শ্রীমৎ গোপাল চাঁদের নিঃস্বার্থ দান ও শ্রীশ্রীহরি লীলামৃত গ্রন্থ মুদ্রণ
তের শ’ বাইশ সালে বারুণী সময়।
ভক্তগণে কিছু অর্থ হরিবরে দেয়।।
সে সময়ে শ্রীগোপাল দুই টাকা দিল।
‘পূজা শেষে গ্রন্থ পাবে’ এই কথা হ’ল।।
তের শ’ তেইশ সালে পূজার সময়।
ওড়াকান্দী শ্রীধামেতে সে-গোপাল যায়।।
পূজা শেষে প্রভু কাছে গোপাল কহিল।
“এইখানি গ্রন্থ নিব মনে ইচ্ছা ছিল।।
কত মূল্য নিব প্রভু জানিবারে চাই।
টাকা দিয়ে একখানি গ্রন্থ নিয়ে যাই।।”
প্রভু বলে “সেই গ্রন্থ ছাপা হয় নাই।
টাকা নিয়ে গ্রন্থ দেব-গ্রন্থ কোথা পাই?
আমি ত বলেছি বাপু! সেই হরিবরে।
গ্রন্থ ছেপে এনে দাও অতীব সত্বরে।।
কি জানি কি করিছে সে কিছু নাহি জানি।
গ্রন্থ বুঝি ছাপা আর হ’ল নারে মণি।।
বড়ই নিরাশ চিত্তে বলিছে গোপাল।
“মোর মনে এক কথা উঠেছে দয়াল।।
আপনার বাক্য নষ্ট হ’তে নাহি পারে।
মনে হয় সেই ভাবে বলোনি আহারে।।
ঠিক ভাবে বাক্য যদি তারে দিতে প্রভু।
গ্রন্থ-ছাপা কার্য্যে বাধা পড়িত না কভু।।
আপনার মনে যেন কি ভাব রয়েছে।
তাই পদে পদে কার্য্য বাধা পড়িতেছে।।”
এ-কথা কহিল যদি গোপাল সুজন।
ধীরে ধীরে গুরুচাঁদ কহিছে বচন।।
“ঠিক ভাবে কথা যদি বলিয়া না থাকি।
ঠিক ভাবে বলে তবে পরীক্ষাটা দেখি।।”
এত বলি দয়াময় ছাড়িয়া আসন।
গোপালের প্রতি চাহি করে নিবেদন।।
“শুন হে গোপাল আমি কহি তব ঠাঁই।
আমার পিতার কীর্ত্তি ছাপাইতে চাই।।
সেই কীর্ত্তি গাঁথা তুমি দেহ ছাপাইয়া।
এ জগতে রহ তুমি অমর হইয়া।।”
প্রভুর বচন শুনি গোপাল অজ্ঞান।
লোটায়ে পড়িয়া বলে “পদে দেহ স্থান।।
কোন কথা আর মোর বলিবার নাই।
কত টাকা লাগে এ’তে তাই জান্তে চাই।।”
প্রভু বলে “টাকা চাই শঞ্চ শতাধিক।
বেশী কিছু লাগে নাকি নাহি তাহা ঠিক।।”
গলবস্ত্র করজোড়ে গোপাল দাঁড়াল।
বারিধারা বহে চক্ষে কহিতে লাগিল।।
“শ্রীমুখের আজ্ঞঅ যদি প্রভু আমি পাই।
নিজ হতে এই টাকা আমি দিতে চাই।।”
নরাচারে শিহরিয়া উঠিলেন প্রভু।
বলে “হেন কথা পূর্ব্বে শুনি নাই কভু।।
কি সাহসে ওরে বেটা এ-মত বলিলি?
পাঁচ শত টাকা লাগে কথা কি বুঝিলি?”
গোপাল কান্দিয়া কয় “দয়ার সাগর।
পাঁচ শত টাকা মোর নহে অগোচর।।
পাঁচ শত ছার কথা তব দয়া বলে।
অসাধ্য সাধন হ’তে পারে ভূমন্ডলে।।
শ্রীমুখের আজ্ঞামাত্র ভরসা আমার।
আজ্ঞঅ পেলে টাকা হবে চিন্তা কিবা আর?”
অন্তর্য্যামী প্রভু সব বুঝিছে অন্তরে।
তথাপি জিজ্ঞাসা তারে মানব আচারে।।
“ওরে বেটা কত কাঠা জমি তোর আছে?
ঠিক ঠিক কথা তুই বল মোর কাছে।।”
গোপাল বলিল “প্রভু তব দয়াগুণে।
দু’শ বিঘা খাস জমি পাই দুই জনে।।
অপুত্রক খুড়া আর আমি অভাজন।
এক সঙ্গে দু’শ বিঘা পাই দুই জন।।
শ্রীমুখেতে আজ্ঞা যদি কর দয়াময়।
এই টাকা দিতে মোর নাহি কোন দায়।।”
গোপালের কথা শুনি প্রভু আনন্দ।
বলে “ধন্য হে গোপাল! তুমি বটে ধন্য।
কতদিনে টাকা তুমি আনিবে হেথায়?”
“দশদিনে দিব টাকা” সে গোপাল কয়।।
প্রভু বলে “টাকা দাও কিসের কারণ?”
গোপাল কহিছে “শুন পতিত পাবন।
চিরকাল কত ভাবে ক্ষয় হল ধন।
কিন্তু তার কোন চিহ্ন নাহিক এখন।।
শুধু ধনক্ষয় নহে হয়েছি দায়িক।
কোথা গেল এত ধন নাহি পাই ঠিক।।
এবে তাই ভেবে আমি দেখিলাম মনে।
এতদিন গেল ধন শুধু অকারণে।।
অকাজে ভেঙ্গেছি অর্থ কাজ নাহি করি।
দিনে দিনে দেনা-দায় দেখি ডুবে মরি।।
মনে তাই ভাবিয়াছি সেই পথ ছেড়ে।
ঠিক পথে ধন কিছু ভাঙিব সংসারে।।
সৎপথে সৎকার্য্য আমি নাহি চিনি।
নিজগুণে চিনাইলে আজ গুণমণি।।
ব্রহ্ম বিষ্ণু শিব যাঁরে ধ্যানে নাহি পায়।
তাঁর লীলা লেখা হ’ল মানব-ভাষায়।।
প্রচার হইবে তাহা প্রতি ঘরে ঘরে।
তার চেয়ে শুভ কর্ম্ম আছে কি সংসারে?
মনে মনে ইচ্ছা মোর ছিল বহু দিন।
কিন্তু মনে ভাবি আমি কতই মলিন।।
মলিনের ধন কিসে শুভ কর্ম্মে লাগে?
তাই ভেবে এ প্রস্তাব করি নাই আগে।।
অদ্য যবে শ্রীমুখেতে দিলে আজ্ঞা করি।
ডোবা মনে জেগে ওঠে আশা-ভরা তরী।।
মনে হ’ল হেন দিন আর নাহি পাব।
সর্ব্বস্ব বিক্রয় করে টাকা এনে দিব।।
এই ভাবে সে-গোপাল যদি কথা কয়।
ক্ষণেক নিস্তব্ধ থাকি’ বলে দয়াময়।।
“মনে হয় তব বাক্য নাহি হবে ফাঁকা।
ঘরে যাও হে গোপাল নিয়ে এসো টাকা।।
আজ্ঞামাত্রে সে গোপাল দন্ডবৎ করে।
এস্তে ব্যত্তে উপস্থিত হ’ল নিজ ঘরে।।
পত্নী তাঁর মহাসতী শ্রীকাঞ্চন দেবী।
ঠিক যেন মূর্ত্তিমতী ভগবতী-ছবি।।
তাঁরে ডাকে আর ডাকে নিজ পুত্রগণে।
হরশীত কাশীনাথ ভাই দুই জনে।।
সকলে নিকটে এলে কহিছে বচন।
“আমার বচন সবে শুন দিয়া মন।।
যাহা জিজ্ঞাসিব তার সকল উত্তর।
দেহ সবে অকপটে ফেলে অন্ধকার।।
এই ঘর এই বাড়ী বলত কাহার?
কার গুণে কর সবে এ-ঘর সংসার?
কেবা রক্ষা করে বল পিবদে পড়িলে?
কার কৃপাবলে সবে আছ ভূমন্ডলে?
ইহার উত্তর আগে দেহ মোর ঠাঁই।
আর কিছু কথা আছে পরে বলি তাই”
গোপালের কথা শুনি কাঞ্চন জননী।
উত্তর করিল তাঁরে জুড়ি দুই পাণি।।
“শোন প্রভু! যেই ভাব আসে মোর মনে।
সব-কিছু ঘটিতেছে হরি-কৃপা গুণে।।
সেই হরি ওড়াকান্দী অবতীর্ণ হল।
তাঁর দয়া ভিন্ন কেবা কোথা বাঁচে বল।।
সকলি দিয়াছে তিনি ধন, জন, প্রাণ।
ত্রিভুবনে নাহি বন্ধু তাঁহার সমান।।
তিনিই করেন রক্ষা সম্পদে বিপদে।
ভক্তি যেন থাকে প্রভু তাঁর রাঙ্গা পদে।।
মাতা যদি বলে ইহা পুত্রে বলে তাই।
মনে খুসী হ’ল তবে গোপাল গোঁসাই।।
পুনরায় প্রশ্ন করে বুঝিবারে মন।
“বেশ হল সবে মিলে বলত এখন।।
এমন বান্ধব যিনি ভক্ত-শিরোমণি।
তিনি যদি চায় কিছু আপনা আপনি।।
সেই দ্রব্যে তাঁরে দেয়া মন্দ কিংবা ভাল।
মন খুলে সেই কথা সবে মোরে বল।।
আর কিছু এই সাথে বলিবারে চাই।
এক সাথে দুই ভাব যেন আমি পাই।।
বাঁচায়ে রাখিছে যিনি সকল সময়।
এমন কি তিনি যদি প্রাণ নিতে চায়।।
কোন ভাব তোমাদের মনে তাতে আসে?
সে-উত্তর দেও মোরে সকলে শেষে।।”
আবার কাঞ্চন দবী করজোড়ে কয়।
“শোন প্রভু সার কথা যাহা মনে হয়।।
কি কারণে জিজ্ঞাসিছ কিছু নাহি বুঝি।
যাহা আসে মনে তাহা কই সোজাসুজি।।
যিনি রক্ষা করে প্রাণ, প্রাণ যে তাঁহার।
তাঁর প্রাণ তিনি নিবে বাঁধা কিবা তার।।
তবে বটে ধন্য হই যদি চেয়ে নেয়।
তার তূল্য দয়া আমি দেখিনা কোথায়।।”
শ্রীকাঞ্চন দেবী যবে এ-মত কহিল।
গোপাল কহিল “মোর জন্ম ধন্য হল।।
পতি-পত্নী একমতি যদি নাহি হয়।
পরম দুর্ভাগা তারা জানিবে ধরায়।।
তোমার উত্তর শুনি বড়ই আনন্দ।
এবে শুন বলি সব প্রশ্নের সম্বন্ধ।।
শ্রীহরির লীলাগীতি-লীলামৃত নাম।
লিখেছে তারকচন্দ্র কবি গুনধাম।।
“সেই গ্রন্থ ছাপা হবে” বলেছে ঠাকুর।
গ্রন্থ পড়ে ধন্য হবে লনাথ আতুর।।
পাঁচশত টাকা তাতে খরচ লাগিবে।
প্রভু বলে “এই টাকা খরচ লাগিবে।।
প্রভু বলে “এই টাকা বল কেবা দিবে?”
আমি তাই মনে ভাবি হেন শুভ কর্ম্ম।
পরম পবিত্র অতি পুণ্যময় ধর্ম্ম।।
তাই বলিয়াছি আমি মহাপ্রভু ঠাঁই।
আজ্ঞা পেলে সব টাকা আমি দিতে চাই।।
দয়া করে প্রভু মোরে দিয়াছেন আজ্ঞা।
আমার রাখিতে হবে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।।
প্রশ্ন করি বুঝিলাম সবাকার মন।
বল কোন কার্য্য সবে করিবে এখন?”।।
গোপালের কথা হ’লে জননী কহিল।
“আপনার কথা শুনে প্রাণে শান্তি এল।।
আমি বলি ধান চাল যাহা কিছু আছে।
এই টাকা দেহ প্রভু সব-কিছু বেচে।।
ভিক্ষা করে খাই খাব তাতে নাই দুঃখ।
গ্রন্থ-ছাপা হলে মনে পাব স্বর্গসুখ।।”
এমত কহিল যদি কাঞ্চন জননী।
পুত্রগণে বলে “মোরা এই বাক্য মানি।।”
তবে ত গোপাল সাধু উতি উতি ধায়।
দেখে কিছু ধান্য আছে একটী গোলায়।।
সেই ধান আরো চাল বিক্রয় করিল।
ইতি উতি করে টাকা পাঁচ শত হল।।
সামান্য কতক চাল রহিল গৃহেতে।
কোন ভাবে দিন যাবে নাহি ভাবে চিতে।।
টাকা নিয়ে ওড়াকান্দী হইল উদয়।
তাহাতে দেখিয়া সবে মানিল বিস্ময়।।
প্রভু বলে “কি গোপার! আনিয়াছ টাকা?
আমি জানি গোপালের কথা সব পাকা।।”
গোপাল কান্দিয়া বলে “দয়াল আমার।
তোমার ইচ্ছায় চলে সর্ব্ব চরাচর।।
শ্রীমুখের বাক্য কভু নষ্ট নাহি হয়।
সব টাকা আনিয়াছি তোমার দয়ায়।।”
এত বলি টাকাগুলি দিল প্রভু ঠাঁই।
টাকা পেয়ে প্রভু বলে “আর ভয় নাই।।
গোপালের ভক্তিগুণে গ্রন্থ ছাপা হবে।
গ্রন্থ পেয়ে হরিভক্ত কত সুখ পাবে।।
শোন বলি হে গোপাল! যে কার্য্য করিলে।
বাবার দয়ায় তুমি অমর হইলে।।
এই দান শ্রেষ্ঠ বলি করে ঘরে ঘরে।
অক্ষয় তোমার কীর্ত্তি হবে চিরতরে।।”
প্রভুর মধ্যম পুত্র সুধন্য কুমার।
তারে ডাকি প্রভু বলে এই সমাচার।।
আর বলে “আন ডেকে সেই হরিবরে।
গ্রন্থ নিয়ে যাক চলে ছাপাবার তরে।।”
প্রভুর আদেশে তবে আসে হরিবর।
কবিচুড়ামণি যিনি দূর্গাপুরে ঘর।।
আর কত ভক্ত এল প্রভুর আলয়।
সবারে ডাকিয়া প্রভু বারে বারে কয়।।
“এই যে গোপাল সাধু মস্ত বড় দাতা।
এর মত লোক আর নাহি দেখি কোথা।।
লীলামৃত ছাপাইতে সব টাকা দিল।
এতবড় দাতা আর কোথা আছে বল?
আর শুভ ভক্তগণ নিগূঢ় কাহিনী।
কোন লেখা খেলে টাকা আমি সব জানি।।
জোয়ারের জল যথা আসে নদী ভরে।
ভাটা এলে স্রোত ধরে যায় পুনঃ ফিরে।।
কবে আছে কবে নাই-নাহিক ঠিকানা।
কোন দিকে কেহ তারে বাঁধিতে পারে না।।
যেই কালে মানবের ঘরে ধন থাকে।
কোন ব্যবহারে তারে নরপ্রাণী রাখে?
আত্ম-সুখে ক্ষয় তারে করে পলে পরে।
টাকা কিন্তু সব দেখে কথা নাহি বলে।।
দিনে দিনে সহে টাকা সব অপমান।
শেষকালে একদিনে কোথা চলে যান।।
“শ্রী রূপেতে আসে টাকা লহ্মীর বাহন।
লহ্মীর সঙ্গেতে থাকে নিজে নারায়ণ।।
বিশ্ববাসী সবে যাঁর অপমান সন্তান।
আত্মসুখী নরে তাঁরে করে অপমান।।
বিশ্বের মঙ্গলে যার ধন নিয়োজিত।
তার ধন ক্ষয় কভু হবে না নিশ্চিত।।
গোপালের ধন দান হল সে পর্যায়।
গোপালের ধন আর নাহি হবে ক্ষয়।।”
শত মুখে প্রভু কহে প্রশংসা বচন।
গোপালের দান ব্যাপ্ত হল ত্রিভুবন।।
প্রভু তবে ডাক দিয়া কহে হরিবরে।
“চলে যাও কলিকাতা গ্রন্থ ছাপিবারে।।
সুধন্য, গোপাল আর তুমি একজন।
তিন জনে এক সঙ্গে করহ গমন।।”
প্রভুর আজ্ঞাতে তিনি তখনি ছুটিল।
পরদিনে কলিকাতা উপস্থিত হল।।
পান্ডুলিপি প্রেসে দিলে গন্ডগোল হয়।
প্রেস’য়ালা বলে “ইহা ছাপা নাহি যায়।।”
কারণ জিজ্ঞাসা করে সুধন্য কুমার।
প্রেস বলে “এক স্থানে আপত্তি আমার।।
নমঃশূদ্র ঘরে এল স্বয়ং ভগবান।
এই কথা ছাপিবারে নাহি বলে প্রাণ।।”
বহু তর্কাতর্কি পরে তবে রাজী হল।
ছলে বলে কিছু টাকা বেশী নিয়া নিল।।
ছিদাম মুদির লেনে ছিল এক প্রেস।
এতদিনে তাহা বুঝি হইয়াছে শেষ।।
“শাস্ত্র প্রচার প্রেসে” নাম বলি কয়।
দুই মাসে ছাপানর কার্য্য শেষ হয়।।
প্রুফ দেখা লেখা জোখা করে হরিবর।
এই কার্য্যে বহু শ্রম হইল তাহার।।
তাতে নাহি দুঃখ পায় মনেতে আনন্দ।
ছাপা হল লীলামৃত প্রেম-মকরন্দ।।
প্রভুর মনন আর গোপালের ধন।
শ্রম করে হরিবর হয়ে একমন।।
তের’শ তেইশ সালে গ্রন্থ ছাপা হ’ল।
প্রতিখন্ড তিনটাকা মূল্য রেখে দিল।।
উদিল লীলামৃত পূর্ণচন্দ্র প্রায়।
ভকত-চকোর সুধা পান করে তায়।।
ব্যাধিতের ব্যথা-হীরা শোকেতে সান্ত্বনা।
কর্ম্মপাকে মহানন্দ গ্রন্থ পড়িল না।।