শরণাগত হও
শ্রীরামকৃষ্ণ এইবার পশ্চিমের গোল বারান্দায় আসিয়া বসিয়াছেন। বন্দ্যোপাধ্যায়, হরি, মাস্টার প্রভৃতি কাছে বসিয়া আছেন। বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংসারে কষ্ট ঠাকুর সব জানেন।
বন্দ্যোকে শিক্ষা – ভার্যা সংসারের কারণ – শরণাগত হও
শ্রীরামকৃষ্ণ – দেখ, “এক কপ্নিকে বাস্তে” যত কষ্ট। বিবাহ করে, ছেলেপুলে হয়েছে, তাই চাকরি করতে হয়; সাধু কপ্নি লয়ে ব্যস্ত, সংসারী ভার্যা লয়ে। আবার বাড়ির সঙ্গে বনিবনাও নাই, তাই – আলাদা বাসা করতে হয়েছে। (সহাস্য) চৈতন্যদেব নিতাইকে বলেছিলেন, শুন শুন নিত্যানন্দ ভাই সংসারী জীবের কভু গতি নাই।
মাস্টার (স্বগত) – ঠাকুর বুঝি অবিদ্যার, সংসারের কথা বলছেন। অবিদ্যার সংসারেই বুঝি “সংসারী জীব” থাকে।
(মাস্টারকে দেখাইয়া – সহাস্যে) “ইনিও আলাদা বাসা করে আছেন। তুমি কে, না ‘আমি বিদেশিনী’; আর তুমি কে, না ‘আমি বিরহিণী।’ (সকলের হাস্য) বেশ মিল হবে।
“তবে তাঁর শরণাগত হলে আর ভয় নাই। তিনিই রক্ষা করবেন।”
হরি প্রভৃতি – আচ্ছা, অনেকের তাঁকে লাভ করতে অত দেরি হয় কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ – কি জানো, ভোগ আর কর্ম শেষ না হলে ব্যাকুলতা আসে না। বৈদ্য বলে দিন কাটুক – তারপর সামান্য ঔষধে উপকার হবে।
“নারদ রামকে বললেন, ‘রাম! তুমি অযোধ্যায় বসে রইলে রাবণবধ কেমন করে হবে? তুমি যে সেইজন্যে অবতীর্ণ হয়েছ!’ রাম বললেন, ‘নারদ! সময় হউক, রাবণের কর্ম-ক্ষয় হোক; তবে তার বধের উদ্যোগ হবে’।”১
The problem of Evil and Hari (Turiyananda) – ঠাকুরের বিজ্ঞানীর অবস্থা
হরি – আচ্ছা, সংসারে এত দুঃখ কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ – এ সংসার তাঁর লীলা; খেলার মতো। এই লীলায় সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য, জ্ঞান-অজ্ঞান, ভাল-মন্দ – সব আছে। দুঃখ, পাপ – এ-সব গেলে লীলা চলে না।
“চোর চোর খেলায় বুড়ীকে ছুঁতে হয়। খেলার গোড়াতেই বুড়ী ছুঁলে বুড়ী সন্তুষ্ট হয় না। ঈশ্বরের (বুড়ির) ইচ্ছা যে খেলাটা খানিকক্ষণ চলে। তারপর। –
ঘুড়ি লক্ষের দুটা-একটা কাটে,
হেসে দাও মা, হাত-চাপড়ী।
অর্থাৎ ঈশ্বরদর্শন করে দুই-একজন মুক্ত হয়ে যায়, অনেক তপস্যার পর, তাঁর কৃপায়। তখন মা আনন্দে হাততালি দেন, ‘ভো! কাটা!’ এই বলে।”
হরি – খেলায় যে আমাদের প্রাণ যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – তুমি কে বল দেখি; ঈশ্বরই সব হয়ে রয়েছেন – মায়া, জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব।২
“সাপ হয়ে খাই, আবার রোজা হয়ে ঝাড়ি! তিনি বিদ্যা-অবিদ্যা দুই-ই হয়ে রয়েছেন। অবিদ্যা মায়ার অজ্ঞান হয়ে রয়েছেন, বিদ্যা মায়ার ও গুরুরূপে রোজা হয়ে ঝাড়ছেন।
“অজ্ঞান, জ্ঞান, বিজ্ঞান। জ্ঞানী দেখেন তিনিই আছেন, তিনিই কর্তা – সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার করছেন। বিজ্ঞানী দেখেন, তিনিই সব হয়ে রয়েছেন।
“মহাভাব, প্রেম হলে দেখে তিনি ছাড়া আর কিছুই নাই।
“ভাবের কাছে ভক্তি ফিকে, ভাব পাকলে মহাভাব, প্রেম।
(বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি) – “ধ্যানের সময় ঘন্টাশব্দ এখনও কি শোনা?”
বন্দ্যো – রোজ ওই শব্দ শোনা! আবার রূপদর্শন! একবার মন ধরলে কি আর বিরাম হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – হাঁ, কাঠে একবার আগুন ধরলে আর নেবে না। (ভক্তদের প্রতি) – ইনি বিশ্বাসের কথা অনেক জানেন।
বন্দ্যো – আমার বিশ্বাসটা বড় বেশি।
শ্রীরামকৃষ্ণ – কিছু বল না।
বন্দ্যো – একজনকে গুরু গাড়োল মন্ত্র দিয়েছিলেন, আর বলেছিলেন, “গাড়োলই তোর ইষ্ট।” গাড়োল মন্ত্র জপ করে সে সিদ্ধ হল।
“ঘেসুড়ে রামনাম করে গঙ্গা পার হয়ে গিছল!”
শ্রীরামকৃষ্ণ – তোমার বাড়ির মেয়েদের বলরামের মেয়েদের সঙ্গে এনো।
বন্দ্যো – বলরাম কে?
শ্রীরামকৃষ্ণ – বলরাম কে জানো না? বোসপাড়ায় বাড়ি।
সরলকে দেখিলে শ্রীরামকৃষ্ণ আনন্দে বিভোর হয়েন। বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সরল; নিরঞ্জনকেও সরল বলে খুব ভালবাসেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – তোমায় নিরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করতে বলছি কেন? সে সরল, সত্য কি না। এইটি দেখবে বলে।
……………………………………….
১ অধ্যাত্মরামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড।
২ ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি, ত্বং কুমার উত বা কুমারী।
ত্বং জীর্ণো দণ্ডেন বঞ্চসি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ।। [শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্, ৪।৩]
-১৮৮৪, ২৪শে মে-
…………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : অষ্টাদশ অধ্যায় : ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….