ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

বিজয়, কেদার প্রভৃতির প্রতি কামিনী-কাঞ্চন সম্বন্ধে উপদেশ

শ্রীরামকৃষ্ণ – বন্ধনের কারণ কামিনী-কাঞ্চন। কামিনী-কাঞ্চনই সংসার। কামিনী-কাঞ্চনই ঈশ্বরকে দেখতে দেয় না

এই বলিয়া ঠাকুর নিজের গামছা লইয়া সম্মুখ আবরণ করিলেন। আর বলিতেছেন,  আর আমায় তোমরা দেখতে পাচ্চ? – এই আবরণ! এই কামিনী-কাঞ্চন আবরণ গেলেই চিদানন্দলাভ।

“দেখো না – যে মাগ সুখ ত্যাগ করেছে, সে তো জগৎ সুখ ত্যাগ করেছে! ইশ্বর তার অতি নিকট।”

কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া নিশশব্দে এই কথা শুনিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (কেদার, বিজয় প্রভৃতির প্রতি) – “মাগ সুখ যে ত্যাগ করেছে, সে জগৎ সুখ ত্যাগ করেছে। – এই কামিনী-কাঞ্চনই আবরণ। তোমাদের তো এত বড় বড় গোঁফ, তবু তোমরা ওইতেই রয়েছ! বল! মনে মনে বিবেচনা করে দেখ!-”

বিজয় – আজ্ঞা, তা সত্য বটে।

কেদার অবাক্‌ হইয়া চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর বলিতেছেন,

“সকলকেই দেখি, মেয়েমানুষের বশ। কাপ্তেনের বাড়ি গিছলাম; – তার বাড়ি হয়ে রামের বাড়ি যাব। তাই কাপ্তেনকে বললাম, ‘গাড়িভাড়া দাও’। কাপ্তেন তার মাগ্‌কে বললে! সে মাগও তেমনি – ‘ক্যা হুয়া’ ‘ক্যা হুয়া’ করতে লাগল। শেষে কাপ্তেন বললে যে, ওরাই (রামেরা) দেবে। গীতা, ভাগবত, বেদান্ত সব ওর ভিতরে! (সকলের হাস্য)

“টাকা-কড়ি সর্বস্ব সব মাগের হাতে! আবার বলা হয়, ‘আমি দুটো টাকাও আমার কাছে রাখতে পারি না – কেমন আমার স্বভাব!’

“বড়বাবুর হাতে অনেক কর্ম, কিন্তু করে দিচ্চে না। একজন বললে, ‘গোলাপীকে ধর, তবে কর্ম হবে।’ গোলাপী বড়বাবুর রাঁড়।”

পূর্বকথা – ফোর্টদর্শন – স্ত্রীলোক ও “কলমবাড়া রাস্তা”

“পুরুষগুলো বুঝতে পারে না, কত নেমে গেছে।

“কেল্লায় যখন গাড়ি করে গিয়ে পৌঁছিলাম তখন বোধ হল যেন সাধারণ রাস্তা দিয়ে এলাম। তারপরে দেখি যে চারতলা নিচে এসেছি! কলমবাড়া (Sloping) রাস্তা! যাকে ভূতে পায়, সে জানতে পারে না যে আমায় ভূতে পেয়েছে। সে ভাবে আমি বেশ আছি।”

বিজয় (সহাস্যে) – রোজা মিলে গেলে রোজা ঝাড়িয়ে দেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও-কথার বেশি উত্তর দিলেন না। কেবল বলিলেন –

“সে ঈশ্বরের ইচ্ছা।”

তিনি আবার স্ত্রীলোক সম্বন্ধে কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – যাকে জিজ্ঞাসা করি, সেই বলে আজ্ঞে হাঁ, আমার স্ত্রীটি ভাল। একজনেরও স্ত্রী মন্দ নয়। (সকলের হাস্য)

“যারা কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকে, তারা নেশায় কিছু বুঝতে পারে না। যারা দাবাবোড়ে খেলে, তারা অনেক সময় জানে না, কি ঠিক চাল। কিন্তু যারা অন্তর থেকে দেখে, তারা অনেকটা বুঝতে পারে।

“স্ত্রী মায়ারূপিণী। নারদ রামকে স্তব করতে লাগলেন – ‘হে রাম। তোমার অংশে যত পুরুষ; তোমার মায়ারূপিণী সীতার অংশে যত স্ত্রী। আর কোন বর চাই না – এই করো, যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয়, আর যেন তোমার জগৎমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই’!”

গিরীন্দ্র, নগেন্দ্র প্রভৃতির প্রতি উপদেশ

সুরেন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা গিরীন্দ্র ও তাঁহার নগেন্দ্র প্রভৃতি ভ্রাতুষ্পুত্রেরা আসিয়াছেন। গিরীন্দ্র আফিসের কর্মে নিযুক্ত হইয়াছেন। নগেন্দ্র ওকালতির জন্য প্রস্তুত হইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরীন্দ্র প্রভৃতির প্রতি) – তোমাদের বলি – তোমরা সংসারে আসক্ত হইও না। দেখো, রাখালের জ্ঞান অজ্ঞান বোধ হয়েছে, – সৎ অসৎ বিচার হয়েছে! এখন তাকে বলি, ‘বাড়িতে যা; কখন এখানে এলি, দুই দিন থাকলি।’

“আর তোমরা পরস্পর প্রণয় করে থাকবে – তবেই মঙ্গল হবে। আর আনন্দে থাকবে। যাত্রাওয়ালারা যদি একসুরে গায়, তবেই যাত্রাটি ভাল হয়, আর যারা শুনে তাদেরও আহ্লাদ হয়।

“ঈশ্বরে বেশি মন রেখে খানিকটা মন দিয়ে সংসারে কাজ করবে।

“সাধুর মন ঈশ্বরে বার আনা, – আর কাজে চার আনা। সাধুর ঈশ্বরের কথাতেই বেশি হুঁশ। সাপের ন্যাজ মাড়ালে আর রক্ষা নাই! ন্যাজে যেন তার বেশি লাগে।”

পঞ্চবটীতে সহচরীর কীর্তন – হঠাৎ মেঘ ও ঝড়

ঠাকুর ঝাউতলায় যাইবার সময় সিঁথির গোপালকে ছাতির কথা বলিয়া গেলেন। গোপাল মাস্টারকে বলিতেছেন, “উনি বলে গেলেন, ছাতি ঘরে রেখে আসতে।” পঞ্চবটীতলায় কীর্তনের আয়োজন হইল। ঠাকুর আসিয়া বসিয়াছেন। সহচরী গান গাইতেচেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া আছেন।

গতকল্য শনিবার অমাবস্যা গিয়াছে। জ্যৈষ্ঠ মাস। আজ মধ্যে মধ্যে মেঘ করিতেছিল। হঠাৎ ঝড় উপস্থিত হইল। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। কীর্তন ঘরেই হবে স্থির হইল।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সিঁথির গোপালের প্রতি) – হ্যাঁগা ছাতিটা এনেছ?

গোপাল – আজ্ঞা, না। গান শুনতে শুনতে ভুলে গেছি!

ছাতিটি পঞ্চবটীতে পড়িয়া আছে; গোপাল তাড়াতাড়ি আনিতে গেলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আমি যে এতো এলোমেলো, তবু অত দূর নয়!

“রাখাল এক জায়গায় নিমন্ত্রণের কথায় ১৩ই-কে বলে ১১ই!

“আর গোপাল – গোরুর পাল! (সকলের হাস্য)

“সেই যে স্যাকরাদের গল্পে আছে – একজন বলছে, ‘কেশব’, একজন বলছে, ‘গোপাল’, একজন বলছে, ‘হরি’, একজন বলছে, ‘হর’। সে ‘গোপালের’ মানে গোরুর পাল!” (সকলের হাস্য)

সুরেন্দ্র গোপালের উদ্দেশ্য করিয়া আনন্দে বলিতেছেন – ‘কানু কোথায়?’

-১৮৮৪, ২৫শে মে-

……………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : অষ্টাদশ অধ্যায় : একত্রিংশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!