ভবঘুরেকথা

তিরোভাব ও মিলন
নরদেহ আবরণে হরিচাঁদ বিভু।
পুত্ররূপে গুরুচাঁদ আপনি স্বয়ম্ভু।।
আত্মদরশন করি প্রভু হরিচাঁদ।
আপনা বিলা’তে কাটে সংসারের ফাঁদ।।
পবিত্র গার্হস্থ ধর্ম জীবে শিক্ষা দিতে।
গৃহী থেকে পারি কই ভাবিলেন চিতে।।
পবিত্র চরিত্র হ’বে গৃহস্থের মূল।
মূলভিত্তি স্থুল হ’লে সব অনুকূল।।
কৃষি বাণিজ্যাদি বটে শিখা’ল স্বহস্তে।
এক দেহে গুরুভার শিখানো গৃহস্থে।।
কা’কে ভার দি’ব প্রভু ভাবে মনে মন।
চেয়ে দেখে সঙ্গে এল কোন কোন জন।।
রুদ্রশক্তি হীরামনে দেখিবারে পায়।
বৃহস্পতি শক্তি নিয়ে এল মৃত্যুঞ্জয়।।
শিবশক্তি শ্রীগোলোক নারিকেল বাড়ী।
কৃষ্ণশক্তি শ্রীলোচন ঘুরে বাড়ী বাড়ী।।
প্রহলাদ-আহলাদ নিয়ে দশরথ হয়।
বিশ্বনাথ, ব্রজ, নাটু, রাখাল নিচয়।।
অংশ অবতার যত পূর্বেতে আইল।
‘আমি পূর্ণ’ জানি তারা সকলে জুটিল।।
মম শক্তি বহিবার এরা নহে যোগ্য।
‘ভাবনা অতীত’ আমি নাহি দৃশ্য, ভোগ্য।।
খণ্ড অবতারে যে’বা এল ধরা’পরে।
আপনা রাখিতে পূর্ণ ভজিল আমারে।।
রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, আদি অথবা গৌরাঙ্গ।
আমাকে সাধনা করে পেতে মম সঙ্গ।।
‘পূর্ণ আমি’ সর্বময় ‘অপূর্ণের পিতা’।
‘সাধনা, আমার কন্যা আমি জন্মদাতা।।
শ্রীগৌরাঙ্গ হরি বলে রাম পূজে দুর্গা।
শ্রীকৃষ্ণের প্রেম দিল রাধিকা বিসর্গা।।
বুদ্ধের তপস্যা লাগে ‘বুদ্ধ’ সাজিবারে।
বিনা সাধনায় এরা কিছু নাহি পারে।।
আমি হরিচাঁদ এবে পূর্ণ অবতার।
অজর, অমর, আমি ক্ষীরোদ-ঈশ্বর।।
মম শক্তি ধরিবারে কারো সাধ্য নাই।
ধরিলে ধরিতে পারে মহাদেব সাঁই।।
ধরিয়া অনন্ত কাল ক্ষীরোদ সাগরে।
মুনিরূপে ধ্যান করে পাইতে আমারে।।
অংশ অবতার মোর যতবার হয়।
কোন বারে মহাদেব আসেনা ধরায়।।
ইচ্ছা তাঁর পূর্ণ অবতার যবে হবে।
আসিয়া আমার খেলা আনন্দে খেলিবে।।
এত ভাবি’ হরিচাঁদ শঙ্করে স্মরিল।
করজোড়ে মহাকাল সম্মুখে দাঁড়া’ল।।
হরিচাঁদ বলে “দেব-দেব মহাদেব।
মম ইচ্ছা গৃহধর্মী জীবকে তরা’ব।।
চিত্তশুদ্ধি একাগ্রতা বীর্যবত্তা লাগি।
সংসারী সাজিয়া আমি সাজিব বিরাগী।।
আদর্শ গৃহীসাজে তোমাকে সাজা’ব।
মম কার্য শেষ করি তোমাতে মিশিব।।
আমা তোমা দুই শক্তি একত্র হইবে।
পাপী তাপী যোগীন্যাসী সবে ছায়া পাবে।।”
মহাদেব বলে “নাথ! যে আজ্ঞা তোমার।
মনের বাসনা আমি পুরা’ব এবার।।
পুত্ররূপে তব ঘরে নরদেহ ল’ব।
শান্তিমাতা বক্ষ সুধা পিয়ে ধন্য হ’ব।।”
সেই হেতু পুত্ররূপে এল গুরুচাঁদ।
মহাকাল গুরুচাঁদ পিতা হরিচাঁদ।।
গুরুচাঁদ জন্ম পরে প্রভু সাজে দীন।
সংসার বাসনা দিনে দিনে হ’ল ক্ষীণ।।
ক্রমে ক্রমে হরিচাঁদ বিরাগী সাজিল।
সংসারের ভার গুরুচাঁদ হস্তে নি’ল।।
ত্রিংশ বর্ষ বয়ঃক্রম যখনে হইল।
গৃহস্থের গূঢ়নীতি সব শিক্ষা হ’ল।।
আদর্শ গৃহস্থ সাজে প্রভু গুরুচাঁদ।
মনে মনে মহাপ্রভু পাইল আহ্লাদ।।
পূর্বের প্রতিজ্ঞা মত দিন কাছে এল।
গুরুচাঁদ বর দেহে মিশিতে ইচ্ছিল।।
সর্ব কর্ম ত্যাগ করি প্রভু কতদিন।
গৃহ মাঝে বন্ধ রহে যেন দীনহীন।।
নিকটে যাইতে সবে প্রভু করে মানা।
অন্তরঙ্গ ভক্ত তাহা শুনেও শুনে না।।
বার’শ চুরাশী সাল সে ফাল্গুন মাসে।
বুধবার প্রাতঃকাল তারিখ তেইশে।।
মহাপ্রভু বলে ডেকে ভক্তগণ ঠাই।
“মাহেন্দ্র সুযোগ এল এবে আমি যাই”।।
গঙ্গাচর্ণা নিবাসিনী যমবুড়ী নাম।
ভবানী নামিনী দেবী নড়াইল ধাম।।
রামধন, গোলোক পাগল, মহানন্দ।
উপস্থিত যত ছিল সবে নিরানন্দ।।
কেঁদে কেঁদে সবে বলে মহাপ্রভু ঠাই।
“কি উপায় হবে বাবা! তুমি যবে নাই”।।
প্রভু বলে “শুন, শুন প্রিয় ভক্তগণ।
নিশ্চয় জানিও মোর নাহিক মরণ।।
কায়া ছাড়ি এবে আমি বাহির হইব।
গুরুচাঁদ দেহে গিয়া আপনি মিশিব।।
আমা’ ভাবি গুরুচাঁদে ভকতি করিবে।
গুরুচাঁদ মধ্যে তবে আমাকে দেখিবে।।
যেই গুরুচাঁদ সেই আমি বটে হই।
আমি ছেড়ে কোথা যা’ব গুরুচাঁদে রই”।।
এতবলি মহাপ্রভু কায়া তেয়াগিল।
জ্যোতিঃরূপে গুরুচাঁদ অঙ্গেতে মিশিল।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ অভিন্নাত্মা আত্মা।
পিতাপুত্রে এক দেহে হইল সমতা।।
মানুষে মানুষ মিশে কি মানুষ হ’ল।
হরিগুরুচাঁদ প্রীতে হরি হরি বল।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!