গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: ছয়
-মূর্শেদূল মেরাজ
ইড়া আর পিঙ্গলা নাম্নী দুইটি নাড়ী পরস্পরের সহিত জড়িত হয়েছে সুষুম্না-নাড়ীকে কেন্দ্র করে, মেরুদণ্ডের প্রান্তভাগ থেকে উত্থিত হয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে সীমাবদ্ধ হয়েছে এবং সম্মিলিত হয়েছে। মেরুদণ্ড তান্ত্রিক সাধনার বড় স্থান অধিকার করে রয়েছে। ছয়টি কেন্দ্র এই মেরুদণ্ডের ওপর অবস্থিত।’
ফকির লালন সাঁইজির শিষ্য দুদ্দু শাহ্ বাউলের অর্থ বর্ণনা করেছেন এভাবে-
যে খুঁজে মানুষে খুদা
সেই তো বাউল,
বস্তুতে ঈশ্বর খুঁজে
পাই তার উল।।
পূর্ব জন্ম না মানে
ধরা দেয় না অনুমানে,
মানুষ ভজে বর্তমানে
হয় রে কবুল।।
বেদ তুলসী মালা টেপা
এসব তারা বলে ধুঁকা,
শয়তানে দিয়ে ধাপ্পা
করে ভুল।।
মানুষে সকল মেলে
দেখেশুনে বাউল বলে,
দীন দুদ্দু কি বলে
লালন সাঁইজির কুল।।
চৌদ্দ
বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন সাঁইজি যে গুরুবাদী মতাদর্শ প্রবর্তন করে গেছেন। তা তিনি কোনো নির্দিষ্ট জাতি-ধর্ম-বর্ণ-কুলের জন্য নির্ধারণ করে যান নি। লালন মতাদর্শ এক অবারিত দ্বার। সকল মহৎপ্রাণ শুদ্ধাচারির জন্যই তা সদা উন্মুক্ত।
ফকির লালন সাঁইজি তাঁর মতাদর্শ গানে গানে সুরে সুরে ব্যক্ত করে গেছেন। তাঁর সে সকল গান ভক্ত-অনুসারীদের হাত ধরে ছড়িয়ে পরেছে বিশ্বময়। দেশীয় বাদ্যযন্ত্র একতারা-ডুগি, দোতারা, মন্দিরা, ঢোল-খোল, বাঁশির মুর্চ্ছনায় গীত এ সকল পদ সাধারণের কাছে গান হিসেবে সমাদৃত হলেও। লালন মতাদর্শীদের ভাষায় লালনের পদ কেবল গান নয়; এগুলো আদৌতে ‘জ্ঞান’।
আর এই জ্ঞানের ধারা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে গুরুভজনা করে, গুরুর চরণে আশ্রয় নিয়ে, গুরুকৃপার আশায় সাধককুল যুগে যুগে লালন মতাদর্শে লীন হয়েছে। লালন পদের নিগূঢ় তত্ত্ব জেনে সাধককে স্থূল, প্রবর্ত, সাধক দেশ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় সিদ্ধির দেশে।
অনেকে লালন মতাদর্শকে সুফিবাদের ধারা বলে প্রমাণ করার চেষ্টার করলেও, আদৌতে লালন সাঁইজির ফকিরি মূলত বাংলা অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত অত্যন্ত গুরুত্ববহ একটি স্বতন্ত্র মতাদর্শ। লালনের দর্শন এমনি এক সমৃদ্ধ মতাদর্শ যাতে এ অঞ্চলের লোকায়ত দর্শন, বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু, ব্রাহ্ম, নাথ, বৈষ্ণব সহজিয়া, সুফিবাদ, মরমীবাদ, বাউলবাদ সকল কিছুর উপস্থিতি থাকলেও সে স্বতন্ত্র এক ধারা সৃষ্টি করেছে।
গবেষক মনসুর উদ্দিন বলেন, ‘লালন ছিলেন ভোরের কোকিল, আটপৌরে ভাষার প্রাণবান কবি। হৃদয়ের অনুভূতি ও দার্শনিক তত্ত্ব এমন সরল করে বাংলার আর কোন কবি প্রকাশ করেছেন বলে আমার জানা নেই।’
আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন- আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’
সাধুগুরুরা বলেন, বহুজনমের কর্মগুণে মানুষ গুরু আশ্রিত হতে পারে। লালন মতাদর্শে দীক্ষা গুরুই পরম আরাধ্য; তিনিই সাঁই। ভক্তরা গুরুকে ভজনের মধ্য দিয়েই পরম স্রষ্টার দর্শন প্রত্যাশা করে। এ প্রসঙ্গে ফকির লালন সাঁইজি বলছেন-
যেহি মুর্শিদ সেই তো রাছুল
ইহাতে নেই কোন ভুল
খোদাও সে হয়;
লালন কয় না এমন কথা
কোরানে কয়।।
দীক্ষার পর গুরু উপযুক্ত শিষ্যকে সযতনে সাধন-ভজনের প্রতিটি পর্ব শিক্ষা দেন। চাল-জল দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। যা শেষ হয় স্থূল, প্রবর্ত, সাধক পেড়িয়ে সিদ্ধির দেশে। তারপর শিষ্যকে বাকিটা পথ নিজেকেই পাড়ি দিতে হয়। কারণ এ পথ হলো এমন পথ যা জানলে বা বুঝলেই হয় না। যথাযথভাবে যে পালন করে, করণকারণ করে সেই সিদ্ধির দেশের চরমে পৌঁছাতে পারে।
এই গুজ্জাতিগুজ্জ রহস্যে ঘেরা ফকির লালন সাঁইজি গুরুবাদের যে পূর্ণাঙ্গ বিধান দিয়ে গেছেন তা গুরু-শিষ্য পরম্পরার অতুলনীয় উদাহরণ। কারণ এতে সাধককে যেমন সকল কিছু ছেড়ে ফকির হতে হয়। নি:স্ব হতে হয়। শূন্য হতে হয়। তেমনি হতে হয় শুদ্ধ, স্বচ্ছ, নির্মল, প্রশান্ত তথা প্রেমময়।
এই রসরতির সাধ্য-সাধনায় মূলকথা ভক্তি। ভক্তিতে মুক্তি। আর যার ভক্তি যত প্রগাঢ়, প্রেম যত জাগ্রত সেই মুক্তির দিশা পায়।
লালন মতাদর্শে, গুরু-শিষ্য সাক্ষাতে পরস্পর হাত জোড় করে ভক্তি বিনিময় করে। চোখে চোখ রেখে হয় ভাববিনিময়। গুরুর চরণে নিজেকে নিবেদন করে দিতে হয় স্থিরতার পরীক্ষা। লালন ঘরের গুরুরা সাধারণত সাদা বস্ত্র পরিধান করে। তবে সম্পূর্ণ সাদা পরার অধিকার পায় গুরু কর্তৃক খেলাফত প্রাপ্তির পর থেকেই।
ফকির লালন সাঁইজি তার প্রায় প্রতিটি পদের ভনিতাতেই গুরু সিরাজ সাঁইজিকে ভক্তিভরে স্মরণ করেছেন। অবনত হয়ে গুরুর প্রতি কৃতজ্ঞার যেমন প্রকাশ করেছেন। তেমনি আকুল হয়ে গুরুর কৃপা কামনা করেছেন। গুরুর আদেশ যথাযথ পালন করে উঠতে পারেন নি বলে নত শিরে বারং বার নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন।
ফকির লালন সাঁইজি নিজের নাম-পরিচয়-জাত-বর্ণ-ধর্ম সকল কিছুই যেমন অজ্ঞাত রাখতে পেরেছেন। তেমনি নিজ গুরু সিরাজ সাঁইজিকেও রেখেছেন রহস্যের চাদরে মুড়ে। সত্য বলতে, ফকির লালন মানেই রহস্যের ধুম্রজ্বাল। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যেমন সমস্ত সৃষ্টিতে নিজেকে প্রকাশ করে রেখেছেন, তাও তাকে বোঝার সাধ্য কারো নেই।
তেমনি ফকির লালন সাঁইজি তাঁর সকল কিছুই ব্যক্ত করে গেছেন তাঁর রচিত পদে। কিন্তু তা বোঝার সাধ্য কারো নাই। কারণ জ্ঞান যত প্রজ্ঞার দিকে অগ্রসর হয় প্রতিবারই পদের প্রতিটি শব্দের-প্রতিটি অক্ষরের ভিন্ন অর্থ উপস্থিত হয় সাধকের সামনে। তাই তাঁর পদের ব্যাখ্যা করা সহজ তো নয় মোটেই; কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব।
এই গুজ্জাতিগুজ্জ রহস্যে ঘেরা ফকির লালন সাঁইজি গুরুবাদের যে পূর্ণাঙ্গ বিধান দিয়ে গেছেন তা গুরু-শিষ্য পরম্পরার অতুলনীয় উদাহরণ। কারণ এতে সাধককে যেমন সকল কিছু ছেড়ে ফকির হতে হয়। নি:স্ব হতে হয়। শূন্য হতে হয়। তেমনি হতে হয় শুদ্ধ, স্বচ্ছ, নির্মল, প্রশান্ত তথা প্রেমময়।
এতে গুরুর যেমন সকল কিছুই শিষ্যকে ঘিরে। তেমনি শিষ্যেরও সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু গুরু। গুরু-শিষ্যের এই যুগলবন্দীর মেলবন্ধনে মানবমুক্তির পথ প্রসস্থ হয়। গুরুর প্রতি নিবেদিত হয়ে ফকির লালন বলছেন-
অখণ্ড মণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচর।
গুরু তুমি পতিত পাবন পরম ঈশ্বর।।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব তিনে
ভজে তোমায় নিশিদিনে,
আমি জানি নাকো তোমা বিনে
তুমি গুরু পরাৎপর।।
ভজে যদি না পাই তোমায়
এ দোষ আমি দেবো বা কার,
নয়ন দুটি তোমার উপর
যা করো তুমি এবার।।
আমি লালন একই শিরে
ভাই বন্ধু নাই আমার জোড়ে,
ভুগেছিলাম পক্সজ্বরে
মলম শাহ্ করেন উদ্ধার।।
লালন মতাদর্শে গুরুপূর্ণিমা পালনের কথা জানা যায় না। তবে লালন সাঁইজি জ্যৈষ্ঠ মাসে সাধুগুরুদের জন্য ফল উৎসব করতেন বলে জানা যায়। নয় ফলের সমাহারে এই ফল সেবা হতো। লালন ঘরে অনেক সাধুগুরুই এই উৎসব এখনো ঘটা করে পালন করেন।
তবে সাঁইজি ঘটা করে পালন করতেন দোল পূর্ণিমা। করতেন সাধুসঙ্গ। মহাপ্রভুর জন্মতিথির এই গৌড় পূর্ণিমার তিথিটিকে অনেকে গুরুপূর্ণিমা বলেও বিবেচনা করেন। যদিও সাধুগুরুরা বলেন কৃষ্ণের দোলকে কেন্দ্র করেই ফকির লালন এই সাধুসঙ্গ আয়োজন করতেন।
তথাপি ফকির লালনের পদে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু যেমন করে বিরাজ করে; তাতে তার জন্মতিথি উপলক্ষ্যে যদি লালন সাঁইজি সাধুসঙ্গ করে থাকেন তাও অবান্তর হবার কথা না। এই যুক্তিকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। বেদ-পুরাণ যেখানে ফকির লালন সাঁইজির কাছে প্রশ্নবিদ্ধ তাই তার রচয়িতা বা সংকোলকের জন্মতিথি ঘটা করে পালনের প্রশ্ন উঠে না।
কিন্তু গুরুবাদ এবং গুরু-শিষ্য পরম্পরা নিয়ে যার ধ্যান-জ্ঞান তিনি গুরুপূর্ণিমা বা মহালগ্ন পালন করবেন না সেটা মেনে নেয়াও একটু জটিল। তাই ব্যক্তিগতভাবে আমি ধারণা করি ফকিরকুলের শিরোমনি লালন সাঁইজি দোলের পূর্ণ চাঁদেরই গুরুকে ভক্তি নিবেদন করতে গুরুপূর্ণিমা পালন করতেন।
পনেরো
সবশেষে আমি অধম এই গুরুপূর্ণিমার শুভলগ্নে জগতের সকল গুরুকে ভক্তি নিবেদন করে এই লেখার ইতি টানছি এখানেই। গুরু, গুরুবাদ, গুরু-শিষ্য পরম্পরা ও গুরুপূর্ণিমা বিষয়ে লিখে বুঝানো সাধ্যাতীত। কারণ যে এই ভাবের সুধা পান না করেছে তাকে কয়েক কথায় তা বোঝানো সম্ভব নয়।
তাই এই লেখা যত দীর্ঘই করি না কেনো তা অপূর্ণই থেকে যাবে চিরকাল। কারণ গুরুবাদী মানুষ, ভক্তিবাদী মন, গুরু আশ্রিত, গুরুজ্ঞানী জন হাজার হাজার বাক্যে নয়, লক্ষ্য লক্ষ্য শব্দে নয় গোটা তিনেক অক্ষরেই পুরোটা বুঝে নিবে।
অন্যদিকে ভক্তিহীন-প্রেমহীন-নিবেদনহীন প্রাণ পৃথিবীর তাবৎ তাবৎ শাস্ত্র পড়েও তা জানতে পারবে না। সেই জ্ঞানকে সম্মান জানাতে পারবে না। তাই গুরু বন্ধনা দিয়ে এই লেখা এখানেই শেষ করছি। যাতে বন্দনা দিয়ে এ পথের নতুন যাত্রীরা তাদের যাত্রা এখান থেকেই শুরু করতে পারে। সাধু-গুরু-বৈষ্ণব-পাগল সর্বচরণে পাপীর মস্তক দণ্ডপাত। জয় গুরু।।
শ্রী শ্রী গুরু-বন্দনা। পদকর্তা-শ্রীল সনাতন দাস গোস্বামী-
আশ্রয় করিয়া বন্দোঁ শ্রীগুরু চরণ।
যাহা হৈতে মিলে ভাই কৃষ্ণপ্রেমধন।।
জীবের নিস্তার লাগি নন্দ-সুত হরি।
ভুবনে প্রকাশ হয় গুরু-রূপ ধরি।।
মহিমায় গুরু কৃষ্ণ এক করি জান।
গুরু-আজ্ঞা হৃদে সব সত্য করি মান।।
সত্য-জ্ঞানে গুরু-বাক্যে যাহার বিশ্বাস।
অবশ্য তাহার হয় ব্রজভূমে বাস।।
যার প্রতি গুরুদেব জন পরসন্ন।
কোন বিঘ্নে সেহ নাহি হয় অবসন্ন।।
কৃষ্ণ রুষ্ট হলে গুরু রাখিবারে পারে।
গুরু রুষ্ট হলে কৃষ্ণ রাখিবারে নারে।।
গুরু মাতা গুরু পিতা গুরু হন পতি।
গুরু বিনা এ সংসারে নাহি আর গতি।।
গুরুকে মনুষ্য জ্ঞান না কর কখন।
গুরু-নিন্দা কভু কর্ণে না কর শ্রবন।।
গুরু-নিন্দুকের মুখ কভু না হেরিবে।
যথা হয় গুরু-নিন্দা তথা না যাইবে।।
গুরুর বিক্রিয়া যদি দেখহ কখন।
তথাপি অবজ্ঞা নাহি কর কদাচন।।
গুরু-পাদপদ্মে রহে যার নিষ্ঠা ভক্তি।
জগৎ তারিতে সেই ধরে মহাশক্তি।।
হেন গুরু-পাদপদ্ম করহ বন্দনা।
যাহা হৈতে ঘুচে ভাই সকল যন্ত্রণা।।
গুরু-পাদপদ্ম নিত্য যে করে বন্দন।
শিরে ধরি বন্দি আমি তাহার চরণ।।
শ্রীগুরু-চরণ পদ্ম হৃদে করি আশ।
শ্রীগুরু-বন্দনা করে সনাতন দাস।।
(সমাপ্ত)
<<গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: এক
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………….
আরো পড়ুন:
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: এক
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: দুই
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: তিন
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: চার
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: পাঁচ
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: ছয়
গুরুপূর্ণিমা
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com