ভবঘুরেকথা
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু চৈতন্য নিমাই বৈষ্ণব

স্থূলদেশের অর্থ দুই প্রকার। তাহার মধ্যে এক প্রকার মাতৃ-গর্ভের ‘অন্য প্রকার বহির্জগতের ভাব প্রকাশ। স্থূল তটস্থের দেশ মায়াময় জম্বুদ্বীপ।

স্থূল কাহাকে বলে?
স্থূল অর্থ পিণ্ডাকার। বিন্দুরূপী শত্রু-শোণিত একযোগ হইলে পিণ্ডাকার হইয়া ক্রমে বৃদ্ধি পায, তাহার নাম স্থূল।

তটস্থ কাহাকে বলে?
তটস্থ অর্থ উৎপত্তি। যাহাতে দশ ইন্দ্রিয়ের উদ্ভব, তাহার নাম তটস্থ। পিতৃমাতৃ অর্জিত মায়াশক্তির সৃষ্টিকে স্থূল তটস্থ বলি এবং জীবের বাসস্থানকে দেশ বলি। মাতাার নাভির নিম্নভাগে অষ্টদল পদ্মেতে জীবের বাসস্থান।

মায়াপাশ কাহাকে বলে?
পিতা পুত্রের পাশে বদ্ধ থাকিয়া নিত্য-অনিত্য জ্ঞানশূন্য হইয়া আমি ও আমার মায়াকৃত ‘অহং’ বাচ্য শব্দই মায়ময়।

জম্বুদ্বীপ কাহাকে বলে?
উৎপত্তি, প্রলয়, জন্ম, মরণ যাহাতে আছে, তাহার নাম জম্বুদ্বীপ।

কাল- অনিত্য কাল কাহাকে বলে?
যে সময় মাতাপিতার সঙ্গম হইয়া মাতার অষ্টদল পদ্মমধ্যে মায়াকৃতভাবে স্থিতি হয়েন, সেই সময়কে অনিত্য কাল বলে।

পাত্র- সৃষ্টিকর্ত্তা ব্রহ্মা কাহাকে বলে?
যাহার দ্বারা কার্য্য সম্পাদন হয় বা যিনি সৃজন করেন ও সৃজন করান এবং যদ্বারা দেহ উৎপন্ন হয় অর্থাৎ পিতামাতার সঙ্গমে যে শুক্রশোণিত সংযোগে জগৎ সৃজন করেন, তাহাই পাত্র সৃষ্টিকর্তা বলিয়া কথিত হন।

আশ্রয়- পিতামাতার চরণ কাহাকে বলে?
পিতামাতার চরণ অনগত হওয়াকেই আশ্রয় বলে।

আলম্বন-বেদাদী কার্য্য কাহাকে বলে?
যে কার্য্য দ্বারা স্থূলের কার্য্য সম্পাদন হয়, তাহাকে আলম্বন বলে।

উদ্দীপন- পুরাণাদি শ্রবণ কাহাকে বলে?
যে শাস্ত্র শ্রবণে মায়াকৃত জীবাত্মা মায়া কার্য্যাদি হইতে মুক্ত হইয়া পাপ পূণ্য জন্ম-মরণ বিনাশে নিত্যেতে জীবন মুক্ত হওত: পূনর্ব্বার সদজ্ঞান লাভ করেন, সেই শাস্ত্রকে সূক্ষ্ম তটস্থের দেশ বা প্রবর্ত্তের দেশ বলে।

সূক্ষ্ম তটস্থ কাহাকে বলে?
সূক্ষ্ম অর্থ- চৈতন্য ব্রহ্ম। তটস্থ অর্থ উৎপত্তি।
ব্রহ্ম-স্বরূপে অপ্রাকৃত অপঞ্চীকৃত পঞ্চভূতের চিৎশক্তির অর্থাৎ জ্ঞানের দ্বারা শ্রীচৈতন্য গুরু অর্জত অযোনিসম্ভবা উৎপত্তি তত্ত্বোদ্ভব দেহকে সূক্ষ্ম তটস্থ বলে।

নিত্য নবদ্বীপ কাহাকে বলে?
নিত্য অর্থ যাহার উৎপত্তি বা জন্ম মরণ নাই এবং যাহাতে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করা যায়, তাহার নাম নিত্য।
নবদ্বীপ অর্থ নতুন দ্বীপ, চিৎশক্তি দ্বারা সৃজিত হৃদয়স্থানকে নবদ্বীপ বলা যায়, অর্থাৎ চৈতন্য গুরুরূপে যে স্থানে উদয় হয় বা যাহাতে শ্রীচৈতন্যের বাসস্থান, সেই স্থানের নাম নবদ্বীপ।

কাল- নিত্য কলি কাহাকে বলে?
কালের শেষ, প্রবর্ত্তের প্রথম এই সন্ধির সময় মন্ত্রার্থ দ্বারা গুরু চৈতন্যরূপে দেখা দিয়া অজ্ঞানী জীবকে চৈতন্য করাইয়া আত্ম নিত্য কার্যাদি সম্পন্ন করান তাহাই কাল নিত্য কলি।

পাত্র-শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু কাহাকে বলে?
শ্রী অর্থ- সুন্দর, কৃষ্ণ অর্থ- কর্ষণ করিয়া আকর্ষণ করা, চৈতন্য অর্থ- চেতন করা, মহাপ্রভু অর্থ- মহাভাব দেখানো। অর্থাৎ যিনি নিত্য কার্যাদি করাইবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ হওত: জগতের মন সুন্দররূপে আকর্ষণ করিয়া অসার সংসার বিনাশ করেন ও চৈতন্যরূপে অজ্ঞানী জীবকে চেতন করাইয়া ‘আমি আমার’ অহং বাচ্য মায়াকৃত শব্দ বিনাশ করত: দেহ নিত্য ও আত্মা চৈতন্য জ্ঞান জন্মাইয়া জগন্ময় চৈতন্য দেখাইয়াছেন, তাঁহাকে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু বলে।

আশ্রয়- শ্রীগুরু চরণ কাহাকে বলে?
যিনি অজ্ঞানী জীবকে, মাতৃগর্ভের সপ্তম মাসে সেই পারমার্থিক তত্ব জানাইয়া জীবন মুক্ত করেন, নাম ও মন্ত্র দ্বারা নববিধ ভক্তি জানাইয়া চেতন করাইয়াছেন, তাহাই শ্রীচৈতন্য গুরুর চরণ আশ্রয়।

আলম্বন- হরিনাম সংকীর্ত্তন কাহাকে বলে?
হরি অর্থ- যিনি মন হরণ করেন, সংকীর্ত্তন অর্থ- রাধাকৃষ্ণের লীলা গুণাদি কীর্তন ও নৃত্য করা।

উদ্দীপন- বৈষ্ণব গোঁসাই কাহাকে বলে?
দেখিয়া শুনিয়া মনের যে ভাবের উদয়ের দ্বারা পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ গোচর জ্ঞান হয় বা দর্শন করা যায় ও রাধাকৃষ্ণ তত্ত্ব, পঞ্চতত্ত্বাদি এবং সাধকদেশের বৃন্দাবন লীলাদি জানা যায়, তাহাকে উদ্দীপন বৈষ্ণব গোঁসাই বলে।

সাধকের দেশ- নিত্য বৃন্দাবন কাহাকে বলে?
যে দেশ চুরাশী ক্রোশ ব্যাপিত ও দৈর্ঘ্য প্রস্থ সমান, তাহাকে নিত্য বৃন্দাবন বলে।

চুরাশী ক্রোশ কাহাকে বলে?
চুরাশী অঙ্গুলী অর্থাৎ সাড়ে তিন হাত দেহকে চুরাশী ক্রোশ বলে।

কাল- দ্বাপর কাহাকে বলে?
দ্বাপর অর্থ দ্বিতীয় তত্ত্ব। যে সময় শ্রীকৃষ্ণ বৈষ্ণব গুরুরূপে দেখা দিয়া কামবীজ গায়ত্রী উপাসনা তত্ত্ব দ্বারা সর্বচিত্ত আকর্ষণ করিয়া ও সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র ভেদতত্ত্ব জানাইয়া প্রকৃত দেহকে অপ্রাকৃত করত: উজ্জ্বল রস সাধন করার সময়কে কাল দ্বাপর বলে।

পাত্র- শ্রীনন্দের নন্দন কাহাকে বলে?
ত্রিভুজ মুরলীধর শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীনন্দের নন্দন বলে। অর্থাৎ যিনি বৈষ্ণব গুরু রূপে পারমার্থিক তত্ত্ব জানাইয়া সাক্ষাৎ ভজন শিক্ষা দেখাইয়া অর্ন্তযামীরূপে দেখা দিয়া বৃন্দাবন যে কৃষ্ণ, রাধা ও গোপী সঙ্গে লইয়া অনাদি অনন্তকাল পর্যন্ত যে লীলা কার্য্য করিয়াছেন, তাহা জানানোকেই পাত্র শ্রীনন্দের নন্দন বলে।

আশ্রয়- সখির ভাব কাহাকে বলে?
সখির অনুগত থাকিয়া তাহাদের আজ্ঞাবর্ত্তী হইয়া তদনুরূপে আদেশ পালন করাকেই আশ্রয় সখির ভাব বলে।

আলম্বন- ভাবনাময়ী কাহাকে বলে?
সখির আজ্ঞা আকাঙ্খায় থাকিয়া তাহাদের আদেশানুযায়ী কার্য্য করাকেই আলম্বন ভাবনাময়ী বলে।

উদ্দীপন- পূর্বরাগ কাহাকে বলে?
প্রথম অনুরাগকে পূর্বরাগ বলে অর্থাৎ দর্শন ও শ্রবণাদির দ্বারা মনের যে অনুরাগ উদয় হইয়া দর্শন শ্রবণাদির আকাঙ্খা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়াকেই উদ্দীপন পূর্ব্বরাগ বলে।

সিদ্ধির দেশ- বৃহৎ বৃন্দাবন কাহাকে বলে?
চুরাশী ক্রোশ ব্যাপিত দেহ বৃন্দাবন সূক্ষ্ম চারি ক্রোশ অন্তর্গত দ্বি ক্রোশ নিত্যক্রিয়া কৈশোর ভজন স্থানকে সিদ্ধির দেশ বৃহৎ বৃন্দাবন বলে।
যে যে সময় রসপ্রেম শৃঙ্গারকাল উপস্থিত হয়, সেই কালকে অর্থাৎ নায়ক-নায়িকা চিত্তাকর্ষণে আঠার দণ্ড স্তম্ভন কৈশোর ভজন সময়কে আঠার দণ্ড নিশা বলে।

পাত্র- শ্রীরাধিকাজী কাহাকে বলে?
যিনি রসময়ী মূর্ত্তি ধারণ করিয়া রসরাজকে আকর্ষণ করে, রসাস্বাদন করায়, তাহাকে পাত্র শ্রীরাধিকাজী বলে।

আশ্রয়- শ্রীরূপমঞ্জরী কাহাকে বলে?
যিনি অপ্রাকৃত দেহ দ্বারা নিজ্য কার্য্য করত: নিত্যবস্তু সাধন করিয়া নিত্যেশ্বরী প্রাপ্ত হয়েন, তাহাকে আশ্রয় শ্রীরূপমঞ্জরী বলে।

আলম্বন- প্রেমসেবা কাহাকে বলে?
শ্রীরূপমঞ্জরীর অনুগত হইয়া অর্থাৎ মঞ্জরীরূপাবর্ত্ত গুরুর নিকট গমন করত: আশ্রয় গুরু অষ্টশক্তিকে প্রাপ্ত হইলে তাহাকে আলম্বন প্রেমসেবা বলে।

উদ্দীপন- বংশীধ্বনি কাহাকে বলে?
শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনি উদ্দেশ্যে শ্রবণেন্দ্রিয় নিয়োজিত রাখিয়া ষোড়শোপচারে পূজা করিবার জন্য পুষ্টাদি সংগ্রহ করাকে উদ্দীপন বংশীধ্বনি বলে অর্থাৎ বংশীধ্বনি শ্রবণমাত্র কৃষ্ণরূপ হৃদয়ে উদয় হওয়ায়, মন ব্যাকুলিত হইয়া কৃষ্ণসঙ্গমে যাওয়ার ইচ্ছাকে উদ্দীপন বংশীধ্বনি বলে।

……………………………………..
তত্ত্বরসামৃত জ্ঞানমঞ্জরী
-শ্রীশ্রী চরণ দাস

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!