পবিত্র ব্যক্তিত্বের মধ্যে ভক্ত শান্ত ও অনন্তের এক যোগসূত্র দেখতে পান। প্রথমে তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বের অপূর্ব মাধুর্যে আকৃষ্ট হন এবং পরে তার মাধ্যমে তাঁর অন্তরের উপলব্ধি হয়।
আমাদের অনুভূতিগুলিকে কোনকিছুতে কেন্দ্রীভূত করা প্রয়োজন, আমরা যদি কোন পবিত্র প্রতিমা বা ব্যক্তিত্বতে আকৃষ্ট না হই, তবে স্বাভাবিকভাবেই আমরা কোন মানুষকে বেছে নেই এবং তাতেই আসক্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু যদিও প্রথমে এইসব মহাপুরুষের মানবিক গুণগুলিই আমাদের আকর্ষণ করে, পরে তাঁদের ঈশ্বরীয় সত্তা আমাদের কাছে প্রকাশ পায়।
আর এখানেই ঈশ্বরের অবতারের পুজোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একটি বাড়ি করতে গেলে আমাদের একটি নক্সা (Model) লাগে। আমরা দেখতে পাই অবতার পুরুষদের দেহ ও মন যেন কাচের আধার আর তার ভেতর থেকে পরমাত্মা প্রকাশ পাচ্ছেন; আমাদের দেহ-মন বড় জোর লোহার খাঁচার মতো।
এই লোহার খাঁচাকে কাচের আধারে রূপান্তরিত করাই আমাদের কাজ। অবতার পুরুষগণ নিজেদের অতিমানবিক আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে লোহার খাঁচাকে কাচের আধারে রূপায়িত করার উপায় আমাদের দেখিয়ে গেছেন। এইসব অবতার পুরুষদেরও নিয়মিত আধ্যাত্মিক সাধনা ও অভ্যাস সহায়ে নিজ নিজ শরীর ও মনের পূর্ণ উৎকর্ষতা অর্জন করতে হয়েছিল!
তাঁদেরও শরীর-মনকে সম্পূর্ণ ঠিক রাখতে হতো। পুরাণে এইসব মহাপুরুষদের জীবন-বর্ণনায় দেখা যায় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আদর্শের এক আশ্চর্য সমন্বয়। তাঁদের ক্ষেত্রে জ্ঞানাতীত অবস্থার প্রকাশ হয় সজ্ঞানের মাধ্যমে। আমরা যদি তাঁদের মানবীয় গুণের দ্বারা আকৃষ্ট হই, তবে কালে আমরাও তাঁদের ঈশ্বরীয় ভাবের সংস্পর্শে আসব।
এমনকি একনিষ্ঠ অদ্বৈতবাদীও আমাদের কাছে তাঁদের চিন্তারাশি এমনভাবে তুলে ধরতে পারেন যা আমরা বর্তমান স্তরে থেকেও বুঝতে ও গ্রহণ করতে পারি। তিনি আমাদের হাত ধরে উচ্চ থেকে উচ্চতর সত্যে নিয়ে যেতে আগ্রহী।
একটি অবস্থায় প্রতিমা উপাসনার প্রয়োজন আছে; তবে এই অবস্থার ঊর্ধ্বে উঠতেই হবে। মানুষ যদি তার সকল অনুভূতি ও আবেগের আশ্রয়স্থলরূপে কোন পবিত্র মূর্তিকে গ্রহণ না করে, তবে সে বীভৎস কোন এক মূর্তিকে, পুরুষ বা নারী পুতুলকে গ্রহণ করে, তার পুজো করতে থাকবে ও তার দাসে পরিণত হবে।
কোন্ প্রতিমা হিতকর: রক্ত-মাংসের একটি সাধারণ মূর্তি, না উচ্চতর কোন আদর্শের প্রতীক? সাধারণ মনুষ্য-মূর্তিতে কোন উচ্চতর আদর্শের সন্ধান পাওয়া যায় না। আবার তুমি যদি অমূর্তের কথা ভাব, তবে অমূর্ত (Abstract) অমূর্তই থেকে যাবে, এদিকে পুরুষ বা নারী-রূপী মানবীয় পুতুলগুলি আমাদের সব মনকে টেনে নেবে, সেগুলিই প্রকৃত সত্য বলে মনে হবে, আর অন্য সব কিছুই তার পেছু পেছু চলবে- যেন তাই স্বাভাবিক।
আমাদের পুরুষ বা নারী-রূপ থেকে স্বতন্ত্র ও আমাদের ব্যক্তিত্ব থেকে স্বতন্ত্র, আমাদের নিজ অন্তরের ঈশ্বরকে আমরা যত বেশি ভাবতে পারব, অন্যদের স্থূল শরীর ও ব্যক্তিত্ব থেকে স্বতন্ত্র তাদের অন্তরের ঈশ্বরীয় অস্তিত্বও আমরা তত বেশি ধারণা করতে পারব।
আর তখনই আমরা নিরাপদ হব। তখন থেকেই আমরা আর কখনো কোন পুরুষ বা নারী-রূপ পুতুলের দাস হব না। মানুষ যে ঈশ্বরকে জানতে চায়, তার স্বরূপের ধারণা সকলের সমান নয়। নিজের সম্বন্ধে জ্ঞানের বিকাশের তারতম্যের উপর এটি নির্ভর করে।
……………………………………..
স্বামী যতীশ্বরানন্দের ‘‘ধ্যান ও আনন্দময় জীবন’’
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে : ভারতের সাধক-সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন