মহিলা কাছারী এবং বিচার ও হুকুম
পয়ার
মালাদেবী হুঁশ হ’য়ে সংকীর্তন ভীতে।
বিনয় চরণে ধরি কহে দশরথে।।
নিশি ভোর পূর্বাকাশে উদয় তপন।
ক’রে দেন প্রভুর সেবার আয়োজন।।
আপনার প্রতি কল্য দেখে অত্যাচার।
গত নিশি সকলে রয়েছে অনাহার।।
দশরথ দশাভঙ্গ ভকতের সঙ্গ।
স্থির হ’ল প্রেমনিধি থামিল তরঙ্গ।।
প্রভু কহে মালাবতী পাক কর গিয়া।
কাছারী করিব অদ্য আহার করিয়া।।
মাতাগণ যাও সবে নিজ নিজ ঘরে।
সকালে বিকালে এসে দেখে যেও মোরে।।
মালাদেবী স্নান করি করিল রন্ধন।
আমন্য তণ্ডুল অন্ন ষোড়শ ব্যঞ্জন।।
ডা’ল ডাল্লা শাক শুক্তা ভাজা বড়া বড়ি।
চালিতা অম্বল আমসির চড়চড়ি।।
মহাপ্রভু সেবা করে হ’য়ে হৃষ্টমতি।
দশরথ গান করে ভোজন আরতি।।
ভোজনান্তে মহাপ্রভু শয়ন করিছে।
মেয়েরা আসিয়া কেহ বাতাস দিতেছে।।
পার্শ্ব লগ্ন শয্যার উপরে পৃষ্ঠদেশ।
ক্ষণকাল হইয়াছে নিদ্রার আবেশ।।
এক মেয়ে বলে দিদি পাখা কর ত্যাগ।
ঠাকুরের পৃষ্ঠদেশে দেখ একি দাগ।।
থাগ্ থাগ্ দাগ হেন কভু দেখি নাই।
জমিয়া রয়েছে রক্ত চেয়ে দেখ ভাই।।
নিদ্রা ভঙ্গে গাত্রোত্থান করিল গোঁসাই।
মেয়ে গণে জিজ্ঞাসিল ঠাকুরের ঠাই।।
একি দাগ দেখি প্রভু তব পৃষ্ঠোপরে।
ঠাকুর কহিছে কল্য মেরেছে আমারে।।
দশরথ পৃষ্ঠে জুতা মারিল নায়েব।
আমার পৃষ্ঠেতে রাখিয়াছে গুরুদেব।।
নারীগণে তাহা শুনে কাঁদিয়া উঠিল।
চক্ষুজলে সকলের বসন তিতিল।।
যে অঙ্গ নির্জনে বসি গড়িয়াছে বিধি।
সে অঙ্গে জুতার বাড়ি চেয়ে দেখ দিদি।।
আহারে দারুণ বিধি এই ছিল মনে।
চাঁদেতে কলঙ্ক দিলি বিচার করলিনে।।
তাহা দেখি দশরথ পড়ে ভূমিতলে।
সর্বাঙ্গ তিতিল তার নয়নের জলে।।
জটিলাকে বেত্রাঘাত করে তার গুরু।
সেই দাগ পৃষ্ঠে ধরে বাঞ্ছা কল্পতরু।।
সে মতে আমাকে রক্ষা কৈল ভগবান।
হায় হায় কেন নাহি গেল মোর প্রাণ।।
এই জন্য আমি কোন বেদনা না পাই।
নায়েবে মেরেছে মোরে মনে ভাবি তাই।।
মালা দেবী লুটে পড়ে ঠাকুরের পায়।
ইহার বিচার প্রভু হইবে কোথায়।।
প্রভু বলে তবে তোরা আয় সব নারী।
মিলাইব হাইকোর্ট মহিলা কাছারী।।
ভাল ভাল বস্ত্র দিল চারিদিকে ঘিরে।
চৌকি সিংহাসন করি পাতি দিল ঘরে।।
বেড়ায় সংলগ্ন করি দিলেন পাতিয়া।
তিনটি বালিশ দিল তার পর নিয়া।।
ছাপ এক চাদর পাতিয়া দিল পরে।
নানা পুষ্পমাল্য মালা দিল থরে থরে।।
তারপর বসাইয়া দিল এক মেয়ে।
কুসুম মুকুট তার মস্তকেতে দিয়ে।।
পদ্মপুষ্প মালা গাঁথি গলে দিল তার।
ঝুলাইয়া দিল মালা বক্ষের উপর।।
উকিল মোক্তার হ’ল মেয়েরা সবায়।
হুজুর সেলাম বলি সম্মুখে দাঁড়ায়।।
যেই নারী মহারাণী সেজে বসেছিল।
রাজ-শ্রী রাজ-মুকুট শোভা তার হ’ল।।
মহাপ্রভু হ’য়ে বাদী করি যোড় হস্ত।
জবানবন্দী করিল নালিশী দরখাস্ত।।
দশরথে মেরেছে নায়েব মহাশয়।
সেই প্রহারের দাগ মম পৃষ্ঠে রয়।।
সত্য মিথ্যা স্বচক্ষে দেখুন একবার।
সুবিচার করুণ হে ধর্ম অবতার।।
যে মেয়ে হইল রাণী সেই মেয়ে কয়।
প্রমাণ করহ শীঘ্র বিলম্ব না সয়।।
প্রভু বলে আমি হইয়াছি ফরিয়াদি।
ধর্মতঃ শপথ সত্য মম জবানবন্দী।।
আমার রাজ্যেতে মিথ্যা নাহি কহে কেহ।
আমার প্রমাণ ধর্ম বিচার করহ।।
মেয়েরা বলেছে এই ধর্মের কাছারী।
আমরা দেখিয়াছি গায় মারে দশ বাড়ী।।
রাণী কহে নায়েব সে বড় অত্যাচারী।
মোকর্দ্দমা জয় তব দিলাম এ ডিক্রি।।
এই শাস্তি হ’বে তার বংশের নির্মূল।
কুষ্ঠব্যাধি খসিবেক হস্তের আঙ্গুল।।
গৃহদাহ হইবে নায়েবী কার্য যা’বে।
কল্য কাছারীতে বসি সংবাদ পাইবে।।
এ সব সংবাদ পেয়ে করিবে রোদন।
পরশু করিবে বেটা গৃহেতে গমন।।
সবে বলে হয় শ্রীহরিচাঁদের জয়।
নাম গানে মাতিল কাছারী ভঙ্গ হয়।।
পরদিন বাটী হ’তে পৌছিল পত্র।
গৃহদাহ হইয়াছে ঘর নাহি মাত্র।।
দৈবাৎ মরেছে তার সুযোগ্য নন্দন।
শিরে করাঘাত করি করিছে রোদন।।
লোক সহ পত্র এল রাজ বাটী হ’তে।
বরখাস্ত হ’লে তুমি নায়েবী হইতে।।
কুষ্ঠ ব্যাধি হ’ল গায় চাকা চাকা দাগ।
বাড়ী চলে গেল করে নায়েবতী ত্যাগ।।
হইল গলিত কুষ্ঠ খসিল আঙ্গুল।
স্বধনে সবংশে দুষ্ট হইল নির্মূল।।
সাধু হিংস্র নায়েবের হ’ল সর্বনাশ।
গ্রামবাসী পাষণ্ডের লাগিল তারাস।।
সেই ভাবে সকলে রহিল মনোল্লাসে।
নাম গানে নিশি ভোর হ’ল ভাবাবেশে।।
কহিছে তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।
সাধুদ্বেষী যেই তার মুণ্ডে হেন বাজ।।