-দ্বীনো দাস
কে বলে রে আমি আমি
সেই আমি কি আমিই আমি,
লালন বলে কেবা আমি
আমারে আমি চিনিনে।।
-ফকির লালন সাঁই
পবিত্র কোরআনে সুরা বাকারার ১৫৬ নাম্বার আয়াতে উল্লেখ আছে, ‘মানুষ যে উৎস থেকে এসেছে, সেই উৎসেই ফিরে যাবে।’ গ্রীক ও নিউপ্লটনিক দার্শনিকরাও কোরআনের এ তত্ত্বকে সমর্থন করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, আদৌতে এই উৎস কি এবং কোথায় সে উৎস? ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই সত্য যে, যা থেকে বা যে উৎস থেকে এ জীবজগতের যাত্রা শুরু হয়েছে এবং এ নশ্বর ধরনীতে দীর্ঘপথ পরিক্রমার পর একদিন সেই উৎসের সাথেই জীবের মিলন হবে। ফকির লালন সাঁইজি একই কথা প্রশ্নাকারে বলছেন- “তুমি ছিলে কোথায়, এলে কোথায়, যাবে কার সনে?’
আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে যেতে হবে ফকিরি ও মরমী চিন্তার উৎসে। তার জন্য একটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে। বুঝতে হবে, আমাদের নশ্বর এ দেহের মাঝেই অবিনশ্বর সত্তার বসত। বাইরে হাতড়ে না ফিরে আপন ভাণ্ডে অর্থাৎ দেহমধ্যে নির্ণয় করলে সেই ভেদ জানা যাবে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে বলছে, ‘মোমিনের কলবে আল্লাহ পাকের আসন।’
ফকিরি মনের দেলধুড়া বা আত্ম-অনুসন্ধান স্পৃহা থেকে ফকিরিবাদের উৎপত্তি। ফকিরি চিন্তা-চেতনার মূল ভাবনাই হলো নিজেকে চেনা বা জানা অর্থাৎ আপন দেহ ভাণ্ডের মধ্যস্থ যাবতীয় গুড়রহস্য উদ্ঘাটন করার সাধনা।
শুধু ধর্মের বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান দিয়ে নয়, হৃদয়ের প্রেমেই স্রষ্টাকে লাভ করার শ্রেষ্ঠতম পথ। এর প্রমাণস্বরূপ জগতের অনেক সুফিসাধক, বাউল, ফকির, মরমী সাধক তাদের জীবনদর্শন, বাণী এ আদর্শ সাক্ষ্য হিসাবে রেখে গেছেন। বস্তুত অন্তরের গভীরে উপলব্ধ সত্য শিহরনের অনুভূতি যা কিনা বোধিস্বত্ত্ব ব্যতীত জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, প্রজ্ঞা দ্বারা বিচার্য নয়।
তাইতো সাঁইজি লালন ফকির বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্নক্ষণে বিভিন্নভাবে বলেছেন-
১. দেল ধুড়িলে জানতে পাবি আহাম্মদ নাম হল কেরে।
২. আপন ঘরের খবর নে না।
৩. আপনার আপনি হলে ফানা, সকল যাবে জানা।
একটা পর্যায়ে তিনি আরো বললেন, গুনে পড়ে তাকে পাওয়া যায় না ; এটা অসম্ভব-
গুনে পড়ে সারলি দফা
করলি রফা গোলেমালে,
চিনলি না মন কোথা সে ধন
ভাজলি বেগুন পরের তেলে।।
সাঁইজি বোঝাতে চেয়েছেন, ধর্মের বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান করে, বেশভূষা পরে, দায়সারা ভাবে গুনে-পড়ে দফা বা রফা করলে কাজের কাজ হয় না। বাঁধে কেবল গোলেমাল। তিনি হয়তো খানিকটা ক্ষোভ থেকেই বলেছেন, “চিনলি না মন, কোথা সে ধন।” এই যে ধন ‘পরম ধন’ যা কিনা পরমাত্মাকে বুঝানো হয়েছে। সাঁইজির এই পদের এই ভাবটুকু লিখে বা গুনে পড়ে বোঝানো দুর্ভেদ্য।
গোড়াতে একটা কথা বলে রাখা ভাল আমার নিজের সমন্ধে- আমি কবি-সাহিত্যিক নই। নামমাত্র সাঁইজির একজন কানা ভক্ত মাত্র। তাই সাঁইজির বাণী ও তার গুড়রহস্য সম্পর্কে আমার নিজের জানাশোনাও অতিশয় স্বল্প। কিছুদিন ধরে পত্র-পত্রিকায় দেখছি সাঁইজির সম্বন্ধে কিছু বিক্ষিপ্ত লেখালেখি হচ্ছে। এতে অবশ্য হতাশ বোধ করিনি; এটা অপ্রত্যাশিতও নয়। এমন কি সাঁইজি ফকির লালনের বাণী বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী ‘পল্লিগীতি’ জ্ঞান রূপেই শোনে। ফলে এই গানের ভেতরের লুকায়িত জ্ঞানগত দিকটা তাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরের রয়ে গেছে।
ছেঁউড়িয়ায় সাঁইজির নামে যে মাজার কমিটি বানানো হয়েছে শুরু থেকেই আমি সেই কমিটির সদস্য। এই কমিটির সভাপতি হলো রাষ্ট্রপক্ষ; মানে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক। কারণ লালন সাঁইজির মাজার বেশকিছু বছর হতে রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে। আক্ষেপের বিষয় হলো, যারা ফকিরির যৎসামান্ন্য জ্ঞান রাখে না তাদের হাতেই চলে গেছে লালন ফকিরের মাজার পরিচালনার দায়িত্ব।
তারা ফকিরের কোন মর্মই জানে না। তারা ব্যানার বানিয়ে সাঁইজিকে বলে বাউল সম্রাট। এটা খুবই অন্যায়, মেনে নিতে কষ্ট হয়। সাঁইজি তাঁর কোন কালামে (পদে) নিজেকে বাউল লালন বলে উল্লেখ করেন নি। ভেবে দেখুন তো, কোথাও কি তিনি বাউল নামের দোহায় দিয়েছেন?
এ ব্যাপারে মাজার কমিটির সেক্রেটারি বন্ধু সেলিম ভাইকে বহুবার বলেছি। কিন্তু তিনিও এর সুরাহা করতে পারেন নি। কারণ এই কমিটি সর্ব ক্ষমতা রাষ্ট্রপক্ষের হাতে। তারা কি করে বুঝবে বাউল আর ফকিরের ভেদ কি?
যা হোক, সাঁইজির ভাষায় ফিরে যাই। পরম সত্তাকে চেনা মোটেও সহজ কাজ নয়। সাঁইজি স্বয়ং বলছেন, “পাবে সামান্য কি তাঁর দেখা, বেদে নাই যার রূপরেখা।” সাঁইজি লালন ফকিরের সাধনায়-রচনায় যে দেহতত্ত্বে ভাব ও বস্তুবাদ ব্যক্ত হয়েছে তা দেহ থেকে দেহাতীত সাধনায় সর্বভুতে ঘটে; পটে স্রষ্টার অস্তিত্ব উপলব্ধি করা। এই উপলব্ধির মৌল প্রেরণা আত্মোপলব্ধি, সহজ কথায় যাকে বলে ‘নিজেকে জানা’।
“ইন্নাল্লাহা খালাকা আদামা আলা সুরাতেহি” অর্থাৎ আদম স্রষ্টার সুরাতে তৈরি আর মুমিনের কলবে তাঁর আরস। যদি তাই হয়, তাহলে কেন এত আচার-অনুষ্ঠান করে বাইরে ছুটাছুটি? স্রষ্টার অংশেই যদি আদম সৃষ্টি তবে দেহ মধ্যে খুজলেইতো পাওয়া যাওয়ার কথা। তাইতো এক মহৎ সাধক বলে গেছেন-
মন তোর ঘরে বসে মহাজন,
খুজে মরিস কেন তীর্থ বৃন্দাবন।।
অন্তরে ভক্তি সঞ্চারিত না করে বাহ্যিক পোশাক-পরিচ্ছেদ ধারণ নিরর্থক। গোসাই কুবির বলেছেন-
মন ন রঙ্গায়ে, রঙ্গায়ে যোগী কাপড়া
আসন মারী মন্দিরমে বৈঠা,
ব্রক্ষ ছাড়ী পুজন লাগি পাথরা।।
অর্থ: প্রেমের রঙ্গে মন না রাঙ্গায়ে যোগী তাহার কাপড় রাঙ্গিয়েছেন। দিব্যি মন্দিরের মধ্যে আসন করে বসে ব্রক্ষাকে ত্যাগ করে পাষাণ পূজা করছে। সাঁইজি বললেন, “শালগেরাম কে করে খাড়া ভুতের ঘরে ঘণ্টা নাড়া, কলিরতো ভাই এমনি দাড়া স্থূল কাজে জগৎ মেতেছে।”
“সাধ্য কিরে আমার সেরূপ চিনিতে” ফকির লালন সাঁইজির এই বাণীর মর্মভেদ বুঝতে গেলে আমাদেরকে একটু গভীরে যেতে হয়। মহাবিশ্বের অগণিত মহাজাগতিক বিষয় বাসনার স্রোত মানবদেহে প্রবেশের ফলে মানসিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, তাই জাগতিক জীবন্ত চলমান দৃশ্য মানুষের নি:শ্বাসের সাথে সংযুক্ত থাকে।
এই অনিত্য জগতের ভ্রান্তি, দু:খ, ভোগ এসব হতে মুক্তি পেতে হলে, পরম সত্যের চির আনান্দময়, সুখময় ভাব প্রেম জগতে যেতে হলে যোগ, ধ্যান সাধনা দ্বারা নি:শ্বাসের সৎগতি ও স্তম্ভোনের কার্য নিত্য করতে হবে। আর তা না করলে মানুষের মনুষ্যত্বে মায়ারূপী শয়তান নামক ঘুণ পোকা লেগে ধীরে ধীরে অবক্ষয় সৃষ্টি করবে।
স্রষ্টা তার সৃষ্টির সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডজুড়ে এক বিরাট মায়াজাল সৃষ্টি করে রেখেছেন এই মানুষের পরীক্ষা স্বরূপ। এখানে প্রশ্ন আসে এই মায়া আসলে কি? আর শয়তানই বা কি?
শয়তানের কার্য মায়ায় বশীভূত করে, ধোঁকা দিয়ে মানুষকে সত্য হতে দূরে রাখা। তারপরও যদি প্রশ্ন উঠে, মায়া বা শয়তান আসলে কি? তাহলে বলতে হয়- মায়া হল স্রষ্টার পরিকল্পনার লীলাখেলার কার্যশক্তি। মায়ার কাজ হল মানুষের আত্মা থেকে জড় ও সত্য হতে অসত্যের পথে পরিচালিত করা।
আবার একে ঠেকানোর জন্য সেই পরমস্রষ্টা অবতার হয়ে নেমে আসেন মুক্তিদাতা রূপে। এই যারা সেই অবতারকে অনুসরণ করে তারাই কেবল মুক্তির সন্ধান পায়। এখানেই গুরু ধরার বিরাট সাফল্য, নইলে ঘুরতে হবে লক্ষ্য গলি বেড়ী সার করে।
মানুষের অস্তিত্বে অবস্থানরত বিবেক জ্ঞান ও বৈরাগ্য দিয়ে গুরু নির্ধারিত পথে এই প্রপঞ্চময় মায়াকে বশে রাখা যায়। আমরা এই মানুষজাতি অধিকাংশই ঐ মায়ায় বশীভূত হয়ে রয়েছি। ভোগবিলাশ সুখ স্বাছন্দ নিয়ে ব্যস্ত আছি। দেহ মধ্যস্থ সেই পরমসত্তা বা স্রষ্টার রূপ কোনভাবেই দর্শন করতে পারছি না। তাই সাঁইজি বললেন-
সাধ্য কিরে আমার সে রূপ চিনিতে
অহরনীশি মায়ার ঠুশি জ্ঞান চক্ষুতে।।
আসলে পূর্বপুরুষের ধারা অনুযায়ী যে ধর্ম আমরা সামাজিক ও পারিবারিক দিক থেকে পেয়েছি ওটাকে অন্ধের মত আঁকড়ে ধরে আছি। আবারো সাঁইজির কথাই বলতে হয়- “আধার ঘরে সর্প ধরার মত। এ যেন সেই কলুর বলদের মত, ‘ঢাকে নয়ন পাকে চালায়; কলুর বলদের মত ঘুরার কার্য নয়।’ স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী যারা তবে তাদের উচিত তাকে দেখা বা দেখার চেষ্টা করা নচেৎ-
ধর্ম নিয়ে ভণ্ডামি করার থেকে স্পষ্ট
নাস্তিক উত্তম।।
পবিত্র কোরআন সাক্ষি দিচ্ছে- আদম আল্লাহর সুরাতে, আদমের কলবে আল্লাহর আসন, আল্লাহ তাঁর নূর ও রূহ দিয়া আদম সৃষ্টি করেছেন। এত কিছুর পরও এই মানুষ আমরা- জ্ঞান দিয়ে, প্রজ্ঞা দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে নির্ণয় না করে সেই অন্ধের মত গোড়ামিতে লিপ্ত রয়েছি।
যে আমাকে দেখলো না, চিনলো না, কাল কিয়ামতের দিন আমি তাকে দেখবো না চিনবো না। এ কথাটা কোরআন দেখলে মিটে যাবে। তাহলে কি দাঁড়ালো? আল্লাহকে অবশ্যই চিনতে বা দেখতে হবে। তাইতো সাঁইজি বললেন, “এখানে না চিনলাম যাঁরে ওখানে কেমনে চিনিব তাঁরে?”
খুব সুকৌশলে ফকির লালন সাঁইজিকে উপেক্ষা বা উহ্য রাখা হয় প্রায় সকল ক্ষেত্রে। এই কানা পণ্ডিতরা ভাবে, গ্রাম্য গানের গীতিকার তো আর যাই হোক রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের সমান মর্যাদার হতে পারে না। শহুরে কানা মধ্যবিত্ত পণ্ডিত শ্রেণীর সাহিত্য সংষ্কৃতির জগতে তারা সাঁইজিকে জায়গা করে দিতে পারিনি। জানি না এ কার অক্ষমতা – সাঁইজির? না আমাদের এই জাতির?
এই দেখা বা চিনিবার জন্য আল্লাহ পাক বলছেন- “তোমরা উছিলা তালাশ করো।” আর এই উছিলাই হচ্ছে সদগুরু বা জিন্দাপীর। যাকে বলা হয় নায়েবে রাসুল। আর তাকে পেলে তিনিই দেখিয়ে দেবেন নবীর সন্ধান ও পরমের সন্ধান। আর নবীর সন্ধান পেলেই পরম প্রভুর দর্শন মিলে যাবে অনাসে। নচেৎ কোন কালেও তার দেখা মিলবে না।
সাঁইজি বলেছেন, “জিন্দা পীরের খান্দানে যাও দেখিয়ে দেবে সন্ধানে, আব হায়াতের নদী কোনখানে।’ শিক্ষক ছাড়া যেমন শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব নয়; উকিল ছাড়া মহামান্য জজ-এর কাছে যাওয়া সম্ভব নয়; তেমনি গুরু বা মুর্শিদ ছাড়া স্রষ্টার দরবারে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কথাগুলো কেমন যেন গদছাড়া সরল-সহজ মনে হয় ; কিন্তু এই কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে মূলের হিসাব।
২০০০ সালের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত ফরহাদ ভাইয়ের ‘লালন ও সাম্প্রদায়িকতা’ লেখাটার কথা মনে পরে প্রায়ই। সেই কথাগুলি আজও ভুলতে পারিনি। তার কথার সাথে আমিও একমত পোষণ করে বলছি, ‘বাঙালির দিক থেকে ফকির লালন সাঁই খুব ফেলনা কেউ নন।’
বাঙালিত্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁকে আবহমান বাংলার মধ্যে আত্মস্থ করার চেষ্টা হয় কিনা সেই দিকটা নিশ্চয়। মুখ রক্ষার খাতিরেও ভেবেছিলাম বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংষ্কৃতি সর্দাররা কিছু সত্য লিখবেন-কিছু করবেন। যা দেখে আমাদের গর্ববোধ হবে।
বাংলাকে যতটা আবহমান ধারণা করা হয়েছিল, দেখা গেল ততটা বহতা সে নয়। সতর্কতার সঙ্গেই বহু স্রোত বাইরে রেখে দেওয়া হয়। আমার একটা লোভ চিরকালই ছিল জ্ঞানীগুণিদের লেখা বা প্রানোঞ্জল ভাষার মধ্য থেকে কিছু সারবস্তু অর্জন করবো। কিন্তু তা তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে।
খুব সুকৌশলে ফকির লালন সাঁইজিকে উপেক্ষা বা উহ্য রাখা হয় প্রায় সকল ক্ষেত্রে। এই কানা পণ্ডিতরা ভাবে, গ্রাম্য গানের গীতিকার তো আর যাই হোক রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের সমান মর্যাদার হতে পারে না। শহুরে কানা মধ্যবিত্ত পণ্ডিত শ্রেণীর সাহিত্য সংষ্কৃতির জগতে তারা সাঁইজিকে জায়গা করে দিতে পারিনি। জানি না এ কার অক্ষমতা – সাঁইজির? না আমাদের এই জাতির?
আর আত্মভোলা নিরীহ নিরক্ষর বাংলার যে মানুষগুলো বছরের পর বছর ধরে সাঁইজির যে তত্ত্বে জীবনাচারণ উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্থবিত্ত, কুল, সব ছেড়ে নতুন সত্য জীবন গড়ে তোলার চর্চায় নিয়োজিত, তাদের কারো সাথে সাংবাদিক ভাইরা কোনো আগ্রহই প্রকাশ করে না। ব্যাপারটা এমন যে, গাঁজা খাওয়া আর অদ্ভুত কাপড়চোপড় পরে ঘুরে বেড়ানোটাই যেন লালনপন্থী।
সত্তর দশকের পর থেকে সাঁইজির ২/১ বাণী ‘গানজ্ঞানে’ শহুরে বাবুমশাইরা বা মধ্যবিত্ত শ্রেণী শুনতে শুরু করার পর। কিছু যুবক লম্বা চুল রাখতে শুরু করেছে এবং নিজেকে প্রচার করছে নগর বাউল হিসাবে। তবে তারা সেই অমৃত বাণী বুঝছে কিনা তাতে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে।
সাঁইজির দোল উৎসব, ১লা কার্তিক সাধুসঙ্গ দুটিই ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক ধরণের নিরব লড়াই বা সংঘবদ্ধ নিরব আয়োজন। এগুলো মূর্খদের বিরুদ্ধে নিরব এক আন্দোলন। ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, এই সংঘবদ্ধতার তাৎপর্য অসাধারণ।
ঐ দিনগুলোতে সাঁইজির অনুসারী ও অনুরাগীরা একত্রিত হলেও বাংলাদেশের প্রধান সাংস্কৃতিক ধারার মধ্যে সাড়া জাগানো তো দূরে থাক আগ্রহটুকুও প্রকাশ করে না। না থাক্ তাদের আগ্রহ, না থাক্ তাদের সাড়া। তাতে অসুবিধা নাই। কারণ তাঁর ভক্তরা যে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ছেন। তারা লড়বেনই। তাদের দমানো বা থামানো যাবে না কোনো প্রলোভনেই।
কারণ তাদের এ কাজটা অনেক দূরপাল্লার এবং প্রত্যেকবার তারা প্রমাণিত করে তাদের এই নিরব একত্রিত করণের মধ্য দিয়ে। তাদের এই মহৎ কাজের জন্য, নত:শীরে সাধুবাদ জানাই।
সাঁজির দুটি অনুষ্ঠান এই উৎসবে শহর থেকে যে বাবুরা আসেন টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার তরুণ ভাই ও বোনরা আসেন। দেখি এরা চড়ুই পাখির মত ঘুরে বেড়ায়। বয়োবৃদ্ধ সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরাই সাঁইজির ভাষার কুল পেল না। আর এই চড়ুই পাখির মিষ্টি দলরা কি বুঝবে সাঁইয়ের মর্মভেদ?
মাজারে অনেক রকমের লোকের সমাগম হলেও এই তরুণ সাংবাদিকদের আগ্রহের অন্যতম কেন্দ্র হলো, যারা গাঁজা খেয়ে একটা মেকি ধ্যান বা ব্যোম হয়ে বসে ভণ্ডামি করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের উপর।
আর আত্মভোলা নিরীহ নিরক্ষর বাংলার যে মানুষগুলো বছরের পর বছর ধরে সাঁইজির যে তত্ত্বে জীবনাচারণ উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্থবিত্ত, কুল, সব ছেড়ে নতুন সত্য জীবন গড়ে তোলার চর্চায় নিয়োজিত, তাদের কারো সাথে সাংবাদিক ভাইরা কোনো আগ্রহই প্রকাশ করে না। ব্যাপারটা এমন যে, গাঁজা খাওয়া আর অদ্ভুত কাপড়চোপড় পরে ঘুরে বেড়ানোটাই যেন লালনপন্থী।
তখনো নারীকে প্রয়োজন হয় যেমন শিশুর প্রয়োজন হয় মাকে। শিশু বোঝে না আগুন কি জিনিষ, পানি কি জিনিষ। মোটকথা এই সময়ের সাধকের ভাবটা হয় (বাৎসল্য) সাধক তখন যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে ফেলে, তাই সাধকের শেষ সময় প্রর্যন্ত মমতাময়ী নারী প্রয়োজন। এরপর সাধক ফকির গুরুতে পরিণত হয়। তখন তিনিই স্বয়ং গুরু।
এই সাংবাদিক ভাইদের অনেকেই বাউল-ফকিরদের যৌন জীবন সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী। তাদের ভাব বা বস্তুবাদ বিষয় সম্পর্কে নয় যৌন জীবন নিয়েই তাদের যত চিন্তা-চেতনা। বাউলদের যৌন জীবন সম্পর্কে আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা সুষ্পষ্ট-সুন্দর-সঠিক ধারণা পেয়েছি আমার গুরুজির কাছ থেকে। যা কিনা এখানে এই মূহুর্তে দিতে পারছি না। তবে আগ্রহীদের জন্য কিছুটা চেষ্টা করা যেতেই পারে। তবে তা অবশ্যই সাঁইজির আদেশ ক্রমে-
ফকিরের আসল উদ্দেশ্য যা কিনা মুখ্য তা হল নিজেকে চেনা, স্বরূপ দর্শন। আর তার জন্য অতি প্রয়োজন বিন্দু ধারণ। কিন্তু বর্তমান সমাজে ব্যাপারটা এ রকম অন্নগত প্রাণ আর যোনিগত মন। আর এ কারণেই সমাজে আজ সর্বস্তরে বিন্দুর অধঃগতি।
এটাকে আটকানো বা ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। আর এটাকে জয় করতে হলে সূক্ষ্ম জ্ঞান দিয়ে, প্রেম-ভক্তির খেলায় মত্ত হয়ে সাধনার চরম উৎকর্ষে পৌঁছাতে হয়। সাধনার বলে স্থূল, প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধ এই চারস্তর অতিক্রম করতে হয়।
ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বগতি হতে হতে ক্রমশ ঐ বিন্দু ধারণ তখন স্থিরতার চূড়ান্ত স্থায়িত্ব লাভ করে। যেমন চালের গড়ানো পানি মটকায় তোলা। তখন সে অতি চেতন শুদ্ধ সংষ্কারযুক্ত, প্রজ্ঞাবান আলোক সমতুল্য সত্তায় রূপান্তরিত হয়। পুণাঙ্গ চৈতন্য জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়। এ ভাবে সাধক নিজ আর নিজে থাকে না, সে হয় তখন ঐশ্বরিক সত্তায় সত্তাবান আর তখনই মনের মানুষ, অধর মানুষের দর্শন হয়।
এই সাধনা একা একা হয় না। নারীর (বন্ধুত্ব) বা সহযোগিতা ছাড়া নারীর হাত থেকে বাঁচার উপায় নাই। তাই দরকার হয় নারীর। সে ছলনাময়ী নারী নয় বরং পাশে চাই মমতাময়ী মায়ের মত নারী। বিন্দু রক্ষণের সাধনাকে যে কোলে পিঠে সন্তানের মতো মানুষ করে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সাধনার এই পক্রিয়াগুলি সাধারণ জীব মানুষ জানে না। সাধনার চারস্তর পার হওয়ার পর তখন আর নারীসঙ্গীর প্রয়োজন হয় না। স্থূল-প্রবর্ত-সাধক-সিদ্ধ এই চারস্তর পর্যন্ত নারীসঙ্গীর প্রয়োজন হয়। তারপর নিষ্কাম প্রেম-সুটল সাধনায় সফল হলে ফকির, তখন উন্নত স্তরে পৌঁছায়।
ফকির তখন নিজের মধ্যে খুঁজে পায় পরম গুরুর ঠিকানা। শরীর ভিত্তিক সাধনায় শুদ্ধচিন্তা করেন এমন বিরল সংখ্যক সাধু ফকির ও আছে। তাকেই বলা হয় নিষ্কাম প্রেম সাধক, জিন্দা পীর, সিদ্ধপুরুষ।
তখনো নারীকে প্রয়োজন হয় যেমন শিশুর প্রয়োজন হয় মাকে। শিশু বোঝে না আগুন কি জিনিষ, পানি কি জিনিষ। মোটকথা এই সময়ের সাধকের ভাবটা হয় (বাৎসল্য) সাধক তখন যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে ফেলে, তাই সাধকের শেষ সময় প্রর্যন্ত মমতাময়ী নারী প্রয়োজন। এরপর সাধক ফকির গুরুতে পরিণত হয়। তখন তিনিই স্বয়ং গুরু।
…………………………………..
চিত্র: ফকির লালন সাঁইজির প্রকৃত কোনো ছবি নেই। লেখাতে ব্যবহৃত ছবিটি লালন ফকিরের কাল্পনিক একটি ছবি মাত্র। বহুল ব্যবহৃত হলেও এই ছবির সাথে লালন সাঁইজির আদৌ কোনো যোগসূত্র খুজে পাওয়া যায় না।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………….
আরো পড়ুন:
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: এক
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: দুই
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: তিন
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: চার
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: পাঁচ
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: ছয়
গুরুপূর্ণিমা
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন