ভবঘুরেকথা
মতুয়া সংগীত

গোস্বামীর ভিক্ষা বিবরণ
পয়ার

ভিক্ষা করি গোস্বামী বেড়ান সর্বক্ষণ।
প্রাতঃ হ’তে দ্বিপ্রহর ভিক্ষায় ভ্রমণ।।
ভিক্ষার তণ্ডুল রাখিতেন যার ঘরে।
বলিতেন তণ্ডুল বিক্রয় করিবারে।।
কতক তণ্ডুল রাখি তারকের ঘরে।
বলিতেন তারকে বিক্রয় করিবারে।।
একদিন জয়পুর তারকের বাটী।
গৃহমধ্যে বসিয়া আছেন মাত্র দুটি।।
হেনকালে একজন তণ্ডুল কিনিতে।
উপস্থিত হইলেন সন্ধ্যার অগ্রেতে।।
বলিল তণ্ডুল নাকি আছে তব ঘরে।
বিক্রয় করহ যদি দেহত আমারে।।
তারক বলিল আছে রেখেছে গোঁসাই।
কি দরে খরিদ কর বল শুনি তাই।।
খরিদ্দার বলে ডর সকলের জানা।
বাজারের দর এক সের এক আনা।।
তারক তণ্ডুল এনে তার ঠাই দিল।
পাঁচ আনা দাম দিয়া পাঁচ সের নিল।।
তারকের নিকটেতে গোঁসাই বসিয়া।
বলিছেন মিষ্টভাষে হাসিয়া হাসিয়া।।
তণ্ডুলের মূল্য কেন পাঁচ আনা লও।
দশ পাই রেখে আর ফিরাইয়া দাও।।
আনা আনা লও যদি তণ্ডুলের দাম।
মন্বন্তর বলি তব হইবে দুর্নাম।।
তণ্ডুলের এক সের হ’লে অর্ধ আনা।
কিনিতে বেচিতে কোন আটক থাকে না।।
কিনিতেও ভাল আর বেচিতেও তাই।
উভয়ের মনে কোন গোলমাল নাই।।
তারক বলিল প্রভু কেন কর মানা।
বাজার চলিত দর সের এক আনা।।
গোঁসাই কহিল মূল্য অর্ধ আনা নিব।
দাম জানিবারে কেন বাজারেতে যা’ব।।
সাধুর বাজার বেদ বেদান্তের পার।
সৃষ্টি ছাড়া বেদ ছাড়া সাধুর বাজার।।
গুরু তরুমূলে আনন্দ বাজারে থাকি।
ভবের লোভের হাটে আর কিরে ঢুকি।।
ভিক্ষার তণ্ডুল খাস ভাণ্ডারের ধন।
দরাদরি দিয়া কিবা আছে প্রয়োজন।।
এত শুনি তারক লইল দশ পাই।
দশ পাই ফিরাইয়া দিলেন গোঁসাই।।
সেই হ’তে ভিক্ষার তণ্ডুল যত হয়।
অর্ধ আনা মূল্যে সব করেন বিক্রয়।।
চারিটাকা জমা হ’ল তারকের ঠাই।
চারি টাকা নৌকা হ’তে আনিল গোঁসাই।।
তারকেরে বলে এই টাকা তুমি লহ।
তারক বলিল প্রভু কেন টাকা দেহ।।
গোঁসাই বলিল এই টাকা দিব কেনে।
তোমাকে দিতে পারিলে শান্তি হয় প্রাণে।।
তারক কহিছে প্রভু তব প্রাণে শান্তি।
এ বাক্য মানিতে বড় আমার অশান্তি।।
আমি কেন গ্রহণ করিব তব স্থান।
তব কৃপাবলে মম হইবে কল্যাণ।।
সামান্য অর্থের দ্বারা তুষিবে আমারে।
বালকে পুতুল দিয়া মোহে যে প্রকারে।।
অতুল রাতুল পদ দেহ মস্তকেতে।
অন্যকে তুষিও প্রভু সামান্য ধনেতে।।
শুনিয়া গোঁসাই তবে কহিছে গর্জিয়া।
তবে মোর টাকা দেহ শীঘ্র ফিরাইয়া।।
তারক আনিয়া টাকা রাখিল চরণে।
প্রভু বলে টাকা রাখ তব সন্নিধানে।।
তব বাড়ী থাকি আমি শীতে কষ্ট পাই।
একখানি কাঁথা হ’লে গায় দিব তাই।।
গৃহ হ’তে তারক আনিল এক কাঁথা।
গোস্বামীর পাদ পদ্মে রাখিলেন তথা।।
গোঁসাই বলেন ঘরে কাঁথা এস থুয়ে।
একখানি কাঁথা দেহ কিনিয়ে আনিয়ে।।
তারক বলিল কাঁথা কেহ নাহি বেচে।
গোঁসাই বলিল কায়স্থ বাটীতে আছে।।
বাটীর নিকটে তব পশ্চিম দিকেতে।
বিধবা দুইটি মেয়ে আছে সে বাড়ীতে।।
সিংহ বাটীতে গেলে কাঁথা পারিবা কিনিতে।
শুনিয়া তারক যান তাদের বাটীতে।।
জিজ্ঞাসিল কাঁথা নাকি করিবা বিক্রয়।
তাহারা বলিল খরিদ্দার পেলে হয়।।
অমনি রমণী কাঁথা করিল বাহির।
নিধার্য করিল মূল্য দুই টাকা স্থির।।
আনিয়া দিলেন টাকা গোস্বামীর স্থানে।
দুই টাকা মূল্য হ’ল বলিল তখনে।।
আইল সিংহের নারী মূল্য লইবারে।
তারক দিলেন মূল্য দুই টাকা তারে।।
গোস্বামী কহিছে কথা কাঁথাখান খুলে।
এ কাঁথার মূল্য তুমি কয় টাকা দিলে।।
সুন্দর সেলাই, নাহি এ কাঁথার তুল্য।
এ কাঁথার হইবেক চারিটাকা মূল্য।।
এ কাঁথার মূল্য হইবেক চারিটাকা।
দুই টাকা দিব কেন আমি নহে বোকা।।
স্বামীর নিকটে তবে কহে দুই নারী।
গললগ্নী কৃতবাস করজোড় করি।।
কি কারণে চারিটাকা মূল্য মোরা নিব।
লইব সাধুর টাকা পাপিনী হইব।।
তোমরা বিধবা নারী গোস্বামী কহয়।
কেহ কিছু সাহায্য করিলে ভাল হয়।।
কাঁথা মূল্য দুই টাকা কর অনুমান।
আর দুই টাকা আমি করিলাম দান।।
অবশ্য আমার বাক্য করহ গ্রহণ।
কদাপি আমার বাক্য না কর হেলন।।
সাধু বলে আমারে করহ যদি গণ্য।
বাক্য না রাখিলে হবে সাধুর অমান্য।।
চারিটাকা নিল তারা সন্তুষ্ট হইয়া।
গোস্বামী সন্তুষ্ট হ’ল চারিটাকা দিয়া।।
ভাদ্রমাসে একদিন বৈকাল বেলায়।
গোঁসাই আসিয়া ঘাটে হাঁটিয়া বেড়ায়।।
বরষার জল গেছে বাড়ীর নিকট।
জলকূল জড়াইয়া নির্মাইল ঘাট।।
কাষ্ঠবেচা নৌকা যায় লোহাগড়া হাটে।
ডাক দিয়া সেই নৌকা লাগাইল ঘাটে।।
তারক আসিল সেই কাষ্ঠ কিনিবারে।
কাষ্ঠ কিনিলেন নয় আনা ঠিক করে।।
কাষ্ঠ নামাইয়া দিল কাষ্ঠ বিক্রেতারা।
ফেদিগ্রামে বসতি মুসলমান তারা।।
নয় আনা মূল্য এনে তারক দিয়াছে।
কি কর কি কর ডেকে ঠাকুর কহিছে।।
তারক বলেছে এ কাষ্ঠের দাম দেই।
গোস্বামী বলেন তুমি কর নাকি এই।।
কত কষ্টে কাষ্ঠ বেচে হইয়া দুঃখিত।
বুঝে এর মূল্য দেওয়া তোমার উচিৎ।।
তারক কহিছে যে সময় হ’ল কেনা।
দাম ঠিক ইহার করেছি নয় আনা।।
সাধু কহে নয় আনা দিতে পারিবা না।
আর চারি আনা দিয়া দেহ তের আনা।।
মেয়ারা কহিছে মোরা বেশী কেন নিব।
নয় আনা বেচিয়াছি তাহা ল’য়ে যাব।।
লোচন কহিছে দাম নেও তের আনা।
তাহা না নিলে নিতে হবে সতর আনা।।
মেয়ারা কহিছে সাধু চরণে সেলাম।
ন’ আনার বেশী মোরা না লইব দাম।।
তারক দিলেন এক টাকা এক আনা।
মেয়ারা কহিছে তাহা নিতে পারিব না।।
তের আনা দিয়া শেষে করে সাধাসাধি।
তারা কহে বেশী নিলে হ’ব অপরাধী।।
তোমরা বলহ পাপ মোরা কহি গোনা।
মুখের যবান গেলে কিছুই থাকে না।।
দুনিয়ায় খাঁটি যার মুখের যবান।
দুনিয়ার মধ্যে সেই খাঁটি মুসলমান।।
নয় আনা নিয়া তারা অতিরিক্ত মূল্য।
কূলে ফেলে দিয়া, নৌকা ভাসাইয়া দিল।।
লোচন তারকে কহে এইত ক্ষমতা।
মূল্য দিতে পারিলে না গেল মোর কথা।।
তারক টানিয়া ধরে নৌকা মেয়াদের।
তোমরা নিলেনা মূল্য মোর কর্মফের।।
আমাদের গুরু তোমাদের মুরশিদ।
গুরু বাক্য শিরোধার্য সবার সুহৃদ।।
লয়ে যাও দোষ নাই নিজে ভেঙ্গে খাও।
অথবা ফকিরে দিয়া খয়রাৎ দেও।।
অতিরিক্ত মূল্য তারা দুই আনা নিল।
হাটে গিয়া খোদার নামেতে লুঠ দিল।।
গোস্বামীর নৌকা মেরামত করিবারে।
নৌকাখান উঠাইল নদীর কিনারে।।
তারক আনিয়া নৌকা দিল ধৌত করি।
পরিষ্কার করে তরী বলে হরি হরি।।
ধর্মনারায়ণ পুত্র ঈশান নামেতে।
নৌকা ধৌত করে তারকের সাথে সাথে।।
পাড়িল গাছের ডাব ঢেঁকিতে কুটিল।
তারক ঈশান দোঁহে রস বানাইল।।
সেই রস করিবারে নৌকায় লেপন।
তারক গাবের হাঁড়ি আনিল যখন।।
লোচন কহিছে ওহে তারক থাকহ।
অন্যে দিয়া গাব দিব তুমি রহ রহ।।
গাওনি করিল নৌকা ডাকি ঈশানেরে।
গাব দিতে পাইলেন হৃদয়নাথেরে।।
গোঁসাই দয়াল বড় অভিমান শূন্য।
সে হৃদয়নাথের অবস্থা বড় দৈন্য।।
দুইদিন গাব দিল মেরামত করি।
তৃতীয় দিবসে জলে ভাসাইল তরী।।
তারপর ডাকাইল হৃদয়নাথেরে।
নৌকা মেরামত মূল্য দিব যে তোমারে।।
চারি টাকা দিল তারে নিল সে যতনে।
তারক বলেরে হৃদে এত নিলি কেনে।।
হৃদয় বলিল গোস্বামীর পদ ধরি।
এই টাকা দেহ কেন মনে শঙ্কা করি।।
দুইদিন খাটিয়াছি পাব অর্ধ টঙ্কা।
চারি টাকা নিতে প্রভু মনে করি শঙ্কা।।
গোস্বামী বলেন আমি ভিক্ষা করি খাই।
পুঁজিকরে খেতে দিব হেন কেহ নাই।।
দীন জনে দিব দান এই মোর মন।
নীরু ভীরু লোক মোর পুত্র পরিজন।।
আমি দেই দয়া করে নেও হ’য়ে রাজি।
এই টাকা দিয়া কর ব্যবসার পুঁজি।।
তারক নীরব হ’ল সে কথা শুনিয়া।
হৃদয় লইল টাকা সন্তুষ্ট হইয়া।।
ভিক্ষার তণ্ডুল বিক্রি করিতে করিতে।
ক্রমে চৌদ্দ টাকা হ’ল গোস্বামীর হাতে।।
তারকের নিকটে কহিছে বারে বারে।
এই টাকা দিয়া আমি তোষিব কাহারে।।
একদিন সেই চৌদ্দ টাকা ল’য়ে সাথে।
নৌকাবাহি গেল লক্ষ্মীপাশা বাজারেতে।।
রাধামণি নামে ছিল বৃদ্ধা এক বেশ্যা।
দিন পাত নাহি চলে না চলে ব্যবসা।।
গোস্বামী যাইয়া সেই গৃহেতে প্রবেশে।
হেসে হেসে কহে তারে মৃদু মৃদু ভাষে।।
একেবারে বৃদ্ধা নয় এমতি বয়স।
বৃদ্ধামধ্যে গণ্য হয় প্রৌঢ়ার যে শেষ।।
রাধামণি বাহিরেতে ছিল কার্যান্তরে।
বারে বারে ডাকে তারে শীঘ্র আয় ঘরে।।
রাধামণি যেই গেল গৃহের মাঝেতে।
সেই চৌদ্দ টাকা দিল রাধামণি হাতে।।
রাধামণি ভীত হ’য়ে বাহিরেতে গিয়ে।
নৃত্যমণি বেশ্যাস্থানে বলিল ডাকিয়ে।।
নৃত্যমণি সেই টাকা গোস্বামীকে দিল।
গোঁসাই বিরস মনে ফিরিয়া আসিল।।
লোচন আনিয়া টাকা দিল তারকেরে।
পরদিন নৃত্যমণি আসিয়া বাজারে।।
তারকেরে দেখে বলে গোপনেতে ডাকি।
কেমন গোঁসাই তব মোরে বল দেখি।
যারে তারে ভকতি করেন মহাশয়।
আমাদের তত বড় বিশ্বাস না হয়।।
রাধামণি বৃদ্ধা মাগী তার ঘরে এসে।
চৌদ্দ টাকা সাধে আর মৃদু মৃদু হাসে।।
বলে তোর এখনে ত নাহিক যৌবন।
তোর দশা মোর দশা সমান এখন।।
তুই বৃদ্ধা কি কারণ থাকিস বাজারে।
আমি রোগী ভিক্ষামাগি নগরে নগরে।।
অর্থহেতু অনর্থের কিবা প্রয়োজন।
তোর ভাল হবে তুই মোর কথা শোন।।
তারক শুনিয়া তাই নৃত্যকে বলিছে।
এ কথার মধ্যে কিবা দোষ কথা আছে।।
টাকা যদি সাধিবেন কাম ব্যবহারে।
কেন টাকা সাধিল না যুবতী নারীরে।।
রূপবতী বেশ্যা কত আছে ত বাজারে।
কেন বা না গেল সাধু তার এক ঘরে।।
রূপ নাই গুণ নাই প্রৌঢ়া শেষ বৃদ্ধা।
এটুকু বুঝিয়া দেখ কোনভাবে শ্রদ্ধা।।
তাহা শুনি নৃত্যমণি গলে বাস দিয়া।
বলে অপরাধ ক্ষম সাধুকে আনিয়া।।
তারক আসিয়া বাটী লোচন সম্মুখে।
জিজ্ঞাসিবে মনোভাব, কথা নাহি মুখে।।
অমনি লোচন হাসি কহিছে তারকে।
কিছু কি জিজ্ঞাসা নাকি করিবা আমাকে।।
কি কহিছে নৃত্যমণি অবলা সে নারী।
টাকা সাধিয়াছি রাধামণি দুঃখ হেরি।।
বৃদ্ধ হ’লে বেশ্যা হয় হরি পরায়ণা।
এ সময় বেশ্যাবৃত্তি তার ত’ সাজে না।।
অর্থ জন্য বেশ্যা হয় হ’য়ে দায় ঠেকা।
দুষ্ট কার্য হ’বে ত্যজ্য তাতে দেই টাকা।।
বলিয়াছি দুষ্ট কার্য তেয়াগিয়া থাক।
ভিক্ষামাগি খাওয়াইব হরি বলে ডাক।।
উদর চিন্তায় কেন কুকাজের লোভী।
হরি বলে মেগে খাব হওগো বৈষ্ণবী।।
আমি দিব চৌদ্দ টাকা তুমি কিছু দেও।
পরমার্থ তত্ত্ব নিয়া ভিক্ষা মেগে খাও।।
তুমিত মোহান্ত ভাল থাক এই দেশে।
ওরা কেন ভাল হয় না তোমার বাতাসে।।
যশাই বৈরাগীর ছেলে হ’য়েছে ঠাকুর।
তার প্রেম বন্যা এসে লাগে জয়পুর।।
তুমি জয়পুর সাধনের বাড়ী কোলা।
প্রেমভক্তি দেয় হরি করি শেষ লীলা।।
কোলা আর জয়পুর প্রেম চলাচল।
এর মধ্যে কেন থাকে দুষ্ট আর খল।।
যাহা ভাল বুঝি তাহা করিয়াছি আমি।
ভাল মন্দ বিচার করিয়া লহ তুমি।।
তুমি বহু শাস্ত্র জান পড়িয়াছ কত।
মুখস্থ করেছ চৈতন্য চরিতামৃত।।
তাহাতে যাহা লিখিল তাত প’ড়ে থাক।
মঙ্গলাচরণ পদ বিচারিয়া দেখ।।
কৃষ্ণভক্ত বাধা যত শুভাশুভ কর্ম।
সেওত জীবের এক অজ্ঞানতঃ ধর্ম।।
লজ্জ ঘৃণা অষ্টপাশ সকল উঘারি।
শুভাশুভ যত কর্ম দিতে হবে ছাড়ি।।
কৃষ্ণভক্ত হবে ত বিচার সব ফেল।
পর উপকারী হ’য়ে হরি হরি বল।।
লোচনের লীলা খেলা অলৌকিক কাজ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!