বৈশ্য দস্যুর প্রস্তাব
পয়ার
নবরূপে লীলা জীবশিক্ষার কারণ।
শিখাইল জীবগণে আত্মসমর্পণ।।
বসিতেন মহাপ্রভু ভক্তগণ ল’য়ে।
কেহ এসে নিয়া যেত নিমন্ত্রণ দিয়ে।।
পথে যেতে ভক্তগণ নামগান করে।
কত লোক কাঁদিতেন প্রভুপদ ধরে।।
কেহ বা দাঁড়া’ত পথে হস্ত প্রসারিয়া।
বাঞ্ছা পুরাইত তার গৃহেতে যাইয়া।।
দধি দুগ্ধ ঘৃত অন্ন পায়স পিষ্টক।
ভক্তমনোনীত দ্রব্য যত আবশ্যক।।
কোন দিন মহাপ্রভু ভক্তগণ সঙ্গে।
থাকিতেন সুধাময় কৃষ্ণকথা রঙ্গে।।
নাম গান প্রেম কথা সর্ব্বদা আনন্দ।
ডাকিয়া হাকিয়া বলে বল রে গোবিন্দ।।
একদিন হরিচাঁদ বসিয়া বিরলে।
নিষ্কাম প্রবন্ধে পুরাতন কথা বলে।।
শুন শুন ভক্তগণ কথা পুরাতন।
রাঢ় দেশে ছিল এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী দোহে বড়ই দুঃখিত।
ব্রাহ্মণ সে দস্যু, জ্ঞান নাহি হিতাহিত।।
বনমধ্যে গিয়া চুরি ডাকাইতি করে।
ধন সব লুটে লয় লোকে মরে ডরে।।
রাজা টের পেল দুরিত ব্রাহ্মণ।
দস্যুবৃত্তি করি করে ধন উপার্জ্জন।।
মহারাজ একদিন মহাক্রোধ করি।
লোক দিয়া লুঠিল সে ব্রাহ্মণের বাড়ী।।
নিযুক্ত করিল গ্রামে চারিটি সিপাই।
কোন খানে ব্রাহ্মণে যেতে সাধ্য নাই।।
ভিখারী হইয়া ভিক্ষা করিবারে যায়।
দস্যু বলি কেহ তারে ভিক্ষা নাহি দেয়।।
এখানে তাহাকে কেহ ভয় নাহি করে।
নির্ভয় হইল সবে দস্যু মরে ডরে।।
ব্রাহ্মণের ঘরে আর নাহি মিলে অন্ন।
দূর দূর করে সবে গেলে ভিক্ষা জন্য।।
উপায় নাহিক আর অন্ন নাহি পায়।
অন্ন বিনে দৈন্য দশা জীর্ণ শীর্ণ কায়।।
ব্রাহ্মনী কহিছে এবে উপায় কি করি।
অন্নকষ্টে ইচ্ছা হয় ফাঁসী ল’য়ে মরি।।
ব্রাহ্মণ কহিছে তবে ব্রাহ্মণীর ঠাই।
তিষ্ঠ তিষ্ঠ অদ্য আমি ভিক্ষা লাগি যাই।।
যদি ভিক্ষা নাই পাই মরিব পরাণে।
শেষে তুমি প্রাণ ত্যাজ মম মৃত্যু শুনে।।
এত বলি দস্যু কাননেতে চলে গেল।
গলে ফাঁস ল’য়ে দ্বিজ ঝুলিতে লাগিল।।
তাহা দেখি রাজদূত ফিরাইয়া আনে।
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী দোহে দিল রাজা স্থানে।।
হুকুম হইল এরা সাত দিন তরে।
বন্ধিভাবে থাকিবেক রাজ কারাগারে।।
আর সাতদিন এরা বাটিতে থাকিবে।
রাজদূত সঙ্গে করি ভিক্ষা মেগে খাবে।।
এই ভাবে কষ্ট করে কালের হরণ।
জীয়ন্তে মরণ সম না হয় মরণ।।
কাঞ্চিগ্রামে এক বিপ্র বৈষ্ণব সুজন।
লীলাজী বলিয়া নাম প্রেম মহাজন।।
সেই গ্রামে বৈশ্য সাধু এক সদাগর।
সাধু বৈষ্ণবের সেবা করে নিরন্তর।।
বৈশ্য সাধু বাড়ী সাধু আসে আর যায়।
অন্য ঠাই ভ্রমি আসে সাধুর আলয়।।
সাধু বৈশ্য বৈষ্ণব সেবায় মন কৈল।
শত শিষ্য সঙ্গে করি লীলাজী চলিল।।
দস্যু দুষ্ট বৃদ্ধ দ্বিজ ভেবেছেন মনে।
এ সব লোকেরে সাধু খেতে দেয় কেনে।।
পায়স পিষ্টক ঘৃত দুগ্ধাদি শাল্যণ্য।
লুচি পুরী ছানা দধি জল পান জন্য।
মালা ল’য়ে সাধু হ’য়ে অঙ্গে করে ফোঁটা।
কি বুঝিয়া খেতে দেয় সদাগর বেটা।।
এবে আমি সাধু হয়ে ভুলাইব লোক।
ভিক্ষা করি খেতে পা’ব পরিয়া তিলক।।
লীলাজী যাইতে পথে দস্যু ধরে পায়।
বলে প্রভু এক ছড়া মালা দেও আমায়।।
লীলাজী বলেন তোর মালাতে কি কাজ।
দস্যু বলে সাধু হ’ব ল’ব সাধু সাজ।।
হাসিয়া দিলেন সাধু এক খন্ড মালা।
ব্রাহ্মণ বলেন মোর গেল ভব জ্বালা।।
মালাটি লইয়া গলে লইলেন ফোঁটা।
চুল ফিরাইয়া মাথে বাঁধে উভ ঝুটা।।
হরি হরি বলি ছাড়ে ঘন ঘন ডাক।
সদাগর ভবনেতে দিল গিয়া হাক।।
সদাগর ভাবিলেন দস্যু এ ব্রাহ্মণ।
এর যদি হ’য়ে থাকে হরিনামে মন।।
বেশী করি সমাদর করিবে উহারে।
তাতে যদি দস্যুবৃত্তি হ’তে মন ফিরে।।
সেবা শুশ্রূষাদি বহু মতে তারে কৈল।
তাহাতে দস্যুর আরো গাঢ় ভক্তি হৈল।।
ভাবে মনে বহু দিন করি দস্যুবৃত্তি।
এই মত খেতে দিয়া কেবা করে ভক্তি।।
অন্নাভাবে দুটা ভাত খাইবার লাগি।
ভাব ধরে হইয়াছি কপট বৈরাগী।।
তাহাতে না খেতে মেলে কহন না যায়।
প্রকৃত বৈরাগী হ’লে আরো কিবা হয়।।
অন্বেষী কাঁচের পাত্র প্রাপ্ত হৈনু সোনা।
সাধুপদরজ বাঞ্ছে তারক রসনা।।