…যে ব্যক্তির সহিত অন্য ব্যক্তির জন্মের পারিপার্শ্বিক ও পারিবারিক অবস্থার তারতম্যই সূচীত করে যে পূর্ব-জন্মের কর্মফল অনুযায়ী ঐরূপ হইয়াছে। দ্বিতীয়ত, দেখা য়ায় যে কাহারও ভিতর কাম এবং কাহারও মধ্যে ক্রোধের সংস্কার বিদ্যমান। ইহার কারণ পূর্বে নিশ্চিয় সে এইরূপ কার্য করিয়া থাকিবে অর্থাৎ তাহার পূর্বে জন্ম হইয়াছিল। আবার একই মায়ের দুই সন্তানের মধ্যে অনেক বিষয়ে পার্থক্য দেখিতে পাওয়া যায়। উহাদের পিতা-মাতা একই, ভোজন একই প্রকার; অথচ দুইজনের সংস্কার, স্বভাব ভাগ্য তথা পুরুষার্থের মধ্যে পার্থক্য হইয়া থাকে। ইহার কারণ স্বরূপ আপনাকে পূর্বজন্মের কর্ম ও সংস্কার মানিতেই হইবে। আপনি ইহাও দেখিবেন, কেহ হয়ত অল্প বয়সেই কোন বিদ্যা বা কলাতে অসাধারণ পারদর্শীতা দেখায়, আবার কেহ পিতা-মাতা এবং অধ্যাপকের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বে কিছুমাত্র উৎকর্ষ সাধন করিতে সক্ষম হয় না। কেহ প্রসিদ্ধ গায়ক হয়, কেহ শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে, আবার কেহ মূর্খ হইয়াও কুশল ব্যবসায়ী সিদ্ধ হইয়া থাকে। এই সকল হইতে স্পষ্ট প্রামাণিত হয় যে মানুষ পূর্ব জন্মে যে কার্য বা অভ্যাস করিয়া থাকে বর্তমান জন্মে তাহার সেই কার্য বা অভ্যাসের স্বাক্ষর পাওয়া যায়।
ইহা ছাড়া মানুষের মনে মুক্তি বা সুখ শান্তির ইচ্ছা অথবা মৃত্যু ভয় ইত্যাদি হইতে ইহাই সিদ্ধ হয় যে আত্মা নিশ্চয়ই পূর্বের কোন না কোন জন্মে সম্পূর্ণ সুখ-শান্তি অনুভব করিয়া থাকিবে অথবা পূর্বের জন্মে মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করিয়া থাকিবে, বহুবার দু:খ ভোগ করিবার ফলে এখন সে মুক্তি চাহিতেছে। এই সমস্ত হইতে ইহাই প্রমানিত হয় পূনর্জন্ম আছে। শিশু জন্মাইবার পর বিনা শিক্ষাতেই স্তন্যপান করে, ইহার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে সে পূর্বে জন্ম লইয়াছে এবং পূর্বাভ্যাস বা অভিজ্ঞতা তাহার আছে।
…কল্পান্তে মনুষ্যাত্মা একেবারে অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন হইয়া পরে, যাহা কবর দাখিলেরই সামিল। এইরূপ অবস্থায় পরমাত্মা সৃষ্টিতে অবতীর্ণ হইয়া ঈশ্বরীয় জ্ঞান দ্বারা সকল মনুষ্যাত্মাকে কবর হইতে উদ্ধার করেন অর্থাৎ অজ্ঞান নিদ্রা হইতে জাগরিত করেন এবং উহাদের পরমধামে লইয়া যায়। কিন্তু যাহারা ঈশ্বরীয় জ্ঞান শ্রবণ করিয়া পবিত্রতা ধারণ করে না- তাহাদিগকে শান্তিদানের মাধ্যমে কর্মফল মুক্ত করিয়া পরমধামে ফিরাইয়া লইয়া যান। লোক কবর দাখিলের প্রকৃত অর্থ না জানার জন্য এইরূপ মন্তব্য করে যে মনুষ্যাত্মা এইবারই জন্মগ্রহণ করে! ভাবিয়া দেখুন, মনুষ্যাত্মা যদি জন্ম পুনর্জন্ম না লয়, তবে জনসংখ্যা এত বৃদ্ধি পাইতেছে কেন? প্রতিদিন জংসং খ্যা বৃদ্ধির কারণ হইতেছে যে আগের আত্মাগুলি পুনর্জন্ম লইয়াই চলিয়াছে; আর প্রতিদিন নূতন নূতন আত্মা সৃষ্টিতে আগমন করিতেছে। চারিত্রিক উন্নতির জন্য পুনর্জন্ম মানা বিশেষ প্রয়োজন। কারণ এই জন্মের কর্মফল আগামী জন্মে ভোগ করিতে হইবে, এই ভয় যদি না থাকে তবে মানুষ নিজ কর্মের উৎকর্ষের প্রতি মনোযোগ না দিয়া অন্যর অনিষ্ট করিয়াও নিজে সুখি হইবার চেষ্টা করিবে; ইহাতে সংসারে উশৃঙ্খলতা বাড়িয়া যাইবে।
পুনর্জন্ম না মানিলে আপািন জানিতে পারিবেন না যে আত্মা অপবিত্রতা, দু:খ এবং অশান্তির বর্তমান অবস্থায় কেমন করিয়া পৌঁছিল। আত্মা প্রকৃতপক্ষে স্বধর্ম অনুযায়ী পবিত্র এবং শান্ত স্বরূপ, সেইজন্যই তাহার শান্তি লাভের ইচ্ছা হয়। ইহা সুস্পষ্ট যে কোন কারণবশত: উহা সেই পবিত্র এবং শান্ত অবস্থা হইতে বিচ্যুত হইয়া বর্তমান অবস্থায় উপনীত হইয়াছে। কাম-ক্রধাদি পাঁচ বিকার উহার উহার পতনের কারণ। এই সমস্ত কারণের মধ্যে দেহাভিমানই সর্বপ্রধান। অতএব এখন আপনার প্রকৃত স্বরূপকে জানিয়া পূর্বের পবিত্র ও শান্ত স্থিতি প্রাপ্ত করিবার অভ্যাস করুন।
ইহা বলিবার উদ্দেশ্য হইতেছে, দেহ বোধ ছাড়িয়া নিজেকে আত্মা নিশ্চয় করুন। এই দেহাভিমানের জন্যই মানুষের মধ্যে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহঙ্কার ইত্যাদি বিকার বর্তমান। লোকে বলে আমরা এইগুলি ত্যাগ করিতে ইচ্ছুক, কিন্তু ইহারা আমাদের ত্যাগ করিতে চাহে না। তাহারা এই বিকারকে ছাড়িবে কি করিয়া? ইহাদের মূল দেহাভিমান, যতদিন না তাহাকে ত্যাগ করিবে অর্থাৎ যতদিন স্বয়ং দেহের পরিবর্তে আত্মা নিশ্চয় না করিবে ততদিন এই বিকার কিছুতেই দূর হইবে না। যখন মানুষ কাহারও দেহকে দেখে, স্ত্রী-পুরুষ পার্থক্য বোধ করেও দৈহিক সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হয় তখনই তাহার মনে কামনার উৎপত্তি হয়। এই ধরনের মানুষ দৈহিক সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হয় তখনই তাহার তাহার মনে কামানার উৎপত্তি হয়। এই ধরনের মানুষ দৈহিক বয়স বিবেচনা করিয়া একজন অপরজন হইতে বড় বিবেচনায় ঐ ব্যক্তি বয়সে ছোট হাওয়াসত্ত্বেও তাহার কথা শুনিতেছে না, বোধে তাহার মনে ক্রোধের সঞ্চার করে। এইরূপ নিকট দৈহিক সম্পর্কযুক্তগণ যেমন স্ত্রী, পুত্র ইত্যাদি মনে মোহভাব আনিয়া দেয় এবং তাহাদের জন্য লোভের বশীভূত হইতে হয়। এই দেহাভিমান মানুষকে অত্যন্ত দু:খী করিয়াছে। মানুষ ইহার হাত হইতে রক্ষা পাইতেছে না, কারণ সে নিজেকে আত্মা নিশ্চয় করিতে পারিতেছে না। এই দেহাভিমানকে অতিক্রম করিবার উপায় বা পথ হইতেছে যে কোন ব্যক্তির দেহকে না দেখিয়া তাহার ভ্রূকুটি মধ্যস্থ আত্মাকে দেখিবার অভ্যাস করা। মনে করিতে হইবে আমি স্বয়ং আত্মা মুখ দ্বারা বলিতেছি এবং যে আমার কথা শ্রবণ করিতেতে সেও আত্মা। শরীর দ্বারা কার্য করিবার সময় মনে করিতে হইবে, আমি আত্মা এই শরীর দ্বারা কার্য করিতেছি। এইরূপ অভ্যাসের দ্বারা আত্মিক-স্থিতিও পরিপক্ক হইতে থাকিবে এব আত্মাও পবিত্র হইয়া যাইবে।