ভবঘুরেকথা

বাল্য জীবন
গোলক চাঁদের বরে রত্ন জনমিল।
দিনে দিনে মাতৃকোলে বাড়িতে লাগিল।।
অশ্বিনীর মাতা পিতা আনন্দ হৃদয়।
মহারত্ম কোলে করি হরিগুণ গায়।।
কার্তিকের পুত্র দেখে আনন্দ হৃদয়।
পাগলের গুণগান গাহিয়া বেড়ায়।।
মাতৃ স্নেহে আশ্বিনী বাড়িতে লাগিল।
বিধাতার বিধি যাহা কে খণ্ডাবে বল।।
দুই বর্ষ ছয়মাস বয়স যখন।
তার মাতা পরলোকে করিল গমন।।
শিশুবেলা যার মাতা পরলোকে যায়।
তার দুঃখ সারে নাকো লোকে তাই কয়।।
মাতৃহারা শিশু সদা কান্দিয়া বেড়ায়।
তার পিতা কোলে করি করে হায় হায়।।
অশ্বিনীর পিসি মাতা দেখিয়া এ দৃশ্য।
তাহাকে পালিল শেষে মনে হয়ে হর্ষ।।
পিসিমার যত্ন পেয়ে বাড়িতে লাগিল।
তার পর সে কার্ত্তিক বিবাহ করিল।।
অশ্বিনীর বিমাতা সে নাম স্বরুপিনী।
প্রাণ দিয়ে অশ্বিনীকে ভালবাসে তিনি।।
মা মা বলিয়া যখন ডাকিত অশ্বিনী।
ছুটে এসে কোলে নিত হয়ে পাগলিনী।।
বাৎসল্যতে ভরপুর তাহার হৃদয়।
পাড়া প্রতিবেশী সবে মানিল বিস্ময়।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
ক্রমে ক্রমে পঞ্চবর্ষ বয়স হইল।।
একদিন তার পিতা বাড়িতে না ছিল।
পিসিমাতা বিমাতাও কার্যান্তরে গেল।।
একা একা বসে আছে ঘরের ভিতর।
মা বলিয়া কেন্দে ওঠে তাহার অন্তর।।
জলে ভরা আখি দু’টি হাটিতে হাটিতে।
উদয় হইল গিয়ে সে বেলে ঘাটেতে।।
মা মা বলিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।
কান্না শুনে গঙ্গা দেবী ভাসিয়া উঠিল।।
মাতৃ মূর্তি ধরি দেবী পুত্র নিল কোলে।
হরিভক্ত কোলে করি ভাসে আখি জলে।।
শোন তবে ওরে পুত্র তোরে আমি বলি।
তোর মুখে ভাল শুনি হরিনাম বুলি।।
মায়ের কথার বাণী শুনিয়া অশ্বিনী।
প্রাণ ভরে হরিনাম করেন তখনি।।
হরিভক্ত মুখে শুনি হরিনাম ধ্বনি।
নয়ন জলেতে ভাসে মাতা সুরোধনী।।
অলক্ষেতে বসে আছে ভক্ত কোলে করি।
হরিনাম শুনিতেছে সারা দিন ভরি।।
এদিকেতে বাড়ী শুদ্ধ খুঁজিতে লাগিল।
অশ্বিনীকে নাহি পেয়ে প্রাণ উড়ে গেল।।
অশ্বিনীর পিসিমা সে কান্দিয়া ভাসায়।
বিমাতা সে কেন্দে কেন্দে গড়াগড়ি যায়।।
গ্রামবাসী এসে সবে করে হায় হায়।
জলে পড়ে গেছে নাকি মনে এন লয়।।
তাই ভেবে সবে মিলে খুঁজিতে লাগিল।
খাল নাল বিল আর পুকুর খুঁজিল।।
কোথাও না পেয়ে সবে করে হায় হায়।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।।
বেলা গেল সন্ধ্যা হল এমন সময়।
বেলে ঘাট হতে সে হইল উদয়।।
দেখে তার পিসি মাতা কোলেতে করিল।
কোথা ছিলি সোনা মোর কহিতে লাগিল।।
মাতৃহারা শিশু তুই মানিক রতন।
তোরে না দেখিলে বাপ বাঁচে না জীবন।।
বল তুই কোথা ছিলি সত্য করি বল।
আমাদের কাছে তুই না করিস ছল।।
তাই শুনি অশ্বিনী লাগিল বলিতে।
এতক্ষণ ছিনু আমি মায়ের কোলেতে।।
কোলে করে মাতা মোর কহিলেন বাণী।
কোলে বসে হরিনাম কর জাদুমণি।।
মা’র কোলে বসে আমি হরিগুণ গাই।
হরিনাম শুনে মাতা কেন্দে ছাড়ে হাই।।
তোমাদের কথা যেই পড়িল মনেতে।
ছুটিয়া এসেছি আমি মা’র কোল হতে।।
শিশু মুখে এই কথা যখন শুনিল।
নয়নের জলে সবে ভাসিতে লাগিল।।
আশ্চর্য ঘটনা সবে করিয়া শ্রবণ।
বিস্ময় মানিয়া তাই ভাবে মনে মন।।
কেহ বলে এ ছেলের ভাগ্যে কিবা আছে।
মৃত আত্মা এসে তাই হরণ করেছে।।
কেহ ভাল কেহ মন্দ কলিতে লাগিল।
হেনকালে শ্রীকার্তিক কাড়িতে আসিল।।
শুনিয়া সকল কথা মানিল বিস্ময়।
পুত্র কোলে করে তিনি মুখ চুমু দেয়।।
পাগলের বরে এই পুত্র জনমিল।
তবে কেন এ ছেলের বিপদ ঘটিল।।
এর মাতা গিয়াছেন বৈকুন্ঠ ভুবন।
সে কেন করিবে কোলে অপূর্ব কথন।।
মনে হয় ছদ্মবেশে মাতা সুরধনী।
রত্নকে পাইয়া কোলে করেছেন তিনি।।
রত্নকে করিও যত্ন সবারে জানাই।
যারে আনিছে ভবে গোলোক গোঁসাই।।
এর ভবে কোনদিন বিপদ না হবে।
পাগলে আসিয়া তথা রক্ষা সে করিবে।।
এই কথা শুনে সবে সান্তনা পাইল।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।।
তারপরে অশ্বিনীকে পাঠশালে দেয়।
লেখাপড়া করে আর হরিগুণ গায়।।
পাঠশালা শেষ করে আসিলেন বাড়ী।
মা বাপের দুঃখ দেখে লেখা দিল ছাড়ি।।
নিজেদের গরু গুলি মাঠেতে চরায়।
মাঠে গিয়ে গরু রাখে হরিগুণ গায়।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
সংসারের অনটন ক্রমেই বাড়িল।।
একাদশ বর্ষ যবে হইল তাহার।
তার পিতা মনে ভাবে কি করি এবার।।
বড় বেড়ে বাস করে সুধন্য পোদ্দার।
ধনধান্যে পরিপূর্ণ কত মান্য তার।
তার বাড়ী অশ্বিনীকে বেতন করিয়া।
বন্দোবস্ত করে তারে দিল পাঠাইয়া।।
প্রতি মাসে এক টাকা বন্দবস্ত হল।
গরু রাখিবারে রত্ন সেই বাড়ী গেল।।
এইভাবে সেই বাড়ী গরু চরাইত।
পরের ফসল কভু গরুতে না খেত।।
মাঠে গিয়ে গরু রাখে হরিগুণ গায়।
চারিদিকে হতে গরু আসিত তথায়।।
অশ্বিনীকে চটে আর মুখ পানে চায়।
ভাষাহীন পশুজাতি কি যেন কি কয়।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী উঠিয়া দাঁড়ায়।
হস্ত বুলাইয়া গায় স্বান্তনা করিত।।
শুন শুন ওহে গরু আমার বচন।
পরের ফসল কভু খেওনা কখন।।
তাই শুনি গরু গুলি চরিয়া বেড়াত।
পরের ফসলে কভু নাহি মুখ দিত।।
তাই দেখে রাখালেরা আসিত তথায়।
অশ্বিনীকে ডেকে যেতে কহিত সবায়।।
কহ ভাই কার কাছে এ মন্ত্র শিখিলে।
গরুতে না মুখ দেয় পরের ফসলে।।
তাই শুনে তাহাদের বলিত অশ্বিনী।
তন্ত্র মন্ত্র ওই সব আমি নাহি জানি।।
আমি শুধু হরিনাম করিয়া বেড়াই।
হরিনাম ছাড়া কভু মানি নারে ভাই।।
তাই শুনে রাখালেরা মানিত বিস্ময়।
অশ্বিনীকে ভাল তারা বাসিত সবাই।।
গরু লয়ে সন্ধ্যাবেলা গৃহেতে আসিত।
যার যেইখানে স্থান সেখানে দাঁড়াইত।।
দুগ্ধবতী গাভীগুলি দোহন করিত।
পূর্বের চাইতে দুধ অনেক হইত।।
তাই দেখে গৃহস্বামী সন্তষ্ট হইয়া।
অশ্বিনীকে কাছে নিয়ে কহিত কান্দিয়া।।
শুন শুন বাছাধন বলি যে তোমায়।
অবলা এই পশুজাতি কথা নাহি কয়।।
কোন গুণে এরা তোমা এত ভালবাসে।
তোমার কথায় এরা আখি জলে ভাসে।।
কহ বাছা এই ভাব বুঝিলে কেমনে।
মনে হয় পুর্বজন্মে এরা তোমা চেনে।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী ভাবে মনে মনে।
মৌন হয়ে থাকে সদা ঝরে দুনয়েনে।।
তাই দেখে গ্রহস্বামী কিছু না বলিল।
ভোরবেলা সে অশ্বিনী বাড়ী চলে গেল।।
আর নাহি গেল সেই গৃহস্থের বাড়ী।
তার পিতা কহিলেন দু’টি হস্ত ধরি।।
কহ বাপ কি দুঃখেতে বাড়ী চলে এলে।
কথা নাহি কয় শুধু ভাসে আখি জলে।।
এই ভাবে বাল্যকাল হয়ে গেল সায়।
মহাভাবে মহারত্ন হরিগুণ গায়।।
এ দীন বিনোদ বলে পঁচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ওরে মন বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!