গোস্বামী হরিচরণ অধিকারীর রথ যাত্রা
পয়ার
পলিতা গ্রামেতে অধিকারী উপাধ্যায়।
নাম শ্রীহরিচরণ সাধু অতিশয়।।
পাগল গোলোকচাঁদ মন্ত্র শিষ্য তার।
করিবেন রথযাত্রা শুনি সমাচার।।
গোস্বামী গোলোক চলিলেন গুরুপাট।
গিয়া দেখিলেন রথে মিলিয়াছে টাট।।
পাগলের ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র মহানন্দ।
তিনজনে চলিলেন হ’য়ে প্রেমানন্দ।।
রথের বাজারে বহুতর লোক ভিড়।
তিনজন ভ্রমিতেছে দিতেছেন ভিড়।।
টাট মধ্যে পেয়ে সাধু মাধবের সঙ্গ।
দোঁহে করে কোলাকুলি পুলকিত অঙ্গ।।
মাধবে লইয়া গেল গুরুর গোচরে।
ভূমে পড়ি অষ্ট অঙ্গে দণ্ডবৎ করে।।
পদধূলি নিল তুলি দণ্ডবৎ হ’য়ে।
ঠাকুর নিকটে ক্ষণে রহে দাঁড়াইয়ে।।
পাগল কহেন ওহে দয়াল ঠাকুর।
লোকারণ্য সমারোহ করেছো প্রচুর।।
অধিকারী ঠাকুর কহেন যুড়ি কর।
আমি নহে কর্মকর্তা জগৎ ঈশ্বর।।
জ্ঞান কাণ্ড কর্ম কাণ্ড ঐশ্বর্যে যোগ।
আমার কর্তৃত্ব এ সকল পাপ ভোগ।।
গোলোক কহিছে সব ঈশ্বরের খেলা।
ঠিক যেন মিলিয়াছে শ্রীক্ষেত্রের মেলা।।
লোকের সংঘট এতে যদি বৃষ্টি হয়।
আষাঢ় মাসের দিন কি হবে উপায়।।
অধিকারী মহাশয় কহেন পাগলে।
বৃষ্টি নাহি হইবে মাধব দিছেন বলে।।
রথতলে পড়ি অদ্য ত্যাজিবে জীবন।
তাহাতে আমার আরো ভয়াকুল মন।।
শুনিয়া পাগলচাঁদ উঠিল গর্জিয়া।
সত্য কি মাধব ইহা বলেছে আসিয়া।।
আপনার প্রিয়শিষ্য মাধব সদ্জ্ঞানী।
ভক্ত শিরোমণি সে বৈষ্ণব চূড়ামণি।।
রজতের খড়ম দিয়াছে তব পায়।
গুরুপাটে থাকে প্রায় সকল সময়।।
মাস মধ্যে চারি পাঁচ দিন থাকে বাটী।
গুরুকার্য সদা করে অতি পরিপাটী।।
যে কিছু সময় নিজ বাটী গিয়া রয়।
কৃষিকার্য করে মাত্র সেটুকু সময়।।
ছয় পাখী জমি একমাত্র চাষ দেয়।
বীজ বুনাইয়া আর কাছে নাহি যায়।।
আবাদাদি নিগড়ান কিছুই না করে।
মাত্র পৌষ মাসে ধান্য কেটে আনে ঘরে।।
পরিমাণ ধান্য যাহা নিজ বাটী ব্যয়।
উদ্বর্ত ধান্যাদি গুরু পাটেতে পাঠায়।।
হেনকালে সম্মুখেতে আইল মাধব।
বলিতে লাগিল কথা লোকে অসম্ভব।।
বলে মাধা অসম্ভব কথা বল্লি কেনে।
বৃষ্টি হইবে না তুই জানিলি কেমনে।।
অদ্য রাত্রে হবে বৃষ্টি সন্ধ্যার পরেতে।
চারি দণ্ড বৃষ্টি হ’বে পারিবি ঠেকাতে।।
রথের নীচায় পড়ে চাহিলি মরিতে।
গুরুপাটে আসিলি কি জাহিরী জানা’তে।।
তোর দেহে হেন শক্তি হইয়াছে কবে।
অসময় মৃত্যু তোরে কোন যমে নিবে।।
কমল চরণে দিলি রজত পাদুকা।
যে পদ কমলে সদা কমলা সেবিকা।।
এনে দে কমল ফুল যারে পদ্মবনে।
চন্দন মাখিয়া দিব যুগল চরণে।।
অমনি মাধব যাত্রা করে ফুল জন্যে।
গোলোক বলেছে মাধা যা’স কোনখানে।।
হারে মাধা নাহি মেধা শক্তি হৃদি পদ্মে।
বসে থাক মন পাঠা পদ্মবন মধ্যে।।
মাধব নয়ন মুদি বসিল তখন।
গোলোক মানসে পুঁজে শ্রীগুরু চরণ।।
মনে মনে মাধবেরে বনে পাঠাইল।
বন হ’তে পদ্ম পুষ্প মাধব আনিল।।
মনে মনে করিলেন চন্দন ঘর্ষণ।
চন্দনে মাখিয়া পদ্ম পুঁজে শ্রীচরণ।।
বিস্মিত মাধব কহে পাগলের পাশ।
কোথা হ’তে আসে দাদা চন্দনের বাস।।
গোলোক কহিছে ভাই দেখ মন দিয়া।
কে যেন দিতেছে ফুল চন্দনে মাখিয়া।।
আরোপে মাধব করে চরণ নেহার।
চন্দনে চর্চিত পদ্ম দেখে পদোপর।।
তাহা দেখি মাধব উঠিল শিহরিয়া।
গোলোকের পদ ধরি পড়িল কাঁদিয়া।।
মাধবের হস্ত ধরি গোলোক উঠায়।
বলে ভাই শুন কিছু বলি যে তোমায়।।
তোর সঙ্গে মোর হ’ল ভজনের আড়ি।
ধান্য আর দিসনারে ঠাকুরের বাড়ী।।
এত দিন গুরুপাটে কেন ধান্য দিলি।
তুই কি আমার মাকে বারানী পাইলি।।
যদি দিতে ইচ্ছা থাকে আনিস বানিয়ে।
জননীর ঠাই দিস তণ্ডুল আনিয়ে।।
পুনর্বার গুরুপাটে ধান যদি দিস।
ধান বানিবারে তোর নারীকে আনিস্।।
ফিরে যদি গুরুপাটে ধান যাবি দিয়ে।
আমার নিকটে মরিবিরে মা’র খেয়ে।।
শুনিয়া মাধব পাগলের পদ ধরি।
দাদা দাদা বলে কেঁদে যায় গড়াগড়ি।।
পাগল কহিছে মাধা আয় মোর সাথে।
রথের মেলায় যাই সন্ধ্যার অগ্রেতে।।
ডাক দিয়া ভ্রাতুস্পুত্র মহানন্দে বলে।
দোঁহে বৈস পুকুরের দক্ষিণের কূলে।।
দক্ষিণের পাড়ীর দক্ষিণ পার্শ্ব নিয়া।
দু’জনে রাখিল সেইখানে বসাইয়া।।
একখানা ভাঙ্গা চাঁচ দিয়া দুজনায়।
রাখিলেন নিয়া এক গাছের তলায়।।
অল্পক্ষণ পরে বৃষ্টি হ’বে দণ্ড চারি।
তখনে এ চাঁচ দিও মস্তক উপরি।।
বৃষ্টি হ’বে উত্তরিয়া বাতাস হইলে।
বাত বৃষ্টি লাগিবেনা এখানে থাকিলে।।
বৃষ্টি হ’য়ে গেলে ভাল সুবিধা হইলে।
তখনে দু’জনে যেও বাড়ীপরে চলে।।
মাধবে লইয়া তবে গোলোক গোস্বামী।
বাড়ীর উপর গিয়া করে পাগলামী।।
নিজে নানা কার্য করে আরো লোক ধরে।
সকলে বলিয়া দেয় কার্য করিবারে।।
ব’লে দিলে কার্য করে কেহ আনে কাষ্ঠ।
জলপাতা আনে যারা ভক্ত শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ।।
পাক করিবারে নাহি করে আয়োজন।
চুলা জালাইতে, সবে করিল বারণ।।
ঢাকিয়া রাখিল কাষ্ঠ সামগ্রী যতেক।
সব সাবধান করে করি এক এক।।
সভা করি বলিলেন কীর্তন করিতে।
উন্মত্ত পাগল যেন লাগিল নাচিতে।।
জয় হরি বল হরি গৌর হরি বল।
হুঙ্কার করিয়া নাচে কাঁপে ভূমণ্ডল।।
লম্ফ দিয়া পাঁচ সাত হাত উর্দ্ধ হয়।
হেন জ্ঞান হয় যেন শূন্যে উড়ে যায়।।
এক এক বার কহে কেহ হরিচাঁদ।
এক এক বার কহে সত্য গুরুচাঁদ।।
গুরু ঠাকুরকে বলে পাছে ভুলে যাও।
জগন্নাথ বলে ওঢ়াকাঁদি মুখ চাও।।
এক এক বার যায় অন্তঃপুর মাঝে।
এক এক বার আসে বাহিরের কাজে।।
গুরুমাতা পাগলের পাগলাই হেরি।
করযোড়ে দাঁড়াইয়া বলে হরি হরি।।
সন্ধ্যার পরেতে রাত্রি হ’ল দুই দণ্ড।
এমন সময় মেঘ হইল প্রচণ্ড।
আইল প্রবল বৃষ্টি হ’ল দণ্ড চারি।
পাগল বাদল মধ্যে বলে হরি হরি।।
একবার ঘরে যায় হরিবোল দিয়া।
একবার বৃষ্টি মধ্যে পড়ে লাফাইয়া।।
বৃষ্টি মধ্যে ঘুরে যেন কুমারের চাক।
জলধর রবে দেয় হরি ব’লে ডাক।।
জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।
মেঘের গর্জন সঙ্গে গর্জিছে পাগল।।
যখন শ্রীঅঙ্গে লাগে বিদ্যুতের আভা।
সে সময় হইতেছে বিদ্যুতের শোভা।।
আকাশে বিদ্যুৎ শোভা জলদ গর্জন।
পাগলের হাব ভাব তেমন তেমন।।
বিদ্যুতের জ্যোতি শূন্যে নিক্ষরে যখন।
পাগলের অঙ্গ জ্যোতিঃ হ’তেছে তেমন।।
উভয় জ্যোতিতে মিশামিশি ঠেকাঠেকি।
ধাঁ ধাঁ দিয়া লোক চক্ষে লাগে চকমকি।।
পাগল বিক্রম দেখি সবে জ্ঞান শূন্য।
হরি হরি বলিতেছে নাহিক চৈতন্য।।
মেঘের গর্জন কিংবা পাগলের রব।
তাহা কিছু নির্দিষ্ট না হয় অনুভব।।
জয় হরি বল ধ্বনি শুনা যায় বটে।
নির্দিষ্ট না হয় শব্দ কোথা হ’তে উঠে।।
চৈতন্য পাইয়া কেহ করিতেছে জ্ঞান।
পাগলের ধ্বনি কেহ করে অনুমান।।
বাহির বাটীতে ছিল চাঁদোয়া টানান।
অধিকারী কহে চাঁদা শীঘ্র খুলে আন।।
ছিঁড়ে যাবে ভিজিবে থাকিলে ঐ খানে।
পাগল করেন মানা বিনয় বচনে।।
পাগল কহিছে যদি চাঁদোয়া খসাবে।
আপনার এত ভক্ত কোথায় বসিবে।।
শুনে মানা করে অধিকারী মহাশয়।
পাগল সকল লোকে কহিয়া বসায়।।
চাঁদোয়ার নীচে থাক কেহ না উঠিও।
বৃষ্টি অন্তে সব লোক উঠিয়া যাইও।।
সব লোক বসাইয়া বৃষ্টির সময়।
বারবাটী অন্তঃপুরে পাগল ভ্রময়।।
কিছু পরে ঝড় ক্ষান্ত বায়ু বন্ধ পিছে।
জলবিন্দু নাহি পড়ে চাঁদোয়ার নীচে।।
বৃষ্টি অন্তে আকাশে প্রকাশে সব তারা।
পাগল বলিল এবে উঠহে তোমরা।।
মহানন্দ মহানন্দ বলি ডাক দিল।
মহানন্দ ডাক শুনি নিকটে আসিল।।
মহানন্দ মাধবেরে কহিল পাগল।
তোমরা উভয়ে গিয়া দেখহে সকল।।
রসই করিবে যারা সবে দিল ডাক।
চুলা জ্বালাইয়া বলে শীঘ্র কর পাক।।
সবে দেখে পাগলের শুকনা বসন।
চাঁদোয়া অনাদ্র পূর্বে যেমন তেমন।।
খাল ঘাট, বাটী আর পুকুরের পথ।
রথখোলা শুকনা আছয় পূর্ববৎ।।
মধ্যবাড়ী অন্তঃপুর সকল শুকনা।
জলা কাঁদা কিছু নাই দেখে সর্বজনা।।
দেখিয়া সকল লোকে মানিল বিস্ময়।
হরি হরি বলে সবে কার্যান্তরে যায়।।
পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের দক্ষিণেতে।
বিঘত প্রমাণ জল ঘোর ঝটিকাতে।।
পাগল জিজ্ঞাসা করে মহানন্দ ঠাই।
কেমনে ছিলিরে বাপ! বল শুনি তাই।।
মহানন্দ বলে তা কি বলিতে হইবে।
যে ভাবে রাখিলে মোরা ছিলাম সেভাবে।।
সেই ভাঙ্গা চাঁচখানি দিয়া আচ্ছাদন।
সেখানে ছিলাম লোক দশ বারো জন।।
আমরা শুকনা আছি থেকে সেই স্থান।
তাহার নীচেতে জল বিঘত প্রমাণ।।
সেখানে অধিক বৃষ্টি ভাবে বোঝা যায়।
জলময় হইয়াছে শুকনা ডাঙ্গায়।।
দেখে শুনে সকলের লাগে চমৎকার।
কহিছে তারকচন্দ্র রচিয়া পয়ার।।
গুরুপাটে এইখেলা পাগল খেলিল।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি হরি বল।।