নাম হতে ভক্ত বড়
জগতে আসিল এক হরি বোলা পাখি।
হরিনাম উচ্চারণে ঝরে দু’টি আখি।।
নামে প্রেমে মত্ত হয়ে মহাভাবে রয়।
দিবানিশি হরি গুণ গাহিয়া বেড়ায়।।
একদিন সে অশ্বিনী ভাবে মনে মন।
ওড়াকান্দি যাব বলে করিল গমন।।
প্রতি বুধবারে তিনি ওড়াকান্দি যায়।
এইভাবে যাতায়াত করে মথাশয়।।
বুধবারে চলেছেন ওড়াকান্দি পথে।
জলে ভরা আখি দু’টি লাগিল হাটিতে।
মুখে হরি হরি গুণ গাহিতে গাহিতে।
উদয় হইল গিয়ে গোপালগঞ্জতে।।
কয়জন হরিভক্ত আসিয়া মিশিল।
তাহারাও ওড়াকন্দি যাইবে বলিল।।
একসঙ্গে চারিজন করিল গমন।
উলপুর খেয়াঘাটে দিল দরশন।।
খেয়াপার হয়ে শেষে ও পারেতে গেল।
হরি হরি বলে সবে হাটিতে লাগিল।।
কিছু দুর গিয়ে তারা দেখিবারে পায়।
করোজোড়ে এক মেয়ে আসিয়া দাড়ায়।।
অশ্বিনীর চরনেতে প্রণাম কিরল।
জলে ভরা অখি দু’টি কান্দিতে লাগিল।।
কেদ কেদে কহিলেন অশ্বিনীর ঠাই।
কোথায় চলেছ তুমি শুনিবারে চাই।।
অশ্বিনী বলেছে মাগো তোমাকে জানাই।
হরি বলে আজি মোরা ওড়াকান্দি যাই।।
মিনতী কহিছে কেদে মিনতি করিয়া।
তথা গেলে কিবা হয় কহ বিস্তারিয়া।।
অশ্বিনী বলেছে ওড়াকান্দি যেবা যায়।
সকল মনের বাঞ্ছা তার পূর্ণ হয়।।
মিনতী কহিছে আমি বড় অভাগিনী।
শুন তুমি হরি ভক্ত আমার কাহিনী।।
বহুদিন গত হল বিবাহ হয়েছে।
কিন্তু এক ব্যাথা মোর মনেতে রয়েছে।।
বন্ধ্যা বলে ভাল কেউ বাসেনা আমায়।
দিবানিশি কেদে ফিরি সেই বেদনায়।।
অশ্বিনী বলেছে মাগো বাঞ্ছা পূর্ণ হবে।
স্বামীকে সঙ্গেতে করি ওড়াকান্দি যাবে।।
ওড়াকান্দি হরি এসে অবতীর্ণ হলো।
লীলা সাঙ্গ করে তিনি ক্ষীরদেতে গেল।।
তার পুত্র গুরুচাঁদ বর্তমান আছে।
মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে গেলে তার কাছে।।
এই কথা বলে রত্ন গমন করিল।
আশা পেয়ে সেই নারী গৃহেতে চলিল।।
শ্রীউপেন্দ্রনাথ নাম কায়স্থ জাতিতে।
ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সে উচ্চ পদেতে।।
বিত্তশালী মহামান্য অর্থের বড়াই।
অর্থ আছে পুত্র কন্যা তার ঘরে নাই।।
স্বামীর চরণে গিয়ে মিনতী কহিল।
মোরে নিয়ে ওগো স্বামী ওড়াকন্দি চল।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ ওড়াকন্দি আছে।
মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে গেলে তার কাছে।।
উপেন্দ্র বলেছে সেই মিনতীর ঠাই।
নারী জাতি বলে তব জ্ঞান কান্ড নাই।।
নমঃশুদ্র ঘরে কেন ঠাকুর জন্মিবে।
দেখিয়া আমার মনে ভক্তি না আসিবে।।
তোমা লয়ে আমি কবু যেতে না পারিব।
পুত্র কন্যা না হউক এইভাবে রব।।
বড় বড় ডাক্তার কত দেখায়েছি।
আমাদের ভাগ্যে নাই মনেতে জেনেছি।।
শনিয়া স্বামীর বাণী মিনতী তখন।
ছলছল আখি দু’টি ঝরে দু’নয়ন।।
মৌন হয়ে থাকে সদা কথা নাহি কয়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
মনের বেদনা তার মনেতে রহিল।।
একদিন তার স্বামী সেভাবে দেখিয়া।
মিনতীর মনোভাব বুঝিতে পারিয়া।।
কহিলেন শুন তুমি আমার বচন।
ওড়াকান্দি যেতে হবে করেছি মনন।।
কার কাছে শুনিয়াছ ঠাকুরের কথা।
সেই মহাজন কেবা কানকি বারতা।।
স্বপনেতে দেখিয়াছি পুরুষ রতন।
অজানুলম্বিত ভুজ আকর্ন লোচন।।
সে মানুষ স্বপনেতে কহিলেন কথা।
আমার ভক্তের কথা না হবে অন্যথা।।
যে তোমারে বলিয়াছে তারে কোথা পাই।
তারে লয়ে চল মোরা ওড়াকান্দি যাই।।
মিনতী কহিছে আমি তার দেখা পাব।
আমাদের সঙ্গে যেতে তাহাকে কহিব।।
মিনতীর অন্তরেতে ভক্তির উদয়।
মনে মনে ভাবিতেছে কি করি উপায়।।
সেই হরি ভক্ত দেখা কোথা গিয়ে পাব।
আমার মনের কথা তাহাকে জানাব।।
কবে সেই বুধবার মনেতে ভাবিয়া।
এইভাবে দিনগুলি রাখিছে গণিয়া।।
যেইদিন বুধবার মনেতে জানিল।
অনাহারে সে মিনতী রাস্তায় দাড়াল।।
ছল ছল দু’টি আখি পথ পানে চায়।
এই আসে এই আসে ভাবিছে হৃদয়।।
একটার পরে শেষে দেখিতে পাইল।
অশ্বিনী আসিয়া সেথা উদয় হইল।।
অমনি মিনতী গিয়ে চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কাদিতে লাগিল।।
কেদে কেদে সে মিনতী লাগিল বলিতে।
স্বামীর হয়েছে মন ওড়াকন্দি যেতে।।
আমাদের লয়ে তুমি ওড়াকন্দি চল।
অশ্বিনী বলেছে মাগো হইবে মঙ্গল।।
তাই শুনি সে মিনতী দু’টি হাতে ধরি।
বাড়ী মধ্যে নিয়ে গেল অতি যত্ন করি।।
যত্ন করি সে মিনতী ধোয়াল চরণ।
তারপরে ভক্তির ভরে করাল ভোজন।।
ভোজনান্তে আচমন করিল গোঁসাই।
বলে মাগো চল শীঘ্র ওড়াকন্দি যাই।।
উপেন্দ্র মিনতী দোহে করিয়া ভোজন।
একসঙ্গে সবে মিলে করিল গমন।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
ভাবে গদ গদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।।
অগ্রভাগে চলিতেছে অশ্বিনী সুজন।
পিছনেতে চলে তারা আনন্দিত মন।।
এইভাবে চলে তারা বলে হরি হরি।
উদয় হইল গিয়ে ওড়াকন্দি বাড়ি।।
অশ্বিনী বলেছে মাগো শুন দিয়া মন।
কামনা সাগরে স্নান কর দুইজন।।
তাই শুনি দুইজনে কামনা করিয়া।
কামনা সাগরে স্নান করিলেন গিয়া।।
তারপর চলিলেন গুরুচাঁদ কাছে।
গদিঘরে গুরুচাঁদ বসিয়া রহেছে।।
চারিদিকে ভক্তগন মাঝে গুরুচাঁদ।
তারাগণ মধ্যে যেন আকাশের চাঁদ।।
কিবা শোভা হইতেছে প্রেমানন্দময়।
ভক্তগনে হরি বলে আনন্দ হৃদয়।।
তাই দেখে সে মিনতী চরণে পড়িল।
গুরুচাঁদ পদ ধরি কাঁদিতে লাগিল।।
তাই দেখে গুরুচাঁদ কহিল তখন।
বন্ধা নারী গর্ভে কভু হবে না নন্দন।।
হেন বাক্য গুরুচাঁদ যখনেতে কয়।
উপেন্দ্র পড়িল গিয়া গুরুচাঁদ পায়।।
মিনতী উপেন্দ্র দোহে কাঁদিতে লাগিল।
কান্না দেখে গুরুচাঁদ বলিয়া উঠিল।।
তোমাদের ঘরে কভু পুত্র কন্যা নাই।
স্বচোক্ষেতে আমি তাহা দেখিবারে পাই।।
হেন বাক্য শুনে তারা কেঁদে ছাড়ে হােই।
ঘরেতে যাবনা ফিরে কহিলাম তাই।।
তোমার চরণে আজি জীবন ত্যাজিব।
মানব জীবন ধরে কিবা ফল পাব।।
গুরুচাঁদ বলে ভাল ঠেকাইলি দায়।
আমা দ্বারা কোন কিছু না হবে উপায়।।
মোর পিতা হরি চাঁদ বলিত বচন।
আমা হতে নাম বড় সংসার ভুবন।।
নাম হতে ভক্ত বড় এই দুনিয়ায়।
মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে ভক্তের দ্বারায়।।
এইখানে আছে কত হরি ভক্তগন।
ধর গিয়া ইহাদের যুগল চরণ।।
তাই শুনে দুইজনে ভক্ত কাছে যায়।
যার কাছে যায় সেই ভয়েতে পালায়।।
এক একে গদি ঘর শূণ্য হয়ে গেছে।
একপাশে সে অশ্বিনী দাঁড়াইয়া আছে।।
মনে মনে সে অশ্বিনী গুরচাঁদে কয়।
অধমের প্রতি বুঝি কঠিন হৃদয়।।
অধম এনেছে ডেকে এই দুইজন।
তব কৃপা হল নাক ইহার কারণ।।
জলে ভরা আখি দু’টি দাঁড়াইয়া আছে।
তাই দেখে সে মিনতী চরণে পড়েছে।।
কেঁদে বলে ওগো বাবা চরণে জানাই।
তুমি ছাড়া এ জগতে আর কেহ নাই।।
এইভাবে দুইজনে কাঁদিতে লাগিল।
কান্না দেখে অশ্বিনীর দয়া উপজিল।।
মস্তকেতে হস্ত দিয়া কহিল অশ্বিনী।
এই বর্ষ মধ্যে তুই হইবি গর্ভিনী।।
সেই গর্ভে ছেলে হবে দেখিবারে পাই।
এখানে থাকিয়া মাগো আর কার্য্য নাই।।
অধমের কথা যদি সত্য না হইবে।
শ্রীধামেতে এ অশ্বিনী আর না আসিবে।।
গুরুচাঁদ পরণেতে প্রণাম করিয়া।
দুজনারে লয়ে দেশে আসিল চলিয়া।।
সেই দিন ঘরে এসে রিতুবতী হল।
সেই হতে মিনতীর গর্ভ দেখা দিল।।
তাহা জেনে সে উপেন্দ্র ভাবিতে লাগিল।
ভক্তির উদয় হল প্রেমেতে মাতিল।।
হৃদয় চঞ্চল হয়ে মনে মনে কয়।
অশ্বিনীর দেখা আমি পাইব কোথায়।।
মিনতীকে বক্ষে ধরি কেঁদে কেঁদে কয়।
শুন শুন ওগো প্রিয়ে বলিযে তোমায়।।
মানুষ চিনিয়া তুমি আনিলে বাড়ীতে।
আমা হতে ধন্য তুমি আসিয়া জগতে।।
আমি মোর মন প্রাণ কেমন হয়েছে।
সে মানুষ কোথা থাকে যাব তার কাছে।।
বলেছিল ওড়াকান্দি আসিব না আর।
আমি গিয়ে দেই তারে এই সমাচার।।
মিনতী কহিছে জানি তাহার বারতা।
গঙ্গাচন্না বাস করে শুনিয়াছি কথা।।
উপেন্দ্র চলিল সেই মানুষ খুজিতে।
জলে ভরা আখি দু’টি লাগিল হাটিতে।।
কোথা সেই গঙ্গাচন্না ভাবে মনে মন।
গোপালগঞ্জে এসে দিল দরশন।।
তথা হতে টাবুরিয়া নৌকা করে নিল।
গঙ্গাচন্না যাব বলে তাহাকে বলিল।।
সে বলিল মোর বাড়ী পাটগাতী হয়।
গঙ্গাচন্না চেনা আছে শুন মহাশয়।।
উপেন্দ্র বলেছে বড় ভালই হইল।
মোরে লয়ে ওগো মাঝি গঙ্গাচন্না চল।।
যত টাকা চাও তুমি তত টাকা দিব।
গঙ্গাচন্না গিয়ে আমি ফিরিয়া আসিব।।
টাবুরিয়া বলে আমি নৌকা বেয়ে খাই।
টাকা দিলে যেথা যাবে বেয়ে নিব ভাই।।
এত বলি সেই মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল।
ভাটি পেয়ে সেই নৌকা বেগেতে চলিল।
গঙ্গাচন্না খাল বেয়ে চলিতে লাগিল।।
অশ্বিনীর ঘাটে গিয়ে নৌকা ভিড়াইল।
নৌকা হতে সে উপেন্দ্র মাটিতে নামিয়া।।
অশ্বিনীর পদে পড়ে কহিছে কাঁদিয়া।
ওগো বাবা নিবেদন করি শ্রীচরণে।
তোমা সম হরিভক্ত নাহি এ ভুবনে।।
তোমার মুখের কথা সত্য হইয়াছে।
সাত মাস মিনতীর গর্ভ দেখা দিছে।।
উলপুর যেতে হবে চরণে জানাই।
তুমি বিনে আমাদের আর কেহ নাই।।
অশ্বিনী বলেছে আমি এখনে না যাব।
উত্তর মুখেতে আমি কভু না ফিরিব।।
তব ঘরে ছেলে হলে যাইব সেদিনে।
প্রতিজ্ঞা করেছি আমি তোমার কারণে।।
উপেন্দ্র শুনয়া তাহার চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কাঁদিতে লাগিল।।
কেঁদে বলে ওগো বাবা চরণে জানাই।
পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।।
অশ্বিনী চলেছে তুমি ঘরে চলি যাও।
মিনতীকে সঙ্গে করে গুর গুণ গাও।।
তাই শুনে সে উপেন্দ্র ঘরে ফিরে গেল।
অধম বিনোদ বলে হরি হরি বল।।