মধ্যখণ্ড : চতুর্থ তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
শ্রীমদ গোলোক কীর্তনিয়া উপাখ্যান
পয়ার
মল্লকাঁদি বাসী কীর্তনিয়া রঘুনাথ।
তস্য জ্যেষ্ঠ পুত্র নাম শ্রীগোলোকনাথ।।
রামভক্ত করিতেন রামায়ণ গান।
গন্ধর্বের মধ্যে যেন গালব প্রধান।।
নারদ করিল শিক্ষা গালব নিকটে।
রাগ রাগিণীতে তেম্নি শ্রীগোলোক বটে।।
একদিন ডুমুরিয়া গ্রামেতে আসিল।
সিকদার বাটীতে অতিথি হ’য়েছিল।।
সূর্যনারায়ণ সিকদার ডুমুরিয়া।
গোলোকে রাখিল অতি যতন করিয়া।।
নিশি ভোর শুকতারা প্রভাতী গগনে।
ব্রহ্মমুহূর্তের কালে জেগে দুইজনে।।
করিছেন হরিনাম দুই মহাশয়।
গোলোক কহিছে বড় ভাল এ সময়।।
বৈশাখী দ্বাদশী দিন ভায়রো বসন্ত।
শুনাও বসন্ত গান বাসনা একান্ত।।
সূর্য গায় বসন্ত অন্তরা গায় যবে।
গোলোক রাগিণী ধরে মধুর সু-রবে।।
কোথা হ’তে আসিল কোকিল এক ঝাক।
ঘরের চালের পরে পড়িল বেবাক।।
কীর্তনিয়া মহাশয় তান ধরে যবে।
সঙ্গে সঙ্গে তান দেয় পিককুল সবে।।
স্বরের সঙ্গেতে সেই বিহঙ্গম সব।
জ্ঞান হয় করে যেন হরেকৃষ্ণ রব।।
কিছুক্ষণ পরে সেই কোকিলের গণ।
কতক ঘরের মাঝে পশিল তখন।।
কতক পিঁড়ির পরে কতক ধরায়।
স্বরে স্বর মিশাইয়া অশ্রুধারা বয়।।
গান ক্ষান্ত ভানুদিত কিরণ ছড়াল।
কুহু রবে পিক সব উড়িয়া চলিল।।
এমন গায়ক ছিল ভক্ত শিরোমণি।
মাতাইল রামায়ণ সঙ্গীতে ধরণী।।
রামায়ণ গান যদি হ’ত কোনখানে।
বাল বৃদ্ধা যুবামত্ত হইত সে গানে।।
রাম রাম বলি যবে ধরিতেন তান।
স্মৃতি শূন্য হ’ত কারু না থাকিত জ্ঞান।।
এইভাবে গান করে জগত মাতাল।
এবে শুন যে ভাবেতে হরিবোলা হল।।
বাত ব্যাধি হ’য়ে ক্রমে অঙ্গ পড়ে গেল।
ধরাশয্যা গত ক্রমে অচল হইল।।
সবে বলে হরিঠাকুরের কাছে চল।
তাহার কৃপাতে কত রোগ মুক্ত হৈল।।
এদেশে আসেন তিনি রাউৎখামার।
এ গ্রামেও এসে থাকে মৃত্যুঞ্জয় ঘর।।
সেই ঠাকুরকে ভক্তি কর মহাশয়।
মরা জিয়াইতে পারে যদি দয়া হয়।।
গোলোক বলেছে আমি ঠাকুর না মানি।
ওর মত ঠাকুর কত মোট বৈতে আনি।।
সবে বলে নিকটেতে আছেন ঠাকুর।
রাউৎখামার গ্রাম নহে বেশই দূর।।
চল তোমা ধরে ল’য়ে যাই সেই বাড়ী।
গোলোক বলেরে দিলি ভবনদী পাড়ি।।
একেবারে এসেছেন গৌরাঙ্গ নিতাই।
আজ বুঝি উদ্ধারিবে জগাই মাধাই।।
রঘু কীর্তুনের বেটা গোলোক কীর্তুনে।
ওর মত ঠাকুর ত’ আমরা মানিনে।।
কোথাকার বেটা এসে ঠাকুর কোলায়।
ওর মত ঠাকুরে আমার জুতা বয়।।
ওর মত লোক মোর নার দাঁড় বায়।
ওর মত লোক মোর পা ধুয়ে বেড়ায়।।
যত সব মূর্খ ভেড়ে ঠাকুর পেয়েছে।
ঠাকুরালি খাটে না এ গোলোকের কাছে।।
ও ঠাকুর যে মানুষ আমি সে মানুষ।
আমি বুঝি নারী অই ঠাকুর পুরুষ।।
যা থাকে কপালে হ’বে হয় হো’ক ক্লেশ।
কোথা হ’তে স্বয়ং এল কলি অবশেষ।।
আত্ম পরিজন আর প্রতিবাসী লোকে।
সবে মিলে ব’লে ক’য়ে বুঝায়ে গোলোকে।।
এ সময় গৌরব তোমার ভাল নয়।
অহংকার ছাড় এই অন্তিম সময়।।
অসুরত্ব বীরত্ব এখানে পরিহরি।
আত্মশুদ্ধ করিয়া বলহ হরি হরি।।
ঠাকুরের নাম হরি দেয় হরিনাম।
ইহকালে পরকালে পুরে মনোস্কাম।।
নহে দেব দেবী নহে কোন রূপ বার।
দেখিলে প্রত্যয় হ’বে স্বয়ং অবতার।।
হীরামন ম’রেছিল বাঁচাইল প্রাণে।
গোলোক বদন বাঁচিয়াছে প্রভু-গুণে।।
শ্রীহরিচাঁদের গুণে বলিহারি যাই।
ছিল ক্ষুদ্র নমঃশূদ্র হ’য়েছে গোঁসাই।।
যাইতে হইবে শুদ্ধ ভকতি করিয়া।
মন যদি নাহি লয় আসিও ফিরিয়া।।
গোলোক কহিছে যদি ভকতি করিব।
অভক্তি অন্যায় কথা কেনবা কহিব।।
ভক্তিমন্ত হ’লে মুক্তি থাকে তার সাথ।
গোলোকে তরা’লে বলি গোলোকের নাথ।।
দুর্বাক্য আমি যে কত বলেছি তাহারে।
অন্তর্যামী হ’লে তাহা জেনেছে অন্তরে।।
সে কেন করিবে দয়া এ হেন পাপীরে।
মার খেয়ে দয়া করে তাহা হ’লে পারে।।
গোলোক কহিছে তবে ল’য়ে চল মোরে।
দেখি তোর সে ঠাকুর কি করিতে পারে।।
কর্মক্ষেত্রে ভবজীব ভোগে কর্ম ফের।
সারিতে না পারে যদি শেষে পা’বে টের।।
যদি বলিবারে পারে হৃদয়ের কথা।
তবে তার শ্রীচরণে নমিব এ মাথা।।
চারি পাঁচ জন ধরে নিল নৌকা পরে।
শয়ন অবস্থা ধরে নিল খালা পারে।।
হাতে হাতে ধরাধরি শূন্যে শূন্যে রাখে।
ঠাকুরের কাছে গিয়া ফেলিল গোলোকে।।
ঠাকুর আছেন বসে উত্তরের ঘরে।
গোলোকে রাখিল নিয়া পিঁড়ির উপরে।।
প্রভু বলে ও কারে করিলি আনয়ন।
এ নাকি শ্মশান ভূমি করিবি দাহন।।
মরা এনে কেন ফেলাইলি মোর কাছে।
মরা মাদারের গাছ গাজীর নামে বাঁচে।।
নিয়া যা তোদের মরা দূরে নিয়ে রাখ।
গাজী নামে সির্নি মেনে এক মনে থাক।।
সঙ্গে যারা এসেছিল করে পরিহার।
তারা কহে হাজী গাজী তুমি সর্বসার।।
তুমি ওঝা তুমি বৈদ্য তুমি ধন্বন্তরী।
তুমি কৃষ্ণ তুমি বিষ্ণু তুমি হর হরি।।
ঠাকুর বলেন আমি কিসের মানুষ।
বিদ্যাবুদ্ধিহীন আমি অতি কাপুরুষ।।
রঘু কীর্তুনের বেটা গোলোক কীর্তুনে।
আমি কি মানুষ বাপু উহার ওজনে।।
মোর মত লোক ওর পা’র জুতা বয়।
মোর মত লোক ওর পা ধুয়ে বেড়ায়।।
মোর মত লোক ওর নার দাঁড় বায়।
মোর মত লোক ওর মোট বয়ে খায়।।
কলি কালে নাহি কোন স্বয়ং অবতার।
নলীয়া বারের পর বার নাহি আর।।
কোথা হ’তে আসিয়াছি ঠাকুর কিসের।
ব্যাধি যদি নাহি সারে শেষে পা’ব টের।।
শুনিয়া বিস্মিত হৈল গোলোকের মন।
উঠিতে না পারে বলে দেহ শ্রীচরণ।।
অপরাধ করিয়াছি বলে জানা’ব কি।
আমি দৈত্য মদে মত্ত পাষণ্ডী দেমাকী।।
ব্রহ্মাণ্ডেতে নাহি আর মো’সম পাতকী।
সুখে মত্ত হইয়া হয়েছি চির দুঃখী।।
যারা মোরে আনিয়াছে তোমার নিকট।
তাহাদের সঙ্গে আমি করিয়াছি হট।।
সবে বলে তুমি নাকি স্বয়ং অবতার।
ত্যক্ত হ’য়ে তাদের করেছি কটুত্তর।।
আমি ত’ পাষণ্ডী নাহি ভকতি আমার।
তুমি’ত করুণানিধি আমি দুরাচার।।
পতিত পাবন নাম ধর দয়াময়।
এমন পতিত আর পাইবা কথায়।।
কোন যুগে পেয়েছ কি এমন পতিত।
মহাউদ্ধরণ নাম ধর কর হিত।।
অজামিলে উদ্ধারিলে সে হয় ব্রাহ্মণ।
পূর্বে তার ছিল কত সাধন ভজন।।
মাতৃসেবা পিতৃসেবা করিত সদায়।
বৈষ্ণব আচার ছিল সরল হৃদয়।।
মায়া নারী দিয়া তারে মোহে পুরন্দর।
সেই মায়া নারী সঙ্গে করে পাপাচার।।
নারায়ণ নাম ল’য়ে হইল উদ্ধার।
তাহাতে দয়াল নাম না হ’ল প্রচার।।
কলিকালে দয়াল অবতারে দুটি ভাই।
উদ্ধার করিলে প্রভু জগাই মাধাই।।
ব্রহ্ম বংশে অবতংশ জন্মালে দোহারে।
নাম ব্রহ্ম প্রচারিতে দস্যুবৃত্তি করে।।
না করে বৈষ্ণব নিন্দা পরস্ত্রী হরণ।
এ সকল পাপ না করিলে কদাচন।।
জোর জার করে খেত মারিয়া কাড়িয়া।
তাহা দোঁহে উদ্ধারিলে নাম ব্রহ্ম দিয়া।।
তোমাদের দয়াগুণ করিলে প্রচার।
তোমার হইতে হ’ল তাহারা উদ্ধার।।
উদ্ধারিলে হীরানটী প্রচারিলে ভক্তি।
দারুব্রহ্ম অবতারে, তারে কৈলে মুক্তি।।
ভক্তিহীন জ্ঞানহীন আমি পাপাচারী।
পশু হ’তে পশু গণ্য মিছা দেহ ধরি।।
ঠাকুর বলেন বাছা নহেত কপট।
আমার মত ঠাকুরে বহে তোর মোট।।
জগতের মোট বহি ঘুচাই সংকট।
দেরে মোট উঠাইয়া বহি তোর মোট।।
গোলোক বলিছে মোট দিব দয়াময়।
হেন শক্তি দেহ যদি তবে দেওয়া যায়।।
মোট যদি নিতে চাইলে বলিলে শ্রীমুখে।
তবে মোট নিতে হ’বে এই দায় ঠেকে।।
তুমিত’ করুণাময় এবে গেল বোঝা।
নিজশক্তি প্রকাশিয়া তুলে লও বোঝা।।
ঠাকুর বলেন ভাল ঠেকাইলি দায়।
নিলাম এ বোঝা তোর গা তুলিয়া বয়।।
গোলোকের দেহে প্রভু শক্তি সঞ্চারিল।
গেল রোগ সে গোলোক উঠিয়া বসিল।।
স্বেদ কম্প পুলকাশ্রু বহিতে লাগিল।
ঠাকুরের পদ ধরি স্তব আরম্ভিল।।
ভূভার হরণ জন্য তব অবতার।
এবার হরহে! হরি গোলোকের ভার।।
পাষণ্ড দলন কৈলে গৌর অবতারে।
পাপ শিরোচ্ছেদ কৈলে দয়া অস্ত্র ধেরে।।
চক্রধারী দয়া সুদর্শন চক্র ধরি।
ভূভার হরণ কর গোলোক উদ্ধারী।।
প্রতিজ্ঞা করেছ তুমি ভূভার হরিবা।
সাধু পরিত্রাণ আর দুষ্কৃতি নাশিবা।।