বিশ্বাসে মিলায়ে হরি তর্কে বহুদূর
দেহ ছাড়ি গুরুচাঁদ মুদিলা নয়ন।
গৃহ হ’তে দূরে ছিল প্রমথরঞ্জন।।
আইন সভার কার্যে ব্যস্ত কলিকাতা।
“টেলিগ্রাম” যোগে তারে জানায় বারতা।।
অতঃপর গৃহে গেল প্রমথরঞ্জন।
কোনরূপ নহে তার বিষাদিত মন।।
সবে কয় “প্রভু দেহ গিয়াছে ছাড়িয়া।”
শুনিয়া প্রমথ তাহে উঠিল হাসিয়া।।
ডেকে কয় “সত্য নয় এ সব কাহিনী।
আমার ঠাকুর্দা কেবা তাহা আমি জানি।।
তার বাক্য মিথ্যা হ’তে কভু দেখি নাই।
সে যে চলে গেছে তাহা বিশ্বাসে না পাই।।
বারে বারে আমাকে যে বলে গেছে কথা।
তোরে না বলিয়া আমি যাব না’ক কোথা।।
তার বাক্য মিথ্যা হ’বে করি না বিশ্বাস।
নিশ্চয় ঠাকুর্দা আছে আমাদের পাশ।।
যার ইচ্ছা সেই শ্রাদ্ধ পার করিবারে।
শ্রাদ্ধের প্রস্তাব নাহি কর মোর ধারে।।”
শ্রাদ্ধ করা অর্থ তারে দিলাম বিদায়।
তাহারে বিদায় দিতে প্রাণে নাহি কয়।।
আইন সভার কার্য বহু আছে মোর।
কলিকাতা যাব চলে রাত্রি হ’লে ভোর।।
নীরবে শুনিল নব যত কিছু কথা।
করিতে লাগিল চিন্তা হেঁট করে মাথা।।
মনে মনে চিন্তা করে সে নব কুমার।
প্রমথরঞ্জনে ক’বে সব সমাচার।।
একাকী তাহারে প্রভু বলেছে যে কথা।
প্রমথরঞ্জনে ক’বে সে সব বারতা।।
অভিমন্যু বিশ্বাসের দোকানের কাছে।
সব কথা মনে করি নব বসিয়াছে।।
অধর বিশ্বাস আর প্রমথরঞ্জন।
হেনকালে সেই পথে করিছে গমন।।
এক দৃষ্টে রহে চেয়ে সে নব কুমার।
অন্তরের ভাষা ফেটে নয়নে তাহার।।
চাহিয়া তাহার পানে প্রমথরঞ্জন।
অন্তরের ভাব সব করিল গ্রহণ।।
গদীঘরে গিয়া পরে সংবাদ পাঠায়।
ইচ্ছা করে নব তাহা ফিরাইয়া দেয়।।
মনে ভাবে আমি বুঝি করেছি অন্যায়।
গোস্বামী বিপিন চাঁদে তাই ডেকে কয়।।
“ঠাকুরের দূত আমি দিয়াছি ফিরায়ে।
দয়া করে ঠাকুরকে আনুন ডাকিয়ে।।
সকলের অগোচরে সব কব তারে।
পেয়ে আজ্ঞা তবু তাই যাই নাই ধারে”।।
গোস্বামী বিপিন চন্দ্রে সকল খুলিয়া।
সে নব কুমার কহে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
বিপিন গোস্বামী তাই শুনিয়া সকল।
ঠাকুরের কাছে যায় আঁখি ছল ছল।।
বহুক্ষণ আলাপন করিয়া যখন।
অন্দরে করিছে যাত্রা প্রমথরঞ্জন।।
হেনকালে গোস্বামীজী করজোড়ে কয়।
“আমার সঙ্গেতে বাবা আসুন সেথায়।।
নিবেদন আমাদের কিছু বটে আছে।
তার জন্য আসিয়াছি আপনার কাছে”।।
শোনামাত্র চলে দ্রুত প্রমথরঞ্জন।
রাস মণ্ডপেতে আসি দিল দরশন।।
সর্ব দ্বার রুদ্ধ করি গিয়ে দোতালায়।
তিন জনে এক সঙ্গে বসে কথা কয়।।
যে সব বলিয়া গেছে প্রভু গুরুচান।
সে নব কুমার সব তাহারে জানান।।
সকল জানানো হ’লে তারা দুই জন।
লুটায়ে পড়িল ধরে তাহার চরণ।।
বলে “বাবা মতুয়ারে রক্ষা কর তুমি।
তোমার মধ্যেতে আছে নিজ অন্তর্যামী।।
নিজ মুখে সেই কথা বলেছে মোদেরে।
দয়া করে আমাদিগে’ রেখ কোলে করে।।”
সকল শুনিয়া বলে প্রমথরঞ্জন।
“তোমরা বলিলে সব কেমন বচন।।
স্বয়ং শক্তিধারী ছিল মোর পিতামহ।
যক্ষ রক্ষ দেব যারে পুঁজে অহরহ।।
তার সেই শক্তি বল কিসে আমি ধরি?
মূষিক ধরিতে পারে যাহা ধরে করী?
হলাহল বিষপান সাজে ভোলানাথে।
সে সব সাজিলে বল কেমনে আমাতে?
বিশ্বাসের বলে বটে মিলে হরিধন।
সিংহ দুগ্ধ মেটে পাত্রে রহে না কখন।।
এ সব আমারে কেন কর নিবেদন।
এ সবের যোগ্য আমি নহি কদাচন।।
তবে এক কথা আমি বলিবারে পারি।
নিতান্ত আমারে যদি রাখ সবে ধরি।।
তোমরা যতেক আছ ঠাকুরের গণ।
যারা কেহ ওড়াকান্দি কর আগমন।।
ঠাকুরের এই বাড়ী তোমাদের বাড়ী।
আমাকে রাখিতে পার’ করিয়া প্রহরী।।
যা’তে এই ঘর বাড়ী পরিষ্কার রয়।
সেই চেষ্টা পারি আমি করিতে সদায়।।
ইহার অধিক আমি করিতে না পারি।
রাখিলে রাখিতে পার সাজায়ে প্রহরী।।
তার মধ্যে আর মোর আছে বহু কথা।
সকল মতুয়াগণে ডেকে আন হেথা।।
সকলের মনোভাব আগে জানা চাই।
সকলে না বলে যদি তা’তে আমি নাই।।
ঠাকুরালী পদ নিতে মনে করি ভয়।
ঠাকুর বল কি মেলে মুখের কথায়?”
এইভাবে কথা বলে প্রমথরঞ্জন।
মনে মনে খুশী তাতে সাধু দুই জন।।
আদি কালে গুরুচাঁদ যেমন কহিল।
প্রমথরঞ্জনে তাহা প্রত্যক্ষ হইল।।
প্রমথরঞ্জন পরে গেল কলিকাতা।
সকলের কাছে নব বলে সব কথা।।
আসিল গোপাল সাধু লক্ষ্মীখালী হ’তে।
যাদব নকুল দোঁহে এল এক সাথে।।
গোপাল বিপিন আর যাদব নকুল।
একসঙ্গে চারিজনে করিলেন স্থুল।।
“কুলে যদি নিতে হয় মতুয়ার তরী।
প্রমথরঞ্জনে তবে কর গো কাণ্ডারি।।”
এই তত্ত্ব স্থির হ’ল খুলনা শহরে।
প্রমথরঞ্জনে সবে রহিলেন ধরে।।
শ্রীগুরু চরিত গাঁথা নাশে ভব ভয়।
পদে পদে জেনে বার্তা মহানন্দ কয়।।