হরিভক্তে বাসে ভাল সর্ব্ব দেবতায়
ধন্য শ্রীতারকচন্দ্র সাধু শিরোমণি।
যাঁর শিরে হরিচাঁদ প্রেম-রস-খানি।।
অপূর্ব্ব তাঁহার কীর্ত্তি শুন সর্ব্ব জন।
কালীমাতা করে কৃপা স্নেহের কারণ।।
লহ্মীপাশা কালীকাতা সবে জানে কথা।
বহু পুরাতন তাহে ‘জাগ্রত দেবতা।।”
নবগঙ্গা নদীতীরে প্রকান্ড মন্দির।
বরাভভ মুর্ত্তি সেখা দাঁড়াইয়া স্থির।।
মন্দিরের গাত্রে লেখা যাহা পরিচয়।
জনশুতি তাহা ভিন্ন অন্য কথা কয়।।
পরিচয়-পত্রে শব্দ খেলা “অনুমান।।”
সেই জন্য জনশ্রুতি মানিব প্রধান।
রামদাস সাধু যিনি মৈথিলিী ব্রাহ্মণ।
শ্রীহরির পূর্ব্ব পুরুষ সেই মহাজন।।
লহ্মীপাশা বাস করে সেই মহাশয়।
তাঁহার সমাধি পরে এ মন্দির হয়।।
“হরিলীলামৃত” গ্রন্থে আছে বিবরণ।
স্বহস্তে তারকচন্দ্র করেছে লিখন।।
জনশ্রুতি ইতিহাস দোঁহে মিলি কয়।
এ সিদ্ধান্ত সত্য তাই লিখিনু হেথায়।।
মন্দিরে গাত্রে লেখা “কামদেব” নাম।
ভাবে বুঝি ইনি “রামদাস গুণধাম।।
বহু কাল পরে যবে লিখেছে লিখন।
“রাম” সাজে “কাম” “দাস” “দেবে” নিমগন।।
এগার পঁচিশ অঙ্ক লেখে অনুমান।
সেই কালে রামদাস ছিল অধিষ্ঠান।।
তাতে বলি মন্দিরের গ্রাত্রে যাহা লেখা।
আক্ষরিক সত্য তাতে নাহি যায় দেখা।।
যা’ হোক তা’ হোক এই মানিলাম সার।
মন্দির নির্ম্মিত হ’ল সমাধি উপার।।
এবে শুন কালীমাতা কি কার্য্য করিল।
দেশবাসী সবে সেই কথা জানে ভাল।।
একদা শাখারী এক এল লহ্মীপাশা।
বহু অর্থলাভ হবে মনে করে আশা।।
মন্দিরেতে গিয়া তেঁহ প্রণাম করিল।
লাভশায় মা’র কাছে, মানত মানিল।।
পরে গ্রামে মধ্যে সেই ব্যক্তি চলে গেল।
এবে শুন পূর্ব্বে কোন ঘটনা ঘটিল।।
তারক গানের লাগি যেতে চায় ঢাকা।
শান্তি দেবী মাগিলেন তার কাছে শাঁখা।।
ঢাকা হতে সে তারক শাঁখা এনেছিল।
শান্তিদেবী সেই শাঁখা শ্রীহস্তে পরিল।।
ক্ষীরোদ-বাসিনী দেবী শাঁখা পরে হাতে।
কৈলাস-বাসিনী তবে ভাবিলেন চিতে।।
মাতারে দিয়াছে শাঁখা তারক সুজন।
আমি বা বঞ্চিত তাতে হ’ব কি কারণ?
মাতৃ-ভক্ত সে তারক আমি জানি মনে।
ক্ষীরোদ-বাসিনী পুত্র একা নি’বে কেনে?
শ্রীহরির প্রিয়জন মোদের আত্মীয়।
আদরের ধন সে যে প্রিয় হতে প্রিয়।।
মাতা তারে কৃপা করে আমি কিবা করি?
মনে হয় তারকের অন্যারূপ ধরি।।
তাহলে আদর মোরে করিবে তারক।
শাখা পাব বস্ত্র পাব পাইব পুলক।।
এই ইচ্ছা দয়ামীয় করিলেন মনে।
কিছু পরে সে শাঁখারী আসিল সেখানে।।
শাঁখারী দেখিয়া মাতা ইচ্ছা করে মনে।
তারকে করিবে দয়া মাতা সেই দিনে।।
শাঁখারী মানৎ করে দেবী তাহা শোনে।
‘তথাস্তু’ বলিলা দেবী আপনার মনে।।
গ্রাম মধ্যে সে শাঁখারী পশিল যখনে।
ঘরে ঘরে খরিদ্দার হ’ল সর্ব্ জনে।।
নিমেষের মধ্যে তার বিক্রী হ’ল সারা।
ভাব দেখে সে শাঁখারী যেন বাক্য-হারা।।
দ্রুতগতি পুনরায় নৌকায় আসিল।
পুনরায় দ্রব্য লয়ে গ্রামেতে ছুটিল।।
মন্দিরের কাছে গিয়ে হইল স্মরণ।
মায়ের কৃপাতে হল লভ্য অগণন।।
পুনরায় মন্দিরেতে পাশিল শাঁখারী।
প্রণাম করিছে সেথা বহুক্ষণ ধরি।।
ব্রহ্মা বিষ্ণু যাঁর মায়া বুঝিতে না পারে।
সেই মায়াময়ী এল কন্যারূপ ধরে।।
লাল চেলি পরিধানে এলায়িত কেশ।
আলো-করা কালোরূপে ডুবে গেছে দেশ।।
মলিন বদন যেন আঁখি ছল ছল।
কাঙ্গালীনী সাজে মাতা দিয়ে মায়া-জাল।।
শাঁখারী প্রণাম করি উঠিল দাঁড়ায়।
দেখে কালো মেয়ে এক বসেছে তখায়।।
মিটি মিটি কালোরূপে দিতেছে ঝলক।
শাঁখারী দাঁড়ায়ে দেখে পড়ে না পলক।।
কালো মেঘ কালে যেন সৌদামিনী হাসে।
হাসিয়া জননী তারে বলে মৃদুভাষে।।
“শুন গো শাঁখারী তুমি আমি যাহা কই।
আমি বটে তারকের প্রিয়-কন্যা হই।।
বড় সাধ মনে মোর শাঁখা পরিবারে।
এক জোড়া শাঁখা তুমিদিয়ে যাও মোরে।।”
শাঁখারী বলিল “মাগো বলিয়াছ ভাল।
শাঁখা দিলে দাম তার কেবা দিবে বল?
তোমার পিতার নাম বলিল তারক।
আম’ত চিনি না মাগো সেই কোন লোক।।
হাসিয়া দেখাল দেবী “অই দেখা যায়।
নদীর ওপারে মোর পিতার আলয়।।
তুমি যদি মোর আগে যাও সেই বাড়ী।
কোথায় রয়েছে টাকা বলে দিতে পারি।।
গৃহ মধ্যে ঝাঁপি আছে ঢাকনীতে ঢাকা।
তার মধ্যে পিতা মোর রাখিয়াছে টাকা।।
বহুদিন তার মধ্যে রাখিয়াছে পিতা।
মনে হয় তার মনে নাহি সেই কথা।।
এ ভাবে বলিলে পিতা দিয়া দিবে দাম।
শ্রীঘ্র শাখা দেও তুমি “মায়া” মোর নাম।।”
ঈশ্বরী যে ইচ্ছা করে কেবা বাধা দেয়।
শাখারী ভুলিয়া গেল দেবীর কথায়।।
সযতনে দুই হাতে পরাইল শাঁখা।
দেবীর বদনে খেলে বিদ্যুতের রেখা।।
পরশনে শাঁখারীর কর্ম্ম-বন্ধ ক্ষয়।
“সংসার আসর” মনে সেই ভাব হয়।।
শাঁখা বেচা টাকা নেয়া সব যেন ফাঁকি।
প্রাণ তার কেন্দে কেন্দে ওঠে থাকি থাকি।।
মাতারে ডাকিয়া বলে “শুন গো জননী।
তোমার গৃহেতে আমি যাইব এখনি।।
মোর সাথে চল তুমি নাহি কর দেরী।
আমার কি হ’ল তাহা বুঝিতে না পারি।।
মনে শুধু বলে যাই তারকের বাড়ী।
মোর সাথে চল মাতা চল তাড়াতাড়ি।।”
মায়াময়ী ছল করি বলিলেন কথা।
শাঁখারী বুঝিবে কিবা যাহা বলে মাতা।।
“অগ্রভাগে তুমি যাও পার-ঘাটে।
দেবীর মন্দিরে পূজা দিব আমি বটে।।
পূজা সারি পরে আমি যাব নিজ ঘরে।
অপেক্ষা করহ কিছু নদীর কিনারে।।”
কথা শুনি সে শাঁখারী নদী তীরে যায়।
অপেক্ষা করিল সেথা কতক সময়।।
এক দ্বার মন্দিরের অন্য দ্বার নাই।
দ্বার প্রতি লক্ষ্য করে রয়েছে সদাই।।
কই কোথা কেহ নাই কেহ না আসিল।
শাঁখারী ভাবিল বুঝি মেয়ে ফাকি দিল।।
পুনরায় মন্দিরেতে করিল প্রবেশ।
সেথা নাই মানবের কোন গন্ধ-লেশ।।
আশ্চর্য্য মানিয়া চলে সেই যে শাঁখারী।
শ্রীঘ্র গতি উপনীত তারকের বাড়ী।।
দেখিল তারক বসি করে আলাপন।
নবীন বয়স যেন গৌরাঙ্গ বরণ।।
ধীরে ধীরে উপস্থিত তারকের ঠাঁই।
বলে “এক কথা আমি বলিবারে চাই।।
“মায়া” নামে তব কন্যা মন্দিরের ধারে।
এক জোড়া শাঁখা নিল আমার গোচরে।।
তব ঠাঁই পাঠাইল দামের কারণ।।
দয়া করি মোরে দাম দাও মহাজন।।”
শাঁখারীর কথা শুনি হাসিল তারক।
বলে “মোরে তুমি নাকি পেয়েছ বালক?
কন্যা বলি বল কারে কন্যা মোর নাই।
বিবাহ করিনি তার কন্যা কোথা পাই?
অনুমানে বুঝি তোমা ঠকায়েছ কেহ।
শুনিয়া তোমার কথা আমার সন্দেহ।।”
কথা শুনি শাঁখারীর মুখে কথা নাই।
বলে “তার প্রমাণাদি আমি দিতে চাই।।
শাঁখা নিয়ে কন্যা তব বলিয়াছে কথা।
নিশ্চয় তোমারে দাম দিবে মোর পিতা।।
টাকা জন্যেতে যেন চিন্তা নাহি করে।
ঘরের মঘ্যেতে টাকা ঝাঁপির ভিতরে।।
বহু দিন রাখা-টাকা তব মনে নাই।
সত্য কিংবা মিথ্যা তুমি খুঁজে দেখ তাই।।
এই মত কথা যদি বলিল শাঁখারী।
মনে মনে সে তারক উঠিল শিহরি।।
কোন কথা নাহি বলি গৃহ মধ্যে যায়।
ঝাঁপির মধ্যেতে দেখা টাকা বাঁধা রয়।।
আশ্চর্য্য মানিয়া সাধু আসিল বাহিরে।
বারেবারে শাঁখারীরে নিরীক্ষণ করে।
পরে বলে “শুন ভাই মিত্যঅ বল নাই।।
কন্যা মোর কোথা গেল বল দেখি তাই।।”
শাঁখারী বলিল তাঁরে সকল ঘটনা।
হায়! হায়! করি কান্দে তারক রসনা।।
শাঁখারীরে ডেকে কবে “ওরে ভাগ্যবান।
এমন জননী পেয়ে ছেড়ে দিলে কেন?
চল চল শ্রীঘ্র চল মন্দিরেতে চল।
স্বচক্ষে দেখিতে পাবি নিজ কর্ম্মফল।।”
এস্তে ব্যাস্তে দুইজনে গেলে নদী পার।
দ্রুত গতি গেল দোঁহে মন্দির ভিতর।।
দেখে নব শঙ্খ শোভে মায়ের শ্রীকরে।
শাঁখা দেখি সে শাঁখারী বলে উচ্চেঃ স্বরে।।
“ঐ শাঁখা পরায়ে আমি দিছি তার হাতে।
সে যে কন্যা এ যে মাটি সম্ভব কি মতে?”
কান্দিয়া তারক বলে “ওরে ভাগ্যবান।
স্বচক্ষে দেখিল মাতা তবু সন্দিহান?
মাটী-মূর্ত্তি শঙ্খ যদি করেন ধারণ?
অঙ্গুলির পরে তারা করেন গ্রহণ।।
এ যে দেখ হস্ত-কন্ঠে শোভিছে সুন্দর।
প্রত্যক্ষ দর্শণ তুমি কিবা চাই আর?
ধন্য তুমি জগন্নাতা দেখিলে নয়নে।
শত কোটি দন্ডবৎ তোমার চরণে।।
এত বলি সাধু তার পদে গড়ি যায়।
শাঁখারী কান্দিয়া পড়ে তারকের পায়।।
কেন্দে কেন্দে বলে তাঁরে “ওগো মহাজন।
মাতাকে দেখিুন শুধু তোমার কারণ।।
তোমাকে করেছে দয়া দয়াময়ী শ্যাম।
বত গুণে দেখিলাম হর-মনোরাম।।
নয়নের ঘোর মোরে কেটেছে এখন।
তুমি মম গুরু মোরে দেহ গো চরণ।।
অনেক বলিয়া তাঁরে তারক শান্তায়।
ব্যবসায় ফেলে পরে গৃহে চলে যায়।।
সেই হতে তার মন হইল উদাসী।
গৃহ ছেড়ে চলে গেল হইল সন্ন্যাসী।।
এ দিকেতে রাত্রিকালে তারক দেখিল।
স্বপ্ন-ঘোরে মাতা তারে আপনি কহিল।।
“তব কন্যা পরিচয় শাঁখা লইয়াছি।
এই শাঁখা চিরকাল তব ঠাঁই যাচি।।”
স্বপ্নাদেশে যে আদেশ তারক পাইল।
আপন জীবনে যাহা সর্ব্বদা পালিল।।
চিরকাল ঢাকা হতে শাখা এন দেয়।
ওড়াকান্দী লহ্মীপাশা এই দু‘জা’গায়।।
হরি ভক্তে ভালবাসে সর্ব্ব দেবতায়।
হরি-ভক্ত-পদ-রজঃ মহানন্দ চায়।।