শ্রীরামপুর কলেজে প্রবেশ করেই আমি কাছাকাছি একটা বোর্ডিং হাউসে ঘর নিয়েছিলাম। গঙ্গার ধারে পুরানো ধরণের পাকাবাড়ি, নাম ‘পন্থী’। আমার নূতন আবাসে প্রথম যেদিন শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজী বেড়াতে এলেন, সেদিন তিনি আমার ঘরে প্রবেশ করেই একটি অদ্ভুত কথা বললেন, “দেখ! অনেক বছর আগে, ঠিক তোমার এই ঘরেতেই, আমার সামনে একটি মুসলমান যাদুকর চারটি ভোজবাজির খেলা দেখেছিলেন।”
শুনে উদ্দীপ্ত কৌতূহলে সামান্য আসবাবভরা ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে বললাম, “কি আশ্চর্য! এই নতুন সজ্জিত ঘরেরও কিছু পুরান ইতিহাস আছে তাহলে!”
গুরুজী অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে হেসে বললেন, “তা আছে বই কি! সে এক লম্বা কাহিনী। মুসলমানটি ছিল একজন ফকির, নাম আফজল খাঁ। এক হিন্দুযোগীর হঠাৎ দেখা পেয়ে গিয়ে সে তাঁর কাছ থেকে ঐরকম অদ্ভুত বিদ্যা লাভ করেছিল।
আফজলের বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের এক গ্রামে। ছেলেবেলায় সে একদিন দেখে যে, ধূলায় ধূসরিত এক সন্ন্যাসী তাদের গাঁয়ে এসে উপস্থিত।
সন্ন্যাসীটি তাঁকে বললেন, “বাবা, বড়ই তেষ্টা পেয়েছে, একটু জল এনে দিতে পার?”
আফজাল বলল, “সাধু মহারাজ! আমি মুসলমান, আপনি হিন্দু হয়ে আমার হাত থেকে জল খাবেন কি করে?”
সন্ন্যাসী বললেন, “বাছা! তোমার সত্যি কথায় ভারি খুশি হলাম। আমি ওসব অশাস্ত্রীয় জাতিভেদের ছোঁয়াছুঁয়ির নিয়ম মানি না। যাও, চট করে আমায় জল এনে দাও।”
আফজলের ভক্তিপূর্ণ ব্যবহারে যোগীটি তার প্রতি সস্নেহে দৃষ্টিপাত করে গম্ভীরভাবে বললেন, “তোমার পূর্বজীবনের কর্মফল খুবই ভাল। আমি তোমায় একটি যোগের কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছি। এতে করে অদৃশ্য জগতের অংশবিশেষকে তোমার নিয়ন্ত্রণ করবার ক্ষমতা জন্মাবে। তাকে কেবল উপযুক্ত ক্ষেত্রেই ব্যবহার করবে; কিন্তু খবরদার! তোমার স্বার্থসিদ্ধির জন্যে তা কখনো ব্যবহার করো না যেন।
কিন্তু হায়! দেখতে পাচ্ছি পূর্বজন্মের কতগুলো সর্বনাশা কুকর্মের বীজও তুমি সঙ্গে বহন করে এনেছ। দেখো যেন, আবার নতুন কুকর্ম করে আর সেগুলোকে ফুটিয়ে তুলো না। তোমার পূর্বজীবনের কর্মফল এত জটিল যে, এ জন্মে তোমায় যোগাভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে সংসারের মঙ্গলসাধন করেই তা কাটাতে হবে।”
তারপর সেই হতভম্ব ছেলেটিকে এক জটিল প্রক্রিয়া শিখিয়ে দিয়ে যোগী অন্তর্ধান করলেন।
আফজল বিশ বৎসর ধরে সেই যোগ প্রক্রিয়াগুলি খুব নিষ্ঠার সঙ্গে অভ্যাস করেছিল। তার অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা বহু মানুষকে তার প্রতি আকৃষ্ট করতে শুরু করল। মনে হয় এক অদৃশ্য আত্মা, যাকে সে ‘হযরত’ বলে ডাকত, সে সর্বদাই তার সঙ্গে সঙ্গে ফিরত।
ফকিরের সামান্যতম ইচ্ছাও সে তৎক্ষণাৎ পূরণ করে দিত। গুরুর সাবধান বাণী অগ্রাহ্য করে আফজল ক্রমশঃ তার ক্ষমতার অপব্যবহার করতে শুরু করল। যে কোন জিনিস একবার মাত্র ছুঁয়ে আবার রেখে দিলে, সঙ্গে সঙ্গে সেটা একেবারে বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যেত। এই রকম হাত সাফাই-এর ব্যাপার দেখে লোকে কেউ বড় একটা তাকে আর ঘরে আনতে চাইত না।
মাঝে মাঝে সে কলকাতার বড় বড় সোনারূপার দোকানে গিয়ে উপস্থিত হতো। দোকানদার ভাবত, বুঝিবা বড়দড়ের কোন খদ্দের এল। আফজল কোন গহনা নেড়েচেড়ে রেখে দিয়ে দোকান থেকে বেরোবার পরই সেসব একেবারে অদৃশ্য হয়ে যেত!
তার কেরামতি শিখে নেবার আশায় শত শত ছাত্র তাকে প্রায়ই ঘিরে থাকত। সঙ্গে বেড়াতে যাবার জন্য আফজাল মাঝে মাঝে তাদের ডাকত। স্টেশনে গিয়ে একগোছা টিকিট নিয়ে দেখেশুনে তা আবার ফিরিয়ে দিয়ে বলত, ‘নাহ! আজ আর আমাদের যাওয়া হল না, এখন আর টিকিট কিনব না।’ বলে কেরাণীকে টিকিটগুলো ফেরৎ দিয়ে সটান রেলে গিয়ে চেপে বসত।
তখন দেখা যেত যে, ঠিক সেই টিকিটগুলোই আবার তার হাতে এসে পৌঁছে গেছে। “এইরকম লোক ঠকানো জবরদস্তি আর জুলুমবাজি দেখে লোকে রেগে আগুন হয়ে উঠল। বাঙ্গালী গাহনা ব্যবসায়ী আর স্টেশনের টিকিটবেচা কেরাণীর দল তো ভয়ে কাঁটা।
পুলিশও প্রমাণের অভাবে তাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে নিরুপায় হয়ে পরে। আফজাল কেবল একবারমাত্র বললেই হল, ‘হযরত! এসব হঠাও!!’
ব্যাস্, সঙ্গে সঙ্গে সাফ্!
শ্রীযুক্তেশ্বরজী আসন ছেড়ে উঠে পরে গঙ্গার ধারে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে গেলাম, উদ্দেশ্য আফজলের এইসব আশ্চর্য কাণ্ডকারখানার আরও কিছু ব্যাপার শুনব। গুরুজী বলে চলেন, “এই ‘পন্থী’ বাড়িটি আগে আমার এক বন্ধু্র ছিল। আফজলের সঙ্গে আলাপ হতে সে একদিন তাকে এখানে ডেকে আনল।
সেই সঙ্গে বন্ধুটি আরও জনাকুড়িক পাড়াপ্রতিবেশীদেরও ডাকলো; তাদের মধ্যে আমিও একজন। আমার তখন যুবা বয়স আর এই দুষ্টু ফকিরের ভোজবাজির খেলা দেখবার জন্যে মনে তখন খুবই আগ্রহ।”
গুরুদেব হেসে বললেন, “এধারে কিন্তু ঠিক হুঁশিয়ার ছিলাম। দামী কোন কিছুই পরে যাই নি। আফজল আমার আপাদমস্তক বেশ ভালভাবে নিরীক্ষণ করে নিয়ে বলল, “দেখছি তোমার হাত দু’টি বেশ মজবুত। আচ্ছা নীচে বাগানে চলে যাও; গিয়ে একটা বেশ চকচকে পাথর নিয়ে তার উপর তোমার নাম লিখে গঙ্গার জলে যতদূর পারো জোরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এস।”
হুকুম তো তামিল করে এলাম। যখন গঙ্গার জলের ভিতর পাথরটি টুপ করে পরে ডুবে গেল, ফকির সাহেব তখন বলল, “একটা পাত্রে গঙ্গার জল ভরে এই বাড়ির সামনে এনে রাখ।”
পাত্রটি জল ভরে এনে রাখতেই ফকির সাহেব চিৎকার করে বলে উঠল, “হযরত! এই পাত্রের ভিতর পাথরটি এনে রাখ!”
তখনই পাথরটি তার ভিতর এসে গেল। হাত ঢুকিয়ে পাথরটি বার করে নিয়ে দেখলাম যে, আমার সই যেমনটি করেছিলাম ঠিক তেমনটি পরিষ্কারই রয়েছে।
বাবু আমার এক বন্ধুও, সেই ঘরে উপস্থিত ছিল। সে একটি ভারী পুরান সোনার ঘড়ি আর তার চেন পরেছিল। ফকির সাহেব তার হাত নেড়েচেড়ে দেখে খুব তারিফ করল। সঙ্গে সঙ্গেই সে দু’টি হাওয়া হয়ে গেল!
বাবু ত’প্রায় কেঁদেই ফেলে। কাকুতিমিনতি করে বলতে লাগল, “আফজল! ও আমার বহুদিনের পৈতৃকসম্পত্তি, দয়া করে আমায় ফিরিয়ে দাও।” ফকির সাহেব নিতান্ত অনাসক্তভাবে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, তারপর বলল, “দেখ! তোমার লোহার সিন্দুকে পাঁচশ টাকা আছে। সেগুলো নিয়ে এসো; তবেই বলে দেব কোথায় তোমার ঘড়ি ও ঘড়ির চেন আছে।”
‘উদভ্রান্ত’ বাবু ত’ তখনই দৌঁড়ল বাড়ির দিকে। খুব শীগগির ফিরে এসে পাঁচশটি টাকা আফজলের হাতে তুলে দিল।
ফকির সাহেব তখন যেন নিতান্ত অনুকম্পাবশতঃই বাবুকে বলল, “তোমার বাড়ির কাছে যে ছোট্ট সাঁকোটি আছে সেখানে যাও আর দেখ, যেতে যেতে হযরতকে ডেকে তোমার ঘড়ি, ঘড়ির চেন সব ফেরৎ দিয়ে দিতে বোলো; তা হলেই তুমি তোমার সব জিনিস ফেরৎ পাবে।”
বাবু তো তাড়াতাড়ি ছুঁটলো। ফিরল কিছুক্ষণ বাদে। মুখে নিশ্চিন্ত হাসি; তবে সঙ্গে আর ঘড়িটড়ি কিছুই নেই! বাবু বলল, “ফকির সাহেবের কথামত যেমনি হযরতকে ডেকেছি অমনি যেন শূন্য থেকে ঘড়িটড়ি সব আমার ডান হাতের উপর ঝুপ করে এসে পরল। বাব্বা! আর তা এখানে নিয়ে আসি! সোজা বাড়িতে গিয়ে একেবারে সিন্দুকে তাদের বন্ধ করে রেখে তবে তোমাদের এখানে আসছি।”
ঘড়ির মুক্তিপণ আদায়ের এই আনন্দ-নিরানন্দের নাটকের সাক্ষী, বাবুর বন্ধুরা সব অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে আফজলের দিকে তাকাল। ফকির সাহেব তখন যেন সান্ত্বনা দেবার মতলবেই আবার আরম্ভ করল, “আচ্ছা, তোমরা কি পানীয় চাও বল। হযরত এখনি তা এনে দেবে।”
জনকতক দুধ চাইল, কেউ কেউ আবার ফলের রস খেতে চাইল। বাবু খেতে চাইল হুইস্কি। যদিও তাতে আমি খুব বেশি আশ্চর্য হই নি।
ফকির সাহেব হুকুম করল। অনুগত হযরত মুখবন্ধ পানীয়ের পাত্রগুলো সব যেন শূন্য থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল, আর তা সব ঠকাস ঠকাস করে মেঝের উপর এসে পরতে লাগল। একে একে সবাই তাদের ফরমাসী জিনিসগুলো পেল।
তারপর চার নম্বরের ব্যাপারটি হচ্ছে আরও অদ্ভুত! আফজল বলল যে, সে এখানে বসে বসেই সবাইকে এক বিরাট ভোজ খাওয়াতে পারে। প্রস্তাবটি আমাদের গৃহস্বামীর কাছে অতিশয় মনোরম ও সুখপ্রদ বলেই বোধ হল।
বাবুর ঘা তখনও শুকোয় নি, মনে তখনও দারুণ জ্বালা ছিল। মুখটা হাঁড়ি করে বলল, ‘”আমার পাঁচশ টাকা তো গেছে, তা যাক, তার বদলে আমি রাজারাজড়াদের মত সোনার থালায় বিরাট ভোজ চাই।” উপস্থিত সবাই নিজের নিজের পছন্দের কথা জানানো মাত্র, ফকির সাহেব তখন সেইসব হযরতকে হুকুম করল।
সঙ্গে সঙ্গে বাসনপত্রের একটা ঝনঝনানির শব্দ উঠল আর সোনার থালার উপর গরম লুচি, নানারকমের অতি উপাদেয় আর সুস্বাদু তরকারি, ব্যঞ্জন প্রভৃতি নানাবিধ রসনাতৃপ্তিকর সুখাদ্য, বহুপ্রকারের অসময়ের ফল ; সব যেন শূন্য থেকেই আবির্ভূত হয়ে আমাদের পায়ের কাছে এসে পরতে লাগল।
খাবারদাবার ছিল অতি চমৎকার। ঘণ্টাখানেক ধরে খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমরা ঘর ছেড়ে বেরোতে গেলাম। একটা ভীষণ শব্দ বাসনপত্রের ঝনঝনানির মত, মনে হল কেউ যেন থালাবাটি সব গুছোচ্ছে। শুনে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ঝকঝকে সোনার বাসনকোসন, এমন কি উদ্বৃত্ত ভোক্ষদ্রব্যের কোন চিহ্নমাত্র নেই!”
জিজ্ঞাসা করলাম, গুরুজী! আফজল যদি এমনভাবে সোনার বাসনকোসন আমদানি করতে পারে, তবে আবার তার পরের ধনে লোভ করা কেন?”
শ্রীযুক্তেশ্বরজী ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন, “দেখ! ঐ ফকিরের কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি খুব বেশি দূর হয় নি। তার যোগের একটা প্রক্রিয়াবিশেষের উপর দখল থাকাতে সে তার যে কোন ইচ্ছা তৎক্ষণাৎ কার্যে পরিণত করতে পারত।
হযরত নামে জনৈক বিদেহীর সাহায্যে, ফকির সাহেব তাঁর প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে যে কোন ইপ্সিত বস্তুর অণুপরমাণু নিয়ে ইথার বা ব্যোমশক্তি দিয়ে সেই জিনিসটি তৈরি করে নিতে পারত। কিন্তু এই রকম ভৌতিকপ্রক্রিয়ার তৈরি জিনিস বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
কাজেই আফজলকে এই পৃথিবীরই ধনরত্ন আহরণ করবার চেষ্টায় থাকতে হত, যা কষ্ট করে উপার্জন করলে দীর্ঘস্থায়ী হয়।” আমি হেসে বললাম, “কিন্তু তাও ত’ কখনও কখনও একেবারে বিনা কারণেই উড়ে যায়, ধরে রাখতে পারা যায় না।”
গুরুজী বলতে লাগলেন, “আফজলের কোনরকম ঈশ্বরানুভূতি বা ভগবদজ্ঞান ছিল না। স্থায়ী আর মঙ্গলজনক কোন অলৌকিক ক্রিয়া কেবল খাঁটি সাধুসন্তরাই দেখাতে পারেন, কারণ তাঁরা সর্বশক্তিমান জগৎস্রষ্টার সঙ্গে একইসুরে বাঁধা।
আফজল ছিল নেহাৎই সাধারণ গোছের একজন মানুষ; কেবল তার এতটুকুমাত্র অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল যে, সে এমন এক সূক্ষ্মস্তরে প্রবেশ করতে পারত, যেখানে সাধারণতঃ কোন মরজগতের লোক মৃত্যু না হলে প্রবেশ করতে পারে না।”
“এখন সব বুঝলাম, গুরুদেব! তা হলে পরজগতেও বেশ কিছু আকর্ষনীয় বৈশিষ্ট্য আছে দেখছি।”
গুরুদেব বললেন, “তা আছে বৈকি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমি আর আফজলকে কখনও দেখিনি। বছরকতক পরে বাবু আমার বাড়িতে এসে খবরের কাগজ খুলে দেখাল যে, সেই মুসলমান যাদুকরটির একটা প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি সেখানে বেরিয়েছে। তাই থেকেই আমি তোমায় এইমাত্র যা বললাম, সেই আফজলের ছেলেবেলায় এক হিন্দুগুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়ার কথা জানতে পারি!”
খবরের কাগজে আফজলের যে স্বীকারোক্তি বেরিয়েছিল, তার শেষ অংশের সারটুকু শ্রীযুক্তেশ্বরজীর যেটুকু স্মরণে ছিল, তা মোটামুটি হচ্ছে এইরকম, “আমি আফজাল খাঁ! আমার প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ আর যারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চায় তাদের সাবধান করে দেবার জন্যে এই কথাগুলো লিখছি।
ভগবৎকৃপায় আর গুরুদত্ত ক্ষমতাবলে আমি যে অদ্ভুতশক্তি হস্তগত করেছিলাম, বছরের পর বছর ধরে তার অপব্যবহার করে এসেছি। আত্মগরিমাপূর্ণ হয়ে ভেবেছিলাম যে, আমি সুনীতি-দুর্নীতির সাধারণ নিয়মকানুনের বহু ঊর্ধ্বে। আমার শেষবিচারের দিন অবশেষে ঘনিয়ে এল।
সম্প্রতি কলকাতার বাইরে একটি বৃদ্ধলোকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। লোকটি অতিকষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল; হাতে ছিল একটি চকচকে জিনিস, দেখতে সোনারই মত। মনে দারুণ লোভ হল। লোকটিকে ডেকে বললাম, “দেখ! আমি একজন বড় দরের ফকির, নাম আফজল খাঁ। তোমার হাতে ওটা কি?”
এটি একটি সোনার তাল; সংসারে এইটিই সবার সর্বস্ব। তা এতে আপনার মত ফকির মানুষের কি দরকার বলুন? যাইহোক মশায়, আপনাকে মিনতি করি আমার খুঁড়িয়ে হাঁটাটা সারিয়ে দিন!”
আমি সোনার তালটি ছুঁয়ে কোন কথাবার্তা না বলেই চলতে শুরু করে দিলাম। বুড়ো মানুষটি আমার পিছন পিছন খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার, “সোনা! আমার সোনা! কৈ আমার সোনা কোথায় গেল, এ্যাঁ?”
তার দিকে দৃকপাতমাত্র না করে এগোতেই লোকটি হঠাৎ বজ্রনিঘোর্ষে বলে উঠল, “কি! তুমি আমায় চিনতে পারছ না?”
ফিরে তাকাতেই আমার বাকশক্তি একেবারে লোপ পেল। ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেলাম। দেখি যে সেই নেহাৎ সাধারণ গোছের বৃদ্ধ খঞ্জব্যক্তিটি আর কেউ নন সেই সাধুশ্রেষ্ঠ স্বয়ং, যিনি বহুদিন পূর্বে আমায় যোগসাধনে দীক্ষিত করেছিলেন। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, সঙ্গে সঙ্গে শরীরও দেখতে দেখতে বেশ জোয়ান আর শক্তিশালী হয়ে গেল।
গুরুদেবের চোখে তখন আগুন জ্বলছিল। বললেন, “বটে! তোমার এই কীর্তি? আজ আমি নিজের চোখে দেখলাম যে, তুমি দীনদুঃখীর উপকারের জন্যে না করে, একটা সাধারণ চোরের মত তোমার ক্ষমতার অপব্যবহার করছ? যাক্! আজ থেকে আর তোমার কোন গুপ্ত ক্ষমতাই থাকবে না, সব আমি কেড়ে নিলাম। হযরত এখন তোমার কাছ থেকে মুক্তি পেল। বাংলাদেশে কেউ আর তোমায় এখন ভয় করবে না।”
উদ্বেগাকুল কণ্ঠে হযরতকে ডাকলাম; এই প্রথম আমি অনুভব করলাম, অন্তরে আর তার কোন সাড়া পাচ্ছি না। কিন্তু হঠাৎ যেন চোখের উপর থেকে একটা কালো পর্দা সরে গেল; আমার ঘৃণ্য অপবিত্রজীবনের ছবি আজ আমি স্পষ্টরূপে দেখতে পেলাম।
“গুরুজী! আপনি আমার জীবনের সুদীর্ঘ ভ্রান্তি দূর করে দিতে এসেছেন বলে আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। বলে তাঁর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, গুরুদেব! আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে, সংসারের যা কিছু কামনা-বাসনা সব আজ থেকে ত্যাগ করলাম। এবার আমি পাহাড়ে গিয়ে নির্জনে ভগবচ্চিন্তায় কাল কাটাব; মনে হয় তাতে আমার পাপজীবনের প্রায়শ্চিত্ত হবে।”
আমার গুরু নীরব অনুকম্পায় আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করে অবশেষে বললেন, “তোমার কথায় আন্তরিকতা আছে বুঝতে পারছি। যাইহোক! তোমার ছেলেবেলায় গুরু আজ্ঞাপালন আর বর্তমান অনুতাপ দেখে তোমায় আমি একটিমাত্র বর দিয়ে যাব।
যদিও তোমার অন্য সব ক্ষমতা এখন চলে গেছে, তবুও যখনই তোমার কেবলমাত্র অন্নবস্ত্রের অভাব হবে, হযরতকে ডাকলে তা এনে দেবার জন্যে তখনই তার সাড়া পাবে। যাও, এখন কোন পাহাড়ের নির্জনতায় ভগবদজ্ঞান লাভ করবার জন্যে মনেপ্রাণে তপস্যা কর।”
“আমার গুরুদেব এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সম্বল রইল কেবল শুধুই চোখের জল আর ভাবনা। আজ আমি সেই পরমদয়াল পরমপিতার ক্ষমালাভের আশায় যাত্রা শুরু করলাম। বিদায়! এ সংসার, বিদায়!”
……………………………………………..
যোগী-কথামৃত ( Autobiography of a Yogi ) শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দ বিরচিত পূজনীয় ও পরমারাধ্য আমার গুরুদেব শ্রী শ্রী স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের শ্রীকরকমলে অর্পিত ।
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে : ভারতের সাধক সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত – প্রণয় সেন