ভবঘুরেকথা
মতুয়া সংগীত

বুদ্ধিমন্ত বৈরাগীর চরিত্র কথন
পয়ার

পাগলের বরেতে সাহসে করি ভর।
আর এক প্রস্তাব লিখিব অতঃপর।।
বুদ্ধিমন্ত বৈরাগীর চরিত্র পবিত্র।
রচনা করিতে মম শক্তি নাই তত্র।।
জয়নগর বন্দরে গিয়াছে বুধই।
হাই ছাড়ে সদা বাবা হরিচাঁদ কই।।
জোনাসুর কুঠির উপর দিয়া পথ।
সে পথে যাইতে দেখে বেগুনের ক্ষেত।।
একেত’ কার্ত্তিক মাস কুঠির উপরে।
নীল, গাজা খড়ি পোড়াইত যথাকারে।।
বহুদিন প’চে প’চে মাটি হ’ল সার।
নূতন বেগুন গাছ তাহার উপর।।
ধ’রেছে বেগুন মাত্র তোলা নাহি আর।
নূতন বেগুন সব দেখিতে সুন্দর।।
বুনোজাতি তারা ক্ষেত করিয়াছে ভালো।
নব নব বেগুনে করেছে ক্ষেত আলো।।
দেখি দুই তিন বন্দে বেগুন উত্তম।
তার মধ্যে এক বন্দে অতি মনোরম।।
বুনোজাতি নাম তার বুধই সর্দার।
তাহার বেগুন ক্ষেত বড়ই সুন্দর।।
বুদ্ধিমন্ত তাহা দেখি না পারে রহিতে।
যেন কত দায়, নারে সুস্থির হইতে।।
হইল তাহার মনে এভাব উদয়।
এ বেগুন লাগাইব প্রভুর সেবায়।।
বাটী গিয়া বড়শী দিয়া কৈ মাছ ধরি।
সেই মাছ আর এই বেগুন তরকারী।।
লক্ষ্মীমাতা করে যদি ব্যঞ্জণ রন্ধন।
জগন্নাথ খেলে মম সফল জীবন।।
কেমনে বেগুন নিব অস্থির ভাবিয়া।
হেনকালে এক নারী উপস্থিত গিয়া।।
বুধই তাহাকে বলে শুন ওগো মাতা।
কাহার বেগুন এই জান সেই কথা।।
নারী বলে জানি আমি বার্তাকুর বার্তা।
বুধই বুনোর ক্ষেত আছে তার মাতা।।
ওই দেখা যায় সেই বুধইর বাড়ী।
বুধই বাড়ীতে নাই বাড়ী আছে বুড়ি।।
বার্তা শুনি বুদ্ধিমন্ত চলে গেল তথা।
যথায় বসিয়া আছে বুধইর মাতা।।
বুড়ির চরণে গিয়া করিল প্রণাম।
বলে মাতা মোর হয় বুদ্ধিমন্ত নাম।।
তব ছেলে বুদ্ধিমন্ত আমিও বুধই।
আমি তব ছেলে মোর মিতা গেছে কই।।
মিতা বুঝি বাড়ী নাই খেতে কিবা আছে।
শীঘ্র মোরে খেতে দাও ক্ষুধা হইয়াছে।।
বুড়ি বলে মোরা বুনো শোন ওরে বাবা।
ভাজা পোড়া ঘরে নাই খেতে দিব কিবা।।
চিড়া না বানাই মোরা মুড়ি না বানাই।
বানাইতে নাহি জানি ভাত মাত্র খাই।।
বুধই বলেছে মাতা বড় ক্ষুধা পাই।
মা বলেছি তব ভাত খেলে দোষ নাই।।
বুড়ি ভাবে মা বলে চরণে দিল হাত।
ভক্তি করে সেবা দিল খেতে চায় ভাত।।
বড়ই মমতা হ’ল বুড়ির অন্তরে।
জল দেওয়া পান্তাভাত দিল বুধইরে।।
বাবা জগবন্ধু বলি ছাড়িলেন হাই।
বলে বাবা ভাবনার ফল যেন পাই।।
বুড়ি দিল পান্তাভাত সম্মুখে আনিয়ে।
ক্ষেতে ছিল কাঁচালঙ্কা আনিল দৌড়িয়ে।।
খাইয়া বলে গো মাতা বড় ভাল খাই।
মরিচ আনিতে মা বেগুন দেখতে পাই।।
মিতা নাই বাড়ী মা কি বলিব তোমায়।
গুটি কত বেগুন লইতে ইচ্ছা হয়।।
ভাত খেয়ে দণ্ডবৎ করে তার পায়।
বুড়ির পায়ের ধূলা মাখে সর্ব গায়।।
বুড়ি বলে বাবা’ত বেগুন নিতে চেলে।
বুধই কহিছে মাতা ভাল হয় দিলে।।
আগে আগে বুড়ি যায় বেগুনের ক্ষেতে।
সুন্দর সুন্দর গুলি লাগিল তুলিতে।।
বৈরাগী ফেলিয়া দিল গায়ের চাদর।
বেগুন তুলিয়া বুড়ি রাখে তার পর।।
বেগুন তুলিল প্রায় ছয় সাত সের।
বুদ্ধি কহে আর কার্য নাহি বেগুনের।।
অমনি প্রণাম করি বুড়ির পদেতে।
বেগুন চাদরে বেঁধে নিল মস্তকেতে।।
বুদ্ধি কহে আশীর্বাদ কর মা আমায়।
এ বেগুনে জগবন্ধুর সেবা যেন হয়।।
পথে আসি দাঁড়াইয়া রহিলেন বুড়ি।
বেগুন লইয়া বুদ্ধি যায় দৌড়াদৌড়ি।।
ত্বরা করি উত্তরিল বাটীতে আসিয়া।
কবজী মারিতে গেল বড়শী লইয়া।।
নৌকা বেয়ে বিলমধ্যে গিয়া তাড়াতাড়ি।
প্রধান কবজী মৎস্য মারে তিন কুড়ি।।
মৎস্য আর বেগুন লইয়া প্রাতঃকালে।
বাবা জগবন্ধু বলি ওঢ়াকাঁদি চলে।।
পথে যেতে ডাকে কোথা বাবা জগবন্ধু।
উথলিল তাহার হৃদয়ে প্রেম সিন্ধু।।
এইভাবে পথে ডাক ছাড়িতে ছাড়িতে।
উপনীত হইল ওঢ়াকাঁদির বাড়ীতে।।
প্রণমিয়া জিজ্ঞাসিল লক্ষ্মীমার ঠাই।
বলিলেন শান্তি দেবী প্রভু বাড়ী নাই।।
বুদ্ধি কহে জগবন্ধু কোথায় আমার।
মাতা বলে গিয়াছেন রাউৎখামার।।
আজ্ঞা দিল লক্ষ্মীমাতা যাহ তুমি তবে।
এনেছ বেগুন মৎস্য উহা কেবা খাবে।।
অন্তর্যামিনী কমলা জেনে মনোভাব।
বলে বুদ্ধ তোর শুদ্ধ ভক্তের স্বভাব।।
তুই মোর প্রাণাধিক তুই মোর প্রাণ।
তোর মুখে প্রভু করে অন্নজল পান।।
এনেছ যে বেগুন বুনোর ভাত খেয়ে।
বুড়ির পায়ের ধূলা অঙ্গেতে মাখিয়ে।।
কত কষ্টে এনেছ বিলের কই ধরি।
মানসে মানসা তোর ভোজ ল’বে হরি।।
এমন ভক্তির মাছ ভক্তির বেগুন।
ঠাকুর না খেলে হবে বেগুনে বেগুন।।
ব্যস্ত হ’য়ে বুদ্ধি কহে শুনগো জননী।
রাখ তব অর্ধ অংশ হরি অর্ধাঙ্গিনী।।
সেই মাছ তরকারী অর্ধ অর্ধ রেখে।
রাউৎখামার চলে মনের পুলকে।।
ঠাকুর ছিলেন রামসুন্দরের বাড়ী।
দণ্ডবৎ কৈল গিয়া শ্রীচরণে পড়ি।।
মন জেনে অন্তর্যামী বলিল তখন।
কোথা হ’তে এলি বাছা এত ব্যস্ত কেন।।
বুদ্ধি কহে বালাবাড়ী চল দয়াময়।
তাহা হ’লে আমার অভীষ্ট পূর্ণ হয়।।
এনেছি মাছ তরকারী মনে আছে তাক।
অক্রুর বালার ভার্যা করিবেন পাক।।
আপনি করুন সেবা ভক্তবৃন্দ ল’য়ে।
কমলাঁখি তাহা দেখি যাই সুখি হ’য়ে।।
বুধইর নৌকাপরে উঠে দয়াময়।
বালাদের বাড়ী গিয়া হ’লেন উদয়।।
অক্রুরের স্ত্রীর কাছে বুদ্ধিমন্ত গিয়া।
বিনয় করিয়া বলে চরণ ধরিয়া।।
যে ভাবে আনিল তাহা বলিল তখন।
বলে মাতা ভাল ক’রে করগে রন্ধন।।
অক্রুর বালার ভার্যা শুনে চমকিতা।
আমি কি করিব পাক ভয় হই ভীতা।।
ভয় ভীতা শ্রদ্ধান্বিতা ভক্তির সহিতে।
পাক করি ঠাকুরে বলিল যোড়হাতে।।
সেবায় বসিল প্রভু ভক্তগণ ল’য়ে।
প্রেমানন্দে বুদ্ধিমন্ত বেড়ায় নাচিয়ে।।
স্ত্রীর সঙ্গে অক্রুর করে পরিবেশন।
ভক্ত সঙ্গে মহাপ্রভু করেন ভোজন।।
ভোজনান্তে মহাপ্রভু করে আচমন।
সভাকরি বসিলেন ল’য়ে ভক্তগণ।।
গিরি কীর্তনিয়া আর মথুর দু’জনে।
গোবিন্দ মতুয়া আদি বালারা সগণে।।
শ্রীরামসুন্দর আর গুরুচাঁদ ঢালী।
ঠাকুর নিকটে সুখে বসিল সকলি।।
পাকের প্রশংসা আর মৎস্য বেগুন।
ভোজনান্তে সবে প্রকাশিছে তার গুণ।।
সুন্দর বেগুন আর মৎস্যের আস্বাদন।
হয় নাই হবে নাক এমন সুস্বাদন।।
ঠাকুর জিজ্ঞাসা করে বুদ্ধিমন্ত ঠাই।
এ বেগুন কোথায় পাইলে বল তাই।।
বুদ্ধিমন্ত আদ্যোপান্ত কহে বিবরণ।
শুনে রোমাঞ্চিত সব ভক্তের গণ।।
কেহ কেহ কাঁদে প্রেমে গদ গদ হ’য়ে।
কেহ কাঁদে ঠাকুরের চরণে পড়িয়ে।।
কেহ কেহ কাঁদে প্রেমে গড়াগড়ি দিয়ে।
প্রেমের বন্যায় সবে চলিল ভাসিয়ে।।
কেহ কেহ বুদ্ধিমন্তে ধরে দেয় কোল।
প্রেমাস্ফুট শব্দে কেহ বলে হরিবোল।।
অই প্রেমে উঠে গেল কীর্তনের ধ্বনি।
প্রেমের তরঙ্গে ভাসে ভক্ত শিরোমণি।।
নাহি লোক নিন্দা ভয় অলৌকিক কাজ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!