ডক্টর মীডের সন্দেহ
উনিশ শ’ পাঁচ সালে বঙ্গ ভঙ্গ হয়।
পর বর্ষে ওড়াকান্দী মীডের উদয়।।
প্রভু গুরুচাঁদ আগে প্রতিজ্ঞা করিল।
প্রতিজ্ঞা জানিয়া প্ৰভু জমিদান দিল।।
জমি পেয়ে মীড মনে পাইল আনন্দ।
তাহা করে যাহা বলে প্রভু গুরুচন্দ্র।।
প্রভুর গৃহেতে মীড সদা আসে যায়।
মন খুলে উভে মিলি কত কথা কয়।।
যত মীড আসে কাছে ততই বিস্ময়।
কোনজন গুরুচাঁদ বুঝিয়া না পায়।।
কভু ভাবে জ্ঞানবান পুরুষ বিশেষ।
পুনঃ দেখে জ্ঞানে তার নাহি কোন শেষ।।
এইভাবে দিন যায় যায় না সন্দেহ।
মীড কাজ করে মনে বড় উৎসাহ।।
একদা প্রভুর ঠাই মীড বসিয়াছে।
আসিতেছে ভক্তগণ মীড দেখিতেছে।।
মনে মনে ভাবে মীড কিবা গুণে এরা।
গুরুচাঁদে বলে “ইনি জগতের সেরা।”
অন্তর্যামী গুরুচাঁদ জানিয়া অন্তরে।
মীড প্রতি চাহি তবে এই উক্তি করে।।
“শুনহে ডক্টর মীড আমার বচন।
তোমাদের দেশে কত আশ্চর্য ঘটন।।
বিজ্ঞানের বলে জানি তোমাদের জাতি।
আশ্চর্য ঘটনা করে সবে দিবারাতি।।
টেলিগ্রাফ করিয়াছে আর টেলিফোন।
শত ক্রোশ দূরে করে কথোপকথন।।
আর নাকি আবিস্কার করেছে সম্প্রতি।
বিনা-তারে কথা কয় জেলে এক-বাতি।।
আর আর অত্যাশ্চর্য কতই ঘটনা।
তোমাদের জাতি করে করিয়া সাধনা।।
সব পারে বটে তারা কিন্তু বলি তবু।
মরা-দেহে প্রাণ দিতে পারে নাই কভু।।
আর বলি শুন মোরা ভারতের বাসী।
যন্ত্র পাতি নাহি বটে নহি সে প্রত্যাশী।।
(* রেডিও)
মোরা জানি এই ভাণ্ডে সৰ্ব্ব শক্তি রয়।
জাগা’তে পারিলে তারে সব জানা যায়।।
যন্ত্ৰযোগে যেই কথা বলিছ তোমরা।
নিজ-হৃদি-মধ্যে তাহা পাই যে আমরা।।
তাহার প্রমাণ আছে শাস্ত্রে পুরাণেতে।
কত ঠাঁই কত জনে জানে এই মতে।
একটি প্রাচীন কথা বলি তব ঠাঁই।
কোন গুণে মোরা তাহা জানিবারে পাই।।
নিচল পুরেতে জান এই বঙ্গ দেশে।
দরিদ্রের ঘরে জন্ম দুই কন্যা এসে।।
জ্যেষ্ঠা কন্যা গুণে ধন্যা ধৰ্ম পথে মন।
সন্ন্যাসিনী ভাবে করে জীবন যাপন।।
কনিষ্ঠা সরলা অতি বুঝে না সন্ন্যাস।
গৃহ ধৰ্ম্মে মন তার গৃহে করে বাস।।
কিছু কাল পরে দেখ বিধির ঘটনা।
জ্যেষ্ঠা উদাসিনী হ’ল করিতে সাধনা।।
কনিষ্ঠারে পিতামাতা বিবাহ করা’ল।
পতি সনে সতীরাণী পতিগৃহে গেল।।
কঠোর সাধনা করে সে জ্যেষ্ঠা ভগিনী।
দিনে দিনে শক্তি লাভ করিলা আপনি।।
হেন শক্তি লাভ হ’ল করিলে মনন।
অভিশাপে নিতে পারে জীবের জীবন।।
কনিষ্ঠা ভগিনী কিন্তু হেথা গৃহবাসে।
অন্য সাধনাদি কিছু মনে নাহি আসে।।
“পতি-প্রীতি-কাম” যাহা তাহাই সাধন।
এক মনে করে সতী পতির পূজন।।
পতির শান্তির লাগি সব বিসর্জ্জন।
দিতে পারে সতী যদি কভু করে মন।।
পতি তাঁর নিৰ্ব্বিকারে কৃষি কৰ্ম করে।
অফলা জমিতে ফলে সতী যার ঘরে।।
পতির মনন সতী জানিবারে পারে।
সতীর চিন্তন পতি রাখে প্রাণে ধরে।।
শন্তির কুটিরে দোঁহে শান্ত হ’য়ে রয়।
পাপ তাপ দোঁহে দেখি দূরে সরে যায়।।
হেনকালে একদিন সে-জ্যেষ্ঠা ভগিনী।
কনিষ্ঠারে দেখিবারে ইচিছলা আপনি।।
মনে মনে এই ভাব দেখা’বে তাহারে।
কত দুঃখে আছে ভগ্নী থাকিয়া সংসারে।।
বিষম সংসার তাহে অসীম যন্ত্রণা।
সন্ন্যাসিনী-জীব-ধন্যা, মিলেনা তুলনা।।
এত ভাবি সন্ন্যাসিনী বনস্থলী ছাড়ি।
ভগিনীর গৃহ পানে চলে তাড়া তাড়ি।।
হস্তেতে ত্রিশূল তার রদ্ৰাক্ষ গলায়।
মুক্তকেশী রুক্ষ দৃষ্টি দেখে লাগে ভয়।।
খর পদে ক্ষিন্ন-নারী ক্ষিপ্ৰ গতি চলে।
পথ ধরি চলি যায় কথা নাহি বলে।।
হেন কালে দুষ্ট বুদ্ধি কাক এক জন।
করিল পুরীষ ত্যাগ থাকি উড্ডয়ন।
মলত্যাগ করি কাক উড়ে যেতে চায়।
পড়িল কাকের বিষ্টা নারীর মাথায়।।
আঁখি ঘুরাইয়া নারী শূন্য পানে চায়।
দেখে কাক দিয়ে ডাক দূরে সরে যায়।,
ক্রোধে রক্তচক্ষু নারী দিল অভিশাপ।
“আরে দুৰ্ব্বদ্ধি তোর এত বড় দাপ।।
অকারণে মোর মুণ্ডে মলত্যাগ কৈলি।
দিনু অভিশাপ তুই মুণ্ড শূন্য হৈলি।।”
বলা মাত্র মুণ্ড খসি কাক পড়ে গেল।
‘যথা কৰ্ম যথা ফল’ সে নারী কহিল।।
এ দিকে আপন গৃহে কনিষ্ঠা ভগিনী।
“হায়, হায়” করি দেবী উঠিলা আমনি।।
পুনরায় পথে ধায় সেই সন্ন্যাসিনী।
ক্রোধেতে পূর্ণিত মন কঠিন চাহনি।।
কিছু দূর গেলে পুনঃ ঘটিল ঘটনা।
এক দৃষ্টে বক করে মাছের সাধনা।।
ক্ষণ পরে সেই নারী সেই পথে যায়।
শব্দ শুনি বক ফিরি তার পানে চায়।।
প্রাণ ভয়ে বক যবে আকাশে উড়িল।
পাখসাট বায়ু তার মস্তকে লাগিল।।
কাকের আচারে ক্ষুব্ধ ছিল তার মন।
বকের ব্যাভারে হ’ল দ্বিগুণ এখন।।
সন্ন্যাসিনী বলে “বক করহে অপেক্ষা।
এই দণ্ডে দিব তোরে সমুচিত শিক্ষা।।
মোরে অবহেলা করি উড়িবারে চাও।
এই দণ্ডে ওরে মূর্খ! ভষ্ম হয়ে যাও।।”
দুরন্ত বালক যদি অস্ত্র হাতে পায়।
ভাল মন্দ দ্রব্য কত কেটে করে ক্ষয়।।
যাবৎ সু-ধার অস্ত্র তার হাতে থাকে।
তাবৎ অনিষ্ট করে চক্ষের পলকে।।
বলবান কেহ যবে অস্ত্র কাড়ি লয়।
দুরন্ত দুর্ব্বল সাজে কথা নাহি কয়।।
সেই নারী সে প্রকার সাধনা-প্রভাবে।
কিছু শক্তি লাভ করি মরিল গৌরবে।।
ক্ৰোধ-বাণে শক্তি তার ক্রমে হল ক্ষয়।
অভিশাপে বক হেথা পড়িল ধরায়।।
হেথা সতী নিজ গৃহে বসিয়া দেখিল।
দিদির কোপেতে তার বক মৃত হ’ল।।
“এতই কঠিন প্রাণ দিদি গো তোমার’।
বলে দেবী পুনঃরায় করে হাহাকার।।
উদ্দেশ্যে দিদির প্রতি বলিছে বচন।
“ধৰ্মনীতি দিদি তুমি না জান কখন।।
“দয়া বিনা ধৰ্ম নাই” মহাজন বাক্য।
তব প্রাণে তাহা কভু নাহি হ’ল ঐক্য।।
মহারাজ যুধিষ্ঠির ধৰ্ম অবতার।
যে বাক্য কহিল তেঁহ দ্রৌপদী গোচর।।
ক্রোধে পাপ ক্রোধে তাপ ক্রোধে কুলক্ষয়।
ক্রোধে বুদ্ধিভ্রংশ ইথে নাহিক সংশয়।।
ক্রোধ রিপু বসে দিদি যে কাজ করিলে।
স্বখাত-সলিলে তুমি ডুবিয়া মরিলে।।
“ক্রোধস্তু সাশ্রয়দ্রোহী তং শ্রেয়োহসী পরিত্যজেৎ”
—বৃহদ্ধৰ্মপুরাণম্
এতকাল সাধনাতে পেয়েছিলে যাহা।
‘কাগাবগা’ খুন করে শেষ হল তাহা।।”
এতেক বলিয়া দেবী নীরব হইল।
আরোপেতে স্বামী-ধ্যানে ডুবিয়া রহিল।।
দেখে দেবী আরোপেতে স্বামী কৰ্মরত।
গাত্রে তার ঘৰ্মরাশি ঝরে অবিরত।।
দারুণ নিদাঘ – তাপে তাপিত শরীর।
শুষ্ক – কণ্ঠ পিপাসায় বড়ই অস্থির।।
এহেন দেখিয়া দেবী ব্যথা পায় প্রাণে।
প্রাণে প্রাণে স্বামী-ধনে গৃহ পানে টানে।।
সতীর চিন্তনে পতি থাকিতে না পারে।
কৰ্ম ছাড়ি গৃহ পানে চলে ধীরে ধীরে।।
ক্ষণ পরে গৃহ দ্বারে উপনীত হ’ল।
দেখে পত্নী দাঁড়াইয়া আঁখি ছল ছল।।
সযত্নে পতিরে দেবী বসা’ল আসনে।
পদ ধৌত করিবারে শুদ্ধ-বারি আনে।।
যতনে পতির পদ সে-জলে ধোয়ায়।
আপন অঞ্চলে পদ যতনে মুছায়।।
তালপত্র-পাখা আনে করিতে ব্যজন।
হেন কালে দিদি তার করে আগমন।।
বহিৰ্দ্ধারে থাকি দিদি সংবাদ পাঠায়।
নিজ আগমন বার্ত্তা প্রকারে জানায়।।
মনে ভাবে ভগ্নী আসি স্বামী সমিভ্যারে।
অবশ্য লইবে তারে সমাদর করে।।
নিজ শক্তি দেখাইয়া লাগাবে চমক।
ঠিক যেন যাদুকরে ভুলায় বালক।।
কল্পনা করিয়া তেহ হাসে মনে মন।
মনে ভাবে ‘আমি ভবে শ্রেষ্ঠ এক জন’।।
কঠোর সাধনা বলে লভেছি শকতি।।
বিশ্ববাসী সবে মোরে করিবে ভকতি।।
এ সব চিন্তায় তার পুলকিত অঙ্গ।
মুহুৰ্ত্তে সকল ভাব হল তার ভঙ্গ।।
যে জন সংবাদ লয়ে গৃহ মধ্যে যায়।
সেই ফিরি আসি তবে বলিছে তাহায়।।
“শোন সন্ন্যাসিনী! তুমি আমার বচন।
তোমার সংবাদ আমি বলেছি এখন।।
তব ভগ্নী শুনিয়াছে তব আগমন।
কিন্তু অন্য কার্যে তিনি নিযুক্ত এখন।।
স্বামীর সেবাতে তেঁহ আছে তাঁর পাশে।
জুড়াতে স্বামীর অঙ্গ পাখার বাতাসে।।
তব কাছে আসিবারে সম্ভব না হবে।
আপনি চলুন সেথা আত্মীয়তা-ভাবে।।
নিজ মুখে ভগ্নী তব এ সব কহিল।
তোমাকে লইতে সাথে আমাকে পাঠা’ল।।
কথা শুনি সন্ন্যাসিনী ক্রোধে হতবাক।
মনে ভাবে ‘বোন’ হ’য়ে এতই দেমাক্”।।
আপন ভগিনী তাই এবে দিনু ক্ষমা।
দেখা যাক কোথা তার অহঙ্কারে সীমা।।
এক দুই তিন বারে ক্ষমিব তাহারে।
পুনঃ দোষ পেলে রক্ষা নাহিক সংসারে।।
এত ভাবি ক্ষুদ্ধ মনে গৃহ মধ্যে যায়।
কিন্তু সন্ন্যাসিনী মনে মানিল বিস্ময়।।
যেইমাত্র প্রাঙ্গণেতে পদ পড়ে তার।
প্রাণ যেন শূন্য হয়ে করে হাহাকার।।
কি যেন পরম ধন হারাইয়া গেল।
কি যেন হারায়ে প্রাণ চঞ্চল হইল।।
ইতি উতি করি ক্রমে গৃহ পানে যায়।
দেখে ভগ্নী মগ্ন আছে স্বামীর সেবায়।।
অকস্মাৎ ক্রোধ তার জুলিয়া উঠিল।
ডাক দিয়া ভগিনীরে কহিতে লাগিল।।
ওরে ছন্নমতি। তুই কি মোহে মাতিয়া?
আমাকে অবজ্ঞা করি আছিস বসিয়া?
কি আর বলিব তোরে শুধু নিজ-ভগ্নী।
তাই কষ্টে রাখি চেপে মোর ক্রোধ-অগ্নি।।
যদ্যপি অপর কেহ করিত এমন।”
এই কথা বলা মাত্র কি হ’ল তখন।।
হস্ত তুলি ভগ্নী তারে নিষেধ করিল।
স্তব্ধ হ’য়ে সন্ন্যাসিনী চাহিয়া রহিল।।
কে যেন জিহবার শক্তি করিল হরণ।
কোন কথা করিবারে নারে উচ্চারণ।।
বিস্ময়ে চাহিয়া রহে ভগিনীর দিকে।
স্বর্গ জ্যোতিঃ ফুটে যেন ভগিনীর মুখে।।
তবে সেই দেবী-ভগ্নী হাসি হাসি কয়।
“অকারণে রোষ দিদি করোনা আমায়।।
ক্রোধে যদি অগ্নি বল অগ্নির কি গুণ ?
দগ্ধ কার্যে অগ্নি দেখ বড়ই নিপুণ।।
নিজ’ পর বলি অগ্নি চিনে না কাহারে।
যারে পায় তারে খায় নিত্য নির্ব্বিকারে।।
আর দেখ ছাই রাখে আগুনে চাপিয়া।
কিন্তু অগ্নি নাহি থাকে চুপটি করিয়া।।
ধীরে ধীরে ভষ্মরাশি ভেদ করি উঠে।
ভষ্মে খেয়ে অগ্নি পরে চারিদিকে ছুটে।।
যে-জন আগুনে চাপে অগ্নি তারে খায়।
তাই বলি “দিদি! অগ্নি-চাপা ভাল নয়।।
আপন ভগিনী বলি করিয়াছ ক্ষমা।
কিন্তু নিজে কত পাপ করিয়াছ জমা।।
কি ভয় দেখাও দিদি ছোট ভগিনীরে।
আমি নই ‘কাগা’ ‘বগা’ বিলের ভিতরে।।
মুণ্ড কাট ভষ্ম কর আপন গৌরবে।
মনে বলে তব শাস্তি অনন্ত রৌরবে।।
তত্ত্ব নাহি জানি যেবা করে দোষ-কৰ্ম।
ক্ষমা পেলে পেতে পারে যদি রাখে ধৰ্ম।।
কিন্তু তত্ত্ব জানি যেবা ধৰ্ম নাহি পালে’।
তাহার উদ্ধার নাহি হবে কোন কালে।।
আমরা গৃহস্থ জন পদে পদে দোষী।
সেই চিন্তা মোরা সবে করি দিবানিশি।।
সংসার ছাড়িয়া যারা ধৰ্ম্মের কারণে।
সব ছাড়ি চলে যায় গহন কাননে।।
তারা যদি মূঢ়-সম করে দোষ-কৰ্ম।
কিসে ঠিক থাকে তার সন্ন্যাসের ধৰ্ম ?
ক্ষুদ্র জীব ‘কাগা’ ‘বগা’ বিবেক-বিহীন।
তার প্রতি ক্রোধ করে কোন অর্ব্বাচীন ?
বিশেষতঃ ইন্দ্রিয়াদি সংযম কারণে।
লয়েছ সন্ন্যাস ব্রত প্রথম জীবনে।।
এত কষ্ট সহি যাহা কর উপাৰ্জ্জন।
‘কাগা’ ‘বগা’ খুন করে হারালে এখন।।
অধিক তোমাকে দিদি কি আর বলিব।
ধৰ্ম-কৰ্ম-সব-বৃথা না গেলে স্বভাব।।”
এতেক বলিয়া দেবী মৌন হয়ে রয়।
সন্ন্যাসিনী হত-তেজ পড়িল ধরায়।।
কান্দিয়া কান্দিয়া কহে ভগিনীর প্রতি।
“ভগ্নী নহ দিদি তুমি মহামান্যা সতী।।
তোমারে দেখিয়া ধন্য হইল জীবন।
তোমাকে গুরুত্বে আমি করিনু বরণ।।”
এই ভাবে সন্ন্যাসিনী সংশোধন হ’ল।
বল মীড কোন গুণে এসব ঘটিল।।
মীড কহে “বড় কৰ্ত্তা! শুন মোর কথা।
ধৰ্ম-গ্রন্থ মাত্রে লিখে কত উপকথা।।
সে-সব শিক্ষার লাগি করয় রচন।
প্রত্যক্ষে এসব নাহি ঘটে কদাচন।।”
মীডের সন্দেহ দেখি প্ৰভু ডেকে কয়।
“প্রত্যক্ষ ঘটনা এবে শুন মহাশয়।।
মম পিতা হরিচাঁদ আছিলেন যিনি।
শুন এবে কোন কার্য করিলেন তিনি।।
অধিক দিনের কথা নহে এই সব।
শুনহে প্রত্যক্ষ শক্তি অতুল বিভব।।
যুধিষ্ঠির-রঙ্গ নামে ভক্ত এক জন।
একদা পিতার ঠাঁই করে নিবেদন।।
“পরম দয়াল হরি! কৃপা নেত্ৰে চাহ।
অভাগার পানে চাহি দু’টি কথা কহ।।
বড় ইচছা হইয়াছে যাইব বাদায়।
আনিয়া বাদার গাছ লাগা’ব নৌকায়।।
তব আজ্ঞা বিনে বনে যেতে শঙ্কা করি।
অনুমতি কর তুমি দয়াময় হরি।।”
পিতা বলে ‘যুধিষ্ঠির! কোন ভয় নাই।
করগে বাদার কাজ স্মরিয়া গোঁসাই।।
যুধিষ্ঠির বলে ‘হরি আর কে গোঁসাই।
জগত-গোঁসাই তুমি ক্ষীরোদের সাঞী।।
তোমার নামের বলে জলে ভাসে শীলা।
তোমার নামেতে শিব জপে জপ মালা।।
স্মরিয়া তোমার নাম চলিনু বাদায়।
করহে দয়াল প্রভু যাহা ইচ্ছা হয়।।”
এতেক বলিয়া তবে ভক্ত যুধিষ্ঠির।
প্ৰণিপাত করি চলে চক্ষে বহে নীর।।
গৃহে আসি লোক জুটি উঠিল নৌকায়।
“জয় হরিচাঁদ” বলি বাদা-প্রতি ধায়।।
কাজ করে যুধিষ্ঠির স্মরে হরিচান্দে।
সন্ধ্যাকালে নায় বসি হরি বলে কান্দে।।
কাজ প্রায় শেষ হ’ল এ হেন সময়।
শুনহে ডক্টর মীড! কি ঘটে তথায়।।
একদা প্রভাত কালে একা যুধিষ্ঠির।
একা ছুটে চলে যেথা অরণ্য গভীর।।
কিছু দূর গিয়ে তেহ শুনে এক শব্দ।
শব্দ শুনি যুধিষ্ঠির দাঁড়াইল স্তব্ধ।।
হেনকালে যমদূত-সম বিভীষণ।
প্রচণ্ড দুরক্ত ব্যাঘ্ৰ দিল দরশন।।
ব্যাঘ্ৰ দেখি যুধিষ্ঠিরে না সরে বচন।
মনে ভাবে এর হাতে নিশ্চয় মরণ।।
কে মোরে রক্ষিবে আজ কাল-দূত হতে?
নিশ্চয় পড়িনু মারা আসিয়া বাদাতে।।
কি ফল ভারিয়া আর –কোন রক্ষা নাই।
মৃত্যু-পূৰ্ব্বে প্রাণ ভরে হরি গুণ গাই।।
পরম দয়াল হরি হরিচাঁদ মোর।
তাঁরে ডাকি দেখা যদি দেয় মনোচোর।।
সে-বিনে নাহি রে বন্ধু এ-বিপদ কালে।
তাঁরে ডাকি দয়া যদি করে দুঃখী বলে।।
এত ভাবি যুধিষ্ঠির কেন্দে কেন্দে কয়।
“কোথা র’লে হরিচাঁদ প্রভু দয়াময়।।
তব আজ্ঞা মতে বাবা আসিয়া বাদায়।
তুমি বলেছিলে বাবা নাহি কোন ভয়।।
তব বাক্য মিথ্যা নহে আমি অভাজন।
মম-কৰ্ম-দোষে বাক্য হইল লঙ্ঘন।।
শত অপরাধী পিতা আছি রাঙ্গা পায়।
দয়া করি কর রক্ষা যদি ইচছা হয়।।
জীবনে মরণে কৰ্ত্তা তুমি বিশ্ব-পতি।
ডুবা’লে ডুবাতে পার যাহা হয় মতি।।
মরিতে আমার প্রাণে কোন শঙ্কা নাই।
মরি বাঁচি সদা যেন তব নাম গাই।।
“হরিচাঁদ, হরিচাঁদ, হরিচাঁদ’ বলে’।
ভূমিতলে যুধিষ্ঠির পড়িলেন ঢলে।।
এবে শুন ওড়াকান্দী কোন কাণ্ড হয়।
কোন কার্য করে সেথা হরি রসময়।।
যেই মাত্র যুধিষ্ঠির ‘হরিচাঁদ’ কয়।
পিতা তবে ডাকিলেন আমার মাতায়।।
বলে “শুন শান্তি দেবী আমার বচন।
শীঘ্ৰ করি ধামা এক কর আনয়ন।।
বড়ই বিপদে আছে ভক্ত যুধিষ্ঠির।
তার লাগি প্রাণ মোর বড়ই অস্থির”।।
পিতৃ আজ্ঞা শুনি মাতা ধাইয়া চলিল।
বড় এক ধামা আনি তাঁর হস্তে দিল।।
উপুড় করিয়া ধামা চাপা দিয়া রাখে।
‘ভয় নাই যুধিষ্ঠির’ বলে পিতা ডাকে।।
ওদিকে মাটিতে পড়ি শুনে যুধিষ্ঠির।
“ভয় নাই ভয় নাই” রব সুগম্ভীর।।
মস্তক তুলিয়া তাই চাহিয়া দেখিল।
অত্যাশ্চর্য কাণ্ড দেখি বিস্মিত হইল।।
চেয়ে দেখে যুধিষ্ঠির আঁধারের রেখা।
অরণ্য বেড়িয়া শেষে ব্যাঘ্ৰে দিল ঢাকা।।
আঁধারের আস্তরণ চক্ষের পলকে।
বিপদে টানিয়া নিল আলোর ঝলকে।।
সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়ে ভাবে যুধিষ্ঠির।
প্রেমে পুলকিত তনু চক্ষে’ প্রেম নীর।।
কেন্দে বলে ‘এই কার্য হরিচাঁদ-বিনা।
অন্য কেহ ত্রিভুবনে করিতে পারে না।।
নিশ্চয় দয়াল হরি করিয়াছে রক্ষা।
অপরাধ ভঞ্জনার্থে দিল এই শিক্ষা’।।
অতঃপর নৌকা ছাড়ি দেশ পানে ছুটে।
হরিচাঁদ রূপ সদা চিত্তে তার ফুটে।।
তার মাতা পুত্র লাগি বহু চিন্তা করে’।
উপনীত ওড়াকান্দী শ্ৰীহরি গোচরে।।
পদে পড়ি সেই বুড়ী কান্দি কান্দি কয়।
‘বল প্ৰভু দয়া করি কি হবে উপায় ?
যদাবধি যুধিষ্ঠির গিয়াছে বাদায়।
তার লাগি চিন্তা করি প্রাণ কান্দে হায়।।
কতদিন গত হ’ল তবু নাহি ফিরে।
প্রাণ মোর ওঠে কেন্দে নাহি থাকে ঘরে।।
তোমার আজ্ঞায় সে ত গিয়াছে বাদায়।
কোন ভাবে যুধিষ্ঠিরে রেখেছ কোথায়?”
বুড়ীর বিনয় শুনি পিতা তারে কয়।
“ঘরে যাও বুড়ী তুমি নাহি কোন ভয়।।
আমাকে হৃদয় মধ্যে রাখে যুধিষ্ঠির।
সদা তারে ঘিরে রাখে অভয়-প্রাচীর।।
বন মধ্যে একদিন ব্যাঘ্র এসেছিল।
ভয় পেয়ে যুধিষ্ঠির আমাকে ডাকিল।।
ভক্তে রক্ষিবারে আমি করি আয়োজন।
ধামা দিয়া ব্যাঘ্র আমি ঢেকেছি তখন।।
অই দেখ অইখানে ধামার ঢাকনি।
ব্যাঘ্র-বদ্ধ আছে তথা দিবস রজনী।।
যেই ক্ষণে যুধিষ্ঠির বন ছাড়ি আসে।
আমি ছাড়ি দিব ব্যাঘ্র যেতে নিজ বাসে।।
অদ্য যুধিষ্ঠির দেখি নৌকা ছেড়ে দিল।
ভয় নাই ঢাকা-ব্যাঘ্ৰ দেখিবে ত চল।।
প্রভুর বচনে বুড়ী সাহসী হইয়া।
ব্যাঘ্ৰ দেখিবারে চলে প্ৰভু সঙ্গ নিয়া।।
প্রভু বলে “বুড়ী তুমি মোর কথা লও।
ব্যাঘ্ৰ যদি দেখ তবে ঢাকনি উঠাও”।।
প্রভুর আজ্ঞায় বুড়ী ঢাকনি তুলিতে।
লাগিল ভীষণ ব্যাঘ্ৰ গৰ্জ্জন করিতে।।
ভয় পেয়ে বুড়ী পুনঃ ঢাকনি ছাড়িল।
প্রভু বলে “কি গো বুড়ী কথা সত্য হল?”
এই ব্যাঘ্ৰ যদি তুমি না দেখ নয়নে।
আমার বচন সত্য বুঝিতে কেমনে?
থাক এবে যুধিষ্ঠির ছেড়েছে জঙ্গল।
ঈশ্বরের ইচছা ক্রমে হউক মঙ্গল।।
এবে কেন ব্যাঘ্র আর রাখি দিয়ে ঢাকা।
বন্য-পশু কত কাল যায় আর রাখা ?
এত বলি পিতা মোর ঢাকনি উঠায়।
সকলে দেখিল এক মূষিক দৌড়ায়।।
পুনরায় পড়ে দায় সেই যুধিষ্ঠির।
বিষম ঝড়েতে পড়ে? তরণী অস্থির।।
পৰ্ব্বত-প্রমাণ-ঢেউ লাগিছে নৌকায়।
মনে হয় সেই দণ্ডে তরী ডুবে যায়।।
কেন্দে বলে যুধিষ্ঠির “দয়াল ঠাকুর।
এ ভাবে পরীক্ষা বাবা কর কত দূর।।
পরীক্ষা যোগ্য আমি নহি ত কখন।
আমি শুধু আছি বেঁচে দয়ার কারণ।।
কাঠের নৌকায় বসি দেখিতেছি কাণ্ড।
ঝড় আসে বারি ছোটে তরঙ্গ প্রচণ্ড।।
আমি বুঝি কাষ্ঠ-তরী পরে যাহা ঘটে।
সব সত্য হল আজি আমার ললাটে।।
অকুল-ভব-বারিধি দুঃখ-বারি-ভরা।
কাম ক্রোধ লোভ মোহ, তরঙ্গে তাহারা।।
দণ্ডে দণ্ডে সে-তরঙ্গে দেহ-তরী পড়ে।
দিশে-হারা মন মাঝি হাল নাহি ধরে।।
বারে বারে দেহ-তরী ডুবে যেতে চায়।
শুধু মাত্র বেঁচে থাকে তোমার কৃপায়।।
যেই কৃপা রক্ষা করে এ-দেহ তরণী।
কাষ্ঠ তরী রক্ষিবারে সেই পারে জানি।।
যাহা ইচ্ছা কর প্রভু তা’তে আমি রাজি।
ডোবা নায় জানি বাবা তুমি মাত্র মাঝি”।।
এত বলি কান্দাকান্দি করে যুধিষ্ঠির।
মাল্লা মাঝি সবে কান্দে বড়ই অস্থির।।
কত কাল এই ভাবে কাটিল সময়।
সকলে চাহিয়া দেখে জল নাহি নায়।।
সবে ভাবে কিআশ্চর্য জল কোথা গেল ?
কেবা এসে ডোবা নায় জল ফেলে দিল ?
এ দিকে শুনহে মীড আশ্চর্য বারতা।
ওড়াকান্দী বসে কিবা করিলেন পিতা।।
যেই কালে যুধিষ্ঠির নৌকা’ পরে কান্দে।
প্রাণ ভরে এক মনে ডাকে হরিচান্দে।।
সৰ্ব্বদশী পিতা মোর সকলি দেখিল।
পাত্র হস্তে পুকুরের জলেতে নামিল।।
ক্ষিপ্র-হস্তে পুকুরের জল ফেলে কুলে।
তাহা দেখি হীরামন যায় সেই স্থলে।।
পিতার পরম ভক্ত ছিল হীরামন।
তাঁর পদে দেহ-মন সব সমর্পণ।।
মহা বলবান সাধু নামিলেন জলে।
পিতৃ হস্ত হ’তে পাত্র নিল কুতূহলে।।
জল ফেলে অবহেলে ভীমসেন প্রায়।
কুলে উঠি পিতা মোর দাঁড়াইয়া রয়।।
কিছু কাল জল-ফেলা যখনে হইল।
‘থাক’ ‘থাক’ বলি পিতা নিষেধ করিল।।
কূলে উঠি হীরামন হরিচাঁদে কয়।
‘যুধিষ্ঠির রক্ষা পেল তোমার কৃপায়।।’
পিতা কন “হীরামন! এ মোর স্বভাব।
যেই ভাবে ভক্ত ভাবে মোর সেই ভাব।।
ভক্তেতে আমাতে তুমি জানিবে অভিন্ন।
ভক্ত মান্য হ’লে তাতে আমি হই মান্য।।
ভক্ত যা’তে সুখী হয় তাতে সুখী আমি।
ভক্ত মোরে জানে তাই আমি অস্তৰ্যামী।।
অধিক কি কব আমি ভক্তের জীবন।
যথা ভক্ত তথা আমি সত্য-নিরূপণ।।
“নাহং তিষ্ঠামি বৈকুষ্ঠে যোগিনাং হৃদয়ে নচ
মদ্ভক্তাঃ যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদঃ।
-শ্ৰীশ্ৰী হরিভক্তি বিলাস
ভক্তি ডোরে বান্ধে ভক্ত অচ্ছেদ্য-বন্ধনে।
সেই ডোরে টান দিলে থাকি বা কেমনে?
বৈকুষ্ঠে ক্ষীরোদ লক্ষ্মী পদ সেবে মোর।
তাহা হ’তে শান্তি দেয় ভকত-চকোর।।
অধিক কি বলি তুমি ভেবে দেখ মনে।
তোমাকে শাসিল ওঝা কিরূপ শাসনে।।
সেই সব ব্যথা আমি বুক পেতে লই।
ভক্ত যদি সুখে থাকে আমি সুখী হই”।।
পিতার মুখেতে শুনি এ হেন বচন।
ধূলায় পড়িয়া হীরা হ’ল অচেতন।।
পূৰ্ব্ব-স্মতি মনে পড়ি ব্যথা পেল মনে।
“বাবা” বলি তাই পড়ে বাবার চরণে।।
এবে শুন যুধিষ্ঠির বাড়ীতে আসিয়া।
নৌকা রাখি উপনীত ওড়াকান্দী গিয়া।।
সকলের মুখে সব বার্ত্তা শুনি গেল।
শ্ৰীহরি চরণে পড়ি কান্দিতে লাগিল।।
যে ভাবে রক্ষিল তারে হরি দয়াময়।
সব শুনে কেন্দে কেন্দে ধূলাতে গড়ায়।।
পিতা বলে “যুধিষ্ঠির! কান্দিস কি মিছে।
ভয় নাহি ঠাঁই পায় হরি-ভক্ত-কাছে।।
যার জীব সেই রক্ষা করিছে সদায়।
আমিত নিমিত্ত মাত্র আমার কি দায় ?
জলে পড়ি যদি কেহ ডুবে যেতে চায়।
থাকিলে নিকটে লোক ধরিয়া উঠায়।।
যে-জন উঠায় তারে — সে কি রক্ষাকৰ্ত্তা?
উপলক্ষ্য মাত্ৰ সবে-প্রভু হৰ্ত্তা-কৰ্ত্তা ? ‘
যুধিষ্ঠির বলে “প্ৰভু! ভাণ্ডিও না আর।
আমি জানি হৰ্ত্তা-কৰ্ত্তা তুমি সৰ্ব্বসার।।
লক্ষ্য উপলক্ষ্য আদি যাহা কিছু বল।
সকলের মূলে তুমি তুমি সৰ্ব্ব বল।।
তোমার চরণে প্রভু এই নিবেদন।
জন্মে জন্মে ও চরণে থাকে যেন মন।।”
এ ভাবে বিনয় করি যুধিষ্ঠির যায়।
‘বল মীড কোন গুণে এ সকল হয় ? ?
সমস্ত শুনিয়া তবে মীড বলে কথা।
“বড় কৰ্ত্তা শুন তুমি আমার বারতা।।
আমরা ইংরাজ জাতি যাহা কিছু দেখি।
তাহা মানি, অনুমান মনে করি ফাঁকি।।
প্রত্যক্ষ ঘটনা যদি দেখিবারে পাই।
সত্য বলে মানি তাহা ইথে ভুল নাই।।
মীডের বচনে প্রভু হাসিয়া তখন।
ইচ্ছিল মীডের সন্দ” করিতে খণ্ডন।।
ইচ্ছাময় ইচছা যদি করে নিজ মনে।
সকলি করিতে পারে মহানন্দ ভণে।।