দুর্গা পূজার দশ দিক
বাংলা অঞ্চলে সনাতন ধর্মালম্বীদের সর্ববৃহৎ উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। কালের বিবর্তনে এই উৎসবটি সার্বজনীন রূপ নিয়েছে। এটি এখন আর কেবল সনাতন ধর্মালম্বীদের উৎসব হিসেবেই নয় সকলের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। যদিও এই ভারতবর্ষের অন্যান্য পূজার মতো দুর্গাপূজা তেমন প্রাচীন পূজা নয়। যে মার্কণ্ডেয় পুরাণের উপর নির্ভর করে দুর্গা পূজা করা হয় সেটাও বৌদ্ধোত্তর যুগে লেখা।
মার্কণ্ড পুরাণ শঙ্করাচার্যের সময়কার। বাল্মীকি রামায়ণেও এর কোন উল্লেখ নেই। এই মার্কণ্ড পুরাণ থেকে নির্বাচিত ৭০০ শ্লোককে বলা হয় দুর্গাসপ্তশতী বা শ্রীশ্রীচন্ডী। আর অন্য যে সকল গ্রন্থের ওপর নির্ভর করে বিশেষ বিশেষ স্থানে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় সেগুলো হচ্ছে ‘দেবীপুরান’, ‘দেবীভাগবত’, ‘কালিকাপুরান’, ‘বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ’ ও ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’।
এর কোনটাই ১৫০০ বছরের পুরোনো পুস্তক নয়। আর বলাবাহুল্য যে পাঠান যুগের পূর্বে বিভিন্ন শাস্ত্রে উল্লিখিত দুর্গা ছিল অষ্টভুজা। বৌদ্ধোত্তর যুগে এমন কি পাল যুগেও দুর্গাপূজা ছিল না।
এই জমিদারী উৎসব ধীরে ধীরে সমাজের অন্যান্য স্তরে ছড়িয়ে পরে আজ থেকে দেড়শ বছর আগে। হুগলী জেলার নলাগড় থানার গুপ্তিপাড়ায়। সেখানকার কয়েকজন যুবক (বারজন বন্ধু) চাঁদা তুলে একটা পূজার আয়োজন করে। মূলত এরপর থেকেই এই পূজা সাধারণন স্তরে নেবে আসে।
যতদূর জানা যায়, দশভুজা বা বাঙলার এই শরৎকালীন দুর্গাপূজা প্রথম প্রচলন হয়েছিল পাঠান যুগে।এই পূজার প্রবর্তন করেন বরেন্দ্রভুমির রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ রায় (আসল পদবী ছিল সান্ন্যাল)। তিনি বলেন, আমি রাজসূয় যজ্ঞ বা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাই। পণ্ডিতরা বলেন, কলিযুগে অশ্বমেধ চলে না। মার্কণ্ডেয় পুরানে যে দুর্গার কথা আছে তাঁর পূজা করুন।
পন্ডিতদের কথা মত তিনি সাত লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা খরচ করে এই পূজার আয়োজন করেন। পূজাটি এতো জনপ্রিয় হয়েছিল এবং সমাজের উপর প্রভাব পরেছিল যে পরবর্তীকালে বাঙালার রামায়ণকার কবি কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণে এর অন্তর্ভুক্ত করেন। কৃত্তিবাস ছিলেন বাঙলার নবাব হোসেন শাহের সময়কার পাঠান যুগের কবি। বাল্মীকি রামায়ণে এর কোনও উল্লেখ নেই।
এরপর পূজাটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরে। প্রথমদিকে জমিদারদের মধ্যে, তারপর অন্যান্যদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত জিনিসটা হয়ে দাঁড়ায় টাকার খেলার প্রতিযোগিতা। কংসনারায়ণের দেখাদেখি পরের বছর যশোরের রাজা জগদ্বল্লভ রায় সারে আট লাখ টাকা খরচ করে এই পূজার আয়োজন করেন।
এই জমিদারী উৎসব ধীরে ধীরে সমাজের অন্যান্য স্তরে ছড়িয়ে পরে আজ থেকে দেড়শ বছর আগে। হুগলী জেলার নলাগড় থানার গুপ্তিপাড়ায়। সেখানকার কয়েকজন যুবক (বারজন বন্ধু) চাঁদা তুলে একটা পূজার আয়োজন করে। মূলত এরপর থেকেই এই পূজা সাধারণন স্তরে নেবে আসে।
দুর্গা মূর্তি প্রসঙ্গ
বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী রাজ রাজেশ্বরী। ১১শ বছর পূর্বে এই চতুর্ভুজা দেবী (বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী বিবর্তিত হয়ে হিন্দু পৌরাণিক দেবীতে রূপান্তরিত হল) অষ্টভুজায় রূপান্তরিত হল। নাম হল দাক্ষায়ণী। আবার আজ থেকে নয়’শ বছর আগে এই দেবী হয়ে গেল দশভুজা। নাম হল দেবী চণ্ডী।
আমরা যে আজ দশহস্তা দেবী দুর্গাকে দেখতে পাই তার উদ্ভব ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচ’শ বছর আগে। কংসনারায়ণ রায়ের পূজিত সর্বপ্রথম দুর্গা মূর্তি কিংবা আধুনিককালের যে দুর্গা প্রতিমা আমরা দেখি তা হল বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী রাজ রাজেশ্বরী দেবীর বিবর্তন মাত্র। তাই কেউ কেউ যখন দুর্গা দেবী কে বাঙলার জাতীয় দেবী বলে বর্ণনা করে, সেটা আদৌ যৌক্তিক নয়।
প্রসঙ্গ নবপত্রিকা
মার্কণ্ডেয় পুরানের যুগ থেকে আনুমানিক ১২০০/১৩০০ বছর আগে রামায়নে বর্ণিত না থাকলেও সেকালে নবপত্রিকার নবরাত্রি উৎসব ছিল। নয়টা বিশেষ ঔষধীয় গুণসম্পন্ন গাছের মানুষ পূজা করত। এই নয়টা গাছ হল- কদলী, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, অশোক, বিল্ব, দাড়িম্ব, মান, ধান্য। কদলী যেমন খাদ্যমূল্য আছে তেমনি অনেক রোগের প্রতিষেধকও। এর সর্বাংশ কাজে লাগে। তাই ধরা হয় কদলীতে যে প্রাণশক্তির অধিষ্ঠান তার নাম ব্রহ্মাণী।
সেকালে আলু ছিল না, লোকে কচু খেত। এর বিভিন্ন ধরনের গুণ। কচুর মধ্য অনেক গুণ থাকায় এর শক্তির যে শক্তির অধিষ্ঠান তাকে বলা হয় কালিকা। কাচা হলুদ চর্মরোগের ঔষধ। হলুদের হলুদের গুণ থাকায় একে মানুষ পুজা করত। এর পরাশক্তির নাম দুর্গা।
লোকের ধারণা কলা বৌ বুঝি গণেশের বৌ। কলা বৌ গণেশের বৌ নয় বরং মা। দেবতাদের বা দিকে থাকে দেবী। কিন্তু গণেশের দান দিকে আছে কলা বৌ। নবপত্রিকা উৎসবকে উত্তর ভারতের লোকরা নবরাত্রি উৎসব বলে। বাঙলায় নবাব হোসেন সাহেবর সময় রামের জয়কে কেন্দ্র করে কংসনারায়ণ রায় এর প্রবর্তন করেন।
জয়ন্তী লতা শ্বেতী রোগে ব্যবহার হয়। এতে যে শক্তি আছে তার নাম কার্ত্তিকী। অশোক ফুল নানা রোগের ঔষধ। স্ত্রীরোগের ঔষধ অশোকারিষ্ট। এর দেবীর নাম হল শোকরোহিতা।
কাঁচা বেল বহু গুণ সম্পন্ন। এর অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম শিবা। দাড়িম্ব বা ডালিম। খাদ্য হিসাবে ঔষধীয় গুণ সম্পন্ন। এতে যে দেবীর কল্পনা করা হয় তার নাম রক্তদন্তিকা। মান কচুতে যে দেবীর অধিষ্ঠান কল্পনা করা হয় তার নাম চামুণ্ডা। আর ধানে যে দেবীর অধিষ্ঠান তার নাম মহালক্ষ্মী।
নব পত্রিকা বলতে নটা দেবীর কল্পনা করা হত- এগুলো পৌরাণিক কল্পনা। এদের জন্য নটা পৃথক রাত্রি হয়েছিল দেবী পক্ষে। পিতৃপক্ষ শেষে প্রতিপদ থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত। দেবী দুর্গা প্রবেশ করার আগে ওই নয়টা ঔষধিকে স্নান করিয়ে স্থাপন করা হয়। এক বলে নবপত্রিকার প্রবেশ। যাকে বলে কলা বৌ।
লোকের ধারণা কলা বৌ বুঝি গণেশের বৌ। কলা বৌ গণেশের বৌ নয় বরং মা। দেবতাদের বা দিকে থাকে দেবী। কিন্তু গণেশের দান দিকে আছে কলা বৌ। নবপত্রিকা উৎসবকে উত্তর ভারতের লোকরা নবরাত্রি উৎসব বলে। বাঙলায় নবাব হোসেন সাহেবর সময় রামের জয়কে কেন্দ্র করে কংসনারায়ণ রায় এর প্রবর্তন করেন।
……………………………..
সূত্র:
বাংলা ও বাঙালী -শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার।
রক্ত মৃত্তিকা রাঢ় : ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে (প্রথম খন্ড) -কীর্ত্যানন্দ।
………………..
আরো পড়ুন:
অসুরবধ
দুর্গা পূজার দশ দিক
দুর্গা দুর্গতিনাশিনী
শুভ মহালয়া
বাঙালির প্রাণনাথ বেতারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
মা দুর্গার ১০৮ নাম