কর্ম্মী সাধক বিপিনচাঁদের মতুয়া-ধর্ম্ম প্রচার
দেবীচাঁদে গুরু মেনে গুরুচাঁদ কৃপাগুণে
শ্রীবিপিন দিনে দিনে শক্তিশালী হল।
গুরুপদে রেখে নিষ্ঠা প্রাণপণে করে চেষ্টা
হরিভক্ত সর্ব্ব শ্রেষ্ঠা প্রমাণ দেখাল।।
ধর্ম্ম কর্ম্মে সম্মিলণ মতুয়ার যে জীবন
পূর্ণ-ব্রহ্ম সনাতন গুরুচাঁদ করে।
অগ্রণী হইয়া তায় দেবীচাঁদে আগে ধায়
তাঁরে ধরে যেবা রয় তারে নেয় ধরে।।
শ্রীগোপাল গুণধাম বিপিন তপস্বীরাম
আর বহু ভক্ত আছে সেই গণনাতে।
স্বহস্তে মানুষ গড়ে দেবীচাঁদ দিল ছেড়ে
দেশে দেশে ফেলে তাঁরা নাম প্রচারেতে।।
প্রথম পরীক্ষা তায় বিধবার বিয়া দেয়
প্রভু গুরুচাঁদ কয় ‘‘জাতির কারণে।।
বিধবার বিয়া দিব শোন ভক্তগণ সব
এ জাতিকে তরাইব ভাবিয়াছি মনে।।
আমার এ কর্ম্ম-পথে থাকিতে আমার সাথে
ভাল যদি লাগে চিতে তাই মোরে বল।।’’
অগ্রভাগে দেবী কয় ‘‘আপনার এ ইচ্ছায়
বাধ্য আমি সর্ব্বদায় অচল অটল।।’’
গুরু যেই পথে চলে সেই পথে শিষ্যদলে
চলে সবে দলে দলে কিনা প্রতিবাদে।
গোপাল বিপিন দোঁহে কাজ করে সমারোহে
দুই ভাই কথা কহে সদা সিংহনাদে।।
দুই ভাই একত্তরে গুরুআজ্ঞা মান্য করে
বিয়া দিল ঘরে ঘরে মহা অনুরাগে।
গুরুচাঁদ শুনে তাই বলে আর কার্য্য নাই।
এ অবধি যাহা পাই আর নাহি লাগে।।’’
পরীক্ষা হইল শেষ গুরুচাঁদ হৃষীকেশ
ধরিলেন কর্ম্মীবেশ ধর্ম্ম আবরণে।
সাধনার এই পর্ব্ব দেবীচাঁদ দিল অর্ঘ্য
গুরুচাঁদ পাদপদ্মে গোপাল বিপিনে।।
তাই দুই মতিমান গুরুচাঁদে ধরা পান
হয়ে মহাশক্তিমান ধর্ম্মের প্রচারে।
জেলা হতে জেলান্তরে চলে দোঁহে হর্ষান্তরে
নাম দিয়ে ত্রাণ করে যত নারী নরে।।
বরিশাল জিলা পরে দেবীচাঁদ যথা ঘুরে।
দয়া করে বিপিনেরে নিজ সাথে লয়।
এই ভাবে সে বিপিন গুরুরূপে হয়ে লীন
পরিচিত দিনে দিন সবখানে হয়।।
বরিশালবাসী যারা বহু তর্কবাদী তারা
তাহাদের চিন্তাধারা বোঝা বড় দায়।
সহজে বিশ্বাস করা কভু নাহি করে তারা
দেহমন যেন ভরা তর্ক সমস্যায়।।
এ সব লিখন পড়ে বরিশালবাসী পরে
বহুদোষ ইথে ধরে বলিবেন কথা।
আমি বলি ‘‘শুন ভাই দোষ করে লিখি নাই
বল আমি কোথা পাই তেমন যোগ্যতা?
বরিশালবাসী সবে সহে নহে একভাবে
একভাবে এই ভবে নহে সর্ব্বজন।
ভালমন্দ সর্ব্বদায় সর্ব্বদেশে দেখা যায়
তারতম্য যাহা রয় তাহাতে লিখন।।
বিপিন গোস্বামী যিনি শক্তিশালী সাধু তিনি
সর্ব্বদেশে তাঁরে জানি মানে সর্ব্বজন।
বরিশাল বাস তাঁর কিন্তু তাঁর ব্যবহার
সুমহান সদাচার অতি সুশোভন।।
এইরূপ যত যত শির আমি করি নত
তাঁহাদের বিষয়েত এই কথা নয়।
সেই ভাব ধরে যারা তর্কবাদে চিত্ত ভরা
বলিয়া তাদের ধারা ইহা লেখা হয়।।
গোস্বামীজী নিজ মুখে বলিয়াছে যাহা মোকে
তাহা আমি যাই লিখে গ্রন্থের মাঝারে।
সেই কথা পাঠ করে যাহা ইচ্ছা বল মোরে
দোষী হই হত পরে সাধুর বিচারে।।
দেবীচাঁদ মহোদয় নাম প্রচারেতে যায়
বিপিনেরে ডাকি কয় ‘‘চল মোর সাথে।
উদয় গয়েরসকাঠি গুরুচরণের বাটি।
ঘর দ্বার পরিপাটি সর্ব্ববিধ মতে।।’’
তার পুত্র বিশ্বেশ্বর রোগ তার ভয়ঙ্কর
উন্মাদ রোগের পর তার কিবা আছে?
ওঝা বৈদ্য শত শত দেখিয়াছে অবিরত
কিন্তু রোগ দূরীভূত হয় নাই পাছে।।
ঠেকিয়া বিষম দায় মনোকষ্টে দিন যায়
নাহি দেখে সদুপায় ভাবিল অন্তরে।
সব কিছু দেখা হল অনর্থক অর্থ গেল
এখন কি করি বল কিসে রোগ সারে?
মতুয়ার ডঙ্কা ধ্বনি ধ্বনি যেন বজ্রধ্বনি
দেশবাসী সবে শুনিবলে ‘‘একি ভাই।
মতুয়া বলে না কথা হরি বলে যথা তথা
গুরুরূপ প্রাণে গাঁথা অন্য কিছু নাই।।
যে পথে মতুয়া চলে রোগ ব্যাধি যায় চলে
শান্তির হিল্লোলে খেলে আকাশে বাতাসে।
কাজ পেয়ে পরিচয় দুঃখী তাপী ছুটে যায়
শান্তি লোভে পড়ে পায় সবে অনায়াসে।।
ধরিয়া দেবীর পদে সে গুরুচরণ কাঁদে
কৃপা করে দেবীচাঁদ গেল তার বাড়ী।
শক্তিমন্ত গুণধাম অবিরাম করে নাম
উন্মাদের রোগারাম করে বলে হরি।।
বিস্মিত সে দেশবাসী দলে দলে তাই আসি
গোস্বামীর কাছে বসি করে নিবেদন।
‘‘আমরা বুঝেছি মনে নাম তুল্য কোনখানে
কিছু নয় কোন গুণে নামের মতন।।
তাই বলি হে গোঁসাই আমরা যে নাম চাই
সবে শিষ্য হতে চাই এক সঙ্গে মিশি।
সকলের নাম দাও আমাদের গুরু হও
দয়া করে কথা কও এখানেতে বসি।।’’
কথা শুনি দেবী কয় ‘‘কিবা বল মহাশয়
নাম আর কোথা রয় বিনা হরিনাম।
যদি বল মন্ত্র চাই হরি নাম বিনা ভাই
অন্য কোন মন্ত্র নাই আমি বলিলাম।।’’
সাধু যদি এই কয় ঘোর তর্ক মহাশয়
করিলেন সর্ব্বদায় উপস্থিত যারা।
সন্দেহ তাদের মনে কি যেন গোঁসাই জানে
তা না হলে কোন গুণে রোগী যায় সেরে।।
সন্দেহতে নাড়ে মাথা বলে ‘‘দেও আসল কথা
আর কেন চতুরতা করহে গোঁসাই।
ঠিক মন্ত্র দিলে পরে বরিশাল জেলা ভরে
শিষ্য হবে ঘরে ঘরে তাকে ভুল নাই।।’’
গোস্বামী যতেক কয় সন্দ তাতে দৃঢ় হয়
ডাক দিয়া সে সভায় কহে একজনে।
‘‘শোন সব অর্ব্বাচীন বয়সেতে মুঁই প্রাচীন
কয়টা বা বল দিন, রব এইখানে।।
যাহা বলি তাই কর জোরে গোস্বামীরে ধর
তাহা বলে পেতে পার কিছু বস্তু ধনে।
যদি নাহি শোনে কথা কর সবে এক পন্থা
গোস্বামীরে আর জ্যান্তা রেখে কাজ নাই।
নদী মধ্যে নিয়ে যাও সঙ্গে নিও ‘রামদা’ ও’
‘কলি জাটা’ কেটে লও মিলিয়া সবাই।।’’
এই ভাবে কয় যারা বিনা তর্কে কভু তারা
বিশ্বাসের ভাবধারা নিতে নাহি পারে।
বরিশালে এরা যারা তাহাদের ভাব ধারা
বৃথা তর্কে চিত্ত-ভারা সন্দেহেতে মরে।।
অবশ্য সকল দেশে তর্কবাদী আছে বসে
গণনায় দেখি আসে বরিশাল বেশি।
গণতন্ত্র যুগে ভাই ভোট ছাড়া কথা নাই
ভোটে জয়ী যারা ভাই তারা হও সুখী।।
বীর সাধু দেবী চান হল যবে অন্তর্দ্ধান
শ্রীবিপিন মতিমান বরিশাল পরে।
গ্রামে গ্রামে চলে সাধু বিতরিয়া নাম মধু
রূপে যেন স্নিগ্ধ বিধু দেশ আলো করে।।
জুগিয়া গ্রামেতে ঘর মন্ডল উপাধি তার
ভাব নিল মতুয়ার নামেতে অক্রুর।
বাজে কাঁশি বাজে খোল সবে বলে হরিবোল
মৃদঙ্গ মাদল ঢোল দিল সাথে সুর।।
যত দুরে চলে সুর দুর হতে আর দুর
বাজে ধ্বনি কি মধুর প্রাণ কাড়ি লয়।
একে ত নামের গুণ গোস্বামীর ভক্তি তূণ
শর তাতে প্রেমাগুণ বিরহ ব্যাথায়।।
যোদ্ধাবেশে ধর্ম্ম বীর সদা চলে উচ্চ শির
যেথা যেথা দিল ভীর সর্ব্বত্রেতে জয়।
কিবা শক্তি দেবী চান করেছিল তাঁরে দান
দেখা মাত্র বলে যান রোগ সমুদয়।।
মুগ্ধ সব নর নারী কান্দে সবে পদে ধরি
এই ভাবে ঘুরি ঘুরি করিল প্রচার।
সাগর তরঙ্গ যেথা তীরেতে লোটায় মাথা
মতুয়া ধর্ম্মের কথা নিল তার ধার।।
যেথা যায় সেথা কয় ‘‘শুন সবে পরিচয়
হরিচাঁদ দয়াময় পূর্ণ অবতার।
দয়া করে নমঃ কুলে অবতীর্ণ কলিকালে
নিজে প্রভু গেছে বলে ভয় নাই আর।।
মন্ত্র তন্ত্র দীক্ষা নাই পবিত্রতা রক্ষা চাই
গৃহ ধর্ম্মে সব পাই মানব জীবনে।
পবিত্রতা সত্য বাক্য যেন যেবা করে ঐক্য
হরি আচে তার পক্ষ সদা সর্ব্বক্ষণে।।
নরাকারে এবে নাই তবে তাঁরে কোথা পাই
বলিতেছি শোন তাই নিগূঢ় কাহিনী।।
গুরুচাঁদ পুত্র তাঁর নররূপে মহেশ্বর
শক্তি রাখি তাঁর পর গেছে গুণমণি।।
যাহা ছিল হরিচাঁদে ততোধিক গুরুচাঁদে
দেখিয়াছি পদে পদে তাতে বলি ভাই।
এস ছুটে জনে জনে গতি নাই তিনি বিনে
দিন গেল দিনে দিনে আর বেলা নাই।।’’
গোস্বামীর ভীর শুনি দুঃখী তাপী কত প্রাণী
গোস্বামীর গুরু মনি’’ পেল মহা শান্তি।
শিষ্য শাখা সঙ্গে করে সদা প্রেমানন্দে ভরে
আসে ওড়াকান্দী পরে নাহি হয় ভ্রান্তি।।
গোস্বামীর কীর্ত্তি যত ঘটিতেছে অবিরত
বলিতে মনের মত সাধ্য নাহি এবে।
ভবিষ্যতে গুণী যাঁরা সকলি লিখিবে তাঁরা,
তাতে কত সুধাধারা বিশ্ববাসী পাবে।।
আমি দরে মূল সূত্র যাই এই মাত্র
গুরুচাঁদ মধ্যে তত্ত্ব কেবা কিবা পেল?
শ্রীগুরু চরিত গাঁথা পূর্ণ রবে তাঁর কথা
মূল রেখে ডাল পাতা কুড়ান কি ভাল?