শিবপুর ভক্তগণ ও আমমোক্তারি (বকলমা) – শ্রীমধু ডাক্তার
শিবপুর হইতে ভক্তেরা আসিলেন। তাহারা অত দূর হইতে কষ্ট করিয়া আসিয়াছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলেন না। সার সার গুটিকতক কথা তাহাদিগকে বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শিবপুরের ভক্তদের প্রতি) – ঈশ্বরই সত্য আর সব অনিত্য। বাবু আর বাগান। ঈশ্বর ও তাঁর ঐশ্বর্য। লোকে বাগানই দেখে, বাবুকে চায় কয়জনে?
ভক্ত – আজ্ঞা, উপায় কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ – সদসৎ বিচার। তিনি সত্য আর সব অনিত্য – এইটি সর্বদা বিচার। ব্যাকুল হয়ে ডাকা।
ভক্ত – আজ্ঞে, সময় কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ – যাদের সময় আছে, তারা ধ্যান-ভজন করবে।
“যারা একান্ত পারবে না তারা দুবেলা খুব দুটো করে প্রণাম করবে। তিনি তো অন্তর্যামী, – বুঝছেন যে, এরা কি করে! অনেক কাজ করতে হয়। তোমাদের ডাকবার সময় নাই, – তাঁকে আমমোক্তারি (বকলমা) দাও। কিন্তু তাঁকে লাভ না করলে – তাঁকে দর্শন না করলে, কিছুই হল না।”
একজন ভক্ত – আজ্ঞা, আপনাকে দেখাও যা ঈশ্বরকে দেখাও তা।
শ্রীরামকৃষ্ণ – ও-কথা আর বলো না। গঙ্গারই ঢেউ, ঢেউ-এর কিছু গঙ্গা নয়। আমি এত বড় লোক, আমি অমুক – এই সব অহংকার না গেলে তাঁকে পাওয়া যায় না। ‘আমি’ ঢিপিকে ভক্তির জলে ভিজিয়ে সমভূমি করে ফ্যালো।
কেন সংসার? ভোগান্তে ব্যাকুলতা ও ঈশ্বরলাভ
ভক্ত – সংসারে কেন তিনি রেখেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ – সৃষ্টির জন্য রেখেছেন। তাঁর ইচ্ছা। তাঁর মায়া। কামিনী-কাঞ্চন দিয়ে তিনি ভুলিয়ে রেখেছেন।
ভক্ত – কেন ভুলিয়ে রেখেছেন? কেন, তাঁর ইচ্ছা?
শ্রীরামকৃষ্ণ – তিনি যদি ঈশ্বরের আনন্দ একবার দেন তাহলে আর কেউ সংসার করে না, সৃষ্টিও চলে না।
“চালের আড়তে বড় বড় ঠেকের ভিতরে চাল থাকে। পাছে ইঁদুরগুলো ওই চালের সন্ধান পায়, তাই দোকানদার একটা কুলোতে খই-মুড়কি রেখে দেয়। ওই খই-মুড়কি মিষ্টি লাগে, তাই ইঁদুরগুলো সমস্ত রাত কড়র মড়র করে খায়। চালের সন্ধান আর করে না।
“কিন্তু দেখো, একসের চালে চৌদ্দগুণ খই হয়। কামিনী-কাঞ্চনের আনন্দ অপেক্ষা ঈশ্বরের আনন্দ কত বেশি। তাঁর রূপ চিন্তা করলে রম্ভা তিলোত্তমার রূপ চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়।”
ভক্ত – তাঁকে লাভ করবার জন্য ব্যাকুলতা কেন হয় না?
শ্রীরামকৃষ্ণ – ভোগান্ত না হলে ব্যাকুলতা হয় না। কামিনী-কাঞ্চনের ভোগ যেটুকু আছে সেটুকু তৃপ্তি না হলে জগতের মাকে মনে পড়ে না। ছেলে যখন খেলায় মত্ত হয়, তখন মাকে চায় না। খেলা সাঙ্গ হয়ে গেলে তখন বলে, “মা যাব।” হৃদের ছেলে পায়রা লয়ে খেলা কচ্ছিল; পায়রাকে ডাকছে, “আয় তি তি!” করে! পায়রা লয়ে খেলা তৃপ্তি যাই হলো, অমনি কাঁদতে আরম্ভ করলে। তখন একজন অচেনা লোক এসে বললে, আমি তোকে মার কাছে লয়ে যাচ্ছি আয়। সে তারই কাঁধে চড়ে অনায়াসে গেল।
“যারা নিত্যসিদ্ধ, তাদের সংসারে ঢুকতে হয় না। তাদের ভোগের বাসনা জন্ম থেকেই মিটে গেছে।”
শ্রীমধু ডাক্তারের আগমন – শ্রীমধুসূদন ও নাম মাহাত্ম্য
পাঁচটা বাজিয়াছে। মধু ডাক্তার আসিয়াছেন। ঠাকুরের হাতটিতে বাড় ও ব্যাণ্ডেজ বাঁধিতেছেন। ঠাকুর বালকের ন্যায় হাসিতেছেন। আর বলিতেছেন, ঐহিক ও পারত্রিকের মধুসূদন।
মধু (সহাস্যে) – কেবল নামের বোঝা বয়ে মরি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – কেন নাম কি কম? তিনি আর তার নাম তফাত নয়। সত্যভামা যখন তুলাযন্ত্রে স্বর্ন-মণি-মাণিক্য দিয়ে ঠাকুরকে ওজন কচ্ছিলেন, তখন হল না! যখন রুক্মিণী তুলসী আর কৃষ্ণনাম একদিকে লিখে দিলেন, তখন ঠিক ওজন হল!
এইবার ডাক্তার বাড় বাঁধিয়া দিবেন। মেঝেতে বিছানা করা হইল, ঠাকুর হাসিতে হাসিতে মেঝেতে আসিয়া শয়ন করিতেছেন। সুর করিয়া করিয়া বলিতেছেন, “রাই-এর দশম দশা! বৃন্দে বলে, আর কত বা হবে!”
ভক্তেরা চতুর্দিকে বসিয়া আছেন। ঠাকুর আবার গাহিতেছেন – “সব সখি মিলি বৈঠল – সরোবর কূলে!” ঠাকুরও হাসিতেছেন, ভক্তেরাও হাসিতেছেন। বাড় বাঁধা হইয়া গেলে ঠাকুর বলিতেছেন –
“আমার কলকাতার ডাক্তারদের তত বিশ্বাস হয় না। শম্ভুর বিকার হয়েছে, ডাক্তার (সর্বধিকারী) বলে, ও কিছু নয়, ও ঔষধের নেশা! তারপরই শম্ভুর দেহত্যাগ হল১
১ শম্ভু মল্লিকের মৃত্যু – ১৮৭৭
-১৮৮৪, ২রা ফেব্রুয়ারি-
……………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : অষ্টাদশ অধ্যায় : অষ্টম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….