ধন্য ধনী অতিশয়।।
প্রভুকে করিয়া মান্য বহু ধনী হ’ল।
প্রভুর চরণে তার দৃঢ় নিষ্ঠা ছিল।।
গোপাল সাধুর সঙ্গে নামের সমতা।
উভয়ে রাখিত বটে উভয়ের কথা।।
তার পুত্র সনাতন রায় মহাশয়।
পিতৃ মৃত্যু অন্তে এবে সংসার চালায়।।
তিনি আর শ্রীরাজেন্দ্র বিশ্বাস সুজন।
‘রাজসূয়’ যজ্ঞে সব করে আয়োজন।।
মহাধনী সে রাজেন্দ্র বিশ্বাস মহাশয়।
গৌরাঙ্গ বলিয়া সবে ‘রাঙ্গাকর্তা’ কয়।।
ওড়াকান্দি সর্বদায় করে যাতায়াত।
তিনি আর সনাতন থাকে সাথে সাথ।।
যাদব বিশ্বাস ছিল তালতলা গাঁয়।
প্রভুর অগ্রেতে তেহ দেহ ছেড়ে যায়।।
রাউৎখামারে আছে জানি এক মেয়ে।
ঠাকুরকে ভালবাসে সকলের চেয়ে।।
“দাড়িয়ার মেয়ে” বলি লোকে তারে কয়।
ভক্তিমতী নারী বলে জানি পরিচয়।।
রামতনু, যজ্ঞেশ্বর দুই মহাজন।
প্রভুর অগ্রেতে করে স্বলোকে গমন।।
যজ্ঞেশ্বর বিশ্বাসের জানি পরিচয়।
বেথুড়িয়াবাসী তিনি জ্ঞানী অতিশয়।।
রামতনু বাস করে পদ্মবিলা গাঁয়।
তার মত জ্ঞানী সাধু কম দেখা যায়।।
কৃষ্ণপুর, পদ্মবিলা যত ভক্ত রয়।
ক্রমে ক্রমে বলিতেছি সেই পরিচয়।।
বৈষ্ণব, স্বরূপ দাস, ঠাকুর সুজন।
শ্রীহরির ভ্রাতা এই দুই মহাজন।।
ওড়াকান্দি ছেড়ে করে পদ্মবিলা বাস।
সেই স্থানে ছাড়িলেন শেষের নিঃশ্বাস।।
সেই গ্রামে তাহাদের যত বংশধর।
সুখে বাস করিতেছে সবে পরস্পর।।
এই বংশে যজ্ঞেশ্বর ঠাকুর সুজন।
শক্তিশালী লোক এক ছিল সেইজন।।
শ্রীহরিচাঁদের পদে পড়িল কাঁদিয়া।
কিছু শক্তি দিল প্রভু করুণা করিয়া।।
সেই শক্তি বলে বহু রোগারোগ্য করে।
কিছুকাল পরে তেহ গেল বটে মরে।।
এই বংশে লোক সংখ্যা যদিও প্রচুর।
একমাত্র বি.এ পাশ বিজয় ঠাকুর।।
অদ্বৈত ঠাকুর নামে এই গৃহ হ’তে।
গোপাল সাধুকে দেখে হরিনামে মাতে।।
শ্রীমুখেতে আজ্ঞা প্রভু দিলেন যখনি।
নিজ ধামে শ্রীগোপাল মিলায় বারুণী।।
সেই বারুণীতে যায় অদ্বৈত ঠাকুর।
দেখিয়া সাধুর ভাব প্রেমে ভরপুর।।
ব্যবসায় উপলক্ষ্যে গিয়াছিল সেথা।
গোস্বামীর ভাবে তার হেঁট হ’ল মাথা।।
দেশে আসি গুরুচাঁদে অন্যভাবে দেখে।
মতুয়ার ভাব ক্রমে লয় সব শিখে।।
এবে দেখ দেশে দেশে করিছে প্রচার।
দিনে দিনে বাড়িতেছে মহিমা তাঁহার।।
প্রমথরঞ্জনে মান্য করে অতিশয়।
মতুয়া ভক্তের ভক্তি করে সর্বদায়।।
ধন্য ভক্ত কৃষ্ণপুরে তারিণী চরণ।
যার গৃহে গুরুচাঁদ করেন গমন।।
ব্রহ্মদেশে করিতেন ডাক্তারি চাকুরী।
গুরুচাঁদ পদে তার নিষ্ঠা ছিল ভারী।।
তাঁহার তৃতীয় ভ্রাতা নামেতে বিপিন।
গুরুচাঁদ পদে নিষ্ঠা রাখে চিরদিন।।
দেশে দেশে প্রভু যেথা করিত ভ্রমণ।
বিপিন সঙ্গেতে প্রায় করিত গমন।।
পাটীকেলবাড়ী গাঁয় ষষ্ঠী বাবু নাম।
গুরুচাঁদে রাখে নিষ্ঠা সেই গুণধাম।।
প্রভুর অগ্রেতে সাধু জীবন ত্যজিল।
জ্ঞানে গুণে কিবা প্রেমে ভাগ্যবান ছিল।।
কৃষ্ণপুরবাসী সাধু নাম সনাতন।
সহজ সাধক ছিল সেই মহাজন।।
কিছুকাল পূর্বে তেহ ত্যজিল জীবন।
মৃত্যুকালে হরিনাম করে উচ্চারণ।।
তালতলা গ্রামে ঘর নাম বলরাম।
উদাসীর বেশে সদা থাকে গুণধাম।।
তার মাতা ছিল বটে বহু গুণবতী।
ঠাকুরের পদে তার ছিল নিষ্ঠা রতি।।
একদিন সে বলাই ভাবে মনে মন।
দেখা যদি দিত মোরে প্রভু হীরামন।।
ভক্তের বাসনা প্রভু পুরাল অচিরে।
হীরামনে দেখা পেল ঠাকুরের ধারে।।
মল্লকাঁদিবাসী অভিমন্যু বিশ্বাস।
দোকান করিয়া করে ওড়াকান্দি বাস।।
এসব যতেক ভক্ত পাই পরিচয়।
গোলক, তারক, মহানন্দের আশ্রয়।।
গোলক করিত লীলা গিয়া সে দক্ষিণে।
উঠিল কল্লোল সেথা প্রেমের তুফানে।।
গঙ্গাচর্ণা গ্রামে ছিল কার্ত্তিক সুজন।
গোলকের বরে পুত্র জন্মে একজন।।
প্রেমিক সাধক কবি অশ্বিনী গোঁসাই।
গোলকের বরে জন্ম সবে জানে তাই।।
এই গ্রামে ছিল নাম শ্রীরাইচরণ।
অন্য শ্রেষ্ঠ ভক্ত ছিল বিশ্বাস মদন।।
মদনের গৃহে প্রতি শ্রাবণ মাসেতে।
মহা উৎসব হ’ত প্রতি বছরেতে।।
মদনের কাছে ভাব দেবীচাঁদ পায়।
বাড়ী যার বরিশাল বানিয়ারী গাঁয়।।
দেবীর গুণের কথা কহনে না যায়।
তার ঢেউ ধেয়ে চলে জিলায় জিলায়।।
দেবীর তরঙ্গ হ’ল সর্বাপেক্ষা ভারী।
বিস্মৃত হইল ধর্ম গুণেতে তাহারি।।
মহা শক্তিশালী দেখি যত শিস্য তার।
শিস্যের শিস্য যে কত কি বলিব আর।।
দেবীর তরঙ্গ সঙ্গে প্রভু দিল তাল।
গর্জিয়া উঠিল তাল আকাশ-পাতাল।।
জগত জুড়িয়া চলে প্লাবনের ধারা।
গোপাল, বিপিন তা’তে হ’ল মাতোয়ারা।।
গোপালের সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল যারা।
তাহাদের কথা পূর্বে লিখিত হইল।।
গোপাল তরঙ্গে ডুবে কোন কোন দেশ।
সে সব বলিব পরে করিয়া বিশেষ।।
বিপিনের ঢেউ লাগে বরিশাল জিলা।
নরনারী তারে দেখে হইল উতলা।।
যেথা যায় সে বিপিন বহু লোক ধায়।
কি জানি তাহারা ঘোরে কিসের নেশায়।।
রামনারায়ণ নামে উলুবেড়ে ঘর।
উপাধি যাহার বটে হয় সমাদ্দার।।
বিপিনেরে গুরু করি শক্তি লাভ হয়।
তারে কৃপা করিলেন প্রভু দয়াময়।।
বাটনাতলাতে ঘর অমৃত মেস্তরী।
ধন্য হ’ল বিপিনেরে গুরু পদে বরি।।
নামেতে দেবেন্দ্র ওঝা সানকীভাঙ্গা গাঁয়।
তিনি এসে বিপিনের লভে পদাশ্রয়।।
অঘোর নামেতে ভক্ত আছে আর জন।
ভরতকাঠিতে বাস অশ্বিনী সুজন।।
শ্রীরাসবিহারী নামে সেই গ্রামে বাস।
গুরুচাঁদে পূর্ণব্রহ্ম করেন বিশ্বাস।।
কামিনী সরকার বাস করে কুরলতলা।
বিপিনের শিস্য তিনি দেল তার খোলা।।
খুলনা জিলা মধ্যে লক্ষ্মীকাটি গাঁয়।
গোস্বামী নকুল চন্দ্র অতি মহাশয়।।
তাঁহার জীবন বৃত্তান্ত হয়েছে লিখন।
এবে বলি তারে ধরে এল কোনজন।।
পাটগাতী গ্রামে ঘর নাম পুটিরাম।
তারে আনে নাম ধর্মে সেই গুণধাম।।
“গউর ঠাকুর” বলি এবে সবে বলে।
নাম প্রচারিতে সদা দেশে দেশে চলে।।
নকুল গোস্বামী তারে করিয়া গ্রহণ।
শ্রীগুরুচাঁদের পদে করিল সমর্পণ।।
গুরুচাঁদ আজ্ঞা দিল প্রচারিতে নাম।
যশোহরে চলে সদা সেই গুণধাম।।
গাছবাড়ী নিষ্ঠা মনে মহাদেব পাল।
সুন্দর স্বভাব তার হৃদয় কোমল।।
গুরুচাঁদ প্রতি তার নিষ্ঠা অতিশয়।
“গউর ঠাকুর” তা’তে এ ভাব দেখায়।।
উৎসবে যুবক ভক্ত অমূল্য নামেতে।
মহাদেব বাবু তারে রাখে সাথে সাথে।।
ওড়াকান্দি সর্বদায় যাতায়াত করে।
প্রমথরঞ্জনে ভক্তি করে নিষ্ঠা ভরে।।
মতুয়ার মহাসংঘে এদের মতন।
উৎসাহী কর্মীভক্ত আছে অল্পজন।।
আগে বটে সে ‘গউর’ বিয়া করেছিল।
কিছুদিন পরে সেই পত্নী মারা গেল।।
পুনরায় বিভা তেহ না করিল আর।
এবে সেজে রহিয়াছে সে চিরকুমার।।
মতুয়া সংঘের কাজ বহু সেই করে।
রোগারোগ্য করিবারে শক্তি বটে ধরে।।
কোলা পাটগাতী গ্রাম খুলনা জেলায়।
নিত্যানন্দ নামে ভক্ত এক সেথা রয়।।
তার খুড়া শ্রীরাজেন্দ্র মণ্ডল উপাধি।
ঠাকুরের পদে নিষ্ঠা আছে নিরবধি।।
নিত্যানন্দ আছে এবে হয়ে ব্রহ্মচারী।
নকুলের পদাশ্রিত শিস্য বটে তারি।।
রাজেন্দ্রের ভক্তি গুণে প্রভু গুরুচান।
দয়া করি দয়াময় তার গৃহে যান।।
জয়ার আবাদ গ্রামে পরেশ সদ্দার।
শ্রীগুরুচাঁদের পদে দৃঢ় নিষ্ঠা তার।।
জ্ঞানী মানী ধনী তিনি ভক্ত নিষ্ঠাবান।
দয়াময় গুরুচাঁদ তার গৃহে যান।।
প্রভুকে প্রণামী তিনি দেন শত টাকা।
কথা কাজে কোন খানে নেই তার ফাঁকা।।
জয়ার আবাদ বাসী শ্রীরাজেন্দ্র রায়।
তার গৃহে মহাপ্রভু গুরুচাঁদ যায়।।
পাটগাতীবাসী ভক্ত সে রামপ্রসাদ।
দয়া করে তার গৃহে যায় গুরুচাঁদ।।
আমবাড়ীবাসী নাম জানি যে কৈলাস।
হরিভক্ত সেই জন উপাধি বিশ্বাস।।
তার গৃহে দয়াময় পদার্পণ করে।
তার নিষ্ঠা ভক্তি আছে প্রভুজীর পরে।।
নকুলের দাদা যার নাম পঞ্চানন।
জ্ঞানী গুণী ধনী ভক্ত তিনি একজন।।
ফরিদপুরের মধ্যে কান্দি গ্রাম রয়।
“শরৎ ঠাকুর” বলি তার পরিচয়।।
পিতা শিবচন্দ্র মাতা বসন্ত কুমারী।
ঠাকুরের পদে বটে নিষ্ঠা তার ভারী।।
বিনা দায়ে ভক্ত হ’য়ে প্রভুকে পূজিল।
প্রভুর কৃপায় তার শক্তি লভ্য হ’ল।।
নাম ধর্ম দেশে দেশে করিছে প্রচার।
প্রমথরঞ্জনে আছে দৃঢ় নিষ্ঠা তার।।
মতুয়া সংঘের কার্যে বড়ই উৎসাহী।
আনন্দে করিছে কাজ অলসতা নাহি।।
উপাধিতে রত্ন তার নামটি প্রসন্ন।
প্রভুর কৃপায় তিনি ভক্ত বটে ধন্য।।
শ্রীহরি মন্দির করে প্রভুর আদেশে।
প্রতি উৎসবের কালে ওড়াকান্দি আসে।।
তার পুত্র সে দেবেন্দ্র ভকত সুজন।
শরতের সঙ্গে সদা ফিরে সেই জন।।
শরতের গৃহে বটে শ্রীমন্দির রয়।
হরি-গুরুচাঁদ মূর্তি সেথা পূজা হয়।।
এবে বলি অন্য এক ভক্ত পরিচয়।
কাঞ্ছিরাম নাম এবে ‘কাশীরাম’ হয়।।
গ্রন্থপাঠ কাশীরাম করেন মধুর।
‘কাশীরাম’ নাম তাই দিলেন ঠাকুর।।
বনমালী নামে তার পিতা মহাশয়।
সরল সহজ তার ভক্তি অতিশয়।।
আদিবাস সেনদিয়া করিলেন তিনি।
হরি নগরেতে পরে আসিলেন জানি।।
তার পুত্র কাশীরাম বড়ই সরল।
ভক্তি গুণে প্রভু দিল শ্রীপদ-কমল।।
তেরশ’ তিরিশ সালে ওড়াকান্দি যায়।
দেখা মাত্রে প্রভু যেন তারে চিনে লয়।।
সগোষ্ঠী সকলে তাই হরিভক্ত হয়।
নিজ গৃহ তুল্য সদা ওড়াকান্দি রয়।।
প্রমথরঞ্জন যবে ভোটের কারণে।
বহু চেষ্টা করিলেন যেতে নির্বাচনে।।
বহুদিন কাশীরাম ওড়াকান্দি যায়।
তার ভক্তি গুণে প্রভু তার বাধ্য রয়।।
মতুয়া সংঘের কার্যে সেই কাশীরাম।
সতত করিছে চেষ্টা না করি বিশ্রাম।।
মোল্লাহাট থানা মধ্যে গ্রাম হিজলায়।
সাধু ভক্ত এক সেথা নিত্যানন্দ রায়।।
কবিরাজী করিতেন সেই মহাশয়।
পরে যবে ওড়াকান্দি হইল উদয়।।
প্রভু কয় “কবিরাজী হবে না করিতে।
প্রচার কর গে নাম এ বিশ্ব জগতে।।”
তার পত্নী এলোকেশী অতি ভক্তিমতী।
শ্রীমন্দিরে দেখে তিনি সত্যভামা পতি।।
আন্ধারমানিক গ্রাম খুলনা জিলায়।
সেথা এক ভক্ত নাম তারাচাঁদ রায়।।
শ্রীগুরুচাঁদের পদে নিষ্ঠা অতিশয়।
তার প্রতি কৃপা করে প্রভু দয়াময়।।
দক্ষিণেতে প্রভু যবে করেন গমন।
সে তারাচাঁদের গৃহে যান সর্বক্ষণ।।
পরম বিশ্বাসী সাধু ছলাকলা নাই।
তার মত অন্য এক ভক্ত সেথা পাই।।
শ্রীনাথ বলিয়া নাম উপাধিতে মাতা।
এখনে বলিব আমি তার কিছু কথা।।
গুরুচাঁদে মান্য করে স্বয়ং ভগবান।
সব উৎসবের কালে ওড়াকান্দি যান।।
মতুয়া সংঘের কার্যে বড়ই আগ্রহ।
স্তম্ভরূপে সর্বদায় কাজ করে তেহ।।
নিষ্ঠাবান নিরলস সহজ সরল।
ছলাকলা নাহি জানে নহেক চপল।।
বহুস্থানে নাম ধর্ম করিছে প্রচার।
প্রমথরঞ্জনে আছে দৃঢ় নিষ্ঠা তার।।
আন্ধারমানিকে ধন্য এই দুই জন।
এবে শোন অন্য অন্য ভক্ত বিবরণ।।
রামকৃষ্ণ নামে সাধু ঝাঙ্গালিয়া গাঁয়।
সরল সহজ সাধু নিষ্ঠা অতিশয়।।
পুত্র তার গেল মারা এগার বছরে।
মহাদুঃখী রামকৃষ্ণ সদা অশ্রু ঝরে।।
ইতি উতি ভাবি সাধু ওড়াকান্দি যায়।
কেন্দে গিয়ে পড়িলেন ঠাকুরের পায়।।
সকল শুনিয়া প্রভু তারে কৃপা করে।
ওড়াকান্দি বাস করে কিছুদিন পরে।।
ঠাকুরের আজ্ঞা পেয়ে মহোৎসবে যায়।
ফকিরের সাথে সেথা কত বাদ হয়।।
প্রভুর কৃপায় জয়ী রামকৃষ্ণ হয়।
দেশবাসী এসে সবে পড়ে তার পায়।।
সরল বিশ্বাসী ছিল সেই মহাশয়।
আচারে বিচারে দিত সেই পরিচয়।।
তেরশ’ আটচল্লিশ সালে দেহ ছেড়ে গেল।
সরল উদার সাধু রামকৃষ্ণ ছিল।।
সুধন্য বাইন নামে ঘৃতকান্দি গাঁয়।
নিষ্ঠাবান ভক্ত বটে সেই মহাশয়।।
একবার ওড়াকান্দি আসিবার কালে।
গোপালের নৌকা এল রামদিয়া খালে।।
সাধুকে দেখিবে বলে সুধন্য ছুটিল।
সাধুকে দেখিয়া তার প্রাণে শান্তি এল।।
মহাসাধু শ্রীগোপাল চিনিল তাহারে।
বলে তুমি খেতে দিতে পার কি আমারে।।
সুধন্য স্বীকার করে আসিলেন বাড়ী।
বাড়ী এসে আয়োজন করে তাড়াতাড়ি।।
কোন ভাবে কিবা হ’ল কেহ নাহি জানে।
সুধন্য বুঝিল হ’ল গোপালের গুণে।।
তদবধি সুধন্যের এই আচরণ।
লক্ষ্মীখালী দল সেথা করেন ভোজন।।
ঠাকুরের প্রতি নিষ্ঠা রাখে সর্বদায়।
প্রমথরঞ্জনে ভক্তি করে অতিশয়।।
গোপালচাঁদেরে মান্য করে ‘গুরু’ বলে।
যেই ভাবে বলে তিনি সেই ভাবে চলে।।
আদিত্য নামেতে এক ভকত সুজন।
ঘৃতকান্দি গ্রামে জন্ম লয় সেই জন।।
তার কথা পূর্বে আমি বলিয়াছি কিছু।
এবে এক কথা শুন যাহা শুনি পিছু।।
লক্ষ্মীখালী যাবে ছিল আদিত্যের আশা।
আশা পূর্ণ নাহি হতে ছাড়ে দেহ বাসা।।
গুরুচাঁদ বলিলেন শ্রীমৎ গোপালে।
“তোমার বংশেতে জন্ম লবে এক ছেলে।।
ঘৃতকান্দির আদিত্য যাবে তোর ঘরে।
ছেলে হলে সেই কথা জানায়ো আমারে।।”
গোপালের পুত্র বধূ নামেতে তপতী।
এ সময়ে সেই দেবী ছিল গর্ভবতী।।
সেই গর্ভে হ’ল পুত্র নামেতে ভূপাল।
তারে পেয়ে মহাসুখী হল শ্রীগোপাল।।
ঘৃতকান্দি আদিত্যের মাতা যেবা রয়।
মা মা বলি ডাকে তারে ভূপাল মশায়।।
সেই নারী যেই কালে দেহ ছেড়ে গেল।
বহু দুঃখে সে ভূপাল অনেক কান্দিল।।
আশা যদি থাকে মনে তাহা নাকি হয়।
ভূপালের কার্যে তার হয় পরিচয়।।
কি জানি কি করে প্রভু কিছু নাহি জানি।
সামান্য জ্ঞানেতে বল কতটুকু চিনি।।
কোন খানে কোন ভাবে কোন শক্তি রয়।
শক্তিদাতা বিনা বল কেবা তাহা কয়?
গোপাল সাধুর কীর্তি দেবে অগোচর।
এর পরে শোন সবে সেই সমাচার।।
তারে ছুয়ে যেই দেশে যেবা ভক্ত হ’ল।
মহাশক্তিশালী তারা সবে জানে ভালো।।
ক্রমে ক্রমে বলিতেছি সেই পরিচয়।
কি জন্যেতে সে গোপাল সর্বশ্রেষ্ঠ হয়।।
গোপাল তরঙ্গ ছোটে দুকুল ডুবায়ে।
তর্কবাদী ধনী মানী গেল রে ভাসিয়ে।।
গোপালে দেখিয়া সবে লাগে চমৎকার।
পশুপাখি সবে মানে মানব কি আর।।
আসিল দুরন্ত চক্র ভোলার ঘোলায়।
যারে ধরে তারে মারে নৌকা বাওয়া দায়।।
কুলে এসে পশু ধরে জলে টেনে লয়।
সুদীর্ঘ তনুটি তার দেখে লাগে ভয়।।
বিকট গর্জন করে জলেতে ভাসিয়া।
লাগিল বিষম ভয় কুমীর দেখিয়া।।
নদীতটে ভয়ে ভয়ে কেহ নাহি যায়।
সর্বদা সশঙ্ক চিত্তে সবে চেয়ে রয়।।
একদিন দ্বিপ্রহরে ভক্তগণে ল’য়ে।
আসিল গোপাল সাধু ভ্রমণ করিয়ে।।
প্রশস্ত সে ভোলা নদী পড়িয়াছে চর।
পার হ’তে পারে বটে কাটিলে সাঁতার।।
জোয়ার হয়েছে গাঙ্গে ডাকিয়াছে বান।
বিষম পাকেতে জলে খরস্রোত টান।।
নৌকাহীন নদীতটে গোপাল আসিল।
ভক্তগণে সঙ্গে ল’য়ে ঝাঁপায়ে পড়িল।।
“জয় হরি-গুরুচাঁদ” গোপালের ধ্বনি।
নাচিয়া উঠিল যত মতুয়া বাহিনী।।
দুই ভাগ নদী পার এক ভাগ আছে।
এমন সময় কে ঐ ভাসিয়াছে কাছে।।
দুরন্ত কুম্ভীর আসি জলেতে ভাসিল।
বহুত শিকার দেখি আনন্দে ছুটিল।।
সে সময়ে মতুয়ার কি যে ভাব হ’ল।
যারা সঙ্গে ছিল মাত্র তারা জানে ভালো।।
মহা ভয়ে তারা সবে করিল চিৎকার।
গোপালেরে বলে বাবা রক্ষা নাহি আর।।
গোপাল বলিল “কেহ নাহি যাবে মারা।
এক সঙ্গে উচ্চ রবে হরি বল তোরা।।
বিপদভঞ্জন নাম বলরে বদনে।
কুমীর ত তুচ্ছ কথা ছোঁবে না শমনে।।”
এত বলি যেই ধারে ভাসিল কুমীর।
সেই ধারে সাঁতরায় গোপাল সুধীর।।
চিলে যদি ছোঁ মারিয়া ছানা নিতে চায়।
হংসী যথা ডানা তলে ছানা ঢাকা দেয়।।
বিপদের বোঝা নিজে স্কন্ধেতে করিয়া।
ডানাতলে রাখে তার সন্তান ঢাকিয়া।।
সেই ভাবে শ্রীগোপাল ভক্তে রেখে বায়।
যে ধারে কুম্ভীর ভাসে সেই ধারে যায়।।
ভক্তগণে এক সঙ্গে দিল হরি ভীর।
ধ্বনি শুনি থমকিয়া রহিল কুম্ভীর।।
ভক্তগণে যত বলে বল হরি বল।
কুম্ভীর ভাসাল তার দেহটি সকল।।
ভক্তগণে সাঁতারিয়া চলিয়াছে জলে।
সঙ্গে সঙ্গে সে কুমীর সেই দিকে চলে।।
প্রভুর লীলার তত্ত্ব কিছু নাহি জানি।
শুধু দয়া পাই বটে তারে নাহি চিনি।।
ভক্ত প্রতি কত দয়া নাহিক তুলনা
তা’ না হ’লে কভু হয় এমন ঘটনা?
ভক্তের পরীক্ষা নিতে পাঠায় বিপদ।
সে বিপদ পরে হয় পরম সম্পদ।।
ভক্তে নাশিবারে এল দুরন্ত কুম্ভীরী।
শেষে সাথে চলে যেন ভক্তের প্রহরী।।
অল্পজলে আসি পুনঃ কহিল গোপাল।
“প্রাণ ভয়ে বল তোরা বল হরি বল।।”
দুই নল দূরে জেগে রহিল কুমীর।
তার দিকে চাহিলেন গোপাল সুধীর।।
উচ্চরবে ভক্তগণে হরি! হরি! করে।
কুমীর ভাসাল দেহ জলের উপরে।।
জলের উপরে দেখ কুম্ভীর ভাসিল।
গোপালের রূপ দেখে যেন রে কান্দিল।।
আর বার ওড়াকান্দি শ্রীগোপাল যায়।
দৈবক্রমে পা’ রাখিল সাপের মাথায়।।
দুরন্ত ফণিনী তাহা সহ্য নাহি করে।
বিষম দংশন করে শ্রীপদ উপরে।।
“ও বাবা” বলিয়া সাধু হাঁটিয়া চলিল।
সঙ্গে যারা তারা কিছু বুঝিতে নারিল।।
একে রাত্রি তা’তে দেখ ঘোর অন্ধকার।
দুই ক্রোশ পথ তারা হ’ল অগ্রসর।।
বেতকাটা গ্রামে তার মাতুলের বাড়ী।
উপস্থিত হইলেন সেথা তাড়াতাড়ি।।
মাধব ছুটিয়া যবে নিকটে আসিল।
সেইকালে শ্রীগোপাল সকল বলিল।।
আলো ধরে তার পরে চুল টেনে টেনে।
বাহির করিল দন্ত পরে কয় জনে।।
হরি বলে কান্দে সাধু ধারা ব’য়ে যায়।
বাড়ী শুদ্ধ নরনারী কেন্দে পড়ে পায়।।
এবে শোন কি করিল দুরন্ত ফণিনী।
দংশন করিয়া শেষে বুঝিল নাগিনী।।
হরিভক্ত মহাজনে করেছি দংশন।
কর্তব্য আমার তবে ত্যজিতে জীবন।।
দংশনের স্থান হ’তে গিয়া কিছু দূরে।
শরীর বিস্তার করি সর্প গেল মরে।।
সেই পথে পরদিন বহু ভক্ত যায়।
মরেছে দারুণ সর্প দেখিবারে পায়।।
হিংস্র জন্তু মান্য শুধু নাহি করে তায়।
তারা জানে শ্রীগোপাল পরম আশ্রয়।।
আর বার বেতকাটা হালদার বাড়ী।
সামাজিক লোক যত করে তার আড়ি।।
হুড়কা নিবাসী নাম জানি সীতানাথ।
ঘটিল এসব কিছু তাহার সাক্ষাৎ।।
ভক্তগণে সঙ্গে করি গোপাল বসিল।
নানা জনে নানা কথা কহিতে লাগিল।।
বসিয়াছে পূর্বদিকে শ্রীগোপাল সাধু।
আর কেহ নহে সেথা মতুয়ারা শুধু।।
সামাজিক লোক যত বসে অন্য ধারে।
সভাপতি সীতানাথ বসিয়া চেয়ারে।।
গোপালের ছোট মামা নাম সোনারাম।
জ্যেষ্ঠ ছিল নীলমণি অতি গুণধাম।।
সদাচারী সাধু বলি মানিত সকলে।
প্রাণ দিয়ে ভাল তেহ বাসিত গোপালে।।
সোনারাম আছে বেঁচে নীলমণি নাই।
তার গৃহে সভাস্থানে বসিয়া গোঁসাই।।
উত্তীর্ণ হইল সন্ধ্যা এমন সময়।
বিষধর সর্প এক আসিয়া উদয়।।
দক্ষিণেতে সামাজিক লোক বসে ছিল।
তারমধ্যে সেই সর্প উপস্থিত হ’ল।।
মহাভয়ে লোকজন উঠিয়া দাঁড়ায়।
তাহা দেখি সর্প ছুটে পূর্ব দিকে ধায়।।
ভয় পেয়ে মতুয়ারা উঠিতে চাহিল।
ক্রোধ ভরে ডাক দিয়া গোপাল কহিল।।
“এত যদি ভয় প্রাণে ওরে অভাজন!
চুল রেখে মতো’ হ’লি কিসের কারণ?”
স্থাণুবৎ মতুয়ারা বসিয়া পড়িল।
মতুয়ার গাত্রোপরে সে সর্প উঠিল।।
কোনখানে নাহি থেমে চলিতে লাগিল।
গোপালের পদতলে আসিয়া থামিল।।
“সাপ কোথা” “সাপ কোথা” সবে তাই কহে।
অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে বসিতে না চাহে।।
পরে সাধু সর্প প্রতি ডাক দিয়া কয়।
“দয়া করে এবে তুমি যাহ নিজালয়।।”
সকলে দেখিল সর্প ধীরে ধীরে যায়।
আলো ধরে জঙ্গলেতে পৌছাইয়া দেয়।।
এইরূপ কীর্তি কত শত শত আছে।
হইতেছে, হ’বে আর কত হইয়াছে।।
লৌকিক জীবনে আজ পরাহ্ণ বেলায়।
সাংসারিক শোক তাপ এসেছে সেথায়।।
সতী লক্ষ্মী মাতা দেবী কাঞ্চন জননী।
ষষ্ঠ বর্ষ পূর্বে স্বর্গে গেলা চলি জানি।।
তার পূর্বে কাশীনাথ কনিষ্ঠ তনয়।
অকালে চলিয়া গেল রোগ যন্ত্রণায়।।
দু’টি পুত্রবধূ জানি সাবিত্রী, তপতী।
দুইজনে চলে গেল পিছে রেখে পতি।।
তিন কন্যা মধ্যে দু’টি গেছে পরপারে।
আঘাতে আঘাত তার এল পরে পরে।।
সর্বাপেক্ষা গুরুতর আঘাত ভীষণ।
পুণ্যচ্ছবি পৌত্র বধূর অকাল মরণ।।
শ্রীহরষিতের পুত্র আছে দুই জন।
ভূপাল, দেপাল নাম জানে সর্বজন।।
ভূপালের বিয়া হয় বরিশাল জিলা।
শান্তি দেবী নামে কন্যা গুণেতে উজলা।।
রূপে শান্তি গুণে শান্তি শান্তি সর্বস্থানে।
ঠিক যেন শান্তিময়ী শিবের ভবনে।।
তার গুণে শ্রীগোপাল শান্তি পেল প্রাণে।
রাক্ষসী নিয়তি তাহা লিখে না’ বিধানে।।
তেরশত আটচল্লিশ বর্ষ শেষ দিনে।
মর্ত ছাড়ি শান্তি দেবী গেল নিজ স্থানে।।
অসহ্য দুঃখের বজ্র শ্রীগোপাল সয়।
শান্তি বেঁচে নাই বল কোথা শান্তি পায়?
সুপক্ক অমৃত ফল তুল্য সাধুজন।
সবে চায় তার রস করে আস্বাদন।।
দেবতার যজ্ঞে লাগে নরের সেবায়।
অগোচরে কত কীট দেহ মধ্যে খায়।।
সকলের তরে যারা করে আত্মদান।
তাদের কারণে প্রভু করে এ বিধান।।
এই যে বিরাট তরু জাগে উচ্চঃ শির।
এই যে অগাধ সিন্ধু দৃষ্টিহীন তীর।।
কোথা কোন শাখা তার কত দূরে রয়?
কোন শাখা উছলিয়া প্রান্তর ডুবায়।।
লক্ষ লক্ষ জীব ডাল করিয়া আশ্রয়।
আতপে পাদপ-তলে প্রাণে রক্ষা পায়।।
সংসার মরুর তাপে তাপিত মানব।
সু-স্নিগ্ধ বারিতে ডুবে তাপ ভুলে সব।।
বৃহৎ বৃহৎ শাখার কিছু বিবরণ।
বর্ণনা করিব বন্দি’ শ্রীগুরু-চরণ।।
ধন্য ভক্ত শ্রেষ্ঠ সাধু শ্রীনবকুমার।
‘ঠাকুর’ বলিয়া জানি উপাধি যাহার।।
আজীবন ব্রহ্মচারী সাধনে নিপুণ।
জ্ঞানে প্রেমে সর্বখানে যার বহুগুণ।।
“বসুধৈব কুটুম্বকম” যার ব্যবহার।
গুরুচাঁদ রূপ সদা হৃদে গাঁথা যার।।
আদি পর্বে শ্রীগোপাল করুণা করিল।
গুরুচাঁদ পদে তার ভক্তি-অর্ঘ দিল।।
চতুর্দশ বর্ষাবধি গুরুচাঁদ সঙ্গে।
সেবিল চরণ তার সদা মনোরঙ্গে।।
লীলাসাঙ্গ পূর্বে প্রভু তারে সব কয়।
সে বাক্য বহিয়া শিরে বহিয়া বেড়ায়।।
শ্রীগোপাল সঙ্গে এবে করেছে মিলন।
আদর্শ ‘মতুয়া’ বটে সেই একজন।।
মতুয়া সংঘের লাগি নিদ্রা নাই চোখে।
শত শত সু-কল্পনা জাগে তার বুকে।।
“গুরুচাঁদ-শ্রীপ্রমথে” করে এক জ্ঞান।
দিবানিশি সম ভাতি নাহি হয় ম্লান।।
শ্রীগোপাল অনুষঙ্গ কুমুদরঞ্জন।
তেজপূর্ণ ব্রহ্মচারী সেই এক জন।।
ঘৃতকান্দিবাসী সাধু শ্রীরাধাচরণ।
কুমুদরঞ্জন তার দ্বিতীয় নন্দন।।
তের শ’ চৌত্রিশ সালে শিক্ষক সাজিয়া।
লক্ষ্মীখালী সে কুমুদ উপস্থিত গিয়া।।
কর্মগুণে দিনে দিনে কুমুদরঞ্জন।
গোপালের গৃহে হ’ল “আপনার জন”।।
কাশীনাথ দেহ অন্তে কুমুদ তখন।
শ্রীগোপালে সেবা করে পুত্রের মতন।।
সংসারের আয় ব্যয় কিংবা ব্যবসায়।
সকলের কর্তা এবে “মাস্টার মশায়”।।
গোপালের পরিবারে হ’য়েছে অভিন্ন।
শান্তি নাহি পায় প্রভু তার সেবা ভিন্ন।।
সরল সাধক বীর তেজে-ভরা প্রাণ।
তার গুণে বাধ্য সদা শ্রীগোপাল চান।।
শ্রীনবকুমার আর কুমুদরঞ্জন।
শ্রীগোপালচাঁদের দুই বাহুর মতন।।
কুমুদের কর্মশক্তি বড়ই প্রবল।
যেথা যায় সেথা করে একাই সকল।।
“মতুয়া সংঘের” লাগি উৎসর্গিত প্রাণ।
দিবানিশি তাই চিন্তা তাই ধ্যান জ্ঞান।।
প্রমথরঞ্জনে নিজ শিরেতে ধরিয়া।
গোপালচাঁদের দয়া হৃদয়ে ভরিয়া।।
ইষ্ট-নিষ্ঠা পবিত্রতা করিয়া ধারণ।
মতুয়া সংঘের বীর কুমুদরঞ্জন।।
শ্রীপূর্ণচরণ সাধু বুড়বুড়ে গায়।
মৌলিক উপাধি যার ছিল পরিচয়।।
গোপালের শ্রেষ্ঠ শিস্য কহে সর্বজন।
তার কীর্তি কথা পূর্বে হ’য়েছে লিখন।।
অভয় চরণ রায় ধনেখালী ঘর।
গোপালের পদে বহু নিষ্ঠা আছে তার।।
পতি পত্নী এক সঙ্গে করেন সাধন।
শক্তিশালী ভক্ত বটে তিনি একজন।।
“পোদ্দার মশায়” বলি শ্রীগোপাল ডাকে।
ওড়াকান্দি যাতায়াত করেন পুলকে।।
দিগরাজবাসী সাধু অভয় চরণ।
যার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিল ধনী নিবারণ।।
নিবারণ, শ্রীঅভয়, শ্রীরাইচরণ।
দিগরাজবাসী এরা ভাই তিন জন।।
রচক সাধক বটে অভয় চরণ।
সুললিত গান কত করেছে রচন।।
জ্ঞানী-গুণী, ধনী-মানী বংশেতে প্রধান।
মতুয়া সংঘেতে অর্থ করিয়াছে দান।।
পূর্ণ সাধু, রায় অভয়, অভয় চরণ।
তিন জনে এক সঙ্গে করিত ভ্রমণ।।
রামধন নামে সাধু কাইনমারী ঘর।
মহিম মণ্ডল জ্যেষ্ঠ সহোদর যার।।
কেদার বলিয়া ছিল মহিমের পুত্র।
এরা সবে গোপালের বহু-কৃপা পাত্র।।
পরলোকে গেছে সব কেহ নাহি আর।
মতুয়া ধর্মেতে নিষ্ঠা আছিল সবার।।
কানাই মৌলিক নামে হলদীবুনীয়া।
মতুয়া হইল তিনি নামেতে মাতিয়া।।
শ্রীদেবীচাঁদের শিস্য ছিল সেইজন।
নরদেহে বেঁচে তিনি নাহিক এখন।।
রোমজাইপুর গ্রাম রামপাল থানা।
খুলনা জিলার মধ্যে রয়েছে নিশানা।।
বিখ্যাত ‘তাপালী’ বংশ জানে সর্বজন।
সেই বংশে জন্মিলেন সাধু পঞ্চানন।।
পিতা তার জানি নাম শ্রীদুর্গাচরণ।
খুল্লতাত সাধু ভক্ত সে গুরুচরণ।।
পরম তেজস্বী ছিল সে গুরুচরণ।
তার ভয়ে কম্পমান ছিল সর্বজন।।
কি নাম আনিল দেশে সাধুজী গোপাল।
ইতি উতি সব কিছু গেল রসাতল।।
গোপালের পদে পড়ে সে গুরুচরণ।
দয়া করি শ্রীগোপাল করিল গ্রহণ।।
তার ভ্রাতুষ্পুত্র যার পঞ্চরাম নাম।
কেহ পঞ্চানন বলে কেহ পঞ্চরাম।।
গোপালের রূপ দেখি নয়ন ভুলিল।
নাম-সুধা-পান করে পাগল হইল।।
‘পাগল’ ‘পাগল’ বলে উঠে কলরব।
কি যেন পেয়েছে পঞ্চা অতুল বিভব।।
“পাগল দা” বলে তাই ডাকে সর্বজন।
পঞ্চানন, পঞ্চারাম “পাগল দা” এখন।।
মনেতে প্রথমে যাহা করিয়াছে ঠিক।
সেইভাবে আছে চেয়ে ছাড়ে না নিরিখ।।
এক কন্যা আছে মাত্র পুত্র কেহ নাই।
“সকলে আমার পুত্র” সদা বলে তাই।।
“মতুয়া সংঘের” কার্যে বড় তার মন।
করিয়াছে বহু দান তাহার কারণ।।
তার গৃহে গুরুচাঁদ মহাপ্রভু যায়।
ভক্তি গুণে দয়াময় বহু শান্তি পায়।।
‘তাপালী’ বলিতে প্রভু করিলেন মানা।
তদবধি ‘রায়’ বলে হয়েছে নিশানা।।
মহৎ উদার এই “পাগল দা” ভাই।
সাধুর চরণে আমি প্রণাম জানাই।।
‘পাগলের’ গৃহ পার্শ্বে নাম ধনপতি।
সরল সহজ সাধু নিষ্ঠাবান অতি।।
‘পাগলের’ সঙ্গে সঙ্গে সদা সেই চলে।
নীরব সরল সাধু কথা নাহি বলে।।
বরিশাল জিলা মধ্যে রাজাপুর গ্রামে।
জন্মিল মহৎ এক শ্রীঅভয় নামে।।
পিতা তার কবিরাজ দ্বারিক সুজন।
নিজেও অভয় কবিরাজ একজন।।
শ্রীঅভয় কবিরাজ সাধু বিচক্ষণ।
শাস্ত্রজ্ঞানী সূক্ষ্ম বুদ্ধি রাখে সর্বক্ষণ।।
কবিরাজি ব্যবসায়ে বহু যশ ছিল।
প্রতিপত্তি মান যশ বহুত লভিল।।
পূর্ব হ’তে গোপালের সঙ্গে জানাশোনা।
কি যে সে গোপাল সাধু খবর রাখে না।।
শেষকালে হ’ল যবে সত্য পরিচয়।
কুলমান ফেলে এসে কেন্দে পড়ে পায়।।
জ্ঞানী ভক্ত নিষ্ঠা গুণে শক্তি লাভ হ’ল।
সুমধুর গান কত রচনা করিল।।
হরিচাঁদ লীলাগীতি পালা গান করি।
অভিনয় করা’তেন সর্বদেশ ঘুরি।।
রচনা শুনিয়া তার প্রভু গুরুচাঁদ।
‘রসরাজ’ উপাধিটি তারে করে দান।।
তেরশ’ আটত্রিশ সালে গেল লোকান্তরে।
নিশি, শশি দুই পুত্র আছে তার ঘরে।।
তারা সবে পিতৃধর্মে আছে নিয়োজিত।
শ্রীগোপালচাঁদের পদে আছে নিষ্ঠারত।।
নিশির পত্নীর নাম জানি বিনোদিনী।
পতিব্রতা ভক্তিমতী বলে তারে জানি।।
ডাকাতি করিত কালু সাগরের ধারে।
তার দাপে নরনারী সবে ভয় করে।।
গোপালের শিঙ্গা ধ্বনি সাগরে পৌছিল।
পাষাণ ডাকাত কালু তাহাতে গলিল।।
গোপালের পদে পড়ে মাগিল উপায়।
শ্রীগোপাল তারে লয়ে ওড়াকান্দি যায়।।
দয়াময় গুরুচাঁদ করুণা করিল।
পূর্বভাব ছেড়ে কালু মতুয়া হইল।।
মতুয়া কালুরে ধরে শ্রীকৈলাস নাম।
তার গুণে রোগে তেহ পাইল আরাম।।
কৈলাস হইল ভক্ত কালুর কারণে।
নগেন্দ্র বলিয়া সাধু কৈলাসেরে মানে।।
সমুদয়কাটি ঘর জাতিতে কায়স্থ।
দেহে মনে সবখানে সে বড় প্রশস্ত।।
আজীবন ব্রহ্মচারী সাজিয়া রহিল।
“সর্ব জাতীশ্বর” বলি প্রভুকে কহিল।।
তারে দেখে বহু বহু কায়স্থ সুজন।
ওড়াকান্দি ধর্মে মত্ত হ’য়েছে এখন।।
শ্রীনগেন্দ্র কর বলি নাম ছিল তার।
বহু কৃপা করে প্রভু তাহার উপর।।
সুললিত গীত কত করিল রচনা।
নিজ কণ্ঠে করে সদা সে সব সাধনা।।
বজ্র কণ্ঠে সে নগেন্দ্র যবে করে গান।
আনন্দে সবার প্রাণে উঠিত তুফান।।
বর্ষ পূর্বে দেহত্যাগ নগেন্দ্র করিল।
মতুয়া সংঘের বীর একটি কমিল।।
বরিশাল জিলা মধ্যে জগচ্চান গ্রাম।
সেথা জন্ম জগবন্ধু মিশ্র গুণধাম।।
শ্রীরাম চরণ পিতা মাতা ভগবতী।
জগবন্ধু পুত্র পেয়ে আনন্দিত অতি।।
ত্রিংশ বর্ষ বয়ঃক্রম কালে মহাশয়।
বহু কষ্ট পায় তেহ শূল বেদনায়।।
রামনারায়ণ, হরি ঘুরে নানাস্থানে।
তাহাদের কাছে ওড়াকান্দি নাম শোনে।।
বেদনায় যন্ত্রণায় ভাবে মনে মনে।
ওড়াকান্দি হ’তে এসে ত্যজিবে পরাণে।।
বহু কষ্টে ওড়াকান্দি হইল উদয়।
গুরুচাঁদ দৃষ্টি মাত্রে রোগ সেরে যায়।।
মালা ‘ছোটা’ দিয়ে প্রভু আজ্ঞা দিল তারে।
নাম ধর্ম প্রচারিতে সর্ব ঘরে ঘরে।।
সেই হ’তে বরিশাল জিলার দক্ষিণে।
প্রচার করিছে নাম তেহ বহু স্থানে।।
কালীর চর, বালীর চর সবখানে যায়।
শ্রীগোপাল চাঁদের পদে ভক্তি অতিশয়।।
এক গাছে এক নৌকা করিয়া নির্মাণ।
শ্রীগুরুচাঁদেরে তেহ করিয়াছে দান।।
মতুয়া সংঘের এক বীর কর্মী তিনি।
বহু শিস্য আছে তার সেই কথা জানি।।
জুলুহার গ্রামে আছে ভাই দুই জন।
জগবন্ধু, চন্দ্রকান্ত অতি নিষ্ঠা মন।।
গোপালচাঁদের পদে নিষ্ঠা অতিশয়।
ওড়াকান্দি লক্ষ্মীখালী সর্বক্ষণে যায়।।
মতুয়া সংঘের পতি প্রমথরঞ্জন।
একবার এই গৃহে করেছে গমন।।
মতুয়া সংঘের কার্যে কভু পিছে নয়।
কথা ছেড়ে কার্যে তারা দেয় পরিচয়।।
ফুলুহারে নারীভক্তা আছে এক জানি।
বড় তেজময়ী ভক্তা সে কৈলাসমণি।।
পবিত্র চরিত্র নারী অতি ভক্তিমতী।
ঠাকুরের পদে তার আছে নিষ্ঠারতি।।
গোপালচাঁদেরে করি গুরুত্বে বরণ।
হরি-গুরুচাঁদ নাম করিছে সাধন।।
রঘুনাথপুরবাসী উপাধিতে রায়।
সগোষ্ঠী সকলে ভক্ত জানি পরিচয়।।
শিক্ষিত যোগেন্দ্র বাবু এই গৃহবাসী।
শ্রীগোপালে ভক্তি করে সবে মিলে আসি।।
রামপুর গ্রামে বাস পণ্ডিত সুজন।
শ্রীকৃষ্ণ বলিয়া নাম ভকত একজন।।
গোপালচাঁদের পদে নিষ্ঠা অতিশয়।
মতুয়া সংঘের কার্যে ব্যস্ত সর্বদায়।।
সেই গ্রামে ভক্ত সাধু শ্রীউমাচরণ।
মহাভাবে করে সাধু নাম সংকীর্তন।।
সহজ সরল প্রাণ বড়ই উদার।
ওড়াকান্দি লক্ষ্মীখালী যাতায়াত তার।।
বরিশাল জিলা মধ্যে গ্রাম শীতপুর।
তারিণীচরণ বাড়ৈ ভকতি প্রচুর।।
শ্রীগোপালচাঁদের কৃপা তার প্রতি হয়।
সেইখানে শ্রীগোপাল বারুণী মিলায়।।
খুলনা জিলার মধ্যে বটতলা গ্রামে।
গোপালের ভক্ত এক ভোলানাথ নামে।।
অন্তরঙ্গ ভক্ত বলি তার পরিচয়।
বারুণী মিলাতে সাধু তাহারে পাঠায়।।
মঠবাড়ীয়াতে পরে আশ্রম হইল।
সে বারুণীর মেলা পরে সেখানে আসিল।।
মঠবাড়ী আশ্রমের বলি ইতিহাস।
ভক্তগণে যাহা কিছু করেন প্রকাশ।।
শানকীভাঙ্গা কর্মী ভক্ত প্রতাপ বেপারী।
দেশের মঙ্গল কার্যে চিন্তা তার ভারী।।
বহু কার্য করিয়াছে সেই মহাশয়।
কাশীনাথ হালদার তার সাথে রয়।।
অতিশয় নিষ্ঠাবান সাধু কাশীনাথ।
তার ভ্রাতা দীনবন্ধু প্রকৃতিতে সৎ।।
ব্রজেন্দ্র, রাজেন্দ্র আর প্রসন্ন গয়ালী।
এইরূপ কর্মী কত আছে সেই স্থলী।।
মঠবাড়ী বন্দরেতে নামেতে সুরেন্দ্র।
ধনাঢ্য বণিক তিনি জ্ঞানেতে প্রশান্ত।।
গোপালচাঁদের শিস্য দেশভরি রয়।
তাহাদিগে দরশনে চিন্তার উদয়।।
একটি আশ্রম যদি করিবারে পারি।
সদ্ভাব প্রচার হ’বে এই দেশ ভরি।।
এত ভাবি কর্মবীর প্রতাপ ব্যাপারী।
লক্ষ্মীখালী উপনীত সঙ্গী সঙ্গে করি।।
গোপালচাঁদের সঙ্গে হইল আলাপ।
আশ্রম হইল বটে মাতিল প্রতাপ।।
মতুয়া সংঘের পতি প্রমথরঞ্জন।
করিলেন আশ্রমের শুভ উদ্বোধন।।
“হরি-গুরুচাঁদ” নামে আশ্রম হইল।
সমারোহে সেইখানে বারুণী মিলিল।।
এই সূত্রে ভক্ত হ’ল প্রতাপ ব্যাপারী।
কাশীনাথ হালদার সঙ্গে সঙ্গে তারি।।
হারজী নিবাসী ভক্ত শ্রীবিষ্ণু চরণ।
একসঙ্গে তারা সবে হ’য়েছে মগন।।
ছোটশিঙ্গা গ্রামে ঘর শ্রীগুরুচরণ।
উপাধি মেস্তরী তার অতি মহাজন।।
সেথা বাস করে তিনি যশের সহিত।
তার জ্যেষ্ঠ পুত্র নাম সাধু পরীক্ষিত।।
নরেন্দ্র বলিয়া তার কনিষ্ঠ তনয়।
গোপালের রূপ দেখে প্রমে মত্ত হয়।।
ভক্ত বীর জ্ঞানে ধীর সেই পরীক্ষিত।
মতুয়াসংঘের কর্ম করেন বিহিত।।
গোপালচাঁদের পদে নিষ্ঠা অতিশয়।
দুই ভাই এক ভাব ভিন্ন ভাব নয়।।
শ্রীমান কেশবচন্দ্র ফুলঝুরী ঘর।
সরল উদার ভক্ত উপাধি হালাদার।।
শ্রীশশিকুমার নাম অতি নিষ্ঠাবান।
কেশবের পিতা বটে সেই মতিমান।।
কেশবের পিতা মাতা উভয়ে সরল।
ঠাকুর স্মরণে সদা চক্ষে বহে জল।।
কেশব, মণীন্দ্র এরা ভাই দুইজন।
যেমন জনক তারা হ’য়েছে তেমন।।
“অনন্ত বিজয়” নামে মাসিক পত্রিকা।
জাতীয়তাবাদী কথা তা’তে হয় লেখা।।
প্রতিষ্ঠাতা হ’ন তার প্রমথরঞ্জন।
সম্পাদনা ভার মোরে করেছে অর্পণ।।
সহকারী রূপে কাজ করিছে কেশব।
কেশব অক্লান্ত ভাবে কাজ করে সব।।
গোপালচাঁদের প্রিয় কেশব সুজন।
তার পদে নিষ্ঠা রেখে চলে সর্বক্ষণ।।
সোনাখালী ছিল ধনী শ্রীগঙ্গাচরণ।
যার কন্যা শান্তি দেবী জানে সর্বজন।।
ভূপালের কন্যা দিয়ে গোপালেরে চেনে।
মরণের পূর্বে তারে গুরু বলে মানে।।
তার জ্যেষ্ঠ পুত্র নাম যাদব বিশ্বাস।
সসম্মানে করিলেন বি.এ পাশ।।
দ্বিতীয় মুকুন্দ নামে পুত্র গুণধাম।
কেশব বলিয়া জানি তৃতীয়ের নাম।।
এরা সবে গুণবলে ভক্তিমান অতি।
গোপালের পদে সবে রাখে নিষ্ঠারতি।।
চাড়াখালী ছিল সাধু কৃষ্ণকান্ত নাম।
গোপালের ভক্ত ছিল সেই গুণধাম।।
গুরু কৃপা গুণে বহু শিস্য হ’ল তার।
কিছুকাল পূর্বে গেছে ভব-নদী পার।।
হোগলপাতিতে ঘর শ্রীদুর্গাচরণ।
শ্রীগুরুচাঁদের ভক্ত তিনি একজন।।
পঞ্চকরণেতে বাস অভয় চরণ।
উপাধি হালদার যার ভক্ত একজন।।
উমাচরণ নামে তার ভাই অন্যজন।
শ্রীষষ্ঠীচরণ নামে কনিষ্ঠ সুজন।।
অভয়ের পুত্র নাম অতুল হালদার।
বাগেরহাটেতে তিনি একটি মোক্তার।।
বাড়ীশুদ্ধ ওড়াকান্দি মতুয়া সকলে।
গোপালচাঁদের প্রতি নিষ্ঠা রেখে চলে।।
পাঁজাখোলা গ্রামে ঘর দেবেন্দ্র মল্লিক।
শাশুড়ির গুণে হ’ল এ পথে পথিক।।
সেই বুড়ি ছিল বটে অতি নিষ্ঠাবতী।
একনিষ্ঠা ভক্তি ছিল গোপালের প্রতি।।
ডৌয়াতলা গ্রামে ছিল নাম দুর্যোধন।
বিশ্বাস উপাধি যার ভক্ত একজন।।
‘খুড়া’ বলি শ্রীগোপাল করে সম্বোধন।
গোপালে করিত মান্য গুরুর মতন।।
মাদুরপাল্টায় ঘর শ্রীসখীচরণ।
উপাধিতে কবিরাজ সেই মহাজন।।
গোপালচাঁদের পদে নিষ্ঠা অতিশয়।
তার মত ভক্ত বটে কম দেখা যায়।।
আদিকালে গোপালের সঙ্গে সদা ছিল।
তার কৃপাগুণে কীর্তি বহুত দেখিল।।
তার গৃহে গুরুচাঁদ করিল গমন।
মনোসাধে সবে মিলে করিল পূজন।।
দিগরাজবাসী সাধু বনমালী নাম।
সহজ সরল ভক্ত সেই গুণধাম।।
রসিক নামেতে অন্য ভক্ত একজন।
সুললিত গান কত করেছে রচন।।
গোলবুনিয়াতে ঘর শ্রীহরকুমার।
শ্রীহরিচরণ নামে এক ভাই তার।।
ভক্তিমান জ্ঞানবান সাধু বটে তারা।
মতুয়া সংঘের কার্যে দৃঢ় নিষ্ঠা ভরা।।
একরামখালী বাড়ী মহাদেব নাম।
শ্রীগোপালচাঁদের ভক্ত সেই গুণধাম।।
কাশিমপুরেতে বাস নাম শশধর।
ওড়াকান্দি ভক্ত তার স্বভাব সুন্দর।।
পঞ্চমালাবাসী সাধু শ্রীউমাচরণ।
বিশ্বাস উপাধি তার ভক্ত একজন।।
বারুজীবি কুলে জন্ম শ্রীমহেন্দ্র দাস।
ওড়াকান্দি ভক্ত তার দশানীতে বাস।।
গোপালচাঁদের পদে দৃঢ় নিষ্ঠা রাখে।
জাতি-কুল ছেড়ে দিয়ে প্রেমে মত্ত থাকে।।
চাটার্জীখালীতে বাস নাম বলরাম।
গোপালচাঁদের শিস্য সেই গুণধাম।।
শ্রীগুরুচাঁদের সঙ্গে ছিল পরিচয়।
কৃপা করে তারে প্রভু বহু কথা কয়।।
সন্ন্যাসী গ্রামেতে ঘর পরেশ হালদার।
মতুয়া ধর্মের প্রতি বহু নিষ্ঠা তার।।
সেই গ্রামে বাস করে শুকচাঁদ নাম।
হালদার উপাধি তার অতি গুণধাম।।
গোপালের মামা বাড়ী বেতকাটা গ্রাম।
মাতুলের পুত্র শুকচাঁদ গুণধাম।।
আদিবাস ত্যাগ করি সন্ন্যাসী আসিল।
মতুয়াসংঘের কার্যে টাকা দান দিল।।
বেতকাটা হালদার বংশে যতজন।
ওড়াকান্দি ধর্মমতে আছে সর্বজন।।
শ্রীহরিভজন মিশ্র ভোজপতিয়ায়।
ওড়াকান্দি ভক্ত এক সেই মহাশয়।।
গোপালচাঁদের পদে আত্মসমর্পণ।
সেই পদে নিষ্ঠা রেখে চলে সর্বক্ষণ।।
তার সতী নারী জানি অতি ভক্তিমতী।
গোপালচাঁদের পদে আছে নিষ্ঠারতি।।
তার পুত্র জগবন্ধু করেছে রচন।
রচনা শুনিয়া মুগ্ধ প্রমথরঞ্জন।।
দামেরখণ্ডেতে বাস দ্বিজবর নাম।
পরম নৈষ্ঠিক ভক্ত অতি গুণধাম।।
সরল সহজ দ্বিজ উদার পরাণ।
মতুয়া সংঘেতে কৈল বহু অর্থ দান।।
সপ্তাহেতে দুই দিন লক্ষ্মীখালী যায়।
বহু ভক্তি রাখে সদা গোপালের পায়।।
শ্রীবরদা মজুমদার সেই দেশে ঘর।
মতুয়া সুজন বহু ভক্তি আছে তার।।
মতুয়া সংঘের কার্যে করে অর্থ দান।
গোপালচাঁদের পদে সদা নিষ্ঠাবান।।
কাঙ্গালী, রসিক সবে বেতিবুনে ঘর।
গোপালচাঁদের পদে সদা নিষ্ঠা নিরন্তর।।
বরদা বিশ্বাস বাস বাঁশতলী গাঁয়।
ডুমিরিয়া গ্রামে এবে সর্বক্ষণে রয়।।
গোপালচাঁদের ভক্ত সেই একজন।
লক্ষ্মীখালী যাতায়াত করে ঘন ঘন।।
পেস্কারাবাদে বাস গিরীশ সুজন।
গোপালচাঁদের শিস্য সেই একজন।।
মহিষঘাটায় বাস আনন্দ সুজন।
সরস্বতী নামে ভক্তা আছে অন্য জন।।
আনন্দ মণ্ডল জানি নিষ্ঠাবান ভক্ত।
গোপালচাঁদের পদে দৃঢ় অনুরক্ত।।
অশ্বিনী, গোপাল আর দয়াল মণ্ডল।
শ্রীগোপালে গুরু করে বলে হরিবোল।।
গোপালের পত্নী নাম জানি সরস্বতী।
গোধূলি আরেক নাম অতি ভক্তিমতী।।
তরণী গাইন নামে হুড়কাতে বাস।
পূর্ণব্রহ্ম গুরুচাঁদে করিত বিশ্বাস।।
গোপালচাঁদের শিস্য সেই মহাজন।
পাগল উপাধি যার ভক্তির কারণ।।
‘ইচ্ছা-মৃত্যু’ হয় তার লক্ষ্মীখালী ধামে।
শক্তিশালী সে তরণী নিষ্ঠা কিংবা প্রেমে।।
এইরূপ লক্ষ লক্ষ কত কব’ আর।
কত ভক্ত আছে দেখ পশরের পার।।
চালনা নিবাসী সাধু নিবারণ নাম।
সহজ সরল ভক্ত সেই গুণধাম।।
যেই কালে গেল প্রভু খালিসাডাঙ্গায়।
প্রভুকে দেখিতে সাধু সেইখানে যায়।।
পুনঃ নিজ গ্রামে দেখা হ’ল চালনায়।
ঠাকুরের ভক্ত দুর্যোধনের আলয়।।
শ্রীগোপালচাঁদ সেথা উপস্থিত ছিল।
দুইরূপ দেখে তার নয়ন ভুলিল।।
গোপালেরে গুরু করি ওড়াকান্দি যায়।
সগোষ্ঠী সকলে এবে নামে মত্ত হয়।।
মতুয়া সংঘের কার্যে অতি তৎপর।
সেই কার্যে বহু অর্থ দান আছে তার।।
সুন্দরমহল নামে খুলনা জিলায়।
সেই গ্রামে বাস সাধু হীরালাল রায়।।
বসন্ত বলিয়া ছিল তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।
ওড়াকান্দি ধর্মে আছে করিয়া একতা।।
কবিরাজী ব্যবসায় হীরালাল করে।
শ্রীগোপালচাঁদেরে দেখে সব দিল ছেড়ে।।
এবে মত্ত নামে গানে ধর্মের প্রচারে।
মতুয়া সংঘের জন্য বহু কার্য করে।।
সরল উদার সাধু দেল-খোলা ভাব।
ভক্তিমান নাহি কোন মনের গৌরব।।
শ্রীউমাচরণ নামে সাধু সদাশয়।
বর্তমানে দুর্গাটুনী গ্রামে বাস রয়।।
দত্তেরমেট বলি রামপাল থানায়।
আদিবাস সেই গ্রামে করে মহাশয়।।
কাশীনাথ নামে তথা ছিল মহাজন।
তার পুত্র জানি এই শ্রীউমাচরণ।।
শ্রীঅভয় হালদার দিগরাজবাসী।
সে উমাচরণে কন্যা দান করে আসি।।
সরল উদার সাধু সে উমাচরণ।
তার বাড়ী গিয়াছেন প্রমথরঞ্জন।।
মতুয়া সংঘের কার্যে সেই মহাশয়।
করিলেন বহু অর্থ দান সে সময়।।
গোপালচাঁদের শিস্য জানি পরিচয়।
দানশীল ভক্তিমান সেই মহাশয়।।
মাদারতলায় ছিল বরদা সুজন।
গোপালচাঁদের ভক্ত সেই একজন।।
মহাভাবে গান যবে বরদা করিত।
নরনারী সকলের নয়ন ঝরিত।।
নিজে বহু সুললিত করিল রচনা।
গান গেয়ে ভক্ত বীর পুরা’ল বাসনা।।
কয় বর্ষ পূর্বে তেহ গেছে দেহ ছাড়ি।
মণীন্দ্র নামেতে আছে এক পুত্র তারি।।
গোপাল নামেতে ভক্ত বাস দুর্গাটুনি।
ওড়াকান্দি প্রতি নিষ্ঠা আছে তার জানি।।
পাতিবুনে গ্রামে ঘর লালচাঁদ নাম।
ওড়াকান্দি ভক্ত বটে সেই গুণধাম।।
হাটবাড়ী সাধু ভক্ত শ্রীগুরুচরণ।
যার গৃহে গুরুচাঁদ করেন গমন।।
তার নারী ভক্তিমতী বড়ই কর্মিষ্ঠা।
গোপালের পদে তার আছে ইষ্ট নিষ্ঠা।।
সন্তোষ, পূরণ বলি দু’টি পুত্র তার।
সন্তোষ তেজস্বী অতি ভক্তির আধার।।
কীর্তন যখনে করে সন্তোষ গোঁসাই।
ধরা যেন কেঁপে ওঠে তাই টের পাই।।
শৈলমারী গ্রামে সাধু শুকচাঁদ নাম।
নিষ্ঠাবান ভক্ত সেই অতি গুণধাম।।
ধনবান গুণবান গুরুগত প্রাণ।
মতুয়া সংঘের তরে বহু কৈল দান।।
গোপালচাঁদের পদে নিষ্ঠা তার ভারী।
মহাসংঘ অধিপতি গেল তার বাড়ী।।
অবিরাম চোখে জল মুখে যার নাম।
শঙ্করপুরেতে বাস ভক্ত গুণধাম।।
ফেলাকান্ত শিকদার বলি পরিচয়।
গোপালের পদে তার দৃঢ় আর্তি রয়।।
গোপালের আজ্ঞাক্রমে কন্যা বিয়া দেয়।
মহিমের ভ্রাতুষ্পুত্র কানমারী গাঁয়।।
ভক্তিমান সাধু জানি শিস্য আছে তার।
গোপালের কৃপা বহু উপরে তাহার।।
শ্রীকৃষ্ণ মালঙ্গী নামে সাধু গুণাকর।
রুৎলাবুনীয়াতে বাস করে নিরন্তর।।
গোপালচাঁদের শিস্য জানি পরিচয়।
নাম ধর্ম প্রচারিছে বহু শিস্য পায়।।
এবে কৃষ্ণ বেঁচে নাই পুত্র আছে তার।
রাধাকান্ত নামে সাধু স্বভাব সুন্দর।।
পিতৃধর্মে মন রেখে চলে সেই পথে।
গোপালের দায় দেয় ওড়াকান্দি মতে।।
শ্রীরামকাঠিতে ঘর বৈকুণ্ঠ মেস্তরী।
তার পুত্র সে দেবেন্দ্র নিষ্ঠা যার ভারী।।
জ্ঞানীভক্ত শ্রীবৈকুণ্ঠ করে হরিনাম।
নাম ধর্ম প্রচারিতে চেষ্টা অবিরাম।।
চিলতলাবাসী সাধু শ্রীগঙ্গাচরণ।
ঠাকুরের নিষ্ঠা ভক্ত সেই একজন।।
খোষাল নামেতে ভক্ত ভরতকাঠি গাঁয়।
বিপিনচাঁদের শিস্য বহু গুণময়।।
হারজী নিবাসী ভক্ত চন্দ্রকান্ত নাম।
রামনারায়ণে ধরে করে হরিনাম।।
মীরাকাঠি গ্রামে ঘর শ্রীচণ্ডীচরণ।
ওড়াকান্দি মতে ভক্ত তিনি একজন।।
গোপালচাঁদের পদে নিষ্ঠা ভক্তি রয়।।
শ্রীহরির ধর্ম মেনে জীবন কাটায়।।
ওড়াকান্দি ধর্ম-মত প্রচার কারণে।
করিল বিদেশ যাত্রা কত ভক্তগণে।।
যদুনাথ জানি বটে তার একজন।
বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে করেছে গমন।।
বরিশাল জিলাধীনে খেপুপাড়া গাঁয়।
তেরশ’ বাইশ সালে তার জন্ম হয়।।
শ্রীরাজকুমার নামে মাতুল তাহার।
ওড়াকান্দি ভক্ত বলি পরিচয় তার।।
তার সঙ্গে ওড়াকান্দি আসে যদুনাথ।
তার পূর্বে হ’ল তার ঠাকুর সাক্ষাৎ।।
ঠাকুর করিলে আজ্ঞা প্রচারেতে যায়।
ময়মনসিংহ আদি ত্রিপুরা জিলায়।।
ঠাকুরের নামে দেখ কত শক্তি রয়।
রাজা তারে দিল ভেট আগরতলায়।।
ত্রিপুরা জিলায় নাম হইল প্রচার।
ওড়াকান্দি এসে তারা জানে সমাচার।।
গোপালচাঁদের কীর্তি দেখিয়া নয়নে।
ত্রিপুরা জিলার সবে পড়িল চরণে।।
গগন তালুকদার টুবগীতে ঘর।
দীনবন্ধু সরকার সঙ্গে এল তার।।
হেমন্ত সরকার নামে ভক্ত অন্যজন।
লক্ষ্মীখালী করিলেন সবে আগমন।।
ত্রিপুরা জিলাতে তবে শ্রীগোপাল চলে।
বহুত মতুয়া সেথা হল তার ফলে।।
ফরিদপুরেতে বাস যত ভক্তজন।
এবে আমি দিব কিছু সেই বিবরণ।।
ঘৃতকান্দিবাসী সাধু শ্রীমধু বিশ্বাস।
শ্রীকুঞ্জবিহারী দোঁহে এক দেশে বাস।।
মধুর যে জ্যেষ্ঠভ্রাতা নাম কৃষ্ণধন।
ঈশ্বর নামেতে পিতা ছিল বিচক্ষণ।।
দুই ভাই এক ঠাই ভিন্ন ভাব নাই।
মতুয়া সংঘের কার্যে শ্রীমধুকে পাই।।
শত টাকা দুই ভাই করিয়াছে দান।
পূর্বে বলিয়াছি বহু মধুর আখ্যান।।
সর্বনীতি মধ্যে সাধু রাখিয়াছে প্রাণ।
এক পুত্র ব্যবসায়ী একটি বিদ্বান।।
মতুয়ার কাজে এবে সর্বত্রেতে ধায়।
এমন উৎসাহী সাধু কম দেখা যায়।।
পণ্ডিত শ্রীকান্ত সাধু সফলানগর।
“চারণ কবির” মত ছড়ার সাগর।।
উপাধি “চারণ কবি” তাই তারে দিল।
বহু স্থানে হরিনাম প্রচার করিল।।
মহাব্যাধিগ্রস্থ হ’য়ে ওড়াকান্দি যায়।
রোগে মুক্তি পেল শুধু প্রভুর কৃপায়।।
প্রভু তারে পাঠাইল ধাম লক্ষ্মীখালী।
গোপালের ভাব দেখি আখি গেল খুলি।।
গুরু বলে সে শ্রীকান্ত পদানত হ’ল।
তার বরে দেখ এক পুত্র জনমিল।।
পরম তেজস্বী সাধু কেশব গোঁসাই।
দিঘড়া গ্রামেতে বাস জানি বটে তাই।।
শিক্ষা শেষ করি পরে করিত চাকুরী।
ঘুষ নিতে হয় দেখে তাহা দিল ছাড়ি।।
শিক্ষকতা করিবারে বেতকাটা যায়।
মহাসাধু রাধাকান্ত তারে স্থান দেয়।।
শ্রীরাধাকান্তের পুত্র দীন গ্রন্থকার।
কেশবের সঙ্গে গাঢ় প্রীতি হ’ল তার।।
গ্রন্থকার যাতায়াত করে লক্ষ্মীখালী।
কেশবকে সঙ্গে নিল নানা কথা বলি।।
গোপালে দেখিয়া ভোলে কেশবের মন।
ক্রমে ক্রমে যাতায়াত করে ঘন ঘন।।
গোপালের সাথে পরে ওড়াকান্দি যায়।
শ্রীগুরুচাঁদেরে দেখি আঁখি না ফিরায়।।
গুরুচাঁদ কৃপাদৃষ্টি করিলেন তারে।
দিনে দিনে সে কেশব বহু শক্তি ধরে।।
নাম ধর্ম বহু স্থানে করেছে প্রচার।
ক্রমে ক্রমে বাড়িয়াছে বহু শিস্য তার।।
গোপালের শিস্য মধ্যে শ্রেষ্ঠ একজন।
তার পদে নিষ্ঠা ভক্তি রাখে সর্বক্ষণ।।
দেল্বাজারকান্দি গাঁয় রজনী বেপারী।
রাজকুমার পুত্র তার নিষ্ঠা যার ভারী।।
তার নিষ্ঠা দেখি পরে নিজে ভাবে এল।
কেশব গোঁসাইকে পরে গুরুত্বে বরিল।।
রজনীর ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীদেবেন্দ্র নাম।
সুসভ্য শিক্ষিত তিনি অতি গুণধাম।।
দারুণ ব্যাধিতে পড়ি কেশবে ডাকিল।
নাম গুণে অল্পদিনে ব্যাধি মুক্ত হ’ল।।
তদবধি ভাবে মত্ত ওড়াকান্দি যায়।
মতুয়া সংঘের কার্য যতনে চালায়।।
খালকুলা মৃধা বংশে কৃষ্ণকান্ত।
নগেন, পুলিন যারা বহু ভক্তি মন্ত।।
সগোষ্ঠী সকলে আছে ওড়াকান্দি মতে।
পুলিন ধরিল ভাব কেশবের হতে।।
হাজরাগাতী ঢালী বংশে শ্রীবিষ্ণুচরণ।
ভরত পণ্ডিত তার ভ্রাতা একজন।।
ওড়াকান্দি ধর্মে তারা মত্ত হ’য়ে রয়।
শ্রীগুরুচাঁদের গুণ সর্বত্রেতে কয়।।
নাগর বাড়ই নামে ভক্ত একজন।
কেশবের শিস্য জানি সেই মহাজন।।
শিমুলসুরের গাঁয় কৃষ্ণধন নাম।
বাগ্চি উপাধি যার অতি গুণধাম।।
নিবারণ নামে অন্য সেই গৃহে রয়।
ঠাকুরর পদে রাখে নিষ্ঠা অতিশয়।।
দিঘড়া হালদার বংশ সুপ্রসিদ্ধ অতি।
ওড়াকান্দি ভাবে তারা এসেছে সম্প্রতি।।
কানাই, নিমাই আর ভক্তা লালমতী।
গাড়লগাতীতে ঘর ভক্তা জয়মতী।।
শিমুলসুরেতে বাস নগেন্দ্র পণ্ডিত।
বিশ্বাস উপাধি তার অতি শান্ত চিত।।
তিন ভাই সকলেই ভকত সুজন।
তার গৃহে গিয়াছিল প্রমথরঞ্জন।।
ফরিদপুর জিলা মধ্যে জিকাবাড়ী গাঁয়।
শ্রীগুরুচাঁদের সেথা মাতুল আলয়।।
বালা বংশ সুপ্রসিদ্ধ বড়ই সম্মান।
সেই বংশে শান্তি দেবী আবির্ভূতা হ’ন।।
শ্রীগুরুচাঁদের মামা তা’তে তারা বটে।
আদি প্রামাণিক খ্যাতি পরে ‘বালা’ রটে।।
সেই বংশে সৃষ্টিধর গুণবান অতি।
মাতৃ শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে রাখিলেন কীর্তি।।
তিন পুত্র জানি তার জ্যেষ্ঠ কর্ণধর।
শ্রীশশিভূষণ, কার্ত্তিক ভাই পর পর।।
কর্ণধর পড়ে এক দারুণ মামলায়।
মনে হ’ল সেইবারে জল হ’তে যায়।।
শশী আসি ওড়াকান্দি কান্দিয়া পড়িল।
“কোন ভয় নাই” তারে ঠাকুর কহিল।।
গোপালগঞ্জেতে বসে আছে কর্ণধর।
সেই দিন মামলার চূড়ান্ত বিচার।।
হেনকালে দেখে কোর্টে এসেছে ঠাকুর।
কর্ণধর মনে বল পাইল প্রচুর।।
প্রণাম করিলে প্রভু তারে ডেকে কয়।
“খালাস হইবি কর্ণ নাহি কোন ভয়।।”
ঠাকুরে বসিতে দিবে মনেতে ভাবিয়া।
স্কন্ধের চাদর কর্ণ দিল বিছাইয়া।।
চক্ষু পালটিতে দেখে প্রভু সেথা নাই।
প্রেমে গদগদ কর্ণ ছাড়ে দীর্ঘ হাই।।
খালাস হইয়া পরে ওড়াকান্দি গেল।
প্রভুর চরণে পড়ি অনেক কান্দিল।।
শ্রীশশিভূষণে জানি অতি ভক্তিমান।
ঠাকুরের নামে কত রচিয়াছে গান।।
সুললিত গীতগুলি অতি প্রেমময়।
রচনা করিয়া নিজে নাম নাহি দেয়।।
মতুয়া সংঘের কার্যে বড়ই তৎপর।
সংঘের কার্যেতে আছে বড় দান তার।।
পাটকেলবাড়ী গ্রামে নবকৃষ্ণ নাম।
তেজবন্ত ছিল এক ধনী গুণধাম।।
সিংহসম দেশ মধ্যে করিত ভ্রমণ।
সকলে করিত ভয় তাহার কারণ।।
দেশ মধ্যে তার বহু কীর্তি শোনা যায়।
দত্তভাঙ্গা সভা মধ্যে যায় মহাশয়।।
তার পুত্রগণ মধ্যে আছে দুই ভাই।
অপর সকলে গত কেহ বেঁচে নাই।।
মনোহর, শম্ভুনাথ ভাই দুই জন।
উভয়ে পেয়েছে প্রাণ পিতার মতন।।
নিষ্ঠা ভক্ত মনোহর অহংকার নাই।
উপাধি হয়েছে তাই ‘গোঁসাই’ ‘গোঁসাই’।।
সাধুজী গোপালচন্দ্র জন্ম এই বংশে।
আপন আপন ভাব ভাবে সর্ব অংশে।।
‘নোয়াদা’ ‘নোয়াদা’ ডাকে শ্রীগোপালচান।
‘নোয়াদা’ বলিয়া তাই সর্বত্র আখ্যান।।
বড়ই কর্মিষ্ঠ জানি ভাই শম্ভুনাথ।
যাহা দাও তাহা পারে সব কাজে হাত।।
বহু লীলা ঠাকুরের প্রত্যক্ষ করিল।
গ্রন্থ বৃদ্ধি ভয়ে আর বলা নাহি গেল।।
‘মতুয়া সঙ্গীত’ যবে হইল মুদ্রিত।
মনোহর দিল টাকা অতি আনন্দিত।।
মতুয়া সংঘেতে দান তাহাদের বেশী।
দুই ভাই সংঘ- কার্য করে দিবানিশি।।
রাহুথড় গ্রামে নাম অশ্বিনী গোলদার।
তার চিরসাথী জানি সেই মনোহর।।
লক্ষ্মীখালী শ্রীগোপালে গুরু মান্য করে।
ওড়াকান্দি যায় সদা মনোহরে ধরে।।
প্রসিদ্ধ কৃষক কর্মী শ্রীমুকুন্দ লাল।
ঠাকুরের গুণে মেতে বলে হরিবোল।।
রাহুথড়ে কর্মী কবি ভবানী শঙ্কর।
নানা দেশে নাম ধর্ম করিছে প্রচার।।
সাতপাড় গ্রামে ঘর শ্রীনগরবাসী।
হরি বলে নামে মেতে মত্ত দিবানিশি।।
শ্রীলটিয়াবাসী সাধু শ্রীগিরীশ চন্দ্র।
কেহ কেহ ডাকে তারে গোঁসাই গিরিন্দ্র।।
তেজস্বী মতুয়া বীর মত্ত হরি নামে।
প্রচার করিছে নাম ভ্রমি নানা গ্রামে।।
মামুদপুরেতে বাস প্রসন্ন বিশ্বাস।
এবে করিয়াছে বটে ঠাকুরে বিশ্বাস।।
রমেশ, কেশব নামে দুই পুত্র তার।
ঠাকুরের পদে নিষ্ঠা রাখে নিরন্তর।।
ধোপড়া নিবাসী ছিল উদ্ভব সুজন।
যার গানে ভুলে যেত নরনারীগণ।।
শ্রীরামজীবন বালা, উদ্ভব সুজন।
এদের সঙ্গেতে যোগে সে মনমোহন।।
তিনজনে গুরুচাঁদ এক করি দিল।
তিন জনে এক সঙ্গে চলিতে কহিল।।
হরিলীলা গীতি পালা সে রামজীবন।
রচনা করিয়া দেয় হ’য়ে একমন।।
দল করি তিন জনে সেই গান গাঁয়।
লক্ষ্মীখালী শ্রীগোপালে তারা দেখা পায়।।
গুণে বাধ্য হ’য়ে তারে গুরুত্বে বরিল।
অল্পকাল পূর্বে সেই উদ্ভব মরিল।।
বড় গুণবান ছিল উদ্ভব সুজন।
তার লাগি ব্যাথা পায় প্রমথরঞ্জন।।
ঘৃতকান্দিবাসী সাধু শ্রীরাইচরণ।
ওড়াকান্দি যাতায়াত করে ঘন ঘন।।
ইন্দুহাটীবাসী ভক্ত নাম বাবুরাম।
সুরেন্দ্র, উপেন্দ্র দুই পুত্র গুণধাম।।
উপেন্দ্র করিছে কাজ ঠাকুরের বাড়ী।
ঠাকুর বলেন যাহা করে তাড়াতাড়ি।।
জটাধর নামে ভক্ত দূর্বাসুর গ্রাম।
ঠাকুর বাড়ীতে সেই থাকে অবিরাম।।
চণ্ডালাদি নাম পূর্বে কহিত প্রচুর।
চণ্ডদ্বীপ নাম রাখি দিলেন ঠাকুর।।
সেই গ্রামে বহু ভক্ত এইভাবে আছে।
অনন্ত নামেতে ভক্ত নামে মাতিয়াছে।।
ঠাকুরের সেবা তেহ বহুত করিল।
এবে দেশে থেকে সদা বলে হরি বল।।
আরেক সেবক ছিল নাম জলধর।
খুলনা জিলায় বাস সে কৃষ্ণনগর।।
মহাটালী হরিবর ভক্ত একজন।
ধোপড়া নিবাসী জানি সে বিধুভূষণ।।
গুরুচাঁদ চরিতের সংবাদ সংগ্রহে।
নবকুমারের সঙ্গে ঘুরিল আগ্রহে।।
খুলনা জিলার মধ্যে তালবুনে গ্রাম।
শ্রীকালীচরণ নামে ভক্ত গুণধাম।।
বিশ্বাস উপাধিধারী বড় দেল-খোলা।
কেদার ডাকুয়া ভক্ত বাড়ী চণ্ডীতলা।।
খাসেরডাঙ্গায় বাস পাচুরাম মাঝি।
গোপালেরে গুরু করে হ’য়ে মনে রাজী।।
বাইনতলাতে বাস সে মধুসূদন।
গোপালের দৃঢ় ভক্ত ছিল একজন।।
তার ভ্রাতা সে কেদার মাধবে মানিল।
তারে গুরু করি নামে প্রমত্ত হইল।।
আনন্দ বিশ্বাস নামে বাঁশতলী গাঁয়।
গোপালচাঁদের শিস্য জানি পরিচয়।।
বাঁশবেড়ে গ্রামে নাম অশ্বিনী কুমার।
সুন্দরপুরেতে বাড়ী নাম জলধর।।
দুর্গাপুর গ্রামে ঘর সে দুর্গাচরণ।
রসিক মেস্তরী আছে ভক্ত অন্য জন।।
বিশ্বেশ্বর, গুরুদাস দিগরাজে ঘর।
বাল্যকালে লীলা তারা করে চমৎকার।।
শিঙ্গারকুলেত ঘর কালাচাঁদ ঋষি।
ময়নামতি পত্নী তার ভক্তিমতী বেশী।।
ভাগ্যধর রাজবংশী বাস ডুমুরিয়া।
গুরুচাঁদে পূজা করে ভাবেতে মাতিয়া।।
বিহারী নামেতে ভক্ত রাজনগরেতে।
গোপালের কৃপাক্রমে এই ভাবে মাতে।।
অসংখ্য ভক্তের সংখ্যা শেষ কিছু নাই।
যার নাম নাই তার পদে ক্ষমা চাই।।
শ্রীকালীচরণ যিনি তালবুনেবাসী।
সহদেব নামে পুত্র বহু গুণ রাশি।।
গুরুচাঁদ চরিতের লিখন কারণ।
বহু বহু দেশে আমি করিনু ভ্রমণ।।
সর্বদায় সহদেব সঙ্গে সঙ্গে ছিল।
যাহা কিছু বলি আমি সকলি লিখিল।।
পুনরায় ‘কপি’ করি দিল সবটুক।
এত পরিশ্রম তা’তে নাহি কোন দুখ।।
শ্রীমান কেশব আর সে মনমোহন।
সহদেব সহ এই ভাই তিনজন।।
কত যে সাহায্য মোরে করিয়াছে এরা।
মুখেতে বলিয়া তাহা যায় না’ক পারা।।
পিক-কণ্ঠে গান করে সে মনমোহন।
মনে হ’ত কল্প লোকে গিয়াছি তখন।।
‘দয়াল’ নীরবে দেখি মোর প্রতি চায়।
দেখিলে মুখের ছবি পরাণ জুড়ায়।।
গ্রন্থকার পরিচয় দিবার কারণ।
আজ্ঞা করিয়াছে মোরে প্রমথরঞ্জন।।
ভক্তের চরণে মোর এই পরিচয়।
সবার অযোগ্য আমি বলিনু নিশ্চয়।।
অনন্ত করুণা প্রভু করেছিল মোরে।
কর্মদোষে ফেলিয়াছি সব নষ্ট করে।।
সর্বত্র মন্দেতে ভরা ঘোর দুরাশায়।
এই যা’ কহিনু মোর সত্য পরিচয়।।
জাগতিক পরিচয় করি নিবেদন।
পিতামহ নীলমণি সাধু মহাজন।।
তার চারি পুত্র যারা সবে শুদ্ধ শান্ত।
জ্যেষ্ঠ যিনি নাম তার সাধু লক্ষ্মীকান্ত।।
মধ্যম সরল সাধু রাধাকান্ত নাম।
খুলনা জিলার মধ্যে বেতকাটা ধাম।।
তৃতীয় মাধবচন্দ্র সাধু সদাশয়।
চতুর্থেতে রতিকান্ত এই পরিচয়।।
লক্ষ্মীকান্ত ঘরে পঞ্চ পুত্র জন্ম লয়।
পার্বতী, আনন্দ, নব, শিশু, নিত্য কয়।।
মহাসাধু রাধাকান্ত মধ্যম তনয়।
বড়দিয়া গ্রামে বিভা করে মহাশয়।।
জানকী নামেতে কন্যা করিল ঘরণী।
সেই গর্ভে জন্ম মোর সে মোর জননী।।
বিমাতা কাঞ্চন দেবী বহু স্নেহ করে।
তার গুণে শান্তি বহু পাই এ অন্ত্ররে।।
পতি-প্রাণা পত্নী মোর দুঃখের সঙ্গিনী।
সরলা পবিত্রা নারী সে বিন্দুবাসিনী।।
দুই পুত্র দুই কন্যা প্রভু দিল মোরে।
সচ্চিৎ, অচ্যুত নাম দুই পুত্র ধরে।।
আরতি নামেতে জ্যেষ্ঠা কনিষ্ঠা অঞ্জলি।
পিতা মাতা মত্ত মোর সেই স্নেহে ভুলি।।
মহানন্দ, শ্যামানন্দ দুই সহোদর।
মাধবের পুত্র নাই ধরার উপর।।
এক কন্যা প্রভাবতী নিষ্ঠাবতী ছিল।
বিবাহের কিছু পরে পরলোকে গেল।।
তেরশ’ পচিশ সালে প্রভুর কৃপায়।
রতিকান্ত এক পুত্র নিজ ঘরে পায়।।
চিরানন্দ নাম তার বি.এ পাশ করি।
বর্তমানে কলিকাতা করিছে চাকুরী।।
অন্নপূর্ণা নামে দেবী সতীর উদরে।
শ্রীরতির পুত্র চিরানন্দ জন্ম ধরে।।
মহানন্দ, শ্যামানন্দ, চিরানন্দ ভাই।
চিরকাল এক সঙ্গে ভিন্ন ভাব নাই।।
ওকালতী পাশ করি বসি বাগহাটে।
কিন্তু ব্যবসায় ভাল নাহি লাগে মোটে।।
চিরকাল শ্রীগোপাল করিল করুণা।
এতই পাষণ্ড আমি জাগে না চেতনা।।
দয়াময়! গুরুচাঁদ! পতিত পাবন।
পরম দয়াল তুমি বিপদভঞ্জন।।
মহামন্দ মহানন্দ মত্ত অহংকারে।
তোমার চরিত কথা লিখিতে কি পারে?
তোমার কৃপায় সিদ্ধ গোস্বামী গোপাল।
অগোচরে সেই মোরে দিল সব বল।।
প্রমথরঞ্জন মোরে দিলেন প্রেরণা।
হরিভক্তগণে জাগা’ল চেতনা।।
শ্রীনব, কুমুদ দোঁহে সজাগ রাখিল।
তোমার করুণা আসি এ গ্রন্থ লিখিল।।
তুমি যে কি তাহা আমি কিছু বুঝি নাই।
বুঝি বা না বুঝি প্রভু তবু দয়া পাই।।
তুমি যে কি দয়াময়! তাহা জান তুমি।
চরাচর বিশ্বব্যাপী প্রভু অন্তর্যামী।।
সংখ্যাতীত অপরাধ পদে ক্ষমা চাই।
সাষ্টাঙ্গ প্রণাম পদে ক্ষীরোদের সাঁই!
প্রভুর কৃপায় গ্রন্থ হ’ল সমাপন।
জয় হরি-গুরুচাঁদ বল সর্বজন।।