ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

শ্রীকেশবচন্দ্র সেন ও নববিধান – নববিধানে সার আছে

ঠাকুর প্রসাদ গ্রহান্তর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিতেছেন। এমন সময় রাম, গিরীন্দ্র ও আর কয়েকটি ভক্ত আসিয়া উপস্থিত। ভক্তেরা ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন ও তৎপরে আসন গ্রহণ করিলেন।

শ্রীযুক্ত কেশবচন্দ্র সেনের নববিধানের কথা পড়িল।

রাম (ঠাকুরের প্রতি) – মহাশয়, আমার তো নববিধানে কিছু উপকার হয়েছে বলে বোধ হয় না। কেশববাবু যদি খাঁটি হতেন, শিষ্যদের অবস্থা এরূপ কেন? আমার মতে, ওর ভিতেরে কিছুই নাই। যেমন খোলামকুচি নেড়ে, ঘরে তালা দেওয়া। লোক মনে কচ্ছে খুব টাকা ঝমঝম কচ্ছে, কিন্তু ভিতরে কেবল খোলামকুচি। বাহিরের লোক ভিতরের খবর কিছু জানে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কিছু সার আছে বই কি। তা না হলে এত লোকে কেশবকে মানে কেন? শিবনাথকে কেন লোকে চেনে না? ঈশ্বরের ইচ্ছা না থাকলে এরকম একটা হয় না।

“তবে সংসার ত্যাগ না করলে আচার্যের কাজ হয় না, লোকে মানে না। লোকে বলে, এ সংসারী লোক, এ নিজে কামিনী-কাঞ্চন লুকিয়ে ভোগ করে; আমাদের বলে, ঈশ্বর সত্য, সংসার স্বপ্নবৎ অনিত্য! সর্বত্যাগী না হলে তার কথা সকলে লয় না। ঐহিক যারা কেউ কেউ নিতে পারে। কেশবের সংসার ছিল, কাজে কাজেই সংসারের উপর মনও ছিল।

সংসারটিকে তো রক্ষা করতে হবে। তাই অত লেকচার দিয়েছে; কিন্তু সংসারটি বেশ পাকা করে রেখে গেছে। অমন জামাই! বাড়ির ভিতরে গেলুম, বড় বড় খাট। সংসার করতে গেলে ক্রমে সব এসে জোটে। ভোগের জায়গাই সংসার।”

রাম – ও খাট, বাড়ি বখরার সময় কেশব সেন পেয়েছিলেন; কেশব সেনের বখরা। মহাশয়, যাই বলুন, বিজয়বাবু বলেছেন, কেশব সেন এমন কথা বিজয়বাবুকে বলেছেন যে, আমি খ্রাইষ্ট আর গৌরাঙ্গের অংশ, তুমি বল যে তুমি অদ্বৈত। আবার কি বলে জানেন? আপনিও নববিধানী! (ঠাকুরের ও সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) – কে জানে বাপু, আমি কিন্তু নববিধান মানে জানি না। (সকলের হাস্য)

রাম – কেশবের শিষ্যেরা বলে, জ্ঞান আর ভক্তির প্রথম সামঞ্জস্য কেশববাবু করেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (অবাক্‌ হইয়া) – সে কি গো! অধ্যাত্ম (রামায়ণ) তবে কি? নারদ রামচন্দ্রকে স্তব করতে লাগলেন, “হে রাম! বেদে যে পরব্রহ্মের কথা আছে, সে তুমিই। তুমিই মানুষরূপে আমাদের কাছে রয়েছো; তুমিই মানুষ বলে বোধ হচ্ছ বস্তুত তুমি মানুষ নই, সেই পরব্রহ্ম।” রামচন্দ্র বললেন, “নারদ! তোমার উপর বড় প্রসন্ন হয়েছি, তুমি বর নাও।” নারদ বললেন, “রাম! আর কি বর চাহিব? তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি দাও। আর তোমার ভুবনমোহিনী মায়ার যেন মুগ্ধ করো না।” অধ্যাত্মে কেবল জ্ঞান-ভক্তিরই কথা।

কেশবের শিষ্য অমৃতের কথা পড়িল।

রাম – অমৃতবাবু একরকম হয়ে গেছেন!

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, সেদিন বড় রোগা দেখলুম।

রাম – মহাশয়! লেকচারের কথা শুনুন। যখন খোলের শব্দ হয়, সেই সময় বলে ‘কেশবের জয়।’ আপনি বলেন কিনা যে, গেড়ে ডোবায় দল হয়। তাই একদিন লেকচারে অমৃতবাবু বললেন, সাধু বলেছেন বটে, গেড়ে ডোবায় দল বাঁধে; কিন্তু ভাই, দল চাই, দল চাই। সত্য বলছি, সত্য বলছি দল চাই! (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ – এ কি! ছ্যা! ছ্যা! ছ্যা! এ কি লেকচার!

কেহ কেহ একটু প্রশংসা ভালবাসেন, এই কথা পড়িল।

শ্রীরামকৃষ্ণ – নিমাইসন্ন্যাসের যাত্রা হচ্ছিল, কেশবের ওখানে আমায় নিয়ে গিছিল। সেই দিন দেখেছিলাম কেশব আর প্রতাপকে একজন কে বললে, এঁরা দুজনে গৌর নিতাই। প্রসন্ন তখন আমায় জিজ্ঞাসা করলে, তাহলে আপনি কি? দেখলাম কেশব চেয়ে রহিল; আমি কি বলি দেখবার জন্য। আমি বললুম, “আমি তোমাদের দাসানুদাস, রেণুর রেণু।” কেশব হেসে বললে, “ইনি ধরা দেন না।”

রাম – কেশব কখনও বলতেন, আপনি জন্‌ দি ব্যাপটিস্ট।

একজন ভক্ত – আবার কিন্তু কখন কখন বলতেন Nineteenth Century-র (ঊনবিংশ শতাব্দীর) চৈতন্য আপনি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ওর মানে কি?

ভক্ত – ইংরেজী এই শত্যব্দীতে চৈতন্যদেব আবার এসেছেন; সে আপনি।

শ্রীরামকৃষ্ণ (অন্যমনস্ক হয়ে) – তাতো হল। এখন হাতটা১ আরাম কেমন করে হয় বল দেখি? এখন কেবল ভাবছি, কেমন করে হাতটি সারবে!

ত্রৈলোক্যের গানের কথা পড়িল। ত্রৈলোক্য কেশবের সমাজে ঈশ্বরের নামগুনকীর্তন করেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আহা! ত্রৈলোক্যের কি গান!

রাম – কি, ঠিক ঠিক সব?

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, ঠিক ঠিক; তা না হলে মনে এত টানে কেন?

রাম – সব আপনার ভাব নিয়ে গান বেঁধেছেন। কেশব সেন উপাসনার সময় সেই ভাবগুলি সব বর্ণনা করতেন, আর ত্রৈলোক্যবাবু সেইরূপ গান বাঁধতেন। এই দেখুন না, ওই গানটা –

“প্রেমের বাজারে আনন্দের মালা।
হরিভক্তসঙ্গে রসরঙ্গে করিছেন কত খেলা ৷৷

“আপনি ভক্তসঙ্গে আনন্দ করেন, দেখে নিয়ে ওই সব গান বাঁধা।”

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – তুমি আর জ্বালিও না * * আবার আমায় জড়াও কেন? (সকলের হাস্য)

গিরীন্দ্র – ব্রাহ্মরা বলেন, পরমহংসদেবের faculty of organisation নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – এর মানে কি?

মাস্টার – আপনি দল চালাতে জানেন না। আপনার বুদ্ধি কম, এই কথা বলে। (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ (রামের প্রতি) – এখন বল দেখি, আমার হাত কেন ভাঙল? তুমি এই নিয়ে দাঁড়িয়ে একটা লেকচার দাও। (সকলের হাস্য)

ব্রাহ্মসমাজ ও বৈষ্ণব ও শাক্তকে সাম্প্রদায়িকতা সম্বন্ধে উপদেশ

“ব্রহ্মজ্ঞানীরা নিরাকার নিরাকার বলছে, তা হলেই বা; আন্তরিক তাঁকে ডাকলেই হল। যদি আন্তরিক হয়, তিনি তো অন্তর্যামী, তিনি অবশ্য জানিয়ে দেবেন, তাঁর স্বরূপ কি।

“তবে এটা ভাল না – এই বলা যে আমরা যা বুঝেছি তাই ঠিক, আর যে যা বলছে সব ভুল। আমরা নিরাকার বলছি, অতএব তিনি নিরাকার, তিনি সাকার নন। আমরা সাকার বলছি, অতএব তিনি সাকার, তিনি নিরাকার নন। মানুষ কি তাঁর ইতি করতে পারে?

“এইরকম বৈষ্ণব শাক্তদের ভিতর রেষারেষি। বৈষ্ণব বলে, আমার কেশব, – শাক্ত বলে, আমার ভগবতী, একমাত্র উদ্ধারকর্তা।

“আমি বৈষ্ণবচরণকে সেজোবাবুর কাছে নিয়ে গিছলাম। বৈষ্ণবচরণ বৈরাগী খুব পণ্ডিত কিন্তু গোঁড়া বৈষ্ণব। এদিকে সেজোবাবু ভগবতীর ভক্ত। বেশ কথা হচ্ছিল, বৈষ্ণবচরণ বলে ফেললে, মুক্তি দেবার একমাত্র কর্তা কেশব। বলতেই সেজোবাবুর মুখ লাল হয়ে গেল। বলেছিল, ‘শালা আমার!’ (সকলের হাস্য) শাক্ত কিনা। বলবে না? আমি আবার বৈষ্ণবচরণের গা টিপি।

“যত লোক দেখি, ধর্ম ধর্ম করে – এ ওর সঙ্গে ঝগড়া করছে, ও ওর সঙ্গে ঝগড়া করছে। হিন্দু, মুসলমান, ব্রহ্মজ্ঞানী, শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব – সব পরস্পর ঝগড়া। এ বুদ্ধি নাই যে, যাঁকে কৃষ্ণ বলছো, তাঁকেই শিব, তাঁকেই আদ্যাশক্তি বলা হয়; তাঁকেই যীশু, তাঁহাকেই আল্লা বলা হয়। এক রাম তাঁর হাজার নাম।

“বস্তু এক, নাম আলাদা। সকলেই এক জিনিসকে চাচ্ছে। তবে আলাদা জায়গা, আলাদা পাত্র, আলাদা নাম। একটা পুকুরে অনেকগুলি ঘাট আছে; হিন্দুরা একঘাট থেকে জল নিচ্ছে, কলসী করে – বলছে ‘জল’। মুসলমানরা আর একঘাটে জল নিচ্ছে, চামড়ার ডোলে করে – তারা বলছে ‘পানী।’ খ্রীষ্টানরা আর-একঘাটে জল নিচ্ছে – তারা বলছে ‘ওয়াটার।’ (সকলের হাস্য)

“যদি কেউ বলে, না এ জিনিসটা জল নয়, পানী; কি পানী নয়, ওয়াটার; কি ওয়াটার নয়, জল; তাহলে হাসির কথা হয়। তাই দলাদলি, মনান্তর, ঝগড়া, ধর্ম নিয়ে লাটালাটি, মারামারি, কাটাকাটি – এ-সব ভাল নয়। সকলেই তাঁর পথে যাচ্ছে, আন্তরিক হলেই ব্যাকুল হলেই তাঁকে লাভ করবে।

(মণির প্রতি) – “তুমি এইটে শুনে যাও –

“বেদ, পুরাণ, তন্ত্র – সব শাস্ত্রে তাঁকেই চায়, আর কারুকে চায় না – সেই এক সচ্চিদানন্দ। যাকে বেদে ‘সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম’ বলেছে, তন্ত্রে তাঁকেই ‘সচ্চিদানন্দ শিবঃ’ বলেছে, তাঁকেই আবার পুরাণে ‘সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণঃ’ বলেছে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ শুনিলেন, রাম বাড়িতে মাঝে মাঝে নিজে রেঁধে খান।

শ্রীরামকৃষ্ণ – (মণির প্রতি) – তুমিও কি রেঁধে খাও?

মণি – আজ্ঞা না।

শ্রীরামকৃষ্ণ – দেখো না, একটু গাওয়া ঘি দিয়ে খাবে। বেশ শরীর মন শুদ্ধ বোধ হবে।

……………………………………………
১ কিয়দ্দিন পূর্বে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পড়িয়া গিয়া হাত ভাঙিয়া ফেলিয়াছেন। হাতে বাড় দিয়া অনেক দিন বাধিয়া রাখিতে হইয়াছিল। তখনও বাঁধা ছিল।

-১৮৮৪, ৫ই এপ্রিল-

………………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : অষ্টাদশ অধ্যায় : ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!