ভবঘুরেকথা

অশ্বিনীর পরীক্ষা
দেশে গিয়ে সে গোপাল ভাবে মনে মন।
অশ্বিনীর সেই কথা জাগে সর্বক্ষণ।।
পরীক্ষা করিতে যাব গঙ্গাচন্না গায়।
কেমন ত্যাগের ধর্ম বুঝাব তোমায়।।
দশজন হরিভক্ত সঙ্গেতে করিয়া।
যাত্রা করে সবে মিলে শ্রীহরি স্মরিয়া।।
পথে যেতে হরি কথা বলিতে বলিতে।
ভাবে গদ গদ চিত্ত চলেছেন পথে।।
এইভাবে পথে যেতে ভাবিতে লাগিল।
সন্ধ্যাবেলা গঙ্গাচন্না উপনীত হল।।
হরি হরি বলে সবে উঠিল বাড়ীতে।
দেখিয়া অশ্বিনী এসে লাগিল কাঁদিতে।।
হরিভক্ত চরণেতে কেঁদে কেঁদে কয়।
তোমাদের বাড়ী ঘর মোর কিছু নয়।।
জল পাত্র এনে শেষে পা ধোয়াতে যায়।
সকলে পড়িল এসে অশ্বিনীর পায়।।
সে গোপালে ধরে তোলে অশ্বিনী সুজন।
গোপালকে বুকে ধরে করে অলিঙ্গন।
এইভাবে প্রেমাবেশে ধরাধরি করে।
হস্তপদ ধুয়ে সবে বসিলেন ঘরে।।
খেজুরের পাতা দিয়া বিছানা করেছে।
তাহা বিছাইয়া শেষে বসিতে দিয়াছে।।
ঘরেতে তন্ডুল নাস্তি অশ্বিনী জানিয়া।
গ্রামেতে চলিল তিনি ধামা হাতে নিয়া।।
এদিকেতে ঘরে বসে বলে একজন।
গোপাল সাধুকে ডেকে কহিল তখন।।
উপরেতে চেয়ে দেখ তারা দেখা যায়।
ঘরেতে ছাউনি নাই জানাই তোমায়।।
ঝড় বৃষ্টি আসে যদি কি হবে উপায়।
অন্য বাড়ী যাই মোরা থাকিতে সময়।।
তাই শুনি সে গোপাল করিতেছে মানা।
ও কথা বলনা ভাই বৃষ্টিত হবেনা।।
অন্য কথা দিয়া আর কার্য্য কিছু নাই।
এস মোরা সবে মিলে হরি গুণ গাই।।
গোপালের কথা শুনে নামেতে মাতিল।
হরি গুনগানে তারা প্রমত্ত হইল।।
ওদিকেতে সে অশ্বিনী ঘুরিয়া বেড়ায়।
যে বাড়ীতে যায় তারা ভিক্ষা নাহি দেয়।।
গ্রাম ভরি সব বাড়ী ঘুরিতে লাগিল।
এক মুঠি ভিক্ষা তাকে কেহ নাহি দিল।।
নিরূপায় হয়ে রত্ন কাঁদিতে লাগিল।
গুরুচাঁদ ছবিখানি হৃদয় জাগিল।।
কেদে বলে ওগো প্রভু চরণে জানাই।
যাহা চাহিয়াছি আমি দিলে আজি তাই।।
যেমন মানুষ আমি তেমন পেয়েছি।
হরিভক্ত সেবা বাদ তাহা কি চেয়েছি।।
তব ভক্ত ঘরে বসে হরিনাম করে।
কেমনে হইবে সেবা কহ আজ মোরে।।
হরি ভক্তগণ যদি থাকে অনাহারে।
নামের কলঙ্গ হবে এভব সংসারে।।
আমার জীবনে যত দুঃখ কষ্ট হয়।
তাতে আমি ভাবিনাক ওগো দয়াময়।।
এত ভাবি সে অশ্বিনী কেদে ছাড়ে হাই।
তুমি যাতে সুখে থাক এই ভিক্ষা চাই।।
কিছু দুরে ছিল এক কমদের গাছ।
সেই গাছ বুকে ধরে কাদিতেছে আজ।।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।।
ঘোর অন্ধকার রাত্রি ধাদিল নয়ন।
চারিদিকে হইতেছে মেঘের গর্জন।।
মেঘের গর্জন শুনে গোপাল ভেবেছে।
মনে মনে গুরুচাদে চরণে বলেছে।।
শুন শুন গুরুচাঁদ জানাই তোমায়।
ঝড় বৃষ্টি হলে পরে দাড়াব কোথায়।।
কাঙ্গালের বন্ধু তুমি করুনা নিদান।
তব ভক্ত রক্ষা কর করে কৃপা দান।।
গোপালের চক্ষু জলে বক্ষ ভেসে যায়।
ওড়াকান্দি গুরুচাঁদ জানিবারে পায়।।
ভক্তের বিপদ জেনে শ্রীহরি নন্দন।
শ্রীনাথ পাগলে ডেকে কহিল তখন।।
ছাতা এনে দাও তুমি অতি শ্রীঘ্র করি।
ভক্তের বিপদ আমি সহিতে না পারি।।
তখনি শ্রীনাথ ছাতা আনিয়া যোগায়।
গদি ঘরে বসে প্রভু ছাতা মাথে দেয়।।
চারিদিকে ঝড় বৃষ্টি হল অতিশয়।
অশ্বিনীর বাড়ী মেধ্য কিছু নাহি হয়।।
দুই রাশি আড়ে দিঘি হবে অনুমান।
ঝড় বৃষ্টি না হইল রহেছে প্রমাণ।
এ হেন আশ্চর্য্য লীলা কভু দেখি নাই।।
এই যুগে দেখে শুনে মানিলাম তাই।।
অশ্বিনীর কান্না শুনে গুরুচাঁদ কয়।
ওগো বাবা হরিচাঁদ চলিয়ে তোমায়।।
সেই যাহা চেয়েছিল আমি দিনু তাই।
এবে আমি কি করিব চরণে জানাই।।
তব ভক্তগণ সব অনাহারে আছে।
অশ্বিনীর ঘরে বসে হরিনাম নিছে।।
ওগো বাবা হরিচাঁদ কি হবে উপায়।
তোমার নামের বুঝি কলঙ্ক রটায়।।
কৃপা করে কৃপাসিন্ধু দয়াময় হরি।
তোমার ভক্তের ব্যাথা সহিতে না পারি।।
এত ভাবি গুরুচাঁদ ছাড়ে আখিজল।
অন্তরে জানিল তাহা পরম দয়াল।।
ভক্তের লাগিয়া আজি দয়াময় হরি।
শূণ্যেতে ভাসিল এক ব্যাঘ্র পৃষ্ঠে চরি।।
রঘুনাথপুর গ্রাম দিকজয় নাম।
চাউলের কেনা বেচা করে গুণধাম।।
চিতলমারী হাটেতে করেছে গমন।
গঙ্গাচন্না খালমুখে আসিল যখন।।
মধুমতি হতে খাল গঙ্গাচন্না এল।
গোড়া খালে সেই নৌকা চরায় ঠেকিল।।
জলে নেমে ভাগিগন ঠেলাঠেলি করে।
তবু সেই নৌকাখানি কিছুতে না নড়ে।।
কুলে নেমে দিকজয় করে হায় হায়।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।।
ঘোর অন্ধকারে রাত্রি চারিদিকে চায়।
কিছু দুরে আলোময় দেখিবারে পায়।।
দ্রুতগতি গিয়ে দেখে আশ্চর্য্য কাহিনী।
ব্যাঘ্র পৃষ্ঠে বসা আছে হরি গুনমণী।।
হরিচাঁদ বলে ‍শুন ওরে দিকজয়।
নৌকা নিয়ে চলে যাও গঙ্গাচন্না গায়।।
অশ্বিনী নামেতে মোর ভক্ত একজন।
বিপদে পড়িয়া সে যে করেছে রোদন।।
মোর ভক্ত অনাহারে আছে তার ঘর।
শুন শুন দিকজয় বলি যে তোমারে।।
চাউল তাহারে দিয়ে এস শীঘ্রগতি।
তারপর হেটে যেও ওহে মহামতি।।
এই বাক্য বলে হরি অদৃশ্য হইল।
দিশেহারা দিকজয় মাটিতে পড়িল।।
আখি জলে ভেসে ভেসে দিকজয় বলে।
অভাগারে দেখাদিয়ে কেন লুকাইলে।।
আমি বড় অপরাধী এই দুনিয়ায়।
নিজ গুনে দেখা দিলে ওগো দয়াময়।।
কাদিতে কাদিতে গেল নৌকার নিকটে।
ভাগিদের কাছে গিয়ে কহে করপুটে।।
জল হতে নৌকা পরে সকলেতে যাও।
হরিচাঁদ নাম নিযে তরী খুলে দাও।।
গঙ্গাচন্না খাল বেয়ে যেতে হতে ভাই।
তাহা নাহি হলে পরে আর রক্ষা নাই।।
তাই শুনে সবে মিলে নৌকায় উঠিল।
হরিচাঁদ নাম নিয়ে তরুনী বাহিল।।
দ্রুতবেগে চলে তরী সেই খাল বেয়ে।
অশ্বিনীর ঘাটে গিয়ে পড়িল ঠেকিয়ে।।
তাই দেখে দিকজয় ডেকে কয় কথা।
অশ্বিনী নামেতে কেউ আছে নাকি হেথা।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী কাঁদিয়া উঠিল।
হরি বলে হাই ছেড়ে কহিতে লাগিল।।
ওগো বাবা গুরুচাঁদ কি খেলা তোমার।
তব লীলা বুঝিবারে কি সাধ্য আমার।।
কয়জন অনাহারে আছে মম ঘরে।
এখন আসিলে কেবা দুঃখ সহিবারে।।
তাই ভেবে সে অশ্বিনী ছাড়িতেছে হাই।
দিকজয় বলে কেবা কাঁদিতেছ ভাই।।
অশ্বিনী বলে আমি বড় অভাজন।
অশ্বিনী আমার নাম তুমি কোন জন।।
তাই শুনি দিকজয় চরণে পড়িল।
কেদে কেদে দিকজয় কহিতে লাগিল।।
হরিচাঁদ প্রিয় ভক্ত মহাজন।
আমাকে পাঠালে হরি তোমার কারণ।।
হরিভক্ত অনাহারে তব ঘরে আছে।
দেখা দিয়ে হরি আজি আমাকে বলেছে।।
চাউলের নৌকা নিয়ে এসেছিরে ভাই।
যে চাউল দরকার আমি দিব তাই।।
এক কথা বলে সে যে কাদিতে লাগিল।
কান্না শুনে আলো জ্বেলে সকলে আসিল।।
আদি অন্ত সব কথা সকলে শুনিয়া।
গড়াগড়ি যায় সবে মাটিতে পড়িয়া।।
কেহ কেহ কেদে কেদে হল অচেতন।
লেখা দিয়া কি বুঝাব আমি অভাজন।।
বহুক্ষণ পরে শেষে সে কান্না থামিল।
দিকজয় নৌকা হতে চাউল আনিল।।
সে চাউল দিয়ে শেষে রন্ধন হইল।
প্রেমভরে ভক্তগন ভোজন করিল।।
সারানিশি কেদ কেদে করিল কির্ত্তণ।
ভাষা দিয়া কি বুঝাব আমি অভাজন।।
অনেক হইল বেলা বাহ্যজ্ঞান নাই।
হরি বলে কেদে কেদে ছাড়িতেছে হাই।।
এইভাবে ভাবাবেষে মধ্যাহ্ন হইল।
গ্রামবাসী সবে এসে রন্ধন করিল।।
তারপর সকলেতে ভোজন করিয়া।
যার যার দেশে সবে গেল চলিয়া।।
বেলা গেল দিকজয় নৌকায় উঠিণ।
হরি বলে নৌকা বেয়ে হাটে চলে গেল।।
চর্তুগুণ লভ্য হলো সেই হাটে গিয়ে।
হির বলে দিকজল বেড়ায় নাচিয়ে।।
এ হেন আশ্চর্য্য লীলা কে দেখেছে বল।
সেই হতে দিকজয় মতুয়া হইল।।
এ দীন বিনোদ বলে পাচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবিখানা হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাইসব বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!