ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে
কীর্তনান্তে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বিজয় নরেন্দ্র ও অন্যান্য ভক্তেরা আসন গ্রহণ করিলেন। সকলের দৃষ্টি ঠাকুরের দিকে। সন্ধ্যার কিছু বিলম্ব আছে। ঠাকুর ভক্তদের সহিত কথা কহিতেচেন। তাঁহাদের কুশল প্রশ্ন করিতেছেন। কেদার অতি বিনীতভাবে হাতজোড় করিয়া অতি মৃদু ও মিষ্ট কথায় ঠাকুরের কাছে কি নিবেদন করিতেছেন। কাছে নরেন্দ্র, চুনি, সুরেন্দ্র, রাম, মাস্টার ও হরিশ।
কেদার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি, বিনীতভাবে) – মাথাঘোরাটা কিসে সেরে যাবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্ন্নেহে) – ও হয়; আমার হয়েছিল! একটু একটু বাদামের তেল দিবেন। শুনেছি, দিলে সারে।
কেদার – যে আজ্ঞা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (চুনির প্রতি) – কিগো, তোমরা সব কেমন আছ?
চুনি – আজ্ঞা, এখন সব মঙ্গল। বৃন্দাবনে বলরামবাবু, রাখাল এঁরা সব ভাল আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি অত সন্দেশ কেন পাঠিয়েছ?
চুনি – আজ্ঞা, বৃন্দাবন থেকে এসেছি –
চুনিলাল বলরামের সঙ্গে শ্রীবৃন্দাবনে গিয়াছিলেন ও কয়মাস ছিলেন। ছুটি শেষ হইয়াছে, তাই কলিকাতায় সম্প্রতি ফিরিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হরিশের প্রতি) – তুই দুই-একদিন পরে যাস। অসুখ করেছে, আবার সেখানে পড়বি।
(নারাণের প্রতি, সস্নেহে) – ‘বোস্ কাছে এসে বোস্! কাল যাস – গিয়ে সেখানে খাবি। (মাস্টারকে দেখাইয়া) এর সঙ্গে যাবি? (মাস্টারের প্রতি) কিগো?
মাস্টারের সেই দিনই ঠাকুরের সঙ্গে যাইবার ইচ্ছা। তাই চিন্তা করিতেছেন। সুরেন্দ্র অনেকক্ষণ ছিলেন, মাঝে একবার বাড়ি গিয়াছিলেন। বাড়ি হইতে আসিয়া ঠাকুরের কাছে দাঁড়াইলেন।
সুরেন্দ্র কারণ পান করেন। আগে বড় বাড়াবাড়ি ছিল। ঠাকুর সুরেন্দ্রের অবস্থা দেখিয়া চিন্তিত হইয়াছিলেন। একেবারে পানত্যাগ করিতে বলিলেন না। বলিলেন, সুরেন্দ্র! দেখ, যা খাবে, ঠাকুরকে নিবেদন করে দিবে। আর যেন মাথা টলে না ও পা টলে না। তাঁকে চিন্তা করতে করতে তোমার আর পান করতে ভাল লাগবে না। তিনি কারণানন্দদায়িনী। তাঁকে লাভ করলে সহজানন্দ হয়।
সুরেন্দ্র কাছে দাঁড়াইয়া আছেন। ঠাকুর তাঁর দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিয়া উঠিলেন, তুমি কারণ খেয়েছ? বলিয়াই ভাবে আবিষ্ট।
সন্ধ্যা হইল। কিঞ্চিৎ বাহ্য লাভ করিয়া ঠাকুর মার নাম করিয়া আনন্দে গান ধরিলেন-
শিব সঙ্গে সদা রঙ্গে আনন্দে মগনা,
সুধাপানে ঢল ঢল ঢলে কিন্তু পড়ে না (মা)।
বিপরীত রতাতুরা, পদভরে কাঁপে ধরা,
উভয়ে পাগলের পারা, লজ্জা ভয় আর মানে না।
সন্ধ্যা হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ হরিনাম করিতেছেন। মাঝে মাঝে হাততালি দিতেছেন। সুস্বরে বলিতেছেন – হরিবোল, হরিবোল, হরিময় হরিবোল; হরি হরি হরোবোল।
আবার রামনাম করিতেছেন, – রাম, রাম, রাম, রাম! রাম, রাম, রাম, রাম, রাম!
ঠাকুরের প্রার্থনা – How to Pray
ঠাকুর এইবার প্রার্থনা করিতেছেন – “ও রাম! ও রাম! আমি ভজনহীন, সাধনহীন, জ্ঞানহীন, ভক্তিহীন – আমি ক্রিয়াহীন! রাম শরণাগত! ও রাম শরণাগত! দেহসুখ চাইনে রাম! লোকমান্য চাইনে রাম! অষ্টসিদ্ধি চাইনে রাম! শতসিদ্ধি চাইনে রাম! শরণাগত, শরণাগত! কেবল এই করো – যেন তোমার শ্রীপাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয় রাম! আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ হই না, রাম! ও রাম, শরণাগত!”
ঠাকুর প্রার্থনা করিতেছেন, সকলে একদৃষ্টে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিয়াছেন। তাঁহার করুণামাখা স্বর শুনিয়া অনেকে অশ্রুসংবরণ করিতে পারিতেছেন না।
রাম কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (রামের প্রতি) – রাম! তুমি কোথায় ছিলে?
রাম আজ্ঞা, উপরে ছিলাম।
ঠাকুর ও ভক্তদের সেবার জন্য রাম আয়োজন করিতেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (রামের প্রতি, সহাস্যে) – উপরে থাকার চাইতে নিচে থাকা কি ভাল নয়? নিচু জমিতে জল জমে, উঁচু জমি থেকে জল গড়িয়ে চলে আসে।
রাম (হাসিতে হাসিতে) – আজ্ঞা, হাঁ।
ছাদে পাতা হইয়াছে। রামচন্দ্র ঠাকুর ও ভক্তগণ লইয়া গেলেন ও পরিতোষ করিয়া খাওয়াইলেন। উৎসবান্তে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, নিরঞ্জন, মাস্টার প্রভৃতি সঙ্গে অধরের বাড়ি গমন করিলেন। সেখানে মা আসিয়াছেন। আজ মহাষ্টমী! অধরের বিশেষ প্রার্থনা, ঠাকুর থাকিবেন, তবে তাঁহার পুজা সার্থক হইবে।
-১৮৮৪, ২৮শে সেপ্টেম্বর-
……………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : অষ্টাবিংশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….