সন্ন্যাসির কঠিন ব্রত – সন্ন্যাসী ও লোকশিক্ষা
ঠাকুর গঙ্গার ধারের গোল বারান্দায় আসিয়াছেন। কাছে বিজয়, ভবনাথ, মাস্টার, কেদার প্রভৃতি ভক্তগণ। ঠাকুর এক-একবার বলিতেছেন – “হা কৃষ্ণচৈতন্য!”
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয় প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) – ঘরে নাকি অনেক হরিনাম হয়েছে – তাই খুব জমে গেল!
ভবনাথ – তাতে আবার সন্ন্যাসের কথা!
শ্রীরামকৃষ্ণ – ‘আহা! কি ভাব!’
এই বলিয়া গান ধরিলেন-
প্রেমধন বিলায় গোরারায়।
প্রেমকলসে কলসে ঢালে তবু না ফুরায়!
চাঁদ নিতাই ডাকে আয়! আয়! চাঁদ, গৌর ডাকে আয়!
(ওই) শান্তিপুর ডুবু ডুবু নদে ভেসে যায়।
(বিজয় প্রভৃতির প্রতি) – “বেশ বলেছে কীর্তনে, –
“সন্ন্যাসী নারী হেরবে না। এই সন্ন্যাসীর ধর্ম। কি ভাব!”
বিজয় – আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ – সন্ন্যাসীকে দেখে তবে সবাই শিখবে – তাই অত কঠিন নিয়ম। – নারীর চিত্রপট পর্যন্ত সন্ন্যাসী দেখবে না! এমনি কঠিন নিয়ম!
“কালো পাঁঠা মার সেবার জন্য বলি দিতে হয় – কিন্তু একটু ঘা থাকলে হয় না। রমণীসঙ্গ তো করবে না – মেয়েদের সঙ্গে আলাপ পর্যন্ত করবে না।”
বিজয় – ছোট হরিদাস ভক্তমেয়ের সঙ্গে আলাপ করেছিল। চৈতন্যদেব হরিদাসকে ত্যাগ করলেন।
পূর্বকথা – শ্রীরামকৃষ্ণের নামে মারোয়াড়ীর টাকা ও মথুরের জমি লিখিয়া দিবার প্রস্তাব
শ্রীরামকৃষ্ণ – সন্ন্যাসীর পক্ষে কামিনী আর কাঞ্চন – যেমন সুন্দরীর পক্ষে তার গায়ের বোট্কা গন্ধ! ও-গন্ধ থাকলে বৃথা সৌন্দর্য।
“মারোয়াড়ী আমার নামে টাকা লিখে দিতে চাইলে; – মথুর জমি লিখে দিতে চাইলে; – তা লতে পারলাম না।
“সন্ন্যাসীর ভারী কঠিন নিয়ম। যখন সাধু-সন্ন্যাসী সেজেছে, তখন ঠিক সাধু-সন্ন্যাসীর মতো কাজ করতে হবে। থিয়েটারে দেখ নাই! – যে রাজা সাজে সে রাজাই সাজে, যে মন্ত্রী সাজে সে মন্ত্রীই সাজে।
“একজন বহুরূপী ত্যাগী সাধু সেজেছিল। বাবুরা তাকে একতোড়া টাকা দিতে গেল। সে ‘উঁহু’ করে চলে গেল, – টাকা ছুঁলেও না। কিন্তু খানিক পরে গা-হাত-পা ধুয়ে নিজের কাপড় পরে এল। বললে, ‘কি দিচ্ছিলে এখন দাও।’ যখন সাধু সেজেছিল, তখন টাকা ছুঁতে পারে নাই। এখন চার আনা দিলেও হয়।
“কিন্তু পরমহংস অবস্থায় বালক হয়ে যায়। পাঁচ বছরের বালকের স্ত্রী-পুরুষ জ্ঞান নাই। তবু লোকশিক্ষার জন্য সাবধান হতে হয়।”
[শ্রীযুক্ত কেশব সেনের দ্বারা লোকশিক্ষা হল না কেন ]
শ্রীযুক্ত কেশব সেন কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর ছিলেন। – তাই লোকশিক্ষার ব্যাঘাত হইল। ঠাকুর এই কথা বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – ইনি (কেশব) – বুঝেচো?
বিজয় – আজ্ঞা, হাঁ
শ্রীরামকৃষ্ণ – এদিক-ইদিক দুই রাখতে গিয়ে তেমন কিছু পারলেন না।
শ্রীচৈতন্যদেব কেন সংসারত্যাগ করিলেন
বিজয় – চৈতন্যদেব নিত্যানন্দকে বললেন, “নিতাই, আমি যদি সংসারত্যাগ না করি, তাহলে লোকের ভাল হবে না। সকলেই আমার দেখাদেখি সংসার করতে চাইবে। – কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করে হরিপাদপদ্মে সমস্ত মন দিতে কেহ চেষ্টা করবে না!”
শ্রীরামকৃষ্ণ – চৈতন্যদেব লোকশিক্ষার জন্য সংসারত্যাগ করলেন।
“সাধু-সন্ন্যাসী নিজের মঙ্গলের জন্য কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করবে। আবার নির্লিপ্ত হলেও, লোকশিক্ষার জন্য কাছে কামিনী-কাঞ্চন রাখবে না। ন্যাসী – সন্ন্যাসী – জগদ্গুরু! তাকে দেখে তবে তো লোকের চৈতন্য হবে!”
সন্ধ্যা আগতপ্রায়। ভক্তেরা ক্রমে ক্রমে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিতেছেন। বিজয় কেদারকে বলিতেছেন, “আজ সকালে (ধ্যানের সময়) আপনাকে দেখেছিলাম; – গায়ে হাত দিতে যাই – কেউ নাই।”
-১৮৮৪, ২৫শে মে-
…………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : অষ্টাদশ অধ্যায় : ত্রয়োত্রিংশ পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….