-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
ভক্ত তার আরাধ্য দেবতাকে পেতে চায় সকল কিছুর বিনিময়ে। তার জন্য বিভিন্ন মতাদর্শের শাস্ত্রে বিভিন্ন পন্থা লিপিবদ্ধ যেমন আছে তেমনি অনেক গুপ্ত মতাদর্শে রয়েছে অগুণিত লৌকিক আচার। প্রকাশ্যে বা গুপ্তে যেখাবেই আরাধ্য দেবতাকে বা ইষ্ট প্রাপ্তির আশা ভক্ত করুক না কেনো। উভয়ক্ষেত্রেই তাকে সহজ হতে হয়।
অর্থাৎ সহজ মানুষ মানে প্রেমময় হতে হয়। আর প্রেম বিলাতে পারলেই সাধক নিজের ভেতরের প্রেমকে জাগাতে পারে। আর এই যে প্রেমের মাধ্যমে পরমকে পাওয়ার পথ; সেই প্রেমকেই সাধুগুরুরা পাঁচ ভাগে ভাগ করেছে। একেই বলা হয় পঞ্চপ্রেম। সাধুগুরুরা বলেন, পঞ্চপ্রেম দ্বারাই ব্রহ্মান্ড রচনা করেছেন পরম বা পরমেশ্বর। আর এই পঞ্চপ্রেমের মাধ্যমেই সৃষ্টিকূল পরিচালিত হয়ে আসছে। এই পঞ্চপ্রেম হল- সখ্য, শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য ও মধুর।
১. সখ্যপ্রেম
সখ্য প্রেম মূলত বন্ধুতের প্রেম অর্থাৎ বন্ধুর প্রতি বন্ধুর যে প্রেম তাকেই সখ্য প্রেম হিসেবে ধরা হয়। কথায় বলা হয় পরস্পারিক সখ্যতা সেই সখ্যতা মূলত এই সখ্য প্রেমকে নির্দেশ করে। পারস্পারিক যে প্রেম মানুষে মানুষে গড়ে ওঠে তাকেই প্রেমের প্রথম ধাপ বা সখ্য প্রেম বলেছেন সাধুগুরুরা। একজনের সাথে অন্যের সাথে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নয় প্রেমই হবে পরিচয় বা যোগাযোগের এক ও অভিন্ন মাধ্যম।
২. শান্ত প্রেম
সাধুগুরুরা বলেন, তুমি যদি স্থির হতে চাও তাহলে তোমার চারপাশকে আগে স্থির করো। চারপাশের মানুষকে আগে স্থির করো। একটা অস্থির পরিবেশে তুমি স্থির বা শান্ত হতে পারবে না। তাই তোমার ভেতরের যে প্রেম তা তুমি ছড়িয়ে দাও তোমার চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষজনের প্রতি। এতে তারা যেমন তোমার প্রতি স্নেহভাজন হবেন তেমনি তোমার ভেতরেও তাদের প্রতি জাগবে ভক্তিভাব।
আর এই কাজ শুরু হয় পরিবারের সবচেয়ে আপন মানুষ অর্থাৎ পিতামাতার সাথে সন্তানের আচরণের মধ্য দিয়ে। সন্তান পিতামাতাকে যে স্থরের প্রেম করে তাকে সাধুগুরুরা চিহ্নিত করেছেন শান্ত প্রেম নামে। এই প্রেম পিতামাতা থেকে শুরু হয়ে আশপাশের সকলের প্রতি ছড়িয়ে দিতে হয়। তাতে মন স্থির হয় শান্ত হয়। আর মন শান্ত থাকলে দেহও সুস্থ্য থাকে।
৩. দাস্য প্রেম
সাধক পিতামাতাকে যে স্থরের প্রেম করে থাকে তার পরের স্থরের প্রেমই হলো দাস্য বা দাসত্ব্যের প্রেম। এই প্রেম মূলত হয় গুরু শিষ্যের মাঝে। শিষ্য যখন গুরু ভজে তখন তাকে দাস হয়ে গুরুকে পরম জ্ঞানে ভজন-সাধন করতে হয়। গুরু যা বলবেন বা করতে বলবেন সেটাই শেষ কথা জ্ঞান করে ভক্তকে তা পালন করতে হয়।
আর গুরু যা বলবেন তাও নিজ জ্ঞানে বুঝে নিয়ে তা পালনের জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হয় সাধককে। তাই বলা হয় শিষ্যকে দাসত্ব্য প্রেম করতে হয় অর্থাৎ তার নিজের কোনো আর চলন-বলন অবশিষ্ট থাকে না গুরু যা বলেন তাই করতে বাধ্য থাকে।
৪. বাৎসল্য প্রেম
পিতামাতা সন্তানকে যে প্রেম প্রদান করে তাকে বলা হয় বাৎসল্য প্রেম। নিজের সৃষ্ট সন্তান বা সন্তানতুল্য বা সন্তান জ্ঞান করা কাউকে যখন পিতামাতারূপে প্রেম করে তা দাসত্ব প্রেমকেও ছাড়িয়ে যায়। তাকে সার্বক্ষণীক সেবা-ভালবাসা-জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে যে লালন পালন তাই বাৎসল্য প্রেম।
৫. মধুর প্রেম
জগতের সকল প্রেম অর্থাৎ পঞ্চপ্রেমর সর্বোৎকৃষ্ট প্রেম বলা হয় মধুর প্রেমকে। প্রেমিক-প্রেমিকার বা সখা-সখির মাঝে যে মধুর সৃষ্টি হয় তাই মধুর প্রেম। অনেকে একে রাধাকৃষ্ণের প্রেমও বলে থাকে। সাধুগুরুরা বলেন, মধুর প্রেমময় ভাবরস থাকলে সাধুত্ব অর্জন হয়.ফলে দেবতারা ভক্তি দেয়! মনের সকল পাপাচার ত্যাগ করে সাধক যখন মধুর প্রেমে লীন হয় তখনই দর্শন পায়।
সাধন মার্গে বলে, ভক্তকে গুরুর সাথে পর্যায়ক্রমে পঞ্চপ্রেমেই মত্ত্ব হতে হয়। ভক্ত গুরুকে কখনো বৎসরূপে, কখনো দাসীরূপে, কখনো শান্তসমাহিত স্নিগ্ধতার মাধ্যমে, আবার কখনো মধুর রসের মাধ্যমে ভক্তি দিতে হয়। মোটকথা পঞ্চপ্রেমের পঞ্চভাগীদার থাকলেও গুরুকে পঞ্চপ্রেমেই আরাধনা করতে হয়।
বৈষ্ণবরা এই পঞ্চপ্রেমকে পঞ্চরস বলে অবহিত করলেও বাউল মতানুসারীরা পঞ্চরস বলতে- সরল চন্দ্র, গরল চন্দ্র, রোহানী চন্দ্র, ধারা চন্দ্র, আদি চন্দ্র ইত্যাদি বোঝায়। বাউল মতাবাদ গুপ্ত হওয়ায় এই চন্দ্রের ব্যাখ্যা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করা বা তা সহজ অনুধাবন করা সহজ নয়। অনেকে অনেকে এর ব্যাখ্যা লৌকিক ক্রিয়ার মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
অনেকে বলেন, এই পঞ্চরস মূলত হলো দেহের- মল, মূত্র, রজঃ, বীর্য, লালা ইত্যাদি। এই পঞ্চপ্রেম আর পঞ্চরসকে অনেকে একই মনে করলেও এর দ্বিমতও রয়েছে।
আবার অনেকে এই পঞ্চপ্রেমকে তুলনা করেছেন মানবদেহের কণ্ঠ থেকে গুজ্জদ্বার পর্যন্ত যে পঞ্চচক্র রয়েছে তার সাথে। এর এক একটি চক্র অর্থাৎ পঞ্চপ্রেমকে প্রাপ্ত হয়ে সাধক আজ্ঞা চক্র উন্মুক্ত করতে পারে।
1 Comment