শ্রীমল্লোচন গোস্বামীর জয়পুর গমন
পয়ার
গোস্বামী বেড়ান সদা তরণী বাহিয়া।
কখন বা পদব্রজ বেড়ান ভ্রমিয়া।।
ভাদ্র মাসে এক দিন তরীখানি ল’য়ে।
একা চলেছেন সাধু সে তরী বাহিয়ে।।
ধীরে ধীরে চলেছেন তরীখানি ভগ্ন।
তুণ্ড হাতে ধরে ডাণ্ডি করে করি লগ্ন।।
নৌকা বেয়ে এসেছেন লোচন ঠাকুর।
ধীরে ধীরে উত্তরিল এসে জয়পুর।।
বরষায় জলমগ্ন বাড়ীর নিকটে।
বসিছে তারক সে বাড়ীর পূর্ব ঘাটে।।
হরিচাঁদ রূপ চিন্তা বসিয়াছে একা।
হেনকালে গোস্বামী আসিয়া দিল দেখা।।
তারকে জিজ্ঞাসা করে তারকের কথা।
বলহে এখানে তারকের বাড়ী কোথা।।
গোস্বামীকে দৃষ্টি করি তারক চিনিল।
পূর্বে একদিন ওঢ়াকাঁদি দেখা ছিল।।
ওঢ়াকাঁদি শ্রীধামে তারক গিয়াছিল।
সে দিন গোস্বামী ধামে উপস্থিত হ’ল।।
ও হরি! ও হরি! বলে গোস্বামীজী ডাকে।
মহাপ্রভু ডাক শুনে পরম পুলকে।।
তাহা শুনি তারক ভাবিল মনে মনে।
হেন সুধামাখা ডাক ডাকে কোন জনে।।
সামান্য মানুষ না হইবে এই জন।
ইচ্ছা হয় সেবা করি যুগল চরণ।।
বাহির বাটীতে বসি ভাবিতেছি তাই।
নিকটে আসিয়া তবে জিজ্ঞাসে গোঁসাই।।
এখানে বসিয়া বাপ! কি ভাবিছ মনে।
বল শুনি তোমার বসতি কোনখানে।।
বিনয় তারক কহে শুনহে ঠাকুর।
তারক আমার নাম বাড়ী জয়পুর।।
গোঁসাই বলেন তুমি না ভাবিও আর।
ভিক্ষায় যাইয়া থাকি মধুমতী পার।।
দেশে দেশে যখন মাগিয়া খাই ভিক্ষা।
মনন থাকিলে পরে হ’তে পারে দেখা।।
টুণ্ডা হাত পদ মোর বেড়াই হাঁটিয়া।
পদের নীচায় কাষ্ঠ পাদুকা বাঁধিয়া।।
দুই চারি পদ হাটে ঘুরিয়া ঘুরিয়া।
মহাপ্রভু সঙ্গে রঙ্গে কথা ক’ন গিয়া।।
ডেকে বলে ওহে হরি তুমিত গোঁসাই।
আসিলে তোমার বাড়ী বড় ভাল খাই।।
সেই জন্য আসি আমি সময় সময়।
তোমার বাটীতে বড় ভাল পাক হয়।।
লক্ষ্মীর হাতের পাক অন্নাদি ব্যঞ্জন।
কৃষ্ণের নৈবিদ্য আমি করি যে ভোজন।।
হরিচাঁদ প্রভু ক’ন থাক এ বেলায়।
কৃষ্ণের নৈবিদ্য যেন তোমা হ’তে হয়।।
থাকিল লোচন হ’ল ভোজন সময়।
চারিদণ্ড রাত্রিকালে বসিল সেবায়।।
ঠাকুরে বলেন হরি! তুমিও বসহ।
আমি এই বসিলাম মাতাকে বলহ।।
দুই ঘরে দুই প্রভু বসিল সেবায়।
উত্তরের ঘরে হরিচাঁদ দয়াময়।।
পূর্ব ঘরে পিড়িপরে বসিল লোচন।
লক্ষ্মীমাতা দেন অন্ন হ’য়েছে রন্ধন।।
ভোজন করেছে আর বলেছে লোচন।
বড়ই সুপক্ক স্বাদু সুক্তার ব্যঞ্জন।।
হেন ব্যঞ্জনাদি আমি কোথাও না পাই।
তোমার মন্দিরেতে উদর পুরে খাই।।
শান্তিমাতা ব্যঞ্জন দিলেন দুইবার।
তাহা শুনি ব্যঞ্জন দিলেন আরবার।।
আরবার বলে হরি খাইলাম ভাল।
কিবা সুব্যঞ্জন মম রসনা রসিল।।
নদীয়ায় শচীসুত ছিলেন ভিখারী।
তার বাড়ী পেটপুরে খাইবারে নারি।।
গৃহস্থ হ’য়েছ ভাল হইয়াছে ভাল।
মাতা ভাল পাক ভাল খাই আমি ভাল।।
তাহা শুনি মহাপ্রভু লক্ষ্মীমাকে কয়।
পুনঃ ব্যঞ্জনাদি দেহ গোস্বামী সেবায়।।
এইরূপে ব্যঞ্জন লইল পঞ্চবার।
প্রভু হরিচাঁদ বলে না লইও আর।।
তাহা শুনি লোচন ভোজন করে ক্ষান্ত।
হীননিদ্রা জেগে থেকে নিশি করে অন্ত।।
সে হইতে তারকের বাঞ্ছা ছিল মনে।
হেন গোস্বামীর সঙ্গ পা’ব কতদিনে।।
হেন প্রভু তারকের ঘাটেতে উদয়।
গলে বস্ত্র করজোড়ে তারক দাঁড়ায়।।
তারক কহিছে প্রভু আমি সে তারক।
আপনার দরশনে শরীর পুলক।।
ঘাটে নৌকা লাগাইল তারক তখনে।
আনন্দে গোস্বামী ল’য়ে চলিল ভবনে।।
সে হইতে গোঁসাই রহিল সপ্ত বর্ষ।
পূর্ণানন্দ সদা সবে নাহিক বিমর্ষ।।
সময় সময় যাইতেন অন্য স্থানে।
বেশী হ’লে থাকিতেন দুই তিন দিনে।।
তারকের হ’ত যবে একান্ত মনন।
মন বুঝে এসে দেখা দিতেন তখন।।
দশদিন এক পক্ষ কিংবা মাসান্তর।
একারম্ভে থাকিয়া যাইত পুনর্বার।।
কোলাগ্রামে যাইতেন সাধনার ঘরে।
দিন দশ দ্বাদশ থাকিত তথাকারে।।
তারকের হ’ত যদি দেখিবারে মন।
কোলাগ্রামে গিয়া করিতেন দরশন।।
সাধনার বাটী ভক্তি পাইত প্রচুর।
দশ বারো দিন পর যেত জয়পুর।।
কোলাগ্রামে বসতি নামেতে আরাধন।
আরাধন দশরথ ভাই দুই জন।।
ভোলানাথ খুল্লতাত দশরথ নামে।
বড়ই সুখের বাস ছিল কোলাগ্রামে।।
তার জ্যৈষ্ঠ তনয় নামেতে নবকৃষ্ণ।
মথুরানাথ নামেতে তাহার কনিষ্ঠ।।
আরাধন পুত্র ভোলানাথ নাম ধর।
দশরথ নন্দন যাদব কোটিশ্বর।।
দশরথ গৃহিণী সে ফেলী নামে ধনী।
গোস্বামীকে বড় ভক্তি করিতেন তিনি।।
তাহাকে লোচন ডাকিতেন মা বলিয়ে।
ডাক শুনিতেন মাতা অতি হর্ষ হ’য়ে।।
যাদবের মা বলিয়া ডাকিত কখন।
জ্যেঠি বলে কখনো করিল সম্বোধন।।
শ্রীনবকৃষ্ণের চারি পুত্র দুই কন্যা।
জ্যেষ্ঠা কন্যা সাধনা সাধনে বড় ধন্যা।।
সনাতন নামে ছিল ইহাদের জ্ঞাতি।
এক বাড়ী তিন ঘর করিত বসতি।।
তিন ঘর গৃহস্থ একটি বাড়ী পর।
নাহি ভিন্ন ভাব যেন ছিল একতর।।
গণনাতে লোক ত্রিশ ঊনত্রিশ জন।
ছোট বড় নামে প্রেমে মত্ত সর্বজন।।
তার মধ্যে সাধনা নামেতে ছিল যিনি।
সাধনে তৎপরা ছিল যোগেতে যোগিনী।।
অন্নত্যাগী ফলাহারী নিদ্রা না যাইত।
শীতকালে শয্যাতে না শয়ন করিত।।
কটিবেড়া বাসমাত্র গায় নাহি দিত।
ভূমে বাস যোগাসনে যোগেতে বসিত।।
কোলাগ্রামে গোস্বামী লোচন দেব আসি।
সাধনার নিকট থাকিত অহর্নিশি।।
অমায়িক মায়া বাৎসল্যের একশেষ।
গোস্বামী সঙ্গেতে বঞ্চে নাহি কোন ক্লেশ।।
কোন কোন দিন যাইতেন ভিক্ষা জন্য।
জ্ঞান হ’ত বাড়ী যেন হইয়াছে শূন্য।।
সবে চেয়ে রহিত গোঁসাই আশা পথে।
শান্ত হ’ত গোস্বামীজী আসিলে বাটীতে।।
গৃহকার্য করে থাকে গোস্বামী আশায়।
গোঁসাই আসিলে বড় হরষিত হয়।।
পুরুষেরা কার্যন্তরে যাইত যখনে।
গোস্বামীর কাছে যাব সদা ভাবে মনে।।
দিবা ভরি কার্য করি যবে সন্ধ্যা হ’ত।
গোস্বামীর নিকটে এসে সকলে বসিত।।
প্রেমাবিষ্ট অনুক্ষণ থাকিত সবায়।
বাহ্যহারা হ’য়ে কোন নিশি গত হয়।।
এইভাবে জয়পুর থাকেন গোঁসাই।
সময় সময় যেত সাধনার ঠাই।।
যেই ভক্ত সেই হরি ভজ নিষ্ঠা করি।
নামের সহিত আছে আপনি শ্রীহরি।।
মহানন্দ চিদানন্দ রচিতে পুস্তক।
আদেশে প্রকাশে কবি বাসনা তারক।।