বুধই বৈরাগীর গৃহদাহ বিবরণ
পয়ার
লক্ষ্মীপুর গ্রামে বুদ্ধিমন্ত চূড়ামণি।
ভাই ভাই ঐক্য হেন নাহি দেখি শুনি।।
একদিন দুই ভাই ওঢ়াকাঁদি গিয়া।
বাটী আসিলেন মহাপ্রভুকে লইয়া।।
ক্ষণে গান করে দোঁহে দিয়া করতালি।
ক্ষণে নাচে দুই ভাই হরি হরি বলি।।
প্রভুকে আনিয়া ঘরে পুলকিত কায়।
মেয়েরা আনন্দে মগ্ন ঠাকুর সেবায়।।
হেনকালে দীক্ষাগুরু আইল বাটীতে।
দু’টি ভাই আরো পুলকিত হইল তাতে।।
নামেতে গোবিন্দচন্দ্র পাল মহাশয়।
অধিকারী কায়স্থ সে পাল উপাধ্যায়।।
রামভদ্র পাল সিদ্ধ পুরুষ রতন।
সেই বংশধর ইনি সাধু মহাজন।।
রামভদ্র পাল যদি বৃক্ষতলে যেত।
ডাক দিলে পক্কফল মাটিতে পড়িত।।
তাল তাল তোরে ডাকে রামভদ্র পাল।
বলিতে বলিতে অম্নি পড়িত সে তাল।।
অকালে অপক্ক ফল বৃক্ষেতে থাকিত।
ডাক দি’লে পক্ক হয়ে মাটিতে পড়িত।।
আম জাম বদরী বা খর্জূর কাঁঠাল।
অন্যে বলে ডাকে তোরে রামভদ্র পাল।।
বলা মাত্র ফল সব পড়িত তলায়।
অপক্ক থাকিলে পক্ক হ’ত সে সময়।।
এমন মহৎ লোক রামভদ্র পাল।
তাঁর বংশধর শ্রীগোবিন্দচন্দ্র পাল।।
শুষ্ক কাষ্ঠ ধর্ম তার স্নানাদি দু’বেলা।
তিলক ধারণ জপে তুলসীর মালা।।
এহেন গোস্বামী যবে আসিল বাটীতে।
দুই ভাই আনন্দিত হইল মনেতে।।
আসিয়া গোবিন্দ কহে বাছারে বুধই।
বসিতে আসন বাছা করিয়াছ কই।।
চূড়ামণি বুধই কহিছে দু’টি ভাই।
মহাপ্রভু নিকটেতে করিয়াছি ঠাই।।
আমাদের ঠাকুর আছেন যেই ঘরে।
দুই প্রভু সেখানে বসুন একতরে।।
গুরুদেব গোবিন্দ যাইয়া সেই ঘরে।
বলে বুধ এখানে বসা’বি আমারে।।
মেয়েছেলে কত লোক বসিয়াছে ঘরে।
আমি না বসিব এই ঠাকুর গোচরে।।
চূড়ামণি বলে যত আছ বাজে লোক।
বাহিরিতে যাও বৃদ্ধা যুবা কি বালক।।
কেহ না থাকিও আর উত্তরের ঘরে।
মাত্র দুই প্রভু থাকিবেন একত্তরে।।
শুনিয়া সকল লোক আইল নামিয়া।
ঠাকুরের শয্যাপরে গুরু বৈসে গিয়া।।
মহাপ্রভু বুদ্ধিমন্তে ডাক দিয়া বলে।
কাহাকে আনিলি মোর অঙ্গ যায় জ্বলে।।
পাল বলে গাত্র জ্বলে কিসের কারণ।
বুধাইরে কহে পাখা করহ ব্যজন।।
সাধু গুরু দেখিলে মহৎ সুখে দোলে।
আমি গুরু মোরে দেখে অঙ্গ যায় জ্বলে।।
নেরে বাছা ঠাকুরকে নিবি কোনখানে।
বুদ্ধিমন্ত বলে উঠে আসুন আপনে।।
দক্ষিণ ঘরেতে দিল গুরুদেব স্থান।
সেই ঘরে গুরু তবে করিল প্রস্থান।।
গ্রামবাসী যতলোক পুরুষ বা মেয়ে।
প্রভু দরশনে সবে চলিলেন ধেয়ে।।
কেহ হরি বলে কহে করে সেবা কার্য।
পুলকিত অঙ্গ সব জ্ঞান নাহি বাহ্য।।
দক্ষিণের ঘরে গুরু একা মাত্র রয়।
যেই আসে সেই বলে ঠাকুর কোথায়।।
কেহ গিয়ে উঁকি মারে দক্ষিণের ঘরে।
ঠাকুরে না দেখে দুঃখে সবে আ’সে ফিরে।।
বুদ্ধিমন্ত গুরুদেবে ভক্তি আদি করে।
পাক করিবারে দিল দক্ষিণের ঘরে।।
পাক জন্য যত কিছু দ্রব্য এনে দিল।
জল ছিটাইয়া সব দ্রব্য ঘরে নিল।।
পুনঃ পুনঃ ধৌত করি পাক পাত্র আদি।
শুষ্ককাষ্ঠে দিল জল ছিটাইতে বিধি।।
এক মেয়ে সেই কাষ্ঠে জল ছিটাইল।
পরে গুরু শুষ্ককাষ্ঠ পরশ করিল।।
পুনর্বার জল দিল গুরুদেব তায়।
পাক আরম্ভিল কাষ্ঠে অগ্নি না জ্বলয়।।
গুরু বলে নিত্য নিত্য আমি পাক করি।
শুষ্ক কাষ্ঠ উপরে সিঞ্চণ করি বারী।।
এমত কাষ্ঠত আমি পাই নাই কভু।
ঘৃতাদি ঢেলেছি কাষ্ঠ নাহি জ্বলে তবু।।
ধুমায় লোহিত চক্ষু পাক করিবারে।
এত কষ্ট পাই তোরা দেখিলি না মোরে।।
চূড়ামণি রাগ করে মেয়েদের প্রতি।
গুরুদেবে তোরা কেন না করিস ভক্তি।।
মেয়েরা বলেছে কাষ্ঠ শুকনা আছিল।
নিজে গুরু জল দিয়া কাষ্ঠ ভিজাইল।।
বুদ্ধিমন্ত চূড়ামণি প্রভুকে জানা’লে।
পাক করে গুরুদেব অগ্নি নাহি জ্বলে।।
প্রভু বলে তোর গুরু কায়স্থের ছেলে।
নমঃশুদ্র ভেবে মোরে অবজ্ঞা করিলে।।
ঘৃণা মহাপাপ স্পর্শে পালের হৃদয়।
সেই পাপে অগ্নিতাপ হীনতেজ হয়।।
ব্রহ্মতেজ বিষ্ণুতেজ অগ্নিতেজ জ্বলে।
সব তেজ নষ্ট হয় আমাকে নিন্দিলে।।
গুরুকে না চিনে বেটা করে গুরুগিরি।
অহংকারী গুরুকার্যে নহে অধিকারী।।
হেন অহংকারী লোক যথা আইসে যায়।
অগ্নিদগ্ধ নৈলে সেই স্থান শুদ্ধ নয়।।
পাকান্তে করুক সেবা তাতে ক্ষতি নাই।
অর্থলোভে গুরুগিরি এমন গোঁসাই।।
এই বাক্য মহাপ্রভু যখনে বলিল।
অবিলম্বে পাক কার্য সমাধা হইল।।
সেবায় বসিল বহু কষ্টে পাক করে।
দ্বার রুদ্ধ করি সেবা করিলেন পরে।।
সবে বলে দ্বার রুদ্ধ কর কি কারণ।
গুরু বলে না করিও ভোগ দরশন।।
দৈবে যদি কুক্কুরে আসিয়া সেবা দেখে।
কুক্কুর উচ্ছিষ্ট তাহা সেবা করিবে কে।।
বিশেষতঃ শ্রীকৃষ্ণ নৈবিদ্য তাহা নয়।
প্রসাদ না হ’লে অন্ন বৈষ্ণবে কি খায়।।
সেবা করি গুরু বৈসে আসনের পর।
হেথা প্রভুসেবা কার্যে মেয়েরা তৎপর।।
অন্ন লয়ে মেয়ে সব দিলেন প্রভুরে।
ভোজন করেন প্রভু উত্তরের ঘরে।।
একটি কুক্কুর দৈবে আসিল তথায়।
প্রভুর ভোজন পানে একদৃষ্টে চায়।।
জিহ্বা লক্ লক্ করি কাঁপিতে লাগিল।
গৃহ হ’তে প্রভু সেই কুক্কুরে দেখিল।।
পাত্র ল’য়ে প্রভু তবে আসিল বাহিরে।
কুক্কুরকে অন্ন দিয়া প্রভু সেবা করে।।
পালগুরু তাহা দেখি করে হায় হায়।
কিসের ঠাকুর এই কুক্কুরে খাওয়ায়।।
হারে চূড়া হারে বুধ কাণ্ডজ্ঞান নাই।
এই ঠাকুরকে ল’য়ে তোদের বড়াই।।
ওই বেটা যশোমন্ত বৈরাগীর ছেলে।
ঠাকুর জন্মিবে কেন নমঃশুদ্র কুলে।।
অতিশয় ভালোলোক ছিল যশোমন্ত।
তার ঘরে হেন ছেলে বিধির কি কাণ্ড।।
হরিভক্তি বিলাসাদি গ্রন্থ নাহি জানে।
কুক্কুর দৃষ্ট নৈবিদ্য খায় সে কারণে।।
না করে আহ্নিক স্নান নাহি জপমালা।
কুক্কুর লইয়া খায় বেশ করে লীলা।।
মেয়ে মর্দে একসাথে মিশিয়া সকল।
তাল নাই মান নাই বলে হরিবোল।।
আমি গুরু আমার নিকটে না বসিয়া।
প্রেমে মত্ত যত মূর্খ কাহাকে লইয়া।।
বুধই কহিছে হারে পোদা গুরু পাল।
ডাকিলে পড়ে না আর বেল কলা তাল।।
তুমি হও শুদ্র জাতি কায়স্থের কুলে।
গুরুযোগ্য নও গুরু অধিকারী ছেলে।।
গুরু দেখি ভক্তি নাই হয় শিষ্য মনে।
শূদ্রের অবজ্ঞা হয় দেখিয়া ব্রাহ্মণে।।
হাঁড়ি মুচি জোলা দেখি ভক্তির উদয়।
গুরু কি শিষ্যের দোষ বুঝিলেই হয়।।
গ্রন্থে কহে অবৈষ্ণব গুরু কর্তে নাই।
আমাদের ভাগ্যদোষে ঘটিয়াছে তাই।।
‘বিষ্ণুর্জনাতি বৈষ্ণব’ বলে জ্ঞানীজনে।
নিন্দা কর সাক্ষাতে পাইয়া জনার্দনে।।
রাজসূয় যজ্ঞে কি করিল যদুবীর।
মুচিরাম দাস পূজা কৈল যুধিষ্ঠির।।
যজ্ঞে এল মুনি ঋষি ব্রাহ্মণ প্রধান।
সবার উপরে মুচিরামের সম্মান।।
শ্রীরঘুনাথের খুড়া বুড়া কালীদাস।
ঝড়ু ভুঁইমালীর উচ্ছিষ্ট কৈল গ্রাস।।
কুবের জোলার ছেলে তাত বুনে বৈসে।
কৃষ্ণের গলায় মালা পরায় মানসে।।
নকিম তাহার ছেলে দেখিবারে পায়।
আরোপে দিতেছে মালা কৃষ্ণের গলায়।।
চূড়ায় ঠেকিয়া মালা ভূমে পড়ি গেল।
নকিম ডাকিয়া তার পিতাকে বলিল।।
বুনো তাঁত ওহে তাত তবে পা’বে সুখ।
উঁচু কর হাতখানা আরো একটুক।।
পিতার আরোপ পুত্র আরোপেতে জানে।
অন্তরে কৃষ্ণ আরোপ হাতে তাঁত বুনে।।
তাহার তোড়ানি যেবা ভক্তি করি খায়।
হৃদিপদ্মে কালাচাঁদে সেই দেখা পায়।।
কোন কালে পাল বেটা দেখেছিস তারে।
গালাগালি দিস বেটা মরিবার তরে।।
গৃহ হ’তে এক টাকা এনে তাড়াতাড়ি।
প্রণামী বলেছে তুমি শীঘ্র যাও বাড়ী।।
বিদায় করিতে তারে হইল উৎকণ্ঠা।
নাহি গেল বিকালে বাজায় শঙ্খ ঘণ্টা।।
দেবলা গোপাল শ্রীবিগ্রহ সেবা করে।
প্রভু বলে পাল গুরু সেবা করে কারে।।
যে গোপালে পূজা করে ওকি তারে চিনে।
গোপাল উহার পূজা ল’বে কি কারণে।।
ঝাঁজ ঘণ্টা শঙ্খ বাজায়েছে সন্ধ্যাকালে।
তাহা শুনে আমার সর্বাঙ্গ যায় জ্বলে।।
প্রাতেঃ উঠে মহাপ্রভু ওঢ়াকাঁদি যায়।
বুধই বৈরাগী তার পিছে পিছে ধায়।।
পথে হাতে আর কহে অঙ্গ জ্বলে যায়।
তাহা শুনি পাল গুরু ফিরে ফিরে চায়।।
ওঢ়াকাঁদি গিয়া প্রভু হইল উপনীত।
ফিরে এল বুদ্ধিমন্ত হ’য়ে দুঃখ চিত।।
গুরুকে প্রণাম করি বিদায় করিল।
দক্ষিণার টাকা ল’য়ে গুরু গৃহে গেল।।
অগ্রহায়ণ মাসেতে এই কার্য হ’ল।
দৈবযোগে একদিন বিপদ ঘটিল।।
মাঘমাসে বেলা দেড় প্রহর সময়।
অগ্নি লেগে বাড়ী তার দগ্ধ হ’য়ে যায়।।
দশ বিঘা জমির যে ধান্যগোলা সহ।
ঘর দ্বার শয্যা সব হ’য়ে গেল দাহ।।
হুঁ হুঁ শব্দে অগ্নি যদি উঠিলেন জ্বলি।
তার মধ্যে বুদ্ধিমন্ত ঘৃত দিল ঢালি।।
করজোড়ে গলে বস্ত্র বলেছে বচন।
শ্রীমুখের নিমন্ত্রণ করুণ ভোজন।।
তারপর ওঢ়াকাঁদি গেল দুই ভাই।
শ্রীধামে বলিল গিয়া মহাপ্রভু ঠাই।।
বলে ওহে মহাপ্রভু হইয়াছে ভাল।
বাড়ী পুড়ে গেছে এবে লক্ষ্মীপুর চল।।
লক্ষ্মীকান্ত চল যাই লক্ষ্মীপুর গ্রাম।
পরম আনন্দে সবে ল’ব হরিনাম।।
পোড়া বাড়ী শীতল করিতে কেহ নাই।
সে জন্য তোমাকে নিতে আসি দু’টি ভাই।।
চল চল মহাপ্রভু ল’য়ে দলবল।
কৃপাবারি সিঞ্চণে করুণ সুশীতল।।
শুনি মহাপ্রভু আর বিলম্ব না কৈল।
লক্ষ্মীপুর গ্রামে হরি উপনীত হৈল।।
ঠাকুরকে ল’য়ে বাড়ী যায় দু’টি ভাই।
বলে হরি বলরে সুখের সীমা নাই।।
প্রভু সেবা শুশ্রূষাদি করে ভালোমতে।
পাঁচসিকা প্রণামী দিলেন শ্রীপদেতে।।
একজোড়া নববস্ত্র আনিয়া তখন।
আদরে চাদর ধুতি করিল অর্পণ।।
প্রেমানন্দে ভাসে নাই সুখের অবধি।
প্রভুকে রাখিয়া এল ক্ষেত্র ওঢ়াকাঁদি।।
বিংশ জন ভক্ত ছিল মহাপ্রভু সঙ্গে।
আসিতে যাইতে নাম করে নানা রঙ্গে।।
শ্রীহরির কৃপাদৃষ্টি যাহার উপর।
সংসারের চিন্তা আর থাকে না তাহার।।
আদেশ করিল প্রভু ভক্তগণ প্রতি।
সকলে করহ দয়া বুধইকে সম্প্রতি।।
বুধইর বাড়ী পূর্বে যত ঘর ছিল।
ঠাকুর কৃপায় তার দ্বিগুণ বাড়িল।।
পোড়া ধান্যে অবশেষে যাহা কিছু ছিল।
তাহাতে সংসার ব্যয় স্বচ্ছন্দে চলিল।।
তারক পারকহেতু দয়িত পাগল।
কবি কহে হরিবল যাবে ভবগোল।।
মহানন্দ চিদানন্দ গ্রন্থ বিরচিত।
ভূলোক আলোক শ্রীগোলোক পুলকিত।।