আত্মার নিবাসস্থল জানিবার নিমিত্ত তিন লোকের জ্ঞান থাকা বিশেষ প্রয়োজন। পরমাত্মাকেও ত্রিলোকীনাথ বলা হয়। আপনি কি জানেন ঐ তিন লোক কি কি, আর উহাদের মধ্যে কোন লোক হইতে আত্মা এই সৃষ্টি মঞ্চে আসিয়াছে? পরমপিতা পরমাত্মা শিব আমাদিগকে দিব্য দৃষ্টির বরদান দিয়া এই তিন লোকের সাক্ষাৎকার করাইয়াছেন। সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র ও এই পৃথিবী লইয়া যে বিরাট স্থূল সৃষ্টি উহাকে সাকার সৃষ্টি বা সাকার জগৎ বলা হয়। আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি তাহা এই স্থূল সৃষ্টির সামান্য অংশ মাত্র। ইহাকে মনুষ্যলোক, কর্মক্ষেত্র অথবা রঙ্গমঞ্চও বলা হয়, কেন না এইখানে আসিয়াই আত্মা স্থূল অর্থাৎ হাড়-মাংসের শরীর ধারণ করে এবং সুখ ও দু:খের খেলা খেলিয়া থাকে। এইখানে জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দু:খ, কর্ম-বিকর্ম, সঙ্কল্প, বচন ইত্যাদি সবই আছে। এইখানে সর্বদাই মনুষ্য সৃষ্টির নাটক অভিনীত হইয়া চলিয়াছে।
সূক্ষ্মলোক:
এই মনুষ্য সৃষ্টি ছাড়িয়ে, সূর্য ও নক্ষতগ্রগণের উপরে, আকাশ তত্ত্বেরও পরপারে এক শুভ্র-জ্যোতির্লোক বিরাজমান, যাহাকে সূক্ষ্ম দেবলোক বলা হয়। এই সূক্ষ্ম দেবলোকে ব্রহ্মাপুরী এবং শঙ্করপুরী অবস্থিত। তিন সূক্ষ্ম দেহধারী দেবতা যথা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শঙ্কর আপন আপন পুরীতে বিরাজমান রহিয়াছেন। ঐ দেবতাদের দেশে যে সমস্ত দেবতারা বাস করেন তাঁহাদের আমাদের ন্যায় হাড় ও মাংসের কোন স্থূল শরীর নাই। তাঁহাদের সূক্ষ্ম প্রকাশময় শরীর। স্থূল দৃষ্টি দ্বারা তাঁহাদিগকে দেখা যায় না, কিন্তু দিব্য দৃষ্টির দ্বারা তাঁহাদিগকে দর্শন করিতে পারা যায়। ঐ লোকে মনুষ্য লোকের ন্যায় জন্ম-মৃত্যু, জরা-ব্যাধি অথবা শোক-দু:খ নাই। মুখের বচন বা ধ্বনিও ঐ স্থানে হয় না। দেবতাদের কথায় কোন ধ্বনি সৃষ্টি হয় না। ঐ স্থানে কেবল গতি আছে, কিন্তু কোন ধ্বনি বা শব্দ নাই।
পরমধাম, ব্রহ্মলোক, পরলোক বা নির্বাণধাম:
সূক্ষ্ম দেবলোকেরও পরে অন্য এক লোক আছে, যাহাকে পরমধান, ব্রহ্মলোক অথবা পরলোক বলা হয়। ঐ লোকে স্থূল বা সূক্ষ্ম কোন ফ্রকারেরই শরীর হয় না। ঐখানে সঙ্কল্প, বচন ও কর্ম কোনটাই হয় না। ঐখানে চিরশান্তি বিরাজমান। এইজন্য উহাকে শান্তিধাম, মুক্তিধাম বা নির্বাণধাম বলা হয়। সূক্ষ্মলোকে স্বর্ণাভ লোহিত জ্যোতি তত্ত্ব পরিব্যাপ্ত রহিয়াছে তাহাকে ব্রহ্ম বলে। এই ব্রহ্ম-তত্ত্ব চৈতন্য সত্ত্বা নয়, কিন্তু প্রকৃতির ষষ্ঠ তত্ত্ব ও সত্ত্ব, রজ: এবং তম: গুণ হইতে স্বতন্ত্র।
জন্ম মৃত্যু চক্রের রহস্য অবগত-অজন্মা, অভোক্তা, ত্রিকালদর্শী পরমপিতা পরমাত্মা শিব আমাদিগকে এই গূঢ় রহস্য ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেন যে সূর্য এবং নক্ষত্রগণের পরপারে অখণ্ড জ্যোতি ব্রহ্ম তত্ত্বে আত্মাগণ অশরীরী সঙ্কল্প-বিকল্প রহিত, সুখ-দু:খ ও জন্ম-মৃত্যু হইতে মুক্ত অবস্থায় থাকে। ঐ স্থঅন হইতে আত্মাগণ এই সৃষ্টি রূপী রঙ্গমঞ্জে অভিনয় করিতে আসে এবং ভূমিকা অনুযায়ী দেহ রূপ বেশভূষা ধারণ করে। আমাশে উল্কাপাতের ন্যায় আত্মাগণ আপন আপন অভিনয় করিবার জন্য মুক্তি ধাম ছাড়িয়া ইহলোকে প্রবেশ করে। আবার কর্ম অনুসারে ফল ভোগান্তে নিজগ্রামে প্রত্যাবর্তন করে।