নরেন্দ্রাদি সঙ্গে – নরেন্দ্রের সুখ-দুঃখ – দেহের সুখ-দুঃখ
নরেন্দ্র মেঝের উপর সম্মুখে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ত্রৈলোক্য ও ভক্তদের প্রতি) – দেহের সুখ-দুঃখ আছেই। দেখ না, নরেন্দ্র – বাপ মারা গেছে, বাড়িতে বড় কষ্ট; কোন উপায় হচ্ছে না। তিনি কখনও সুখে রাখেন কখনও দুঃখে।
ত্রৈলোক্য – আজ্ঞে, ঈশ্বরের (নরেন্দ্রের উপর) দয়া হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – আর কখন হবে! কাশীতে অন্নপূর্ণার বাড়ি কেউ অভুক্ত থাকে না বটে; – কিন্তু কারু কারু সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকতে হয়।
“হৃদে শম্ভু মল্লিককে বলেছিল, আমায় কিছু টাকা দাও। শম্ভু মল্লিকের ইংরাজী মত, সে বললে। তোমায় কেন দিতে যাব? তুমি খেটে খেতে পার, তুমি যা হোক কিছু রোজগার করছ। তবে খুব গরিব হয় সে এক কথা, কি কানা, খোঁড়া, পঙ্গু; এদের দিলে কাজ হয়। তখন হৃদে বললে, মহাশয়! আপনি উটি বলবেন না। আমার টাকায় কাজ নাই। ঈশ্বর করুন যেন আমায় কানা, খোঁড়া, আতি দারিদ্দীর – এ-সব না হতে হয়, আপনারও দিয়ে কাজ নাই, আমারও নিয়ে কাজ নাই।”
নরেন্দ্র ও নাস্তিক মত – ঈশ্বরের কার্য ও ভীষ্মদেব
ঈশ্বর নরেন্দ্রকে কেন এখনও দয়া করছেন না ঠাকুর যেন অভিমান করে এই কথা বলছেন। ঠাকুর নরেন্দ্রের দিকে এক-একবার সস্নেহ দৃষ্টি করিতেছেন।
নরেন্দ্র – আমি নাস্তিক মত পড়ছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ – দুটো আছে, অস্তি আর নাস্তি, অস্তিটাই নাও না কেন?
সুরেন্দ্র – ঈশ্বর তো ন্যায়পরায়ণ, তিনি তো ভক্তকে দেখবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – আইনে (শাস্ত্রে) আছে, পূর্বজন্মে যারা দান-টান করে তাদেরই ধন হয়! তবে কি জান? এ-সংসার তাঁর মায়া, মায়ার কাজের ভিতর অনেক গোলমাল, কিছু বোঝা যায় না!
“ঈশ্বরের কার্য কিছু বুঝা যায় না। ভীষ্মদেব শরশয্যায় শুয়ে; পাণ্ডবেরা দেখতে এসেছেন। সঙ্গে কৃষ্ণ। এসে খানিকক্ষণ পরে দেখেন, ভীষমদেব কাঁদছেন। পাণ্ডবেরা কৃষ্ণকে বললেন, কৃষ্ণ, কি আশ্চর্য! পিতামহ অষ্টবসুর একজন বসু; এঁর মতন জ্ঞানী দেখা যায় না; ইনিও মৃত্যুর সময় মায়াতে কাঁদছেন! কৃষ্ণ বললেন, ভীষ্ম সেজন্য কাঁদছেন না। ওঁকে জিজ্ঞাসা কর দেখি। জিজ্ঞাসা করাতে ভীষ্ম বললেন, কৃষ্ণ! ঈশ্বরের কার্য কিছু বুঝতে পারলাম না! আমি এইজন্য কাঁদছি যে সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষাৎ নারায়ণ ফিরছেন কিন্তু পাণ্ডবদের বিপদের শেষ নাই! এই কথা যখন ভাবি, দেখি যে তাঁর কার্য কিছুই বোঝবার জো নাই!”
শুদ্ধ আত্মা একমাত্র অটল – সুমেরুবৎ
“আমায় তিনি দেখিয়েছিলেন, পরমাত্মা, যাঁকে বেদে শুদ্ধ আত্মা বলে, তিনিই কেবল একমাত্র অটল সুমেরুবৎ নির্লিপ্ত, আর সুখ-দুঃখের অতীত। তাঁর মায়ার কার্যে অনেক গোলমাল; এটির পর ওটি, এটি থেকে উটি হবে – ও-সব বলবার জো নাই।”
সুরেন্দ্র (সহাস্যে) – পূর্বজন্মে দান-টান করলে তবে ধন হয়, তাহলে তো আমাদের দান-টান করা উচিত।
শ্রীরামকৃষ্ণ – যার টাকা আছে তার দেওয়া উচিত। (ত্রৈলোক্যের প্রতি) জয়গোপাল সেনের টাকা আছে তার দান করা উচিত। এ যে করে না সেটা নিন্দার কথা। এক-একজন টাকা থাকলেও হিসেবী (কৃপণ) হয়; – টাকা যে কে ভোগ করবে তার ঠিক নাই!
“সেদিন জয়গোপাল এসেছিল। গাড়ি করে আসে। গাড়িতে ভাঙা লণ্ঠন; – ভাগাড়ের ফেরত ঘোড়া; মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল ফেরত দ্বারবান; – আর এখানের জন্য নিয়ে এলে দুই পচা ডালিম।” (সকলের হাস্য)
সুরেন্দ্র – জয়গোপালবাবু ব্রাহ্মসমাজের। এখন বুঝি কেশববাবুর ব্রাহ্মসমাজে সেরূপ লোক নাই। বিজয় গোস্বামী, শিবনাথ ও আর আর বাবুরা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ করছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – গোবিন্দ অধিকারী যাত্রার দলে ভাল লোক রাখত না; – ভাগ দিতে হবে বলে। (সকলের হাস্য)
“কেশবের শিষ্য একজনকে সেদিন দেখলাম। কেশবের বাড়িতে থিয়েটার হচ্ছিল। দেখলাম, সে ছেলে কোলে করে নাচছে! আবার শুনলাম লেকচার দেয়। নিজেকে কে শিক্ষা দেয় তার ঠিক নাই!”
ত্রৈলোক্য গাহিতেছেন, – চিদানন্দ সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দের লহরী।
গান সমপ্ত হইলে শ্রীরামকৃষ্ণ ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, ওই গানটা গাও তো গা, – আমায় দে মা পাগল করে।
-১৮৮৪, ২রা মার্চ-
…………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : অষ্টাদশ অধ্যায় : পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….