ঠাকুরদাদা ও মহিমাচরণের প্রতি উপদেশ
‘ঠাকুরদাদা’ দু-একটি বন্ধুসঙ্গে আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। বয়স ২৭/২৮ হইবে। বরাহনগরে বাস। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ছেলে, – কথকতা অভ্যাস করিতেছেন। সংসার ঘাড়ে পড়িয়াছে, – দিন কতক বৈরাগ্য হইয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছিলেন। এখনও সাধন-ভজন করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি কি হেঁটে আসছ? কোথায় বাড়ি?
ঠাকুরদাদা – আজ্ঞা হাঁ; বরাহনগরে বাড়ি।
শ্রীরামকৃষ্ণ – এখানে কি দরকার ছিল?
ঠাকুরদাদা – আজ্ঞা, আপনাকে দর্শন করতে আসা, তাঁকে ডাকি – মাঝে মাঝে অশান্তি হয় কেন? দুপাঁচদিন বেশ আনন্দে যায় – তারপর অশান্তি কেন?
কারিকর; মন্ত্রে বিশ্বাস; হরিভক্তি; জ্ঞানের দুটি লক্ষণ
শ্রীরামকৃষ্ণ – বুঝেছি, – ঠিক পড়ছে না। কারিকর দাঁতে দাঁত বসিয়ে দেয় – তাহলে হয় – একটু কোথায় আটকে আছে।
ঠাকুরদাদা – আজ্ঞা, এইরূপ অবস্থাই হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – মন্ত্র নিয়েছ?
ঠাকুরদাদা – আজ্ঞা, হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – মন্ত্রে বিশ্বাস আছে?
ঠাকুরদাদার বন্ধু বলিতেছেন – ইনি বেশ গান গাইতে পারেন।
ঠাকুর বলিতেছেন – একটা গাওনা গো।
ঠাকুরদাদা গাইতেছেন –
প্রেম গিরি-কন্দরে, যোগী হয়ে রহিব।
আনন্দনির্ঝর পাশে যোগধ্যানে থাকিব ৷৷
তত্ত্বফল আহরিয়ে জ্ঞান-ক্ষুধা নিবারিয়ে,
বৈরাগ্য-কুসুম দিয়ে শ্রীপাদপদ্ম পূজিব।
মিটাতে বিরহ-তৃষা কূপ জলে আর যাব না,
হৃদয়-করঙ্গ ভরে শান্তি-বারি তুলিব।
কভু ভাব শৃঙ্গ পরে, পদামৃত পান করে,
হাসিব কাঁদিব নাচিব গাইব।
শ্রীরামকৃষ্ণ – আহা, বেশ গান! আনন্দনির্ঝর! তত্ত্বফল! হাসিব কাঁদিব নাচিব গাইব।
“তোমার ভিতর থেকে এমন গান ভাল লাগছে – আবার কি!
“সংসারেতে থাকতে গেলেই সুখ-দুঃখ আছে – একটু-আধটু অশান্তি আছে।
“কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে একটু কালি লাগেই।”
“ঠাকুরদাদা – আজ্ঞা, – এখন কি করব – বলে দিন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – হাততালি দিয়ে সকালে বিকালে হরিনাম করবে – ‘হরিবোল’ – ‘হরিবোল’ – ‘হরিবোল’ বলে।
“আর একবার এসো, – আমার হাতটা একটু সারুক।”
মহিমাচরণ আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।
(মহিমার প্রতি) – “আহা ইনি একটি বেশ গান গেয়েছেন। – গাও তো গা সেই গানটি আর একবার।”
ঠাকুরদাদা আবার গাইলেন, “প্রেম গিরি-কন্দরে” ইত্যাদি।
গান সমাপ্ত হইলে ঠাকুর মহিমাচরণকে বলিতেছেন – তুমি সেই শ্লোকটি একবার বলতো – হরিভক্তির কথা।
মহিমাচরণ নারদপঞ্চরাত্র হইতে সেই শ্লোকটি বলিতেছেন –
অন্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্।
নান্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্।
আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্।
নারাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্।
শ্রীরামকৃষ্ণ – ওটাও বল – লভ লভ হরিভক্তিং।
মহিমাচরণ বলিতেছেন –
বিরম বিরম ব্রহ্মন্ কিং তপস্যাসু বৎস।
ব্রজ ব্রজ দ্বিজ শীঘ্রং শঙ্করং জ্ঞানসিন্ধুম্ ৷৷
লভ লভ হরিভক্তিং বৈষ্ণবোক্তাং সুপক্কাম্।
ভব-নিগড়-নিবন্ধচ্ছেদনীং কর্তরীঞ্চ।
শ্রীরামকৃষ্ণ – শঙ্কর হরিভক্তি দিবেন।
মহিমা – পাশমুক্তঃ সদাশিবঃ।
শ্রীরামকৃষ্ণ – লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, সঙ্কোচ – এ-সব পাশ; কি বল?
মহিমা – আজ্ঞা হাঁ, গোপন করবার ইচ্ছা, প্রশংসায় কুণ্ঠিত হওয়া।
শ্রীরামকৃষ্ণ – দুটি জ্ঞানের লক্ষণ। প্রথম কূটস্থ বুদ্ধি। হাজার দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-বিঘ্ন হোক – নির্বিকার, যেমন কামারশালের লোহা, যার উপর হাতুড়ি দিয়ে পেটে। আর, দ্বিতীয়, পুরুষকার – খুব রোখ। কাম-ক্রোধে আমার অনিষ্ট কচ্ছে তো একেবারে ত্যাগ! কচ্ছপ যদি হাত-পা ভিতরে সাঁদ করে, চারখানা করে কাটলেও আর বার করবে না।
তীব্র, মন্দা ও মর্কট বৈরাগ্য
(ঠাকুরদাদা প্রভৃতির প্রতি) – “বৈরাগ্য দুইপ্রকার। তীব্র বৈরাগ্য আর মন্দা বৈরাগ্য। মন্দা বৈরাগ্য – হচ্ছে হবে – ঢিমে তেতালা। তীব্র বৈরাগ্য – শাণিত ক্ষুরের ধার – মায়াপাশ কচকচ করে কেটে দেয়।
“কোনও চাষা কতদিন ধরে খাটছে – পুষ্করিণীর জল ক্ষেতে আসছে না। মনে রোখ নাই। আবার কেউ দু-চারদিন পরেই – আজ জল আনব তো ছাড়ব, প্রতিজ্ঞা করে। নাওয়া খাওয়া সব বন্ধ। সমস্ত দিন খেটে সন্ধ্যার সময় যখন জল কুলকুল করে আসতে লাগল, তখন আনন্দ। তারপর বাড়িতে গিয়ে পরিবারকে বলে – ‘দে এখন তেল দে নাইব।’ নেয়ে খেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিদ্রা।
“একজনের পরিবার বললে, ‘অমুক লোকের ভারী বৈরাগ্য হয়েছে, তোমার কিছু হল না!’ যার বৈরাগ্য হয়েছে, সে লোকটির ষোলজন স্ত্রী, – এক-একজন করে তাদের ত্যাগ করছে।
“সোয়ামী নাইতে যাচ্ছিল, কাঁধে গামছা, – বললে, ‘ক্ষেপী! সে লোক ত্যাগ করতে পারবে না, – একটু একটু করে কি ত্যাগ হয়! আমি ত্যাগ করতে পারব। এই দেখ, – আমি চললুম!’
সে বাড়ির গোছগাছ না করে – সেই অবস্থায় – কাঁধে গামছা – বাড়ি ত্যাগ করে, চলে গেল। – এরই নাম তীব্র বৈরাগ্য।
আর-একরকম বৈরাগ্য তাকে বলে মর্কট বৈরাগ্য। সংসারের জ্বালায় জ্বলে গেরুয়া বসন পরে কাশী গেল। অনেকদিন সংবাদ নাই। তারপর একখানা চিঠি এল – ‘তোমরা ভাবিবে না, আমার এখানে একটি কর্ম হইয়াছে।’
“সংসারের জ্বালা তো আছেই! মাগ অবাধ্য, কুড়ি টাকা মাইনে, ছেলের অন্নপ্রাশন দিতে পারছে না, ছেলেকে পড়াতে পারছে না – বাড়ি ভাঙা, ছাত দিয়ে জল পড়ছে; – মেরামতের টাকা নাই।
“তাই ছোকরারা এলে আমি জিজ্ঞাসা করি, তোর কে কে আছে?
(মহিমার প্রতি) – “তোমাদের সংসারত্যাগের কি দরকার? সাধুদের কত কষ্ট! একজনের পরিবার বললে, তুমি সংসারত্যাগ করবে – কেন? আট ঘরে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতে হবে, তার চেয়ে এক ঘরে খাওয়া পাচ্ছ, বেশ তো।
“সদাব্রত খুঁজে খুঁজে সাধু তিনক্রোশ রাস্তা থেকে দূরে গিয়ে পড়ে। দেখেছি, জগন্নাথদর্শন করে – সোজা পথ দিয়ে সাধু আসছে; সদাব্রতর জন্য তার সোজা পথ ছেড়ে যেতে হয়।
“এতো বেশ – কেল্লা থেকে যুদ্ধ। মাঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করলে অনেক অসুবিধা। বিপদ। গায়ের উপর গোলাগুলি এসে পড়ে!
“তবে দিন কতক নির্জনে গিয়ে, জ্ঞানলাভ করে, সংসারে এসে থাকতে হয়। জনক জ্ঞানলাভ করে সংসারে ছিল। জ্ঞানের পর যেখানেই থাক তাতে কি?”
মহিমাচরণ – মহাশয়, মানুষ কেন বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ – তাঁকে লাভ না করে বিষয়ের মধ্যে থাকে বলে। তাঁকে লাভ করলে আর মুগ্ধ হয় না। বাদুলে পোকা যদি একবার আলো দেখতে পায়, – তাহলে আর তার অন্ধকার ভাল লাগে না।
ঊর্ধ্বরেতা ধৈর্যরেতা ও ঈশ্বরলাভ – সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম
“তাঁকে পেতে হলে বীর্যধারণ করতে হয়।
“শুকদেবাদি ঊর্ধ্বরেতা। এঁদের রেতঃপাত কখনও হয় নাই।
“আর এক আছে ধৈর্যরেতা। আগে রেতঃপাত হয়েছে, কিন্তু তারপর বীর্যধারণ। বার বছর ধৈর্যরেতা হলে বিশেষ শক্তি জন্মায়। ভিতরে একটি নূতন নাড়ী হয়, তার নাম মেধা নাড়ী। সে নাড়ী হলে সব স্মরণ থাকে, – সব জানতে পারে।
“বীর্যপাতে বলক্ষয় হয়। স্বপ্নদোষে যা বেরিয়ে যায়, তাতে দোষ নাই। ও ভাতের গুণে হয়। ও-সব বেরিয়ে গিয়েও যা থাকে, তাতেই কাজ হয়। তবু স্ত্রীসঙ্গ করা উচিত নয়।
“শেষে যা থাকে, তা খুব রিফাইন (Refine) হয়ে থাকে। লাহাদের ওখানে গুড়ের নাগরি সব রেখেছিল, – নাগরির নিচে একটি একটি ফুটো করে, তারপর একবৎসর পরে দেখলে; সব দানা বেঁধে রয়েছে – মিছরির মতো। রস যা বেরিয়ে যাবার, ফুটো দিয়ে তা বেরিয়ে গেছে।
“স্ত্রীলোক একেবারে ত্যাগ – সন্ন্যাসীর পক্ষে। তোমাদের হয়ে গেছে, তাতে দোষ নাই।
“সন্ন্যাসী স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। সাধারণ লোকে তা পারে না। সা রে গা মা পা ধা নি। ‘নি’তে অনেকক্ষণ থাকা যায় না।
“সন্ন্যাসীর পক্ষে বীর্যপাত বড়ই খারাপ। তাই তাদের সাবধানে থাকতে হয়। স্ত্রীরূপদর্শন যাতে না হয়। ভক্ত স্ত্রীলোক হলেও সেখান থেকে সরে যাবে। স্ত্রীরূপ দেখাও খারাপ। জাগ্রত অবস্থায় না হয়, স্বপ্নে বীর্যপাত হয়।
“সন্ন্যাসী জিতেন্দ্রিয় হলেও লোকশিক্ষার জন্য মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করবে না। ভক্ত স্ত্রীলোক হলেও বেশিক্ষণ আলাপ করবে না।
“সন্ন্যাসীর হচ্ছে নির্জলা একাদশী। আর দুরকম একাদশী আছে। ফলমূল খেয়ে, – আর লুচি ছক্কা খেয়ে। (সকলের হাস্য)
“লুচি ছক্কার সঙ্গে হলো দুখানা রুটি দুধে ভিজেছে। (সকলের হাস্য)
(সহাস্যে) “তোমরা নির্জলা একাদশী পারবে না।”
পূর্বকথা – কৃষ্ণকিশোরের একাদশী – রাজেন্দ্র মিত্র
“কৃষ্ণকিশোরকে দেখলাম, একাদশীতে লুচি ছক্কা খেলে। আমি হৃদুকে বললাম – হৃদু, আমার কৃষ্ণকিশোরের একাদশী করতে ইচ্ছা হচ্ছে। (সকলের হাস্য) তাই একদিন করলাম। খুব পেট ভরে খেলাম, তার পরদিন আর কিছু খেতে পারলাম না” (সকলের হাস্য)
যে কয়েকটি ভক্ত পঞ্চবটীতে হঠযোগীকে দেখিতে গিয়াছিলেন, তাঁহারা ফিরিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাদের বলিতেছেন – “কেমন গো – কিরূপ দেখলে? তোমাদের গজ দিয়ে তো মাপলে?”
ঠাকুর দেখিলেন, ভক্তরা প্রায় কেহই হঠযোগীকে টাকা দিতে রাজী নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ – সাধুকে টাকা দিতে হলেই তাকে আর ভাল লাগে না।
“রাজেন্দ্র মিত্র – আটশ টাকা মাইনে – প্রয়াগে কুম্ভমেলা দেখে এসেছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম – ‘কেমন গো, মেলায় কেমন সব সাধু দেখলে?’ রাজেন্দ্র বললে – ‘কই তেমন সাধু দেখতে পেলাম না। একজনকে দেখলাম বটে কিন্তু তিনিও টাকা লন।’
“আমি ভাবি যে সাধুদের কেউ টাকাপয়সা দেবে না তো খাবে কি করে? এখানে প্যালা দিতে হয় না – তাই সকলে আসে। আমি ভাবি; আহা, ওরা টাকা বড় ভালবাসে। তাই নিয়েই থাকুক।”
ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিতেছেন। একজন ভক্ত ছোট খাটটির উত্তরদিকে বসিয়া তাঁহার পদসেবা করিতেছেন। ঠাকুর ভক্তটিকে আস্তে আস্তে বলিতেছেন – “যিনি নিরাকার, তিনিই সাকার। সাকাররূপও মানতে হয়। কালীরূপ চিন্তা করতে করতে সাধক কালীরূপেই দর্শন পায়। তারপর দেখতে পায় যে, সেই রূপ অখণ্ডে লীন হয়ে গেল। যিনিই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ, তিনিই কালী।””
-১৮৮৪, ২৩শে মার্চ-
……………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : অষ্টাদশ অধ্যায় : ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….