মধ্যখণ্ড : তৃতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
গোস্বামী দশরথোপাখ্যান
পয়ার
দশরথ নামে সাধু পদ্মবিলাবাসী।
তত্ত্বজ্ঞানী হরিনামে মত্ত অহর্নিশি।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রীয় পুরুষ রতন।
করে একাদশী ব্রত তুলসী সেবন।।
তিন সন্ধ্যা মালা জপ তুলসী ধারণ।
হরিনাম ছাপা অঙ্গে অতি সুশোভন।।
নিত্য নিত্য প্রাতঃকৃত স্নানাদি তর্পণ।
গুরু পূজা কৃষ্ণ পূজা নৈবিদ্য অর্পণ।।
পক্ষে পক্ষে একাদশী শ্রীহরি বাসর।
স্তব পাঠ নাম পাঠ নাহি অবসর।।
চৈতন্য চরিতামৃত পঠে ভাগবত।
সাধুসেবা মহোৎসব করে অবিরত।।
দিবাহারী এক সন্ধ্যা নাহি দ্বিভোজন।
আতপ তণ্ডুল অন্ন লাবড়া ব্যঞ্জন।।
তৈল মৎসত্যাগী ভক্ষে দিনে একবার।
রাত্রে কিছু ফলাহার কভু অনাহার।।
হেন মতে সদা করে বিশুদ্ধ ভজন।
হরিনাম সংকীর্তন সতত মগন।।
দৈবে ব্যধিযুক্ত হ’ল কার্ত্তিক মাসেতে।
জ্বর হ’য়ে ভুগিলেন কতদিন হ’তে।।
পালাজ্বর হ’ল তার দুইমাস পর।
একদিন হয় জ্বর এক দিনান্তর।।
মাঘমাস এই ভাবে গেল গোস্বামীর।
জ্বরের জ্বালায় আর নাহি পান স্থির।।
ফাল্গুন মাসেতে জ্বর বাড়িল অধিক।
চৈত্র মাস শেষে জ্বর হইল ত্রাহিক।।
আরক পাঁচন বটি কত খাইতেছে।
ক্রমশঃ জ্বরের বৃদ্ধি দুর্বল হ’তেছে।।
ভাল বৈদ্য চিকিৎসক কতই আসিল।
বাছিয়া বাছিয়া কত ঔষধ খাইল।।
তবু রোগ শান্তি নাই হইল কাতর।
শক্তি নাই যষ্ঠিমাত্র চলিতে দোষর।।
প্রচলিত হইয়াছে হরিবলা মত।
কতলোকে ওঢ়াকাঁদি করে যাতায়াত।।
ইহা শুনি দশরথ তবু নাহি যায়।
কি জানি কি ওঢ়াকাঁদি না হয় প্রত্যয়।।
যারা যায় তারা কয় হরি আবির্ভূত।
শ্রীকান্ত হয়েছে এবে যশোমন্ত সুত।।
গেলে মাত্র রোগ সারে করিলে প্রণতি।
কিংবা প্রভু আজ্ঞা দিলে হয় রোগ মুক্তি।।
মুখের কথায় মাত্র রোগের আরোগ্য।
বৈরাগ্য কেহবা পায় যদি থাকে ভাগ্য।।
শুনে দশরথ কয় বিশ্বাস না হয়।
কোন হরি ওঢ়াকাঁদি হইল উদয়।।
না দেখিলে চক্ষু কর্ণ বিবাদ না ঘুচে।
অবশ্য যাইব দেখিবার ইচ্ছা আছে।।
কি ভাব সে ওঢ়াকাঁদি ভক্ত কিংবা হরি।
হেরিব মহাপুরুষে যদি যেতে পারি।।
কল্য প্রাতেঃ দরশন করিব ঠাকুর।
অদ্য গিয়া নিশিতে থাকিব লক্ষ্মীপুর।।
বুদ্ধিমন্ত বুদ্ধিমন্ত ইহা আমি জানি।
হরিভক্ত জ্ঞানী চূড়ামণি চূড়ামণি।।
শুনিয়াছি তারা যায় ঠাকুরের বাড়ী।
তারা যদি বলে তবে মানিবারে পারি।।
আদি অন্ত বৃত্তান্ত শুনিব সেই স্থানে।
কেমন ঠাকুর তিনি তারা ইহা জানে।।
এতবলি যান চলি লক্ষ্মীপুর গ্রামে।
রহিলেন গিয়া বুদ্ধিমন্তের আশ্রমে।।
ঠাকুরের কথা তথা সকল শুনিল।
শুনিয়া অন্তরে বড় ভক্তি জনমিল।।
প্রাতেঃ উঠি চলিলেন ওঢ়াকাঁদি ধাম।
যষ্ঠিহাতে কষ্টেতে গমন অবিশ্রাম।।
ধীরে ধীরে চলিলেন বলবীর্যহীন।
চলে যায় মনে ভয় পালা সেইদিন।।
জ্বর আসিবার ভয়ে হরি হরি বলে।
হরিচাঁদ ব’লে ডাকে ভাসে অশ্রুজলে।।
হরি হরি বলি উতরিল ওঢ়াকাঁদি।
বস্ত্র গলে চক্ষু জলে দাঁড়াইল কাঁদি।।
ঠাকুর বলেন বাছা কি নাম তোমার।
দশরথ বলে আমি বড় দুরাচার।।
নাম মোর দশরথ পদ্মবিলা বাস।
প্রভু বলে তুমিত’ দশরথ বিশ্বাস।।
তুইত’ বিশ্বাস আমি বড় অবিশ্বাস।
তন্ত্রে মন্ত্রে শৌচাচারে না হয় বিশ্বাস।।
কেন বা আসিলি বাছা আমার নিকটে।
তুই শুদ্ধচারী মোর শৌচ নাই মোটে।।
তিনবেলা সন্ধ্যা কর আর স্নানাহ্নিক।
স্নান পূজা সন্ধ্যাহ্নিক মোর নাই ঠিক।।
কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই।
বেদবিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই।।
মোর ঠাই এলি বাছা কিসের কারণ।
কহ শুনি মনোকথা বুঝি তোর মন।।
প্রকাশিয়া বল শুনি ওরে দশরথ।
শুদ্ধাচারী সাধু তোর কিবা মনোরথ।।
কি জানি কি ওঢ়াকাঁদি না হয় প্রত্যয়।
কোথাকার হরি এল ওঢ়াকাঁদি গায়।।
নদীয়াতে গৌররূপে গোলোক-বল্লভ।
ওঢ়াকাঁদি জন্ম তার কিসে অসম্ভব।।
মীন হৈনু, কূর্ম হৈনু, বরাহ নৃসিংহ।
তা হ’তে কি হীন হৈনু ল’য়ে নরদেহ।।
মাতাকে কড়ার দিনু নদীয়া ভুবনে।
করিব মা শেষ লীলা ঐশান্য কোণে।।
এই সেই লীলা এই সেই অবতার।
ইহার উপরে পূর্ণ লীলা নাহি আর।।
মন ঠিক কর বাছা চিন্তা নাই আর।
পালিয়েছে পালা আর না হইবে জ্বর।।
শ্রীগুরু চরণচিন্তে ভব ব্যাধি নাশে।
ওঢ়াকাঁদি এলে তার জ্বর থাকে কিসে।।
দশরথ বলে প্রভু বুঝিনু এখন।
নিজ দাস জানি প্রভু ছলা কি কারণ।।
যুগে যুগে ভক্ত মন বুঝিয়া বেড়াও।
জেনে মন বুঝে মন ছলনা করাও।।
কর্ণকে ছলিতে প্রভু বৃদ্ধ বিপ্র বেশে।
পুত্র কেটে দিতে কও পারণা দিবসে।।
খাইবে মনুষ্য মাংস বলিল সেকালে।
ব্রাহ্মণে মানুষ খায় বুঝিতে নারিলে।।
দান ধর্মে রত কর্ণ নির্মল সুজন।
বুঝে না মনুষ্য মাংস খায় কি ব্রাহ্মণ।।
বুঝিতে কর্ণের মন কিবা বাকী ছিল।
স্বর্ণ দগ্ধ পুনঃ পুনঃ ঔজ্জ্বল্য বাড়িল।।
সূর্যবংশে রঘুরায় বুঝি তার মন।
হ’য়েছিলে দ্বিজ ব্যাঘ্র তোমরা দু’জন।।
তুমি হ’লে দ্বিজ, ব্যাঘ্র হ’ল পঞ্চানন।
দ্বিজসুতে খেতে ব্যাঘ্র করে আক্রমণ।।
দ্বিজ শিশু রূপে গেল রঘুরাজ আগে।
বলেছিল রক্ষা কর মোরে খায় বাঘে।।
রঘু বলে ওরে বাঘ বলিরে তোমাকে।
ছাড় ছাড় খেওনারে ব্রাহ্মণ বালকে।।
ব্যাঘ্র বলে যদি আমি রাজ মাংস পাই।
তাহ’লে দ্বিজের সুতে ছেড়ে দিয়ে যাই।।
রাজা বলে আমার অঙ্গের মাংস খাও।
শরণাগত বালকে ছেড়ে দিয়ে যাও।।
তাহা শুনি স্বীকার করিল ব্যাঘ্রবর।
রাজা দেন গাত্রমাংস ব্যাঘ্রে খাইবার।।
খাইল সকল মাংস অস্থিমাত্র সার।
হেনকালে পরিচয় দিল দিগম্বর।।
চেয়ে দেখ আমি ব্যাঘ্র নহে, পঞ্চানন।
মন বুঝিবারে দ্বিজশিশু নারায়ণ।।
বর দিয়া রঘুরাজে গেলে দুইজন।
অন্তর্যামী হ’য়ে কি বুঝিতে হয় মন।।
শ্রীরাম রাঘব নাম নাশিতে রাবণ।
রঘুনাথ হ’তে তার মঙ্গলাচরণ।।
বিশেষতঃ ভক্তগণে জানাইতে ভক্তি।
জগতের শিক্ষাহেতু এই সব যুক্তি।।
এই আমি মনে মনে ভাবি অনুক্ষণ।
গোপীদের মন বুঝা কোন প্রয়োজন।।
যে দিন করিলে হরি বসন হরণ।
জানা মন কি জানিয়ে হরিলে বসন।।