ভবঘুরেকথা

তারকের কন্যা রূপে কালি
উদ্ধারণ দত্ত নামে, বাস করে ঢাকা গ্রামে
শহরেতে বাণিজ্য করয়।
শাঁখার ব্যবসা করে, ফেরি করে সদা ফেরে
মাঝে মাঝে দোকানেতে রয়।।
নৌকা যোগে নদী ঘাটে, শাঁখার দোকান লয়ে
ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়াইয়া।।
গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে, কত শাঁখা বিক্রি করে
পুনরায় আসিতে ফিরিয়া।।
সহজ সরল মনে, মাতৃ ভাব নারীগণে
নির্বিকার সত্যের স্বভাব।
একদরে বেচা কেনা, সকলের জানা শোনা
সংসারেতে না ছিল অভাব।।
একদিন নৌকা বেয়ে, নবগঙ্গা নদী দিয়ে
আসিলেন লক্ষ্মীপাশা গাঁয়।
জাগ্রত সে কালীমাতা, লোক মুখে শুনি কথা
মন্দিরেতে হইল উদয়।।
ডালা দিয়ে মার পদে, কহিলেন কেন্দে কেন্দে
শুন মাগো বলি যে তোমায়।
ভাল কেনা বেচা হলে, পুন তব পদ তলে
আসিয়া পূঁজিব তব পায়।।
কালীমার পদ তলে, মানত করিয়া চলে
গ্রামে গ্রামে ঘুরিতে লাগিল।
কাছে যত শাঁখা ছিল, সব শাঁখা বিক্রি হল
পুনরায় নৌকায় আসিল।।
নৌকা হতে শাঁখা নিয়ে, কুলে এসে দেখে চেয়ে
এক মেয়ে দাঁড়াইয়া রয়।
ঘোর কৃষ্ণ বর্ণা মেয়ে, শাঁখারীর কাছে গিয়ে
সজল নয়নে মেয়ে কয়।।
শুন বলি ও শাঁখারী, বিলম্ব সহিতে নারী
এক জোড়া শাঁখা আজি দাও।
ব্যালয়ারী শাঁখা নিতে, বাসনা রয়েছে চিতে
শীঘ্র মোর বাসনা পুরাও।।
শাঁখারী দেখিয়া তাই হেন রূপ দেখি নাই
সজল নয়নে দেখে চেয়ে।
মুখে মৃদু মন্দ হাসি, এলাই কেশ রাশি
মাতৃ মুর্তি আছে দাঁড়াইয়ে।।
শাঁখারী সে দিসে হারা মাতৃ ভাব হৃদি পোরা
স্নেহভরে শাঁখা পড়াইল।
শাঁখা দিয়ে দুই হাতে, ঝরে আখি নয়নেতে
ক্ষীণ স্বরে কহিতে লাগিল।।
শুন বলি ওগো মাতা, তোমার বসতি কোথা
সত্য করি দেহ পরিচয়।
তব হাতে শাঁখা দিতে, হেন জ্ঞান হয় চিতে
কোন দেবী হইবে নিশ্চয়।।
তাই শুনি কালীমাতা, ছল করি কয় কথা
মোর পিতা জয়পুর বাস।
শ্রী তারক চন্দ্র নাম, কবি গানে অনুপম
কবি মধ্যে বিখ্যাত থরায়।।
শুনিয়া শাঁখারী তাই, শাঁখার যে মূল্য চাই
এ শাঁখার দুই টাকা দাম।
শিঘ্র করি দাও টাকা, বেচিতে যাইব শাঁখা
বিলম্বেতে নাহি কোন কাম।।
শুনি শাঁখারীর বাণী, বলে মাতা তৃনয়নী
টাকা দিবে আমার পিতায়।
হয়ে নদী তুমি পার, যাহ পিতার গোচরে
মোর পিতা অতি সদায়শ।।
যদি টাকা নাহি থাকে, কহিও মোর পিতাকে
গৃহ মধ্যে ছিকার উপর।
তিন হাড়ী তাতে আছে, যেই হাড়ী আছে নিচে
টাকা আছে তাহার ভিতর।।
কহিও বাবার কাছে, তব কন্যা শাঁখা নিছে
তাব কন্যা মায়া নাম তার।
আমি তার কন্যা একা, চাহিলে সে দিবে টাকা
মিছে তুমি ভাবিও না আর।
শাঁখারী শুনিয়া তাই, ছাড়িয়া দুঃখের হাই
মনে মনে ভাবিতে লাগিল।
আগে আমি না জানিয়া, ভুল করি শাঁখা দিয়া
শাঁখা বিক্রি বৃথা হয়ে গেল।।
আর আয় কি করিব, টাকা বুঝি নাহি পাব
বাকী পলে ফাকি হয়ে যায়।
অজানা এ দেশে এসে, বাকীতে পড়িলে শেষে
টাকা বুঝি আদায় না হয়।।
তাই ভেবে মেয়েটিরে, কহিলেন ধরী ধীরে
ওগো মাগো বলি তব ঠাই।
মম সঙ্গে চল তুমি, তব সঙ্গে যাব আমি
হাতে হাতে টাকা যাতে পাই।।
তাই শুনি কালীমাতা, ছল করি কয় কথা
শুন তুমি আমার বচন।
এই খানে থাক তুমি, মন্দিরেতে যাব আমি
পরে এসে করিব গমন।
মায়ার মায়ায় ভুলে, এ জগত সদা চলে
শাঁখারী, সে ভুলিল মায়ায়।
কালীমাতা চলি গেল, মন্দিরেতে প্রবেশিল
ফিরিয়ে না এল পুনরায়।।
বহুক্ষণ দেরি হল, মায়া ফিরে না আসিল
শাঁখারী হইয়া নিরুপায়।
ব্যস্ত হয়ে তথা গিয়ে, মন্দিরেতে দেখে চেয়ে
কোন মেয়ে দেখিতে না পায়।।
আসিয়া নদীর তীরে, বেয়ে তরী ধীরে ধীরে
নৌকা হতে কুলেতে নামিল।
মনে তার এই ভাব, তারকের বাড়ী যাব
নিরাশায় হাটিতে লাগিল।।
গিয়ে তারকের বাড়ী তারকের চক্ষে হেরি
কহিতেছে বিনয় করিয়া।
কহ ভাই কহ মোরে, চেন নাকি তারকেরে
সেই বাড়ী দেহ চিনাইয়া।।
হাসিয়া তারক কয়, এই বাড়ী তার হয়
তারক আমার নাম হয়।
আসিয়াছ কি কারণ, কহ তব প্রয়োজন
শীঘ্র করি কহত আমায়।।
শুনিয়া শাঁখারী কয়, শুন শুন মহাশয়
তব কন্যা শাঁখা পরিয়াছে।
নদী পারে হল দেখা, আমি তারে দেই শাঁখা
মূল্য দিতে তোমাকে বলেছে।।
শুনিয়া তারক কয়, শুন বলি মহাশয়
এখনও বিবাহ করি নাই।
কন্যা এল কোথা, হতে, আসিয়াছ ফাঁকি দিতে
মনে তুমি ভেবে দেখ তাই।।
শুনিয়া শাঁখারী তাই, ছাড়িয়া দুঃখের হাই
মন দুঃখে কহিতে লাগিল।
ফাঁকি দিতে আসি নাই, ফাঁকিতে পড়েছি ভাই
মোর কথা মিথ্যা হয়ে গেল।।
মায়া নাত (নাম) তার হয়, কন্যা দিল পরিচয়
তারক আমার পিতা হয়।
টাকা যদি নাহি থাকে, বলিও মোর পিতাকে
কোথা টাকা বলেছে আমায়।।
গৃহ মধ্যে আছে ছিকা, হাড়ীতে হাড়ীতে ঢাকা
তিনটি হাড়ী ছিকার মধ্যেতে।
তার মেধ্য নীচে যেটা, সে হাড়ীতে আছে টাকা
সেই টাকা কহিয়াছে দিতে।।
শুনিয়া তারক তাই, আখিতে অন্ত নাই
অনিমেষে গৃহ মধ্যে গেল।
হাড়ী মধ্যে টাকা হেরি, আখিতে ঝড়েছে বারি
মনে মনে ভাবিতে লাগিল।।
সেই টাকা হাতে করি, মুখে বলে হরি হরি
তখনি সে বাহিরেতে এল।
শাঁখারীর হাতে ধরি, কহিয়া বিনয় করি
সেই টাকা শাঁখারীকে দিল।।
টাকা দিয়া তার হাতে, আখিজল নয়নেতে
কেন্দে কেন্দে কহিল তখন।
ভুল হয়ে গেছে ভাই, তব কাছে ক্ষমা চাই
মেয়ে মোর আছে একজন।
কাল বরণ চেহারা, অভিমানে বুক ভরা
মম সঙ্গে কথা নাহি কয়।
তোমার পাইয়া দেখা, হাতে পরিয়াছে শাঁখা
তার টাকা দিলাম তোমায়।।
তারকের চোখে জল, করিতেছে টলমল
শাঁখারী সে কহিল তখন।
কহ কহ কহ তাই, কান্দিতেছ কেন ভাই
কেন তুমি হয়েছ এমন।।
তারক কান্দিয়া বলে, ভাসিয়া নয়ন জলে
শাঁখারীর হস্ত ধরি কয়।
মম কন্যা গেল কোথা, চল চল যাব সেথা
মেয়ে মোর লুকাল কোথায়।।
তারকের ভাব হেরি, দিশে হারা সে শাঁখারী
সজল নয়নে কেন্দে কয়।
মন্দির ভিতরে গেল, আর নাহি ফিরে এল
চল গিয়ে দেখি দু’জনায়।।
দুজনার শিহরণ, জাগিতেছে সর্বক্ষণ
ভাবাবেশে মন্দিরেতে গেল।
প্রস্তর মুরতী খানি, কালীমাতা তৃনয়নী
সেই হাতে শাঁখা শোভা ভাল।।
শাঁখারী দেখীয়া তাই, কেন্দে কেন্দে ছাড়ি হাই
করজোড়ে কহিতে লাগিল।
মানুষের রূপ ধরি, ছল করি শাঁখা পরি
মন্দিরেতে আসিয়া লুকাল।।
এত বলি সে শাঁখারী, কেন্দে যায় গড়াগড়ি
তারকের পদ ধরি কয়।
তুমি সাধু মহাজন, করি এক নিবেদন
দয়া করে রেখ তব পায়।।
তোমাকেই পিতা বলে, মম হাতে শাঁখা নিলে
তুমি হও জগতে মহান।
কি দিব তুলনা তোমা, গুণের নাহিকো সীমা
অধমের কর প্রেমদান।।
তরক কান্দিয়া কয়, হেরি বলি রসনায়
শাঁখারী কে বুকেতে ধরিল।
ভাসিয়া নয়ন জলে, শাঁখারিকে কেন্দে বলে
তোমা পেয়ে হৃদয় শুধিল।।
ধরাধরী দুই জনে, পড়ে তারা ধরাসনে
মায়ের চরণ ধরি কান্দে।
কান্দিয়া কান্দিয়া কয়, পদে যেন মতিরয়
দুইজনে ভাসে প্রেমানন্দে।।
এই ভাবে কান্দি কান্দি মায়ের চরণ বন্দি
যার যার গন্তবেতে গেল।
সে হতে তারক চন্দ্র, মনে হয়ে প্রেমানন্দ
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল।।
দুই জোড়া শাঁখা কিনে, বছরে বছরে এনে
একজোড়া শান্তিমাকে দেয়।
আর জোড়া শাঁখা নিয়ে, কালীমার হাতে দিয়ে
মনে মনে বাসনা পুরায়।।
হরিভক্ত যারা যারা, প্রেমানন্দ তনু পোরা
ভালবাসে সর্ব দেবতায়।
কান্দিয়া বিনোদ বলে, এ জনম গেল চলে
অধমের কি হবে উপায়।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!