ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

পঞ্চবটীমূলে জন্মোৎসবদিবসে বিজয় প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে, জন্মোৎসবদিবসে বিজয়,
কেদার, রাখাল, সুরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীতলায় পুরাতন বটবৃক্ষের চাতালের উপর বিজয়, কেদার, সুরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্তসঙ্গে দক্ষিণাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। কয়েকটি ভক্ত চাতালের উপর বসিয়া আছেন। অধিকাংশই চাতালের নিচে, চতুর্দিকে দাঁড়াইয়া আছেন। বেলা ১টা হইবে। রবিবার, ২৫শে মে, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ১৩ই জৈষ্ঠ; শুক্লা প্রতিপদ।

ঠাকুরের জন্মদিন ফাল্গুন মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। কিন্তু তাঁহার হাতে অসুখ বলিয়া এতদিন জন্মোৎসব হয় নাই। এখন অনেকটা সুস্থ হইয়াছেন। তাই আজ ভক্তেরা আনন্দ করিবেন। সহচরী গান গাইবে। সহচরী প্রবীণা হইয়াছেন, কিন্তু প্রসিদ্ধ কীর্তনী।

মাস্টার ঠাকুরের ঘরে ঠাকুরকে দেখিতে না পাইয়া পঞ্চবটীতে আসিয়া দেখেন যে, ভক্তেরা সহাস্যবদন – আনন্দে অবস্থান করিতেছেন। ঠাকুর বৃক্ষমূলে চাতালের উপর যে বসিয়া আছেন, তিনি দেখেন নাই অথচ ঠাকুরের ঠিক সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। তিনি ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন – তিনি কিথায়? এই কথা শুনিয়া সকলে উচ্চ হাস্য করিলেন।

হঠাৎ সম্মুখে ঠাকুরকে দর্শন করিয়া, মাস্টার অপ্রস্তুত হইয়া তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। দেখিলেন, ঠাকুরের বামদিকে কেদার (চাটুজ্যে) এবং বিজয় (গোস্বামী) চাতালের উপর বসিয়া আছেন। ঠাকুর দক্ষিণাস্য।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে, মাস্টারের প্রতি) – দেখ, কেমন দুজনকে (কেদার ও বিজয়কে) মিলিয়ে দিয়েছি!

শ্রীবৃন্দাবন হইতে মাধবীলতা আনিয়া ঠাকুর পঞ্চবটীতে ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে রোপণ করিয়াছিলেন। আজ মাধবী বেশ বড় হইয়াছে। ছোট ছোট ছেলেরা উঠিয়া দুলিতেছে, নাচিতেছে – ঠাকুর আনন্দে দেখিতেছেন ও বলিতেছেন – “বাঁদুরে ছানার ভাব। পড়লে ছাড়ে না।” সুরেন্দ্র চাতালের নিচে দাঁড়াইয়া আছেন। ঠাকুর সস্নেহে বলিতেছেন, “তুমি উপরে এসো না। এমনটা (পা মেলা) বেশ হবে।”

সুরেন্দ্র উপরে গিয়া বসিলেন। ভবনাথ জামা পরিয়া বসিয়াছেন দেখিয়া সুরেন্দ্র বলিতেছেন, “কিহে বিলাতে যাবে নাকি?”

ঠাকুর হাসিতেছেন ও বলিতেছেন, “আমাদের বিলাত ঈশ্বরের কাছে।” ঠাকুর ভক্তদের সহিত নানা বিষয়ে কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আমি মাঝে মাঝে কাপড় ফেলে, আনন্দময় হয়ে বেড়াতাম। শম্ভু একদিন বলছে, ‘ওহে তুমি তাই ন্যাংটো হয়ে বেড়াও! – বেশ আরাম! – আমি একদিন দেখলাম।’

সুরেন্দ্র – আফিস থেকে এসে জামা চাপকান খোলবার সময় বলি – মা তুমি কত বাঁধাই বেঁধেছ।

সুরেন্দ্র আফিস – সংসার, অষ্টপাশ ও তিনগুণ

শ্রীরামকৃষ্ণ – অষ্টপাশ দিয়ে বন্ধন। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, জাতি, অভিমান, সঙ্কোচ, গোপনের ইচ্ছা – এই সব।

ঠাকুর গান গাহিতেছেন-

আমি ওই খেদে খেদ করি শ্যামা।
গান – শ্যামা মা উড়াচ্ছে ঘুড়ি (ভব সংসার বাজার মাঝে)
ঘুড়ি আশাবায়ু ভরে উড়ে, বাঁধা তাহে মায়া দড়ি।

“মায়া দড়ি কিনা মাঘছেলে। বিষয়ে মেজেছ মাঞ্জা কর্কশা হয়েছে দড়ি। বিষয় – কামিনী-কাঞ্চন।

গান – ভবে আসা খেলতে পাশা, বড় আশা করেছিলাম।
আশার আশা ভাঙা দশা, প্রথমে পঞ্জুড়ি পেলাম।
প’বার আঠার ষোল, যুগে যুগে এলাম ভাল,
(শেষে) কচে বারো পেয়ে মাগো, পঞ্জা ছক্কায় বদ্ধ হলাম।
ছ-দুই-আট, ছ-চার-দশ, কেউ নয় মা আমার বশ;
খেলাতে না পেলাম যশ, এবার বাজী ভোর হইল।

“পঞ্জুড়ি অর্থাৎ পঞ্চভূত। পঞ্জা ছক্কায় বন্দী হওয়া অর্থাৎ পঞ্চভূত ও ছয় রিপুর বশ হওয়া। ‘ছ তিন নয়ে ফাঁকি দিব।’ ছয়কে ফাঁকি দেওয়া অর্থাৎ ছয় রিপুর বশ না হওয়া। ‘তিনকে ফাঁকি দেওয়া’ অর্থাৎ তিন গুণের অতীত হওয়া।

“সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ – এই তিন গুণেতেই মানুষকে বশ করেছে। তিন ভাই; সত্ত্ব থাকলে রজঃকে ডাকতে পারে, রজঃ থাকলে তমঃকে ডাকতে পারে। তিন গুণই চোর। তমোগুণে বিনাশ করে, রজোগুণে বদ্ধ করে, সত্ত্ব গুণে বন্ধন খোলে বটে; কিন্তু ঈশ্বরের কাছ পর্যন্ত যেতে পারে না।”

বিজয় (সহাস্যে) – সত্ত্বও চোর কি না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে পারে না, কিন্তু পথ দেখিয়ে দেয়।

ভবনাথ – বাঃ! কি চমৎকার কথা!

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ এ খুব উঁচু কথা।

ভক্তেরা এই সকল কথা শুনিয়া আনন্দ করিতেছেন।

-১৮৮৪, ২৫শে মে-

…………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : অষ্টাদশ অধ্যায় : ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!