অথ দশরথের বাটী নায়েবের অত্যাচার
পয়ার
কিছুদিন পরে সাধু তৈলকুপি যায়।
গোস্বামীর নিকটেতে ধর্ম শিক্ষা লয়।।
মালাবতী সঙ্গে তাহা করিল যাজন।
অকামনা প্রেমভক্তি ব্রজের ভজন।।
মালাবতী দশরথ মিলে দুইজনে।
মাঝে মাঝে আসে যায় ঠাকুরের স্থানে।।
কোন কোন সময় আসেন একা একি।
ঠাকুরের সঙ্গে এসে করে দেখাদেখি।।
কভু দশরথ ঠাকুরকে ল’য়ে যান।
তিন চারি দিন তথা থাকেন ভগবান।।
কৃষ্ণ গোষ্ঠ নাম পদ সংকীর্তন হয়।
নদীয়াতে যেন শ্রীবাসের আঙ্গিনায়।।
মাতিল অনেক লোক প্রেমে উতরোল।
ঘাটে পথে যেতে খেতে শুতে হরিবোল।।
গ্রামের পাষণ্ডী যারা বাধ্য নাহি তায়।
কাছারিতে নায়েবের কাছে গিয়া কয়।।
কি মত এ গ্রামে আনিয়াছে দশরথ।
গ্রাম্য লোক নষ্ট হ’বে থাকিলে এ মত।।
মেয়ে পুরুষেতে বসি একপাতে খায়।
মেয়েদের এঁটে খায় পদধূলা লয়।।
পুরুষ ঢলিয়া পড়ে মেয়েদের গায়।
মেয়েরা ঢলিয়া পড়ে পুরুষের গায়।।
দিবানিশি হরিনামে পেয়েছে কি মধু।
রাত্রি ঘুম পড়া নাই এ কেমন সাধু।।
ওঢ়াকাঁদি হ’তে হরি ঠাকুরকে আনে।
সে ঠাকুর যেন কোন মোহিনী মন্ত্র জানে।।
বুঝিয়াছি ইহারা নিশ্চয় জানে যাদু।
হরি ব’লে যায় চ’লে সতী কুলবধূ।।
এ গ্রামেতে লেগেছে বাবু বড় হুলস্থূল।
গ্রাম্য নমঃশূদ্রদের গেল জাতি কুল।।
কশ্যপ মুনির বংশ গোত্রজ কাশ্যপ।
দশরথ হ’তে সেই মান্য হয় লোপ।।
ইহার বিচার কর আনিয়া কাছারি।
এই কাণ্ড আপনাকে দেখাইতে পারি।।
ঠাকুর আছেন দশরথের ভবনে।
সকল প্রত্যয় হবে দেখিলে নয়নে।।
রাত্রিকালে হুড়াহুড়ি শুনা যায় শব্দ।
ছয় সাত দিন মোরা হ’য়ে আছি স্তব্ধ।।
নায়েব বলিছে এবে যাওগে সকলে।
আমাকে লইয়া যেও কীর্তনের কালে।।
সূর্যদেব ডুবে গেল সন্ধ্যাকাল এল।
নাম গান কীর্তনেতে সকলে মাতিল।।
পুরুষ যতেক বসা পিড়ির উপরে।
মহাপ্রভু বসেছেন গৃহের ভিতরে।।
দরজার নিকটে খোল করতাল বাজে।
ঠাকুর আছেন বসি কীর্তনের মাঝে।।
রামাগণ অনেক ব’সেছে গৃহভরা।
মাঝে মাঝে হুলুধ্বনি দিতেছে তাহারা।।
কেহ বা প্রভুর অঙ্গে দিতেছে বাতাস।
ঠাকুরের ঠাই বসি পরম উল্লাস।।
নাম গানে যবে প্রেমবন্যা বয়ে যায়।
রামাগণে বামাস্বরে হুলুধ্বনি দেয়।।
গৃহে বসিয়াছে রামাগণ সারি সারি।
প্রভুপার্শ্বে বসিয়াছে মালাবতী নারী।।
কোন নারী ঠাকুরের চরণে লোটায়।
কোন নারী পদ ধরি গড়াগড়ি যায়।।
কোন নারী কেঁদেছে হা হরি জগন্নাথ।
শ্রীপদ ধোয়ায় কেহ ধরি অশ্রুপাত।।
হেনকালে গ্রামীরা নায়েবে ল’য়ে যায়।
বাড়ীর উপরে নিয়া তাহাকে বসায়।।
দুইভাগ করিয়া পীড়ার লোক সবে।
চৌকি পাতি সমাদরে বসায় নায়েবে।।
যে স্থান হইতে ঠাকুরকে দেখা যায়।
এমন স্থানেতে নিয়া নায়েবে বসায়।।
রামাগণ বাহ্যজ্ঞান হারা সবে ঘরে।
নায়েবে বসিয়া সেই ভাব দৃষ্টি করে।।
অজ্ঞান হইয়া কেহ প্রেমে গদগদ।
হা নাথ বলিয়া কেহ শিরে ধরে পদ।।
চতুর্দিকে নারী মালা মালাবতী বামে।
মৃদুস্বরে হরি বলে মত্ত হ’য়ে প্রেমে।।
মালাবতী ভেসেছেন নয়নের জলে।
স্কন্ধে হাত দিয়া হরি কেঁদোনা মা বলে।।
বদনে তাম্বুল চাবা চর্বণ যা ছিল।
কাশীসহ সেই চাবা ঠাকুর ফেলিল।।
মালাবতী হস্তপাতি ধরিল চর্বণ।
মস্তকে পরশ করি করিল ভক্ষণ।।
ভক্ত পদ রজ ভক্ত পদ ধৌত জল।
ভক্ত ভুক্ত শেষে এই তিন মহাবল।।
জগন্নাথ প্রসাদ কুক্কুর মুখ ভ্রষ্ট।
লভিতে বিরিঞ্চি বিষ্ণু শিবের অভীষ্ট।।
স্বয়ং ভগবান মুখ চর্বিত চর্বণ।
মালাবতী সতী তাহা করিল ভক্ষণ।।
শীলা যথা শত কুম্ভ জলে সিক্ত নয়।
প্রেমে দ্রবীভূত নয় পাষণ্ড হৃদয়।।
বিশেষ গ্রামী লোকের ছিল অনুরোধ।
তাহা দেখি নায়েবের উপজিল ক্রোধ।।
ডেকে বলে দশরথ ওরে বনগরু।
মজাইবি দেশ শুদ্ধ ক’রে নিলি শুরু।।
ওরে বেটা ভণ্ড তুই আয় দেখি শুনি।
কি বুঝিয়া ছেড়ে দিলি ঘরের রমণী।।
এত মেয়েলোক কেন দেখি তোর ঘরে।
ঠাকুরে লইয়া কেন এত প্রেম করে।।
ভাল ভাল অই যদি ঠাকুর হইবে।
মেয়েদের সঙ্গে কেন এ রঙ্গ করিবে।।
দশরথ বলে বাবু মোর দোষ কিসে।
যার যার নারী সেই সেই ল’য়ে আসে।।
জেনে শুনে বল বাবু কেবা করে দোষ।
প্রভুকে আনিনু আমি হইয়া সন্তোষ।।
ঠাকুর আছেন মত্ত হরিনাম গানে।
পাষাণ গলিত হয় এ নামের গুণে।।
মেয়েরা এসেছে সব নাম আকর্ষণে।
অগ্নি দেখে পতঙ্গিনী থাকিবে কেমনে।।
নায়েব কহিছে কেন হুলুধ্বনি দেয়।
দশরথ বলে হ’য়ে আনন্দ হৃদয়।।
নায়েব কহিছে কেন পদধরি পড়ে।
দশরথ বলে শুধু গাঢ় ভক্তি করে।।
নায়েব কহিছে তোর নারী কোন প্রমে।
ঠাকুরের কাছে বৈসে মেতে কোন নামে।।
দশরথ কহে ইহা কভু নহে মন্দ।
এ আমার বহু ভাগ্য পরম আনন্দ।।
নায়েব কহিছে ওরে ভণ্ড তপস্বী।
যাহা শুনিয়াছি তাহা দেখিলাম আসি।।
এ হেন কুকর্ম কেবা দেখেছে কোথায়।
ঠাকুরের ত্যজ্য চাবা তোর নারী খায়।।
নারী লোক সঙ্গে করে হরিনাম গান।
শীঘ্র ভণ্ড তপস্বীরে বাহিরেতে আন।।
কোন প্রেম করে নারী লোক সমিভ্যরে।
নিয়া আয় আমি তাই জিজ্ঞাসি ঠাকুরে।।
দশরথ বলে বাবু স্থির কর মন।
আমি সব বলিতেছি ক্রোধ কি কারণ।।
সাধু মুখামৃত খাবে শাস্ত্রে ইহা আছে।
গৌরাঙ্গ লীলায় ইহার প্রমাণ রয়েছে।।
বৈষ্ণব বন্দনা মধ্যে মধুর আখ্যান।
গৌরাঙ্গের নিস্টীবন নারী লোকে খান।।
বন্দিব বৈষ্ণবী শ্রীমাধবী ঠাকুরানী।
প্রভু যারে আলবাটী বলেন আপনি।।
গৌরাঙ্গ যখন নিস্টীবন ফেলাইত।
বদন ব্যাদান করি মাধবী খাইত।।
থু থু করি যখন ফেলিত নিস্টীবন।
মুখে মুখে মাধবী তা করিত গ্রহণ।।
কাকী যে আধার আনি বাছারে খাওয়ায়।
তেমনি মাধবী দেবী খাইত সদায়।।
বিশেষতঃ ভগবান মুখ নিস্টীবন।
মম নারী খেলে তার সফল জীবন।।
নায়েব কহিছে বেটা ভাঙ্গিব ভণ্ডতা।
করেছিস এতদিন আজ যাবি কোথা।।
আন অই ঠাকুরকে কাছারী লইব।
আ’জ অই ঠাকুরের মর্ম কি শুনিব।।
দশরথ বলে আমি প্রাণে যদি মরি।
সেও ভাল প্রভু কেন যাবেন কাছারী।।
করি মানা ঘরে নাহি যেও কোন জন।
মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন।।
মালাবতী ঘর থেকে শুনিলেন তাই।
ডেকে বলে এখানে আসিলে রক্ষা নাই।।
দশরথ মস্তকেতে ছিল এক টিকি।
নায়েব ধরিয়া তাই দিল এক ঝাঁকি।।
চর্মের পাদুকা ছিল নায়েবের পায়।
গোঁড়া বাঁধা লোহাতে কঠিন অতিশয়।।
সেই জুতা খুলে মারে ক্রোধে পরিপূর্ণ।
দশরথ বলে নাহি ভাবি তার জন্য।।
দশরথ মৃত্তিকায় শুইয়া পড়িল।
নায়েবের পদধরি পিঠ পেতে দিল।।
দশজুতা মারিব তোরে রে দশরথ।
যাহাতে না যা’স আর ঠাকুরের সাথ।।
এতবলি পৃষ্ঠে মারে দশজুতা বাড়ী।
জরিমানা ডেকে দশরথে দিল ছাড়ি।।
জরিমানা করিলাম তোরে দশটাকা।
শীঘ্র ফেলা টাকা নৈলে আরো মা’র খাবি।
টাকা যদি নাহি দিস কাছারী যাইবি।।
প্রভু বলে মালাবতী শীঘ্র ঘরে যাও।
দশ টাকা চাহে ওরে কুড়ি টাকা দেও।।
তাহা শুনি মালাবতী কুড়ি টাকা এনে।
নায়েব নিকটে টাকা দিলেন তখনে।।
ঘর হ’তে ঠাকুর কহেন নায়েবেরে।
আর দশ টাকা আমি দিলাম তোমারে।।
কত নিবে কত খাবে প্রজা বেঁচে রৈলে।
ধনে বংশে মজাইলে যে মা’র মারিলে।।
বারে বারে ইচ্ছা কর মোরে মারিবারে।
এই মা’র আমা ছাড়া মারিয়াছ কারে।।
জরিমানা দিলাম যে দশ টাকা বেশি।
এখন নায়েব বাবু হ’য়েছ কি খুশী।।
এমন মধুর নামে পাষণ্ডী হইও না।
এজন্য দিলাম আমি বেশি জরিমানা।।
এখন আমরা গান করিতে কি পারি।
পরকাল যা’তে রহে বলে হরি হরি।।
নায়েব কহিছে এবে আর কার ভয়।
দিবা নিশি হরি হরি বলহ সদায়।।
অমনি বলিয়া সবে প্রভু হরিচাঁদ।
উচ্চৈঃস্বরে সবে করে নাম গান পদ।।
নামে প্রেমে দিশেহারা মাতিয়া উঠিল।
বিষাদে হরিষ হ’য়ে সুখেতে ভাসিল।।
কারু মনে দুঃখ দশরথরে মেরেছে।
তাহা মনে করি হরি বলে কাঁদিতেছে।।
নায়েবের প্রতি কেহ ক্রোধ করি পড়ে।
সে ভাবেও হরি বলে দম্ভ কড়মড়ে।।
কোন মেয়ে বলে হরি আর ভয় নাই।
আনন্দে বলিল হরি আর কিবা চাই।।
কি করিবে কোন বেটা বলে কোন মেয়ে।
নায়েব দিয়েছে আজ্ঞা জরিমানা নিয়ে।।
কোন মেয়ে বলে সব মঙ্গল কারণ।
কি দিয়ে কি করে হরি বুঝে কোন জন।।
একাকী বিশ্বাস মহাশয় মা’র খেল।
নির্বিঘ্ন হইল দেশ ভয় দূরে গেল।।
হরিনাম লইতে নির্বিঘ্ন যদি হয়।
বিশ জুতা বাড়ী খেলে তাতে কিবা ভয়।।
কোন মেয়ে বলে কেন মোরে মারিল না।
চল্লিশ জুতাতে মোর কিছুই হ’ত না।।
কেহ বলে আমারে মারিলে ভাল হ’ত।
কেন মারিল না মোরে পঞ্চাশৎ জুত।।
শ্রীহরি নামের গুণ বাড়ে যে প্রহারে।
তাহাতে কি ব্যাথা হ’ত আমার অন্তরে।।
ধন্য দশরথ ধন্য নায়েব প্রহার।
হরিনাম বিঘ্ন নাশ করে খেয়ে মা’র।।
হরিচাঁদ হরিচাঁদ হরিচাঁদ বল।
কি করিতে পারে আর পাষণ্ডীর দল।।
পাষণ্ডীর গণ সব এল ত্বরা করি।
দাস হ’য়ে হরি বলে দন্তে তৃণ ধরি।।
তাহা দেখি সবে বলে জয় হরি জয়।
জয় মহাপ্রভু হরিচাঁদ জয় জয়।।
কেহ বলে প্রেমানন্দে হরি হরি বল।
এইভাবে মহাভাবে সবে মেতে গেল।।
লম্ফ ঝম্ফ ভূমিকম্প পুলকিত অঙ্গ।
কেহ বা বেহুঁশ আর নহে প্রেম ভঙ্গ।।
বিপক্ষেরা বলে গিয়ে নায়েবের ঠাই।
বলে বাবু দেখ গিয়া আর রক্ষা নাই।।
নায়েব কহিছে খুব কীর্তন হউক।
প্রেমে মেতে যাহা ইচ্ছা তাহাই করুক।।
তোদের কথায় আমি মিছা করি রোষ।
ঘরে দ্বীপ বহুলোক কিবা করে দোষ।।
পতিব্রতা সতী নারী পতি আছে সাথে।
দোষ যদি করে তাহা করে গোপনেতে।।
এখন তাদের প্রতি নাহিক জুলুম।
নাম গান করিবারে দিয়াছি হুকুম।।
মারিয়াছি দশরথে ভাগ্যে কিবা হয়।
এ ঠাকুর সামান্য ঠাকুর যেন নয়।।
আজানুলম্বিত ভুজ আকর্ণ- নয়ন।
মানুষেতে নাহি মিলে এমন লক্ষণ।।
দশটাকা জরিমানা বিশ টাকা দিছে।
কি জানি ঠাকুর যেন মোরে কি ক’রেছে।।
স্বপ্নে দেখিয়াছি অই ঠাকুর আসিয়া।
হস্তের আঙ্গুলি মোর নিল খসাইয়া।।
আরো দেখিলাম যেন আসিয়াছে পত্র।
গৃহদাহ হইয়াছে ঘর নাহি মাত্র।।
ইতি উতি কত যে কি দেখিনু স্বপনে।
নৃত্য করে বাম অঙ্গ শান্তি নাই মনে।।
ফিরে গেল পাষণ্ডীরা অতি মৌন হয়ে।
এ দিকেতে সংকীর্তন উঠিল মাতিয়ে।।
যামিনী হইল ভোর নাম সংকীর্তনে।
সবে প্রেমে মত্ত, ক্ষুধা তৃষ্ণা নাই মনে।।
সংকীর্তন হইতেছে কার নাহি হুঁশ।
ভেদাভেদ জ্ঞান নাই নারী কি পুরুষ।।
বৃংহত বৃংহতি রবে হস্তী হস্তী যুঝে।
হেন রব হইতেছে কীর্তনের মাঝে।।
কীর্তনের রব যেন মত্ত সিংহ রব।
শৃগালের মত ভীত পাষণ্ডীরা সব।।
হেনজ্ঞান হইতেছে সময় সময়।
প্রবল ঝঞ্ঝাটে যেন গ্রাম উড়ে যায়।।
ভেক প্রায় ভীরু হ’য়ে হ’য়ে র’য়েছে পাষণ্ড।
এইরূপে বেলা হ’ল পাঁচ ছয় দণ্ড।।
নিশি ভোর পূর্বাকাশে শূন্যে স্থিতি রবি।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গীত গায় কবি।।