মালসায় কবিগান
খুলনা জেলার মধ্যে মালসা গ্রামেতে।
জাগ্রত সে কালীমাতা বহু দিন হতে।।
নাম করা কালীবাড়ী ছিল এ ধরায়।
শত শত পাঠা বলি হইত তথায়।।
পূজার দিবসে সেই পাঠা বলি হয়।
পর দিন কবিগান হইত তথায়।।
মন্দিরেতে মানত করিত কত জন।
পূজার দিবসে তাহা করিত পালন।।
একদিন তারকের বায়না হইল।
কবিগান গাহিবারে তথায় চলিল।।
নৌকা যোগে দল বল সঙ্গেতে করিয়া।
পূজার দিবসে রাত্রি পৌছালেন গিয়া।।
নৌকা হতে সে তারক একেলা নামিয়া।
ছদ্ম বেসে মন্দিরেতে দেখিলেন গিয়া।।
শত শত ছাগমুন্ড তথায় রয়েছে।
ব্রাহ্মণেরা ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্ব করিতেছে।।
অজা রক্ত নালা বেয়ে নদীতে নেমেছে।
থাকে থাকে সেই রক্ত জমিয়া রহেছে।।
মনে মনে সে তারক ভাবিতে লাগিল।
শত শত প্রাণী বধি মাকে পুজা দিল।।
সন্তানের রক্ত দিয়ে পূজা যদি খায়।
জগত জননী বলে কেন তারে কয়।।
তাই ভেবে সে তারক পিছাইয়া এল।
মনে মনে দুঃখ পেয়ে নৌকায় আসিল।।
নৌকাতে দোঁহারগণ ছিল যত জন।
তাহাদের ডেকে ডেকে কহিল তখন।।
এই খানে গান করা দরকার নাই।
নৌকা বেয়ে চল মোরা দেশে চলে যাই।।
তাই শুনে কহিলেন সূর্য্যনারায়ণ।
হেন কথা বল তুমি কিসের কারণ।।
বায়না পেয়ে এসেছি গাহিবারে গান।
না করিয়া গান মোরা ফিরে যাব ক্যান।।
কত কষ্টে নৌকা বেয়ে আসিয়াছি হেথা।
না বলিয়ে ফিরে গেলে লোকে পাবে ব্যাথা।।
যদি তুমি যেতে চাও না করিয়া গান।
শেষ রাত্রে নৌকা বেয়ে করিব প্রস্থান।।
তারক বলেছে তুমি শুন মহাশয়।
এই খানে যদি থাকি হইবে সংশয়।।
কমিটিতে জানে যদি আসিয়াছি মোরা।
কোন মতে যেতে মোরে দিবে না তাহারা।।
তাই বলি মহাশয় কিছু দূরে যাও।
সেই খানে নৌকা বেধে সকলে ঘুমাও।।
তারপরে শেষ রাত্রে সকলে জাগিয়া।
নৌকা বেয়ে যাব মোরা দেশেতে চলিয়া।।
তাই শুনে সবে মিলে তাহাই করিল।
কিছু দুরে গিয়ে তারা নৌকাটি বাধিল।।
নৌকা পরে পাক করে করিল ভোজন।
তারপর সবে মিলে করিল শয়ন।।
আগা নায়ে সে তারক শয়ন করিল।
কালীমাতা এসে তার শিয়রে বসিল।।
পদ্ম হস্ত বুলাইয়া তারকের গায়।
ডাক দিয়া কালীমাতা তারকেরে কয়।।
শুন শুন শুন বাছা আমার বচন।
মাকে ফেলে চলে যাবে কিসের কারণ।।
মায়ের পরশ পেয়ে তারক জাগিয়া।
মাকে দেখে বসিলেন বিমুখ হইয়া।।
তাই দেখে কালীমাতা কহিল তখন।
কেন বাছা বিষাদিত হইলে এমন।।
তারক বলেছে মাগো বলি তব ঠাই।
তব মুখ দেখিব না মনে ইচ্ছা তাই।।
সন্তানেরে বলি দিয়া পূজা তুমি খাও।
সে কারণে তব মুখ দেখিব না আমি।।
সন্তানের রক্ত তুমি কর হে ভক্ষণ।
জগত জননী তোমা বলে কোন জন।।
তাই শুনে কালীমাতা কহিল তখন।
এই পূজা কোনদিন করি না গ্রহণ।।
ডাকিনী যোগিনী সদা এই পূজা খায়।
আমি কভু কোনদিন থাকিনা হেথায়।।
তারক বলেছে তুমি এই খানে রও।
বর্তমানে দেখিতেছি কেন মিথ্যা কও।।
তাই শুনে কালীমাতা বিনয়েতে কয়।
তব গান শুনিবারে এসেছি হেথায়।।
তুমি যদি চলে যাও না করিয়া গান।
কি করিয়া আমি বাছা জুড়াইব প্রাণ।।
তুমি বাছা নৌকা পথে করিলে গমন।
সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছি শুন বাছাধন।।
এই খানে আজি তুমি কবিগান গাও।
গান গেয়ে তুমি মোর পরাণ জুড়াও।।
তাই শুনে তারকের ঝরে আখি জল।
কালীমার পদে পড়ি বলে হরি বল।।
হেনকালে কালীমাতা হল অন্তর্ধান।
কেন্দে কেন্দে শ্রী তারক হল অজ্ঞান।।
ক্ষণেক চেতনা পেয়ে মনেতে ভাবিল।
দোঁহারগণেরে ডেকে কহিতে লাগিল।।
নৌকা ধয়ে চল সবে কালীবাড়ী যাই।
শেষ রাত্রে তথা গিয়ে ভোর গোষ্ট গাই।।
তাই শুনে কহিলেন সূর্য্য নারায়ণ।
উম্মাদের মত কথা কহ কি কারণ।।
সন্ধ্যায় কহিলে তুমি দেশে চলে যাব।
এই খানে কোন মতে গান না করিব।।
এখন কহিছ কেন কালীবাড়ী যাব।
তোমার মনের ভাব কেমনে বুঝিব।।
তাই শুনে সে তারক কহিল তখন।
একে একে কহিলেন সব বিবরণ।।
তাই শুনে সবে মিলে কান্দিতে লাগিল।
কেন্দে কেন্দে তরী বেয়ে কালীঘাটে গেল।।
ভোর বেলা নৌকা হতে সকলে নামিল।
করিব খোলায় গিয়ে উপনীত হল।।
ঢোল কাশি বাজাইয়া ভোর গোষ্ট গায়।
তাই শুনে চারিদিকে জাগিল সবায়।।
চারিদিকে হতে লোক আসিতে লাগিল।
দেখিতে দেখিতে সেথা লোকারণ্য হল।।
ভোর গোষ্ট গেয়ে পরে আগমনী গায়।
তারপর গাহিলেন ভবানী বিষয়।।
সেই গানে হরে নিল সবাকার প্রাণ।
আখি জলে ভেসে ভেসে শোনে সেই গান।।
কবির খোলায় যত শ্রোতাগণ ছিল।
আনন্দেতে আত্মহারা প্রেমেতে মাতিল।।
হেন দৃশ্য হল সেথা কহন না যায়।
প্রেমেরে তরঙ্গে সবে ভাসিয়া বেড়ায়।।
অলক্ষেতে বসে আছে কালীমাতা যিনি।
নয়ন জলেতে ভেসে গান শোনে তিনি।।
ওদিকেতে মন্দিরেতে পূজক ব্রাহ্মণ।
মা’র চোখে জল ঝরে দেখিল তখন।।
ঝর ঝর আখি জল ঝরিতে লাগিল।
তাই দেখে সে ব্রাহ্মণ মাটিতে পড়িল।।
কেন্দে কেন্দে কহিলেন মায়ের চরণে।
তারকের গান শুনে কান্দ সে কারণে।।
কান্দিয়া ব্রাহ্মণ গেল তারকের ঠাই।
পদে পড়ে কহিলেন শুনহে গোঁসাই।।
তব গান শুনে মাতা আখি জলে ভাসে।
এ জীবন ধন্য হই তোমার পরশে।।
তাই দেখে সে তারক ব্রাহ্মণে ধরিল।
বুকেতে ধরিয়া তারে আলিঙ্গন দিল।।
এহেন আশ্চর্য্য লীলা দেখিয়া নয়নে।
শ্রোতাগণ সবে এসে পড়ে ধরাসনে।।
কেহ কেহ কালীমার মন্দিরেতে গিয়ে।
গড়াগড়ি যায় কেহ মাটিতে পড়িয়ে।।
নারী কি পুরুষ তাহে নাহি ভেদ জ্ঞান।
কেহ কার গায় পড়ে হতেছে অজ্ঞান।।
প্রেমের রঙ্গ ওঠে আকাশ ভেদিয়া।
মাতৃ হারা শিশু যেন বেড়ায় কান্দিয়া।।
কেহ কেহ পড়ে গিয়ে তারকের পায়।
তারকের পদে পড়ে কান্দিয়া ভাসায়।।
তাই দেখে তারকের ঝরে আখি জল।
আধ আধ ভাষা দিয়া বলে হরি বল।।
বহু পরে প্রেমনিধি হইলেন শান্ত।
তাই দেখে সে তারক গান করে ক্ষান্ত।।
গান শেষে সে তারক হইল বিদায়।
দল বল সঙ্গে করে দেশ চলি যায়।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচলিীর ছন্দে।
তারকের ছবি খানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।