ভবঘুরেকথা
ফকির লালন সাঁইজি সাধু গুরু শিষ্য

গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: পাঁচ

-মূর্শেদূল মেরাজ

গুরুবাদে ‘গুরু বিনে গতি নেই’ এই মতাদর্শে শিষ্যরা গুরুকে স্মরণে রেখেই জীবনের সকল কর্ম সম্পাদন করে। মানসপটে গুরুরূপ মূর্ত হয়ে উঠলেই শিষ্য উৎফুল্ল হয়ে উঠে। মন প্রাণ সোপে দিয়ে যে কর্ম করে তাতে ডুবতে পারে। তবে তার জন্য ভক্তকেও হতে হয় শুদ্ধচর্চার অধিকারী। হতে হয় নিরহংকারী।

এ পথে নিজের বিদ্যা, বুদ্ধি, বংশ, ক্ষতি, যশ, মান, সাধন-ভজন নিয়ে গৌরববোধ করলেও বিপদ। তাতেও পতন হওয়ার সম্ভবনা শতভাগ। শিষ্যকে সমর্পিত হয়ে নিজের সকল কিছুই গুরুর চরণে নিবেদন করে। তাই তার আর নিজ বলে কিছু থাকে না। তারপর থেকে সবই গুরুর দান। সবই গুরুর কৃপা। তাই অহংকার করার কোনো সুযোগ নেই। গুরুগীতায় স্বয়ং মহাদেব পাবর্তীকে বলেছেন-

গুরুভক্তি বিহীনস্য তপবিদ্যা ব্রতংকুলম্।
নিষ্ফলং হি মহেশনি! কেবলং লোক রঞ্জনম্।।
গুরুত ভক্তারম্ভ্য দহনং দগ্ধ দুর্গতি কম্মষঃ।
শ্বপচোত্তপি পরেঃ পূজ্যো ন বিদ্যানপি নাস্তিকঃ।।
ধর্মার্থ কামৈঃ কিল্বস্য মোক্ষস্তস্য করে স্থিতিঃ।
সর্বার্থে শ্রীগুরৌ দেবি! যস্য ভক্তিঃ স্থিরা সদা।

অর্থাৎ যদি গুরু ও গুরু ভক্তিশূন্য তাহলে তপস্বী, বিদ্বান, কুলীন সব হওয়াই নিরর্থক। তার বিদ্যা, কুলীনতা, তপস্যা লোকের মনোরঞ্জন করতে পারে। কিন্তু তার কোনও ফল হবে না। গুরু-ভক্তি স্বরূপ আগুন দিয়ে যিনি নিজ পাপ স্বরূপ কাঠকে পোড়াতে পারে সে চণ্ডাল হলেও সম্মানীয় হয়। কিন্তু বিদ্বান বা পণ্ডিত হয়েও যদি গুরুকে মান্য না করে তাহলে সে নাস্তিক, সমাজে-সংসারে সে কখনই সম্মানীয় হতে পারে না।

বাল্মীকি রামায়ণে বলছেন-

স্বর্গ ধনং বা ধান্যং বা বিদ্যা পুত্রাঃ সুখানি চ।
গুরুবৃত্যনুরোধেন ন কিঞ্চিদপি দুর্লভম্।।

অর্থাৎ গুরু ভক্তি করলে স্বর্গ, ধনসম্পদ, বিদ্যা, পুত্র, সুখ ইত্যাদি কোনও কিছুই তার কাছে দুর্লভ থাকে না।

 

এগারো

এতো সাধ্য-সাধনের পর যে গুরুর সন্ধান পাওয়া যায়। যে গুরুর চরণে আশ্রয় নেয়ার জন্য এতো যপ-তপ। তাঁকে পাওয়ার পর যদি তাঁর বাক্য মেনে না চলা হয়। তাঁর দেয়া করণকারণ পালন না করা হয়। তাহলে সবই বৃথা।

তাই গুরু পেলেই হয় না। গুরুকরণ করে গুরুর কৃপায় গুরু হয়ে উঠে। ব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান অর্জন করে তা উপযুক্ত শিষ্যকে দান করে; এই চক্রকে পূর্ণ করে যেতে হয়। এটাই গুরুবাদের রীতি।

সাধুগুরুরা বলেন, মানুষ নিজেই নিজের প্রকৃত গুরু। গুরুর কাজ তাকে সেটা ভক্তকে মনে করিয়ে দেয়া এবং নিজের সাথে পরিচিত হওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়া। দেহধারী গুরুর যে আদৌতে কোনো প্রয়োজন নেই সেটা বোঝার জন্যই গুরু ধরা প্রয়োজন। কারণ গুরুই সেই জ্ঞান প্রদান করে।

গুরু-শিষ্য পরম্পরায় আরেকটি শব্দ হলো ঘরানা বা ঘর। সাধারণত শিল্পের মাঝে যে গুরু-শিষ্য পরম্পরা রয়েছে তাতে কোনো গুরুর বিশেষ শিক্ষা বা শিল্পরীতিকে ঘরানা বলা হয়। এই ঘরানাই আধ্যাত্মবাদে বলা হয় ‘ঘর’। একই মতাদর্শের সিলসিলার কোনো গুরু যদি নতুন কোনো মতাদর্শ বা ধারা প্রবর্তন না করেও; গুরুর সম্মতিতে কিছু সংস্কার করে নিজ শিষ্যদের মাঝে তা প্রচার-প্রসার করে তা সেই গুরুর ঘর বলে বিবেচিত হয়।

লীন হওয়া যাবে পরমের সাথে। জানা জাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে। চেনা যাবে নিজকে। আর এই নিজকে জানা অর্থাৎ স্বরূপের দর্শন লাভের মধ্য দিয়েই যে পরমের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়ে ছিল সৃষ্টির শুরুতে তাতেই লীন হওয়া যাবে। হবে মুক্তি-মোক্ষ-নির্বাণ।

আবার অনেক স্থানে মতাদর্শকেও ঘর বলে বিবেচনা করা হয়। ফকিরির পূন্যভূমি নদিয়ায় ফকিরকুরের শিরোমণি ফকির লালন সাঁইজির সময়কালে এমনি বেশ কয়েকটি ঘরের কথা জানা যায়। এরমধ্যে- লালন ফকিরের ঘর, সতীমাতার ঘর, পাঞ্জুশাহ্’র ঘর, চৌধুরীর ঘর, দেলবার শাহ্’র ঘর উল্লেখযোগ্য।

গুরুবাদী এসকল ঘর ভক্তি আর প্রেমের অনন্য উদাহরণ। যা মানবজাতির জন্য পরম উপহার বলা যায়। গুরুবাদের মানবতাবাদী এমন সত্য মতাদর্শ বিশ্বভূবনে বিরল। নদিয়ায় গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু যে প্রেমের ধারা প্রবাহিত করেছিল সেই স্রোতে প্রেমের যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল।

সেই সর্ব জীবে প্রেম গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারায় আজও বিভিন্ন আঙ্গিকে রূপ-গুণ-ভাব পাল্টে মিশে আছে সমগ্র বাংলা অঞ্চলে। এই মতাদর্শগুলোতে বৈদিক বিশ্বাসের প্রভাব থাকলেও, আদিবৈদিক ভাবধারাও অনেকাংশে লক্ষণীয়। বলা যায় পারস্পরিক বসবাসের সম্প্রীতির যে উদাহরণ দেয়া ভারতবর্ষে তা মূলত এই সব মতাদর্শগুলোই বহন করে চলেছে।

প্রায় একই সময়ে বাংলা অঞ্চলে লোকনাথ বাবা, গণেশ পাগল ও হরিচাঁদ ঠাকুরের মতো সাধক বিচরণ। হরিচাঁদ ঠাকুর ব্রহ্মাণ্যবাদের মাত্রাতিরিক্ত বারাবারির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিম্নবর্গের মানুষের অধিকারের প্রশ্ন প্রবর্তন করেন প্রেমের ধর্ম ‘মতুয়া’ মতাদর্শ।

তবে গুরুবাদে জড়িয়ে আবার যাতে তা ব্রাহ্মণ্যবাদে পরিণত না হয় তাই পরবর্তীতে বিধান করে গুরু প্রথা বন্ধ করা হয়। তাই মতুয়ারা হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরকেই গুরু মেনে প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সংসারী সন্ন্যাসী হয়ে সাধন-ভজন করে চলেছে।

গুরুভক্তিতে নিবেদিত হয়ে কাঁসি, ডঙ্গা, করতাল, ঢোল-খোল বাজিয়ে লাল-সাদা নিশান নিয়ে ‘হরি বল’ ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে যায় গুরুবাড়ির দিকে।

শুধু বাংলা অঞ্চলই নয় ভারতবর্ষ জুড়েই গুরুবাদী এমন অসংখ্য মতাদর্শ-মত-পথ ছড়িয়ে আছে। তাদের আচার-রীতিনীতি-বেশভূষা বাহ্যিকতায় পার্থক্য দেখা গেলেও মূল বিশ্বাস একই। সকলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, গুরুর চরণে আশ্রিত হতে পারলেই, শুদ্ধ মনে গুরু ভক্তি করতে পারলে তবেই প্রাপ্ত হওয়া যাবে পরমজ্ঞান।

লীন হওয়া যাবে পরমের সাথে। জানা জাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে। চেনা যাবে নিজকে। আর এই নিজকে জানা অর্থাৎ স্বরূপের দর্শন লাভের মধ্য দিয়েই যে পরমের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়ে ছিল সৃষ্টির শুরুতে তাতেই লীন হওয়া যাবে। হবে মুক্তি-মোক্ষ-নির্বাণ।

আর এ প্রসঙ্গে মসনবীতে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি বলছেন-

কাজ নাইয়াছতান তা মরা ব বুরিদাহআন্দ,
আজ নফিরাম মরদো জন নালিদাহআন্দ।
ছিনাহ খাহাম শরাহ শরাহ আজ ফেরাক,
তা বগুইয়াম শরেহ দরদে ইশতিয়াক।।

অর্থাৎ বাঁশি বলছে- যখন থেকে আমি বাঁশ ঝাড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি, কেঁদেই চলেছি। আর জেনো আমার এই বেদনা সকল মানুষকে, সকল নর-নারীকে কাঁদতে বাধ্য করেছে। আমি তো এমন হৃদয় অনুসন্ধান করছি যা দু:খের সাগরে নিমজ্জিত; কারণ তাতেই আমি আমার বিরহগাঁথা উজার করে প্রকাশ করতে পরবো। কেননা দু:খীর আহ্বান তো কেবল দু:খীই অনুভব করতে পারে।

 

বারো

সতীমাতার কর্তাভজা সত্যধর্ম হলো- উপাসনায় প্রার্থনায় এক জগৎকর্তার ভজন। অর্থাৎ প্রত্যেকের মাঝে পরমের অংশ হিসেবে যে পরম বাস করে তাকে ঠাকুর জ্ঞানে শ্রদ্ধাভক্তি নিবেদন করা। বৈষম্যমূলক ব্রাহ্মণ্যবাদের বংশগত জাতিভেদের পরিবর্তে গুণ ও কর্মগত গুরুবাদের সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

কর্তাভজা বীজমন্ত্র হলো- সত্যনাম জয়গুরু সত্য। তোমার ছাড়া তিলার্দ্ধ নাই। জয়গুরু সত্য। এই সত্যনামে সর্বপ্রথম সতীমা ও রামশরণ স্বামী-স্ত্রী উভয়ে দীক্ষাগ্রহণ করেন। তাই সতীমা ও রামশরণ কর্তাভজা সত্যধর্মের ধারক।

যিনি এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় ঘটন অঘটন, সকল কার্য-কারণের কারণ ও সর্বময় কর্তা, তাকে-ই কর্তাভজন সত্যধর্ম্মে কর্তা বলা হয়েছে। এই মতাদর্শের প্রবর্তক আউলচাঁদ মহাপ্রভু বলেছেন-

গুরুভক্তি অভিলাষে, থাকবি তক্তে বসে
নাম ধরে ডাকবি ওরে ভোলামন,
মিলবে তোর মনের মানুষ যা বলি তাই শোন।।
(ভাবেরগীত নং- ৩২৭, কলি-২)

অর্থাৎ তোমরা গুরুর আশ্রিত হও, গুরুবাক্য পালন কর, গুরুকে শ্রদ্ধাভক্তি কর। একমাত্র চেতন গুরুই পারে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মাধ্যমে পারমার্থিক মুক্তির সন্ধান দিতে। গুরুর কৃপা বিনে পারমার্থিক মুক্তি কোন ভাবেই সম্ভব নয়।

বৈষম্য মূলক ৪ জাত ৩৬ বর্ণ বংশগত জাতিভেদ-বর্ণভেদ-কৌলিন্য প্রথা তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের সমাজব্যবস্থার পরিবর্তে জাত-পাত-বর্ণ-গোত্র-বিহীন গুণ ও কর্মে যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তির নেতৃত্বে-পৌরহিত্যে সমাজ ব্যবস্থা এবং ধর্ম-কর্ম অনুষ্ঠান পরিচালিত হওয়ার নামই গুরুবাদ।

সতীমাতার কর্তাভজায় মতাদর্শে বিভিন্ন ধারায় বলা হয়েছে-

কর্তাভজা সত্যধর্ম কোন ব্যক্তি গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাকে এক বাক্যে সত্যনামে দীক্ষা দিবে না। গ্রহণেচ্ছুককে প্রথমে সত্যধর্মের মূলস্তম্ভ, মূলনীতি, আদর্শ-উদ্দেশ্য বিষয়ে অবগত করাবে। এসব বিষয় অবগত হওয়ার পর যদি পূর্ণ শ্রদ্ধা-ভক্তি-বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নীতি-আদর্শ-বিধি-নিষেধ যথাযথভাবে পালনের অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়, তাহলে তাকে সত্যনামের আংশিক মূলতত্ত্ব ‘জয়গুরু সত্য’ নামে দীক্ষা প্রদান করবে।

কর্তাভজা সত্যধর্মে দীক্ষাগুরু ও শিক্ষাগুরু একই জন, আত্মজ্ঞান পিপাসু ব্যক্তি অবশ্যই চৈতন্যজ্ঞান সম্পন্ন সদ্গুরুর কাছে থেকে দীক্ষাগ্রহণ করবে।

পারমার্থিক জগতের দৃষ্টিতে দীক্ষা দাতা গুরুদেবই সর্বশ্রেষ্ঠ গুরু। সত্য মতাশ্রিত ভক্তগণ গুরুদেবের শ্রীচরণ কমলে দেহ-মন সমর্পণ করতঃ বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা-ভক্তি সহকারে গুরুকে প্রণতি করবে। কোন গুরুদেব ভক্ত দ্বারা কোন প্রকার শারীরিক সেবা করাবে না; কারণ ইহা অনর্থের মূল।

গুরুদেবের বাক্যসমূহ অবশ্যই সত্যমত সংক্রান্ত ও ভাবেরগীতের আলোকে থেকে হবে। যদি সত্যমত বহির্ভূত কোন বাক্য পালনের জন্য গুরুদেব নির্দেশ করে তাহলে উক্ত বাক্য পালন না করলে শিষ্যের কোন হানি হবে না।

কোনো ভক্ত সত্যনামে দীক্ষাগ্রহণ করার পর গুরুত্যাগ করে অন্য কারো কাছে থেকে দীক্ষাগ্রহণ করবে না। তবে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য স্বধর্মের আদর্শের অনুসারী একাধিক গুরুদেবের উপদেশ গ্রহণ ও সাধুসঙ্গে কোন বিধিনিষেধ নেই।

 

তেরো

বাউল মতাদর্শের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে নানা মুনির নানা মত প্রচলিত আছে। কেউ একে সুফিবাদ থেকে, কেউ বৌদ্ধ মহাযন পন্থী থেকে আবার কেউ একে বৈষ্ণব মতাদর্শ থেকে উদ্ভব বলে চিহ্নিত করেছে। আবার অনেকে একে এ সকল মতধারারই মিলিত রূপ বলে মতামত দিয়েছেন।

অনেকে বাউল মতবাদকে স্থানীয় ধারা বলেও বিশ্বাস করেন। কেউ কেউ মনে করেন, এই মতাদর্শ জগমোহন গোঁসাই থেকে প্রবর্তিত হয়। সম্ভবত ১৪৫০ সালের দিকে বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের বাঘাসুরা গ্রামে এই জগমোহন গোঁসাই জন্মগ্রহণ করেন।

জগমোহন গোঁসাই জগন্মোহিনী বাউল সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। তাকে আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। জগন্মোহিনী সম্প্রদায়ের মূলমন্ত্র ‘গুরু সত্য’। তারা পরলোকগত গুরুর পাদুকাকে সংরক্ষণ করে ভক্তি শ্রদ্ধা করে। এরা জাতপাতের ধার ধারে না। এ সম্প্রদায়ের বাউলরা তিন ভাগে বিভক্ত- গৃহী, সংযোগী ও উদাসী।

আবার অনেকে বাউল মতাদর্শের আদিপুরুষ হিসেবে ‘গুরু কবির’কে চিহ্নিত করেন। যারা গুরু কবিরকে আদিপুরুষ বা সর্বপ্রথম গুরু মান্য করেন; তাদেরকে কবির পন্থী বাউল বলেও ডাকা হয়। আর যারা জগমোহন গোঁসাইকে প্রথমগুরু মান্য করেন তাদের বলা হয় জগন্মোহিনী পন্থী।

একথাও বলা হয়, চৈতন্যদেবের মৈথুনাত্মক সাধনধারা অনুসরণ করে আউল চাঁদের শিষ্য মাধববিধি বাউলমত প্রবর্তন করেন। মাধববিবির শিষ্য বীরভদ্রের তৎপরতায় এই মতের বিস্তৃতি ঘটে। বীরভদ্রের প্রবর্তিত ধারাকে অনেকে শুদ্ধ বাউল ধারা বলে বিবেচনা করেন।

বাউলদের গুরুগৃহ বা গুরুর সমাধিকে কেন্দ্র করে আখড়া গড়ে ওঠে। ঘুরে বেড়ানোই তাদের কাজ, আখড়া সে অর্থে তাদের সাময়িক আবাসস্থল মাত্র। বাউল নারী-পুরুষরা সাধারণত এক রঙের পোশাক পরিধান করে। কাঁধে থাকে ভিক্ষার ঝুলি। তারা সন্তান ধারণ বা প্রতিপালন করতে পারে না।

এ সম্পর্কে ড আহমদ শরীফ তার বাউলতত্ত্ব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘যে-সব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ ইসলাম কবুল করেছিল আর যে-সব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ হিন্দু-সমাজ ভুক্ত হয়ে নিজেদের পূর্বপুরুষের ধর্মাচরণে রত ছিল, তারাই কালে বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছে। বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সাধারণ উল্টরাধিকার ছিল বলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলনে বাউল মত গড়ে উঠতে পেরেছে।’

পনের শতকের শাহ মোহাম্মদ সগীরের ইউসুফ-জুলেখা, মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, ষোলো শতকের বাহরাম খানের লায়লী-মজনু এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃতে ‘বাউল’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। মধ্যযুগের আগে বাউল শব্দটি সাহিত্য পাওয়া যাওয়ার কথা জানা যায় না।

বাউলের উদ্ভব বা উদ্ভবকাল নিয়ে মতোভেদ থাকলেও বাউল গানে মন-প্রাণ জুড়ায় না এমন বাঙালী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গান বাউলদের ধর্মসাধনার অঙ্গ। ঘুরে ঘুরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গাওয়াতেই তাদের আনন্দ। তারা সাদামাটা জীবনযাপন করে। বাউলরা প্রচলিত ধর্ম-মত, জাত-পাত মানে না। তারা মানবধর্মে বিশ্বাসী।

তারা স্বাধীন ও মুক্ত মনের অধিকারী, গৃহী হয়েও বৈরাগ্যপন্থী। দেহের মধ্য দিয়ে নিজেকে সন্ধান করাই বাউল মতবাদের প্রধান লক্ষ। নিজের ভেতরেই তারা পরমের সন্ধান করে। বাউল মূলত একটি বিশেষ লোকাচার ও ধর্মীয় সম্প্রদায়।

বাউলদের মধ্যে গৃহত্যাগী ও গৃহী দুটি ধারাই দেখা যায়। যারা গুরুর কাছ থেকে ভেক খিলাফত গ্রহণ করে তাদের ত্যাগী বা ভেকধারী বলা হয়। তারা সংসার ও সমাজত্যাগী। ভিক্ষাই তাদের অবলম্বন। অন্যদিকে গৃহীরা সংসারে থাকলেও বিশেষ কিছু রীতিনীতি পালন করতে হয়।

বাউলদের গুরুগৃহ বা গুরুর সমাধিকে কেন্দ্র করে আখড়া গড়ে ওঠে। ঘুরে বেড়ানোই তাদের কাজ, আখড়া সে অর্থে তাদের সাময়িক আবাসস্থল মাত্র। বাউল নারী-পুরুষরা সাধারণত এক রঙের পোশাক পরিধান করে। কাঁধে থাকে ভিক্ষার ঝুলি। তারা সন্তান ধারণ বা প্রতিপালন করতে পারে না।

তিনি তার ‘হারামণি’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে বলেছেন, ‘ষট্চক্রের প্রধান কথা আত্মশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করা, শরীর-মধ্যস্থ শক্তিরূপিণী কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করা। কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে অপরিসীম আনন্দের অধিকারী হওয়া যায়। তন্ত্রমতে শরীরে মঞ্জিল আছে, ছয়টি মঞ্জিলের ছয়টি নাম আছে, যথা- মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ এবং আজ্ঞা।

বৈষ্ণবরা গেড়ুয়া, লালন অনুসারীরা সাদা পোশাক পরলেও হলুদ, লাল, কালো সহ আরো বহু বর্ণের পোশাক দেয়া যায় বাউলদের বিভিন্ন পন্থায়। অনেক পন্থায় গুরুর পুরানো পোশাক শত-সহস্র শেলাই-তালি দিয়ে পড়রার রীতিও প্রচলিত আছে।

বাউলরা যুগল সাধনায় কামের ঊর্দ্ধে গিয়ে প্রেমের সাধনে মিলিত হয়। বাউল গান উপভোগ করলেও সমাজ কখনো বাউল সম্প্রদায় বা বাউল সাধনাকে মেনে নেয়নি। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ই তাদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন করা হয়েছে। যা এখনো চলছে।

গুরুবাদী বাউল মতাদর্শে সকল কিছুই আবর্ত হয় গুরুকে কেন্দ্র করে। গুরু আশ্রিত হয়ে সাধক, গুরুর নির্দেশে শুরু করে সাধন-ভজন। গুরুর ধারায় সাধককে এই মতে বেশভূষা, পোশাক, আহার-বিহার পাল্টে ফেলতে হয়। এমনকি নামও পরিত্যাগ করতে হয় কোনো কোনো ধারায়।

সমাজ তাদেরকে স্বীকৃতি না দেয়ায় তারা নিজেরাই দলবদ্ধভাবে বসবাস করে গুরুকে কেন্দ্র করে। লোকালয় থেকে দূরে তারা তাদের আখড়া, আস্তানা বা আশ্রম গড়ে তোলে। তাদের মধ্যে বহু ধারা প্রচলিত থাকায়। সকল ধারা পালন না করলেও অনেক ধারাতেই গুরুর প্রতি ভক্তি নিবেদনে গুরুপূর্ণিমা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

বাউলরা বলেন, যারা বায়ুর সাধনা করে তারাই বাউল। অর্থাৎ দমের বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাধন। গবেষক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন তার গ্রন্থে বাউলে সাধনে ষট্চক্রের কথা উল্লেখ করেছেন।

তিনি তার ‘হারামণি’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে বলেছেন, ‘ষট্চক্রের প্রধান কথা আত্মশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করা, শরীর-মধ্যস্থ শক্তিরূপিণী কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করা। কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে অপরিসীম আনন্দের অধিকারী হওয়া যায়। তন্ত্রমতে শরীরে মঞ্জিল আছে, ছয়টি মঞ্জিলের ছয়টি নাম আছে, যথা- মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ এবং আজ্ঞা।

প্রতিটি কেন্দ্র একটি পদ্মের ন্যায়, তার দল আছে এবং প্রত্যেক দলে সাংকেতিক অক্ষর এবং অদৃশ্য মূর্তির পরিকল্পনা রয়েছে, প্রতি কেন্দ্রের অবস্থান বিভিন্ন স্থলে; মেরুদণ্ডের ওপর দিয়ে দুইটি নাড়ীকে অবলম্বন করে কেন্দ্রগুলোর পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়েছে।

গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: ছয়>>

……………………………….
আলোকচিত্র: ফাহিম ফেরদৌস

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………….
আরো পড়ুন:
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: এক
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: দুই
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: তিন
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: চার
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: পাঁচ
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: ছয়

গুরুপূর্ণিমা
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!