তোতাপুরীর আত্মহত্যার সঙ্কল্প
বাবুরাম প্রভৃতির সঙ্গে, ফ্রি উইল সম্বন্ধ কথা –
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে বৈকাল বেলা নিজের ঘরে পশ্চিমের বারান্দায় কথা কহিতেছেন। সঙ্গে বাবুরাম, মাস্টার, রামদয়াল প্রভৃতি। ডিসেম্বর, ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ। বাবুরাম, রামদয়াল ও মাস্টার আজ রাত্রে থাকিবেন। শীতের (বড়দিনের) ছুটি হইয়াছে। মাস্টার আগামী কল্যও থাকিবেন। বাবুরাম নূতন নূতন আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – ঈশ্বর সব করছেন এ-জ্ঞান হলে তো জীবন্মুক্ত। কেশব সেন শম্ভু মল্লিকের সঙ্গে এসেছিল, আমি তাকে বললাম, গাছের পাতাটি পর্যন্ত ঈশ্বরের ইচ্ছা ভিন্ন নড়ে না। স্বাধীন ইচ্ছা (Free will) কোথায়? সকলই ঈশ্বরাধীন।
ন্যাংটা অত বড় জ্ঞানী গো, সে-ই জলে ডুবতে গিছল। এখানে এগার মাস ছিল; পেটের ব্যারাম হল, রোগের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে গঙ্গাতে ডুবতে গিছল! ঘাটের কাছে অনেকটা চড়া, যত যায় হাঁটু জলের চেয়ে আর বেশি হয় না; তখন আবার বুঝলে, বুঝে ফিরে এল। আমার একবার খুব বাতিক বৃদ্ধি হয়েছিল, তাই গলায় ছুরি দিতে গিছলুম। তাই বলি, “মা, আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি রথ, তুমি রথী; যেমন চালাও তেমনি চলি – যেমন করাও তেমনি করি।”
ঠাকুরের ঘরের মধ্যে গান হইতেছে। ভক্তেরা গান গাহিতেছেন-
১।
হৃদি-বৃন্দাবনে বাস যদি কর কমলাপতি।
ওহে ভক্তিপ্রিয়, আমার ভক্তি হবে রাধাসতী ৷৷
মুক্তি কামনা আমারি, হবে বৃন্দে গোপনারী,
দেহ হবে নন্দের পুরী, স্নেহ হবে মা যশোমতী ৷৷
আমায় ধর ধর জনার্দন, পাপভার গোবর্ধন,
কামাদি ছয় কংসচরে ধ্বংস কর সম্প্রতি ৷৷
বাজায়ে কৃপা বাঁশরি, মন ধেনুকে বশ করি,
তিষ্ঠ হৃদিগোষ্ঠে পুরাও ইষ্ট এই মিনতি ৷৷
আমার প্রেমরূপ যমুনাকূলে, আশা বংশী বটমূলে,
স্বদাসভেবে সদয়ভাবে সতত কর বসতি –
যদি বল রাখাল-প্রেমে বন্দী থাকি ব্রজধামে,
তবে জ্ঞানহীন রাখাল তোমার দাস হবে হে দাশরথি ৷৷
২।
আমার প্রাণ-পিঞ্জরের পাখি গাওনারে।
ব্রহ্ম-কল্পতরুমূলে বসেরে পাখি, বিভুগুণ গাও দেখি (গাও গাও)
আর ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ, সুপক্ক ফল খাওনা রে ৷৷
নন্দন বাগানের শ্রীনাথ মিত্র বন্ধুগণ সঙ্গে আসিয়াছেন। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিয়া বলিতেছেন, “এই যে এঁর চক্ষু দিয়া ভিতরটা সব দেখা যাচ্ছে। সার্সীর দরজার ভিতর দিয়ে যেমন ঘরের ভিতরকার জিনিস সব দেখা যায়।” শ্রীনাথ, যজ্ঞনাথ এঁরা নন্দন বাগানের ব্রাহ্মপরিবারভুক্ত। ইঁহাদের বাটীতে প্রতি বৎসর ব্রাহ্মসমাজের উৎসব হইত। উৎসবদর্শন করিতে ঠাকুর পরে গিয়াছিলেন।
সন্ধ্যার পর ঠাকুরবাড়িতে আরতি হইতে লাগিল। ঘরে ছোট খাটটিতে বসিয়া ঠাকুর ঈশ্বরচিন্তা করিতেছেন। ক্রমে ভাবাবিষ্ট হইলেন। ভাব উপশমের পর বলিতেছেন, “মা ওকেও টেনে নাও। ও অত দীনভাবে থাকে। তোমার কাছে আসা যাওয়া করছে।”
ঠাকুর ভাবে বাবুরামের কথা কি বলিতেছেন? বাবুরাম, মাস্টার, রামদয়াল প্রভৃতি বসিয়া আছেন। রাত্রি ৮টা-৯টা হইবে। ঠাকুর সমাধিতত্ত্ব বলিতেছেন। জড়সমাধি, চেতনসমাধি, স্থিতসমাধি, উন্মনাসমাধি।
বিদ্যাসাগর ও চেঙ্গিস খাঁ – ঈশ্বর কি নিষ্ঠুর? শ্রীরামকৃষ্ণের উত্তর
সুখ-দুঃখের কথা হইতেছে। ঈশ্বর এত দুঃখ কেন করেছেন?
মাস্টার – বিদ্যাসাগর অভিমান করে বলেন, “ঈশ্বরকে ডাকবার আর কি দরকার! দেখ চেঙ্গিস খাঁ যখন লুটপাট আরম্ভ করলে তখন অনেক লোককে বন্দী করলে; ক্রমে প্রায় এক লক্ষ বন্দী জমে গেল। তখন সেনাপতিরা এসে বললে মহাশয়, এদের খাওয়াবে কে? সঙ্গে এদের রাখলে আমাদের বিপদ। কি করা যায়? ছেড়ে দিলেও বিপদ। তখন চেঙ্গিস খাঁ বললেন, তাহলে কি করা যায়।
ওদের সব বধ কর। তাই কচাকচ করে কাটবার হুকুম হয়ে গেল। এই হত্যাকাণ্ড তো ঈশ্বর দেখলেন? কই একটু নিবারণ তো করলেন না। তা তিনি থাকেন থাকুন, আমার দরকার বোধ হচ্ছে না। আমার তো কোন উপকার হল না!”
শ্রীরামকৃষ্ণ – ঈশ্বরের কার্য কি বুঝা যায়, তিনি কি উদ্দেশ্যে কি করেন? তিনি সৃষ্টি, পালন, সংহার সবই করছেন। তিনি কেন সংহার করছেন আমরা কি বুঝতে পারি? আমি বলি, মা, আমার বোঝবারও দরাকার নাই, তোমার পাদপদ্মে ভক্তি দিও। মানুষ জীবনের উদ্দেশ্য এই ভক্তিলাভ। আর সব মা জানেন। বাগানে আম খেতে এসেছি; কত গাছ, কত ডাল, কত কোটি পাতা – এ-সব বসে বসে হিসাব করবার আমার কি দরকার! আমি আম খাই, গাছপাতার হিসাবে আমার দরকার নাই।
ঠাকুরের ঘরের মেঝেতে আজ রাত্রে বাবুরাম, মাস্টার ও রামদয়াল শয়ন করিলেন।
গভির রাত্রি, ২টা-৩টা হইবে। ঠাকুরের ঘরে আলো নিভিয়া গিয়াছে। তিনি নিজে বিছানায় বসিয়া ভক্তদের সহিত মাঝে মাঝে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও বাবুরাম, মাস্টার প্রভৃতি – দয়া ও মায়া – কঠিন সাধন ও ঈশ্বরদর্শন
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) – দেখ, দয়া আর মায়া এ-দুটি আলাদা জিনিস। মায়া মানে আত্মীয়ে মমতা; যেমন বাপ-মা, ভাই-ভগ্নী, স্ত্রী-পুত্র, এদের উপর ভালবাসা। দয়া সর্বভূতে ভালবাসা; সমদৃষ্টি। কারু ভিতর যদি দয়া দেখ যেমন বিদ্যাসাগরের, সে জানবে ঈশ্বরের দয়া। দয়া থেকে সর্বভূতের সেবা হয়। মায়াও ঈশ্বরের। মায়া দ্বারা তিনি আত্মীয়দের সেবা করিয়ে লন। তবে একটি কথা আছে; মায়াতে অজ্ঞান করে রাখে, আর বদ্ধ করে। কিন্তু দয়াতে চিত্তশুদ্ধি হয়। ক্রমে বন্ধন মুক্তি হয়।
“চিত্তশুদ্ধি না হলে ভগবান দর্শন হয় না। কাম, ক্রোধ, লোভ – এ-সব হয় করলে তবে তাঁর কৃপা হয়; তখন দর্শন হয়। তোমাদের অতি গুহ্যকথা বলছি, কাম জয় করবার জন্য আমি অনেক কাণ্ড করেছিলাম। এমন কি আনন্দ আসনের চারিদকে ‘জয় কালী’ ‘জয় কালী’ বলে অনেকবার প্রদক্ষিণ করেছিলাম।
আমার দশ-এগার বৎসর বয়সে যখন ও-দেশে ছিলুম, সেই সময়ে ওই অবস্থাটি (সমাধি অবস্থা) হয়েছিল; মাঠ দিয়ে যেতে যেতে যা দর্শন করলাম তাতে বিহ্বল হয়েছিলাম। ঈশ্বরদর্শনের কতরগুলি লক্ষণ আছে। জ্যোতি দেখা যায়, আনন্দ হয়। বুকের ভিতর তুবড়ির মতো গুরগুর করে মহাবায়ু ওঠে।”
পরদিন বাবুরাম, রামদয়াল বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। মাস্টার সেইদিনও রাত্রি ঠাকুরের সঙ্গে অতিবাহিত করলেন। সেদিন তিনি ঠাকুরবাড়িতেই প্রসাদ পাইলেন।
-১৮৮২, ১৪ই ডিসেম্বর-
……………………
রামকৃষ্ণ কথামৃত : অষ্টম অধ্যায় : অষ্টম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….