-নূর মোহাম্মদ মিলু
বাদশাহ্ হারুনুর রশিদের ষোল বছর বয়সী পুত্র দুনিয়া বিমুখ দরবেশদের সুহবতে থাকতেই বেশি পছন্দ করতো। সে প্রায়ই কবরস্থানে গিয়ে মৃতদেরকে লক্ষ্য করে বলত, তোমরা আমাদের পূর্বে পৃথিবীতে ছিলে এবং এই পৃথিবীর মালিক ছিলে। এখন তোমরা কবরে শুয়ে আছ। হায়! যদি আমি জানতে পারতাম, তোমরা দুনিয়াতে কি করতে এবং লোকজন তোমাদের সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করত? সে এসব কথা বলত, আর ব্যাকুল হয়ে কাঁদত।
একদিনের ঘটনা। এই পুত্র তার পিতা হারুনুর রশিদের নিকট এলো। এ সময় বাদশাহর চতুর্দিকে উযীর-নাযীর ও মন্ত্রী পরিষদ সকলেই বসা ছিলেন। বাদশাহর পুত্রের শরীরে তখন কেবল একটি কম্বল। তার এই অবস্থায় দেখে বাদশাহর সভাপরিষদের কেউ কেউ আড়ালে বলতে লাগল, খলীফাতুল মুসলিমীনের এই পুত্রই হুজুরের বদনাম করবে। হুজুর যদি তাকে একটু শাসন করতেন তাহলে তার এই অবস্থার পরিবর্তন হতো। ধীরে ধীরে এই কথা হারুনুর রশিদের কানে এসে পৌঁছাল। বাদশাহরও এই পরামর্শ পছন্দ হলো। তিনি পুত্রকে বললেন, পুত্র আমার! তোমার এই চাল-চলন আমাকে অপমানিত করছে। পুত্র এই কথা শুনে পিতার দিকে কেবল তাকিয়ে রইলো, কোন কথা বলল না।
ঘটনাক্রমে সেইসময়ই একটি পাখি কেল্লার গম্বুজে বসা ছিল, বাদশাহ পুত্র ঐ পাখিটির প্রতি লক্ষ্য করে বলল, হে পাখি তোমার সৃষ্টিকর্তার কসম! তুমি আমার হাতে এসে বস। পাখি তাঁর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাতে এসে বসল। কিছুক্ষণ পর সে আবার বলল, তোমার স্থানে চলে যাও এবং তোমার সৃষ্টিকর্তার কসম! তুমি আমীরুল মুমিনের হাতে বসবে না। পাখিটি তার স্থানে গিয়ে বসল, আর উঠল না। শিশুটি তার এই ক্ষমতা, সভাপরিষদকে দেখিয়ে বাবাকে লক্ষ্য করে বলল, বাবা আপনি যখন আমাকে দুনিয়ার কারণে অপমানিত করলেন, তখন আমি সংকল্প করে নিয়েছি যে; আমি, আপনার থেকে পৃথক হয়ে যাব। এ কথা বলে সে কোন আসবাব পত্র ও পাথেয় ছাড়াই বেরিয়ে গেল। সঙ্গে শুধু একটি কোরআন শরীফ আর একটি আংটি ছিল।
এভাবে চলতে চলতে সে বসরা শহরে এসে থামল। ওখানকার মজদুরদের সাথে মাটি কাটার কাজ শুরু করল। সপ্তাহে একদিন এক দেরহাম ও এক দেরহামের ষষ্ঠাংশের বিনিময়ে কাজ করত আর সেই আয় অনুযায়ী ব্যয় করত। এভাবেই তার দিন চলতে লাগলো।
হযরত আবু আমের বসরী (রা:) বলেন, আমার ঘরের একটি দেয়াল ধ্বসে গেলে আমি মেরামত করার জন্য মজদুরের তালাশে বের হয়ে দেখলাম, মজদুরদের মধ্যে খুব সুন্দর একটি ছেলে বসে আছে। আমি এমন সুন্দর ছেলে ইতিপূর্বে আর কখনও দেখিনি। তার সামনে একটি বস্তা ছিল, আর সে কোরআন তিলাওয়াত করছিল। আমি তাকে বললাম, এই ছেলে, কাজ করবে? সে বলল, হ্যাঁ। আমরা তো কাজের জন্যই সৃষ্টি হয়েছি। তবে কাজটা কোন ধরনের? আমি বললাম, মাটির কাজ। সে বলল, উত্তম কাজ। তবে আমাকে এক দেরহাম ও এক দেরহামের ষষ্ঠাংশ দিতে হবে এবং নামাযের সময় নামায পড়ার সময় দিতে হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে। আমি তাকে নিয়ে এসে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলাম। মাগরিবের সময় এসে দেখি, সে একাই দশজনের মতো কাজ করেছে। আমি তাকে তার দাবীকৃত মজুরীর চেয়ে দুই দেরহাম বেশি দিতে চাইলাম। সে বলল, হে আবু আমের! আমি এই দুই দেরহাম নিয়ে কি করব? সে তা নিতে অস্বীকার করল। অবশেষে আমি তাকে এক দেরহাম ও এক দেরহামের ষষ্ঠাংশ দিয়ে বিদায় করলাম।
দ্বিতীয় দিন আমি সকালে বাজারে গেলাম, কিন্তু সবদিকে খোঁজ নিয়ে তাকে আর পেলাম না। আমি লোকদের কাছে তার বিবরণ দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সেই ছেলেটি কোথায় গেছে? তারা বলল, সে সপ্তাহে শুধু একদিনবা মজদুরী করে। আপনি তাকে বাজারের দিন দেখতে পাবেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, কাজ আপাতত স্থগিত রাখব যখন সে আসবে তখন তাকে দিয়েই অবশিষ্ট কাজ করাব। অতঃপর যখন বাজারের দিন এলো, আমি তাকে অনুসন্ধান করার জন্য বাজারে গেলাম। গিয়ে দেখি, সে বসে আছে। আমি তাকে সালাম করে কাজের কথা বললাম, সে পূর্বের মতো আমার সঙ্গে শর্ত করল। আমি তার শর্ত গ্রহণ করে তাকে নিয়ে এলাম এবং তাকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে দূরে বসে দেখলে লাগলাম, সে কিভাবে একা দ্রুত কাজ করে। আমি এমন স্থানে বসলাম, যেন সে আমাকে দেখতে না পায়। আমি দেখলাম, সে হাতে পাথর নিয়ে দেয়ালে স্তুপ করে রাখছে, আর পাথরগুলো আপনা থেকেই লেগে যাচ্ছে। তখন আমি মনে মনে বললাম, নিশ্চয় সে কোন আল্লাহ্ওয়ালা হবে। তাই আল্লাহ্ তার কাজে সাহায্য করছেন। সন্ধ্যার সময় যখন সে ফিরে যেতে চইল তখন আমি তাকে তিন দের হাম দিতে চাইলাম। সে নিতে অস্বীকার করল এবং এক দেরহাম ও এক দেরহামের ষষ্ঠাংশ নিল।
তুমি নিজ হাতে আমীরুল মুমিনীনকে এগুলো দিবে এবং বলবে, আমার নিকট অপনার একটি আমানত আছে, এক মুসাফির বালক তা আমাকে দিয়েছে। আমীরুল মুমিনীনকে এটাও বলবে যে, আপনি হুসিয়ার থাকুন, এই গাফলতী এবং প্রতারণার মাঝেই যেন আপনার মৃত্যু না এসে যায়। বালক কথা বলছিল এমন সময় হঠাৎ তার প্রাণপাখি বের হয়ে গেল। সে মৃত্যুবরণ করল।
তিন দিন পর আমি বাজারে এসে তাঁর খোঁজ নিলাম, কিন্তু তাঁকে পেলাম না। লোকজন বলল, সে এক নির্জন স্থানে তিন দিন যাবৎ অসুস্থ হয়ে পরে আছে। তার অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। আমি সেই ব্যক্তিকে সামান্য কিছু বকশিস দিয়ে বললাম, ভাই আমাকে তার কাছে নিয়ে চল। সে আমাকে এক নির্জন স্থানে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি, ওখানে ঘর-দুয়ার কিছুই নেই । সে নিঃস্ব-অসহায়ের মতো বেহুঁশ হয়ে পরে আছে। আমি তাকে সালাম দিলাম। সে আমাকে দেখে মাথা তুললো। দেখলাম, তার মাথার নিচে একটি ইটের টুকরা রাখা আছে। সে মৃত্যৃর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। আমি দ্বিতীয়বার তাকে সালাম দিলাম। সে চোখ খুলে আমাকে চিনতে পারল। আমি তার মাথা আমার কোলে রাখলাম। সে আমাকে এমন করতে নিষেধ করল এবং একটি কবিতা পড়তে লাগলো –
“বন্ধু আমার! স্বচ্ছল জীবন যেন তোমায় ধোঁকা না দেয়। এই জীবন একদিন শেয় হয়ে যাবে এবং এই আরাম-আয়েশ একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। যখন তুমি কোন জানাযা কবরস্থানে নিযে যাবে, তখন থেকে মনে রেখো এরপর তোমাকে ও একদিন কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে।”
অতঃপর সে বলল, হে আবু আমের! আমার প্রাণ-পাখি যখন এই দেহপিঞ্জর থেকে উড়ে যাবে তখন তুমি আমাকে গোসল দিবে এবং আমার পরিহিত কাপড়েই আমাকে কাফন পরাবে।
আমি বললাম, কেন তোমাকে নতুন কাপড়ে কাফন পরাব না? সে বলল, মৃত ব্যক্তির তুলনায় জীবিত ব্যক্তিই নতুন কাপড়ের অধিক হকদার।
আমার গোটা জীবনটাইতো এভাবে কাটিয়ে দিলাম। এখন নতুন কাপড় হলেও তা মাটি হয়ে যাবে, কিন্তু যা অবশিষ্ট থাকবে, তা হলো নেক আমল। আমার এই বস্তা এবং লুঙ্গী কবর খননকারীকে দেবে। আর এই কোরআন শরীফ এবং আংটি আমীরুল মুমিনীন হারুনুর রশিদের নিকট পৌঁছে দিবে। তুমি নিজ হাতে আমীরুল মুমিনীনকে এগুলো দিবে এবং বলবে, আমার নিকট অপনার একটি আমানত আছে, এক মুসাফির বালক তা আমাকে দিয়েছে। আমীরুল মুমিনীনকে এটাও বলবে যে, আপনি হুসিয়ার থাকুন, এই গাফলতী এবং প্রতারণার মাঝেই যেন আপনার মৃত্যু না এসে যায়। বালক কথা বলছিল এমন সময় হঠাৎ তার প্রাণপাখি বের হয়ে গেল। সে মৃত্যুবরণ করল।
তার মৃত্যুর পর আমি জানতে পারলাম যে সে খলীফার কলিজার টুকরো পুত্র। আমি তাঁর সকল ওসিয়ত পূণ্য করলাম এবং কোরআন শরীফ ও আংটি নিয়ে বাগদাদ আসলাম। বাগদাদ এসে আমি খলীফার মহলের দিকে রওনা হলাম। পথিমধ্যে একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে দেখলাম, প্রায় এক হাজার সেনার একটি দল এগিয়ে আসছে। তাদের পেছনে আরো দশটি দল আসছিল । প্রত্যেক দলে অন্তত এক হাজার করে সৈন্য। দশ নম্বর দলটিতে আমীরুল মুমিনীন হারুনুর রশিদ ছিলেন। আমি চিৎকার করে কললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলের নৈকট্যের কসম! আমার কথা একটু শুনুন। আমীরুল মুমিনীন আমার কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি তাঁর নিকটে গিয়ে সেই কোনআন শরীফ ও আংটিটি তাঁকে দিলাম এবং তাঁর পুত্র আমাকে যা বলতে বলেছিল আমি সবকিছু বললাম। আমীরুল মুমিনীন আমার কথা শুনে সামান্য সময় মাথা নিচু করে রাখলেন এবং কাঁদলেন। অতঃপর খাদেমকে বললেন, এই লোককে তোমার কাছে রাখ, যখন আমি খোঁজ করব তখন আমার সামনে নিয়ে আসবে। অতঃপর বাদশাহ্ শাহীমহলে ফিরে এসে খাসকামরায় বসে প্রহরীকে ডেকে বললেন, সেই লোককে নিয়ে এসো। প্রহরী আমার কাছে এসে বলল, হে আবু আমের! আমীরুল মুমিনীন খুবই চিন্তিত, তোমার যদি একান্তই তাঁর সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হয়, তাহলে দশটার জায়গায় পাঁচটা কথা বলবে। আমি বললাম, ঠিক আছে। আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম।
আমীরুল মুমিনীন আমাকে বললেন, হে আবু আমের! আমার কাছে এসে বাসো। আমি তাঁর নিকটে গিয়ে বসলাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি আমার পুত্রকে চিনতে? সে কি কাজ করত? আমি বললাম, সে রাজমিস্ত্রির কাজ করত। অতঃপর বললেন, তুমিও কি তার দ্বারা এই কাজ নিয়েছ? আমি বললাম, হ্যাঁ, নিয়েছি। তিনি বললেন, তাঁর দ্বারা এমন কাজ নিতে কি তোমার লজ্জা হলো না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আত্বীয়তার প্রতিও তুমি সম্মান প্রদর্শন করলে না? আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! আমাকে ক্ষমা করুন, আমি সে সময় তাঁর পরিচয় জানতে পারিনি। তাঁর মৃত্যুর পর আমি জানতে পরি যে, তিনি খলীফাতুল মুসলিমীনের প্রাণপ্রিয় পুত্র। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি কি তাঁকে নিজ হাতে গোসল দিয়েছ? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি নিজ হাতে তাকে গোসল দিয়েছি। তিনি বললেন, তোমার হাত দু’টো একটু বাড়াও। এ কথা বলে তিনি আমার হাত দু’টি নিয়ে তাঁর বুকের উপর রাখলেন এবং অঝোর ধারায় কাঁদলেন। অতঃপর বললেন, তুমি কিভাবে এই নিঃস্ব, অসহায়কে কাফন পরিয়েছ এবং কিভাবে তার উপর মাটি দিতে সাহস করেছ? এ কথা বলে তিনি খুবই বেদনাদায়ক একটি কবিতা পাঠ করলেন এবং বসরা পৌঁছে আপন পুত্রের কবরের সামনে দাঁড়ালেন। তিনি যখন কবর দেখলেন তখন বেহুঁশ হয়ে গেলেন। পরে হুঁশ ফিরে এল তিনি কয়েকটি দুঃখের করিতা পাঠ করলেন। সে সময় উপস্থিত সকলেই আমীরুল মুমিনীনের দুঃখ দেখে কাঁদতে লাগলেন।
হযরত আবু আমের বলেন, সেই রাতে আমি আমার ওযীফা আদায় করে শুয়ে পড়লাম। স্বপ্নে দেখি, একটি নূরের গম্বুজ। তার উপর নূরের আবরণ। হঠাৎ আবরণ সরে গেল এবং হারুনুর রশিদের সেই পুত্র ঐ গম্বুজ থেকে বের হয়ে এসে আমাকে বলল, হে আবু আমের! আল্লাহ তাআলা তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। তুমি যথাযথভাবে আমার ওসিয়ত পূর্ণ করেছ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বাছা! তোমার অবস্থা কেমন, আর তোমার ঠিকানা কোথায় হয়েছে? সে বলল, আমি আমার অতিশয় দয়ালু ও মেহেরবান পরওয়ারদিগারের নিকট আছি। তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট আছেন। তিনি আমাকে এমন এমন নেয়ামত দান করেছেন যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শুনেনি, এমনকি কারো অন্তরে ও সে সবের কল্পনা উদিত হয়নি। আল্লাহ তাআলা আমাকে লক্ষ্য করে কসম খেয়ে বলেছেন, যে বান্দাই দুনিয়ার নাপাকি হতে তোমার মতো বের হয়ে আসবে, তাকেই আমি এইসব নেয়ামত দান করব।
অতঃপর যখন আমার ঘুম ভাঙ্গলো তখন তার সুসংবাদের কারণে আমার মনে এক ধরণের প্রশান্তি অনুভূত হলো।