মধ্যখণ্ড : পঞ্চম তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
ভক্ত স্বরূপ রায়ের বাটীতে প্রভুর গমন
পয়ার
পাইকডাঙ্গা নিবাসী শ্রীস্বরূপ রায়।
বড়ই সম্পত্তিশালী মান্য অতিশয়।।
দেল দোল দুর্গোৎসব ব্রত পূজা আদি।
বার মাসে বার ক্রিয়া করে নিরবধি।।
রাজসিকভাবে সব করিতেন রায়।
নিযুক্ত ছিলেন সদা অতিথি সেবায়।।
বহু দিন পরে তার হ’ল বেয়ারাম।।
ঔষধ সেবন করি না হ’ল আরাম।।
ঠাকুরের লীলাগুণ শুনে লোক ঠাই।
রায় বলে ঠাকুরের কাছে আমি যাই।।
হরিচাঁদ বলিয়া চলিল কাঁদি কাঁদি।
উপনীত হইল শ্রীধাম ওঢ়াকাঁদি।।
প্রভুর সম্মুখে গিয়া রহে দাঁড়াইয়া।
মহাপ্রভু বলে তুমি এলে কি লাগিয়া।।
তুমি হও বড় লোক রাজতুল্য ব্যক্তি।
তোমাকে বসিতে দিতে নাহি মম শক্তি।।
রায় কহে বড় লোক আমি কিসে হই।
দয়া হ’লে শ্রীচরণে দাস হ’য়ে রই।।
বসিতে চাহে না রায় বলেছে কাঁদিয়া।
ঠাকুরের পদ ধরি পড়ে লোটাইয়া।।
প্রভু বলে গৌরব এখন গেছে ঘুচে।
শ্রেষ্ঠত্ব ঘুচা’তে তোরে রোগে ধরিয়াছে।।
যাও যাও ওরে বাছা রোগ তোর নাই।
এইরূপ মন খাটি সর্বক্ষণ চাই।।
ঠাকুরে প্রণাম করি চলিল বাটীতে।
দেহ মন সমর্পিল হরির পদেতে।।
ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত সেই হ’তে হয়।
খেতে শুতে নিরবধি হরিগুণ গায়।।
সেই হ’তে ঘুচে গেল কর্ম রাজসিক।
ভক্তির উদয় হ’ল বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক।।
পূজাদি বৈদিক ক্রিয়া সব ছেড়ে দেয়।
সব সমর্পণ করে ঠাকুরের পায়।।
কতদিনে মনে করে কবে হেন হ’ব।
প্রভুকে বাটীতে এনে সব সমর্পিব।।
একদিন গিয়া ঠাকুরের কাছে কয়।
চল প্রভু একদিন দাসের আলয়।।
ঠাকুর বলেন আমি যাইবারে পারি।
তব গৃহে আছেন বিধবা এক নারী।।
সেই ধনী আছে জানি তব এক অন্নে।
যাইবারে নারি আমি সেই নারীর জন্যে।।
রূপবতী সেই নারী জানি ভালমতে।
শ্বেত রোগ আছে সেই নারীর অঙ্গেতে।।
তব গৃহে আছে বটে তুমি দেখ নাই।
বস্ত্রদ্বারা গুপ্ত করে ঢেকে রাখে তাই।।
সে নারীকে যদি তুই মা বলে ডাকিস।
তা’হলে আমাকে বাছা লইতে পারিস।।
আমি গেলে মা বলিয়া ডাকিতে হইবে।
ডাকামাত্র তার শ্বেত রোগ সেরে যাবে।।
হইয়াছ হরিভক্ত হ’লে রিপুজয়।
এইটুকু বাকী আছে তা’ হলেই হয়।।
ঠাকুরের পদে রায় পড়িল কাঁদিয়া।
এ হেন করুণা-সিন্ধু পেলেম আসিয়া।।
কোন দিন যাবেন তা’ দেন ঠিক করি।
সেই দিন যেতে হবে এ দাসের বাড়ী।।
ঠাকুর দিলেন তার দিন ধার্য করি।
আজ্ঞামাত্র আয়োজন করিল তাহারি।।
দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে যত ভক্তগণ।
সব ঠাই একে বারে হ’ল নিমন্ত্রণ।।
ঠাকুর করিল যাত্রা পাইকডাঙ্গায়।
যাত্রাকালে সঙ্গে ভক্ত দেড় শত হয়।।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ গোস্বামী গোলোক।
আগে যায় হীরামন হইয়া পুলক।।
উপনীত হয় গিয়া গ্রাম ফুকুরায়।
অধিকারী উপাধি ঈশ্বর দেখে তায়।।
ঠাকুরের পিতৃগুরু ঈশ্বর অধিকারী।
পথ আগুলিল গিয়া করযোড় করি।।
ছেঁড়া কাঁথা দিয়া গলে দন্তে তৃণ ল’য়ে।
মুখে নাহি স্ফুরে বাক্য রহে দণ্ডাইয়ে।।
চক্ষের জলেতে বক্ষ ভাসিয়া চলিল।
দেখিয়া প্রভুর মনে দয়া উপজিল।।
ঠাকুর জিজ্ঞাসা করে ভক্তগণ ঠাই।
বলত ঠাকুর বাড়ী যাই কি না যাই।।
হইয়া গুরু ঠাকুর এ হেন দীনতা।
চক্ষে জল দন্তে তৃণ গলে ছেঁড়া কাঁথা।।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ বলে যোড় হাতে।
যাওয়া উচিৎ হয় ঠাকুর বাড়ীতে।।
ঠাকুর চলিল সব ভক্তগণ ল’য়ে।
নাম সংকীর্তন করে আনন্দে মাতিয়ে।।
ঠাকুর বসিল গিয়া ঠাকুরের বাড়ী।
অধিকারী গোস্বামী প্রণামে ভূমে পড়ি।।
গোস্বামী গোলোক বলে জয় হরি বোল।
জয় হরি বলরে গৌর হরি বোল।।
সব ভক্তগণ বলে জয় জয় জয়।
অধিকারী লোটাইল ঠাকুরের পায়।।
প্রভু হরিচাঁদ বলে শুন হে গোঁসাই।
তুমি গুরু আমি শিষ্য ভিন্ন ভেদ নাই।।
ভব কর্ণধার হ’য়ে জগৎ তরা’লে।
নিজে যে তরিবা ইহা কবে ভেবেছিলে।।
কাঁদিয়া কহেন তবে গুরু অধিকারী।
তুমি গুরু আমি শিষ্য তায় যদি তরি।।
মহাপ্রভু বলে কোথা হেন কল্পতরু।
গুরু হ’য়ে শিষ্যকে বলিতে পারে গুরু।।
ভক্তগণ বলে এই ঈশ্বর অধিকারী।
গৌরাঙ্গ লীলায় ছিল শ্রীঈশ্বরপুরী।।
সে ঈশ্বর পুরি ইনি ঈশ্বরাবতার।
ঈশ্বর ঈশ্বর নাম হয় দোঁহাকার।।
অধিকারী ঈশ্বর, ঠাকুরে কেঁদে কহে।
অন্ন ভোজ নিতে হবে এ দীনের গৃহে।।
ঠাকুর কহেন বহু ভক্তগণ সাথে।
একা আমি অন্ন ভোজ লইব কি মতে।।
তাহা শুনি কাঁদে অধিকারী মহাশয়।
কান্না দেখে বলে হরিচাঁদ দয়াময়।।
ভোজন করা’তে ইচ্ছা পাইয়াছি টের।
মাকে বল রাঁধিতে তণ্ডুল দশ সের।।
কাঁচা কলা কুষ্মাণ্ডের করহ ব্যঞ্জন।
এক সের ডাল বল করিতে রন্ধন।।
গৃহে আছে ঘৃত ভাণ্ড আনহ বাহিরে।
কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ করি দেহ সবাকারে।।
পাক হ’ল ভক্ত সব করিল ভোজন।
মহাপ্রভু ভোজ লন আনন্দিত মন।।
গণনাতে একশত ষাটি জন লোক।
ভোজন দেখিয়া নাচে গোঁসাই গোলোক।।
পরিপূর্ণ ভোজনে সকলে হৈল তৃপ্ত।
নৃত্য করে অধিকারী ভোজন সমাপ্ত।।
অধিকারী প্রতি প্রীতি মহাপ্রভু কন।
গোলোকে ল’য়ে আপনি করুন ভোজন।।
ঈশ্বর কৃতার্থ হ’ল প্রভুর সেবায়।
পরে স্বরূপের বাড়ী চলিল ত্বরায়।।
সব ভক্তগণ উঠে হরিধ্বনি দিয়ে।
হীরামন চলিলেন অগ্রবর্তী হ’য়ে।।
অধিকারী গোস্বামীর গলে কাঁথা ছিল।
সেই কাঁথা হীরামন মাথায় লইল।।
প্রভু হরিচাঁদ কহে হীরামন জয়।
জান না কি জন্যে কাঁথা ল’য়েছে মাথায়।।
উহার মনের ভাব দুই প্রভু পিছে।
আমি ভৃত্য দাসরূপ অগ্রে পাঠিয়াছে।।
মহাপ্রভু কহে অগ্রে যাক হীরামন।
অধিকারী কর তার পশ্চাতে গমন।।
আমি যাব তব পিছে আনন্দ হৃদয়।
তার পিছে যাবে দশরথ মৃত্যুঞ্জয়।।
আর সব ভক্ত যাবে তাহার পশ্চাতে।
গোলোক যাউক তার যথা ইচ্ছা মতে।।
তুমি মম অগ্রে থেকে গান ধরে দেও।
নেচে গেয়ে স্বরূপের বাড়ী চলে যাও।।
অধিকারী গোস্বামী ধরিল সংকীর্তন।
পশ্চাতে দোহারী করে যত ভক্তগণ।।
অধিকারী কণ্ঠধ্বনি সিংহের গর্জন।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ তাদৃশ দু’জন।।
আর সব ভক্তগণ পিছে পিছে যায়।
ভীম নাদ কণ্ঠধ্বনি মত্ত হস্তী প্রায়।।
সব জিনি দেয় ধ্বনি গোলোক গোঁসাই।
জ্বলন্ত পাবক যেন অগ্রে পিছে ধাই।।
জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।
সব ভক্ত মধ্যে গোলোকের এই বোল।।
সব ভক্তগণ গায় সুমধুর ধুয়া।
হেলিয়া দুলিয়া নাচে গোবিন্দ মতুয়া।।
বিমুখ হইয়া পিছে মাথা নোয়াইয়া।
কক্ষ বাদ্য বুড়বুড়ি দু’বাহু তুলিয়া।।
তাহা শুনি মঙ্গল সে বুড়বুড়ি দেন।
বুড়বুড়ি করিতে বদনে উঠে ফেণ।।
সব ভক্ত করে লম্ফ উল্লম্ফ প্রল্মফ।
ঠিক যেন তাহাতে হ’তেছে ভূমিকম্প।।
কীর্তন হুঙ্কার উঠে গগন ভেদিয়া।
বৃক্ষ ছেড়ে পক্ষী সব চলিল উড়িয়া।।
শূন্যে উড়ে যায় পক্ষী ভকতের সঙ্গ।
জ্ঞান হয় দেবতারা হ’য়েছে বিহঙ্গ।।
গ্রাম্য পশু বন্য পশু যে ছিল যেখানে।
কীর্তন শুনিয়া ধারা বহে দু’নয়নে।।
ফুকরা হইতে যান বোয়ালিয়া হাট।
দোকানিরা দেখে শুনে কীর্তনের নাট।।
কার হয় অশ্রুপাত করজোড়ে রয়।
কেহ পাখা ধরিয়া বাতাস দেয় গায়।।
বুনোপাড়া গাড়িটানা মহিষ যে ছিল।
সকল মহিষ এসে একত্র হইল।।
কীর্তনের ধ্বনি শুনি উর্দ্ধ মুখ হয়ে।
উর্দ্ধকর্ণ করি যায় পথ আগুলিয়ে।।
অশ্রুজলে পরিপূর্ণ মহিষেরগণ।
বন্দীগুলা রজ্জু ছিঁড়ে আইল তখন।।
মহিষ কতকগুলি দৌড়িয়া চলিল।
আর কতগুলি তারা চাহিয়া রহিল।।
রক্ষকেরা নাহি পারে মহিষ ঠেকাতে।
বহু পরে ঠেকাইল অনেক কষ্টেতে।।
গো-চর নিকটবর্তী যত গরু ছিল।
উর্দ্ধ মুখ কর্ণ পুচ্ছ ধাইয়া চলিল।।
কোনটা গোছড় ছিঁড়ে চক্ষে পড়ে জল।
বৃষভ বলদ চলে ফেলাইয়া হাল।।
বৎস গাভী একত্র হইয়া দেয় লম্ফ।
তাতে যেন হয় বাসুকীর ফণা কম্প।।
হুলস্থূল লাগিয়াছে জীবাদি জন্তুর।
সংকীর্তন সঙ্গে চলে যতেক কুকুর।।
কুক্কুরে কুক্কুরে দেখা বিষম বিপদ।
একত্র হইয়া চলে নাহি হিংসা বাদ।।
এই রূপে উতরিল পাইকডাঙ্গায়।
স্বরূপের বাটী প্রভু হ’লেন উদয়।।
চারি পাঁচ শত লোক একত্র হইল।
হরিনাম সংকীর্তনে সকলে মাতিল।।
বহুক্ষণ পরে সেই কীর্তন ভাঙ্গিল।
স্নানান্তে ভকতগণ ভোজন করিল।।
চিঁড়া দধি মহোৎসব অগ্রেতে হইল।
অন্নপাক অন্তে সবে ভোজনে বসিল।।
খাও খাও দেও দেও নেও নেও রব।
কেহ খায় কেহ দেয় মহা মহোৎসব।।
হেনকালে উপনীত দ্বিজ একজন।
আমাদা নিবাসী নাম শ্রীহরি ভজন।।
মাতুল আলয় ছিল পাইকডাঙ্গায়।
ঠাকুরে প্রণাম করি ভূমিতে লোটায়।।
কাঁদিয়া কাঁদিয়া কহে আমি নরাধম।
জন্মিয়াছি ব্রহ্মকুলে অধমস্যাধম।।
আমাকে করহ প্রভু কৃপার ভাজন।
বহুদিন ব্যাধি মম জ্বর পুরাতন।।
রোগে মুক্ত কর প্রভু নাহিক উপায়।
তব ভক্ত হ’য়ে আমি থাকিব ধরায়।।
হীরামনে ডেকে বলে গোলোক ঈশ্বর।
ব্রাহ্মণকে ধ’রে সেরে দেহ জীর্ণজ্বর।।
শুনি হীরামন গিয়া ব্রাহ্মণকে ধরে।
টানিয়া আনিল তারে বাড়ীর বাহিরে।।
বাটীর ঈশানকোণে পথে ছিল বালী।
পাতা দিয়া বাড়ি মারে আথালী পাতালী।।
উচ্ছিষ্ট কদলী পত্র ছিল তথা পড়ি।
চারি পাঁচ পাতা ধরি মারিলেন বাড়ি।।
বালী মধ্যে ব্রাহ্মণেরে ফেলে লোটাইয়ে।
বালী ধরি দেয় গায় মাজিয়ে ঘষিয়ে।।
প্রভু হরিচাঁদ আজ্ঞা সেরে যাবে জ্বর।
ব্যাধিমুক্ত উঠিয়া বসিল দ্বিজবর।।
ছেড়ে দিল ব্রাহ্মণেরে উঠিয়া দাঁড়ায়।
করজোড়ে দাঁড়াইল অশ্রুধারা বয়।।
ব্রাহ্মণের বক্ষঃস্থল প্লাবিত হইল।
যাও বলি হীরামন তারে আজ্ঞা দিল।।
লোটাইয়া পড়ে গিয়া প্রভুর চরণে।
মহাপ্রভু বলে তোর কি ভাব এখনে।।
ব্রাহ্মণ বলেন মোর আর ব্যাধি নাই।
আজ্ঞা কর নিরন্তর তব গুণ গাই।।
মহাপ্রভু বলে তোর যা ইচ্ছা করিস।
মম ভক্ত প্রতি সদা ভকতি রাখিস।।
থাকিলে ব্রহ্ম গায়ত্রী ব্রাহ্মণ শরীরে।
তবে কি ব্রাহ্মণ অঙ্গে ব্যাধি হ’তে পারে।।
সে সকল মন্ত্র দিয়া আর কি করিবা।
মানুষ বলিয়া আর্তি সতত রাখিবা।।
আজ তোর হ’ল বাছা ব্যাধি সব নাশ।
যাজনিক দ্বিজ বলে না হয় বিশ্বাস।।
মানুষ বলিয়া আর্তি সদা যেন রয়।
যজমান হিংসা যেন তো হ’তে না হয়।।
ব্রাহ্মণ কহিছে আমি এই ভিক্ষা চাই।
তব পদে থাকে মন কর প্রভু তাই।।
তাহা শুনি ব্রাহ্মণেরে করিল বিদায়।
বিদায় লইয়া দ্বিজ যায় নিজালয়।।
ব্রাহ্মণ আরোগ্য হ’ল শরীর পুলক।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত রচিল তারক।।